সুকন্যা সাহা
কেল্টুদা বললেই যে চরিত্রটি আপামর বাঙ্গালী কিশোর কিশোরীর মানসপটে ভেসে ওঠে সেটি হল কালো চোঙ্গা ফুলপ্যাণ্ট; প্যাঁকাটি চেহারা, কোঁকড়ানো চুল আর মাথাভর্তি বদমাইশি ফন্দি। আসলে কমিকসের জাদুকর নারায়ন দেবনাথ কেল্টূদা চরিত্রটিকে খানিক ভিলেন বা অ্যাণ্টিহিরো গোছেরকরে সৃষ্টি করেছিলেন। বাঁটুল দি গ্রেটের চিরাচরিত হিম্যানশিপের থেকে যা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর।
কেল্টুদা যার আসল নাম ভজহরি ভট্টাচার্য্য, বার ছয়েক পরীক্ষায় গোঁত্তা মেরে শিং ভেঙ্গে বাছুরের দলে রয়ে গেছেন। মফঃস্বল শহরের এক বোর্ডিংস্কুলের গল্প নিয়ে নন্টে ফণ্টের কাহিনী আবর্তিত হয়। নানা মজাদার কাহিনীর অন্তে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন। আর গল্পের প্রথমে কেল্টুচরণের দুর্বুদ্ধিতায় নন্টে ফণ্টে প্রাথমিকভাবে জব্দ হলেও শেষপর্যন্ত কেল্টুদা পর্যুদস্ত হয় ফণ্টের বুদ্ধিমত্তায় আর নণ্টে ফণ্টের জয় অনিবার্য হয়। বোর্ডিং স্কুলের নানা চরিত্র নণ্টে ফন্টে, তাদের কম বয়েসী বন্ধুরা, হেডস্যার, হোস্টেল সুপারিটেনডেণ্ট হাতিরাম পাতি, বাবুর্চি, নানা চাকর বাকর এদের নিয়েই জমে ওঠে মফঃস্বলের একটা হোস্টেল স্কুলের গল্প। আর সেখানে কেল্টুদা নামেও কেল্টু কাজেও ভিলেন; তাই কালো রং...কি চেহারায় কি পোশাকে তার ব্র্যান্ড কালার। আর সব ছেলেরা হাফপ্যাণ্ট পড়লেও সিনিয়ার দাদা হিসেবে তার পরণে থাকে ফুলপ্যাণ্ট। আর বয়েসে ছোটো ছেলেদের ওপর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় সে দাদাগিরি চালায়। প্রতিটা গল্পের শুরুতে কেল্টুদা সুপারিটেন্ডেণ্ট হাতিরাম পাতির সুনজরে থাকলেও গল্পের শেষে নণ্টে ফণ্টের বিটকেল বুদ্ধির কাছে হার মেনে লাট খায়।
নণ্টে ফণ্টের কমিকস কিশোর ভারতী পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তারপর থেকে ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ হিসেবে কিশোরভারতীতেই প্রকাশিত হতে থেকে। সেই সময় কিশোর ভারতীর সম্পাদক ছিলেন দীনেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নণ্টে ফন্টের মোট ১৫০ টি গল্প আছে। পরবর্তীকালে দেবসাহিত্য কুটির থেকে এগুলি বই আকারে প্রকাশিত হয়। ২০০৩ সালে এর রঙ্গিন সংস্করণও প্রকাশিত হয়। নণ্টে ফণ্টেকে নিয়ে তৈরী হয়েছে অ্যানিমেটেড কার্টুন ছবি; যেটি টেলিভিশানের আকাশ আট চ্যানেল থেকে নিয়মিত সম্প্রচারিত হত। কেল্টুদার মতো চরিত্র আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে দেখতে পাই...তফাৎ এই যে নারায়ন দেবনাথ তৎক্ষনাৎ তার প্রতিকৃতি এঁকে ফেলে চরিত্রটিতে প্রাণ দান করতেন। নণ্টে ফণ্টে প্রথমে সাদা কালো বা গ্রে স্কেলে প্রকাশিত হত কিশোরভারতীতে, পরবর্তীকালে এটি ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ হিসেবে কিশোরভারতীতেই প্রকাশিত হতে থাকে । এর আগে দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত শুকতারায় প্রাকশিত হতে শুরু করেছে আর রেক জগদ্বিখ্যাত ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ হাঁদা ভোঁদা। বয়েসে বড় কেল্টুদার মাথায় নণ্টে ও ফন্টেকে জব্দ করার নানা বিটকেল ফন্দি ফিকির ঘোরা ফেরা করত। এই গুলির সাহায্যে নন্টে ফণ্টেকে জব্দ করে বোর্ডিং সুপারিনটেন্ডেটের আস্থা ভাজন হওয়ায়ি তার উদ্দেশ্যে ছিল কিন্তু বাস্তবে ঘটত ঠিক তার উল্টোটা। নণ্টে ফণ্টের বদমাইশি ফিকিরে প্যাঁচে পড়ত স্বয়ং কেল্টু আর কেল্টুর জব্দ হওয়ার সেই নানা মজাদার কাহিনী নিয়েই জমজমাট হয়ে উঠেছিল এই কমিক স্ট্রিপটি। হোস্টেল সুপারিটেনণ্ডেট হাতিরাম পাতি একজন বিশালাকায় টাক মাথা ভুঁড়িদার স্যাণ্ডো গেঞ্জী পরিহিত চরিত্র যিনি গল্পের শুরুতে কেল্টুর প্রতি সদয় থাকলেও যখন তার বদমাইশি হাতে নাতে ধরা পড়ে তখন মারমুখী হয়ে যান।
স্রষ্টা নারায়ন দেবনাথের অমর সৃষ্টি এই নণ্টে ফণ্টে সিরিজ, যেখানে তার সহজাত কৌতূক বোধ ও কার্টুন চরিত্র সৃষ্টির অসাধারণ মুন্সীয়ানা মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। নণ্টে, ফণ্টে, কেল্টুদা এই চরিত্রগুলি অক্ষৌহিনী নারায়নী সেনার উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।