![]() |
কার্টুনিস্ট: আর কে লক্ষ্মণ |
মালবিকা মিত্র
দড়াম...ফটাস...ঠকাস...উফস...আহ্... শব্দগুলো খুব পরিচিত। কাউকে অনুসরণ করতে গিয়ে হাঁদা যদি ল্যাম্প পোস্টে ধাক্কা খায় "দুমম", তবে অনিবার্য ভাবে মুখ থেকে বেড়িয়ে আসবে "উফস"। আর তার পরের দৃশ্যে, মাথা ফুলে আলু। কিন্তু এই ঠোক্কর টা যদি "বাঁটুল" খায়, "দুমম" শব্দটা হবে, কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দই হবে না। আর তার পরের দৃশ্যে, ল্যাম্প পোস্ট হেলে বেঁকে কেৎরে গেছে। অতি অস্বাভাবিক সব ঘটনার হাস্যরসাত্মক পরিবেশন।
ঘটনা কি নিছক অস্বাভাবিক? আমাদের চারপাশে অহরহ এই কার্টুন চরিত্রের ভীড়। কখনো বুঝি আমি নিজেও কোনো কার্টুন চরিত্র হয়ে উঠি। সেগুলো আমার ছাত্র ছাত্রীদের খাতায় ধরা আছে। ঘটনা হলো, হাঁদা তার পিসামশাই কে ম্যানেজ করে একটা চাইনিজ কলার শার্ট বাগিয়েছে। হাঁদার ধারণা এমন একটা শার্ট ভূ ভারতে কারুর নেই। দারুণ গর্বে স্লো মোশনে দুপাশ নিরীক্ষণ করতে করতে চলেছে। মাঝে মাঝে টেরি কাটা চুলে হাত বোলাচ্ছে। একটা ভিড় বাসে উঠল। হায় হায়! কি সর্বোনাশ! ভিড়ের মধ্যে দেখে আরও কে একজন সামনের দিকে, একে বারে সেম টু সেম শার্ট। সন্ধানী হাঁদা সামনের দিকে শার্ট লক্ষ্য করে এগুচ্ছে "ঠকাসস"। সাথে সাথে মুখ থেকে "আউচ" শব্দ। ড্রাইভারের পেছনে লাগানো আয়নায় প্রবল ঠোকা, কপাল ফুলে আলু।
![]() |
কার্টুনিস্ট: সতীশ আচার্য |
অফিস টাইমে ভিড় ট্রেন। দুই সীটের মাঝে চ্যানেলে ভোঁদা দাঁড়িয়ে। ভোঁদার পেছনের সিট ফাঁকা হওয়া মাত্র ভোঁদা বসে প-ড়-লো...ঠিক একই সময়ে যুগপৎ পাশের সিটের মহিলা যাত্রীও ফাঁকা সিটে সরে গেলো। ভোঁদা সরাসরি মহিলার কোলে। আসলে ভোঁদার পাশে দাঁড়ানো হাঁদা ইশারায় ভদ্র মহিলাকে সরতে বলেছিল। "উড়িব্বাপ" মহিলার চিৎকার। চারপাশ থেকে কিল চড় টিপ্পুনি। সবটাই হাঁদা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করলো। এতো সবটাই ঘটলো, ঠিক যেন কমিকস।
ঘটনাগুলো চারপাশে ঘটছে। শুধু ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বুকের ছাতি, টেরি কাটা চুল, আর দড়াম ফটাস করে পরিবেশন। ফ্রেশারস' ওয়েলকাম ডে। ছাত্রীদের দারুণ সাজের বাহার। অনুষ্ঠান শেষ, আজ সবাই বুঝি উড়ছে। স্কুল বাস এতো ধার ঘেঁষে এসে দাঁড়ালো যে ভয়ে সবাই একটু পিছিয়ে গেলো। আর সবার পেছনে থাকা মেঘা, পিছোতে গিয়ে পড়লো হাইড্রেনে "ঝপাঙ"। লোকজন সবাই মিলে তুললো, কাদায় স্নান। কেউ কাছে যাচ্ছে না। দূর থেকে পাইপের জলে ধুয়ে দিলো। তারপর মেঘার প্রথম কথাটা ছিল "আউচ্! মাই ইয়ারিং!!" এরপর আপনার শ্রীকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথের দাদা দর্জি পাড়ার নতুন দাকে মনে পরবেই। ফুলবাবু ফান্টুস বাতেলাবাজ নতুন দা কুকুরের তাড়া খেয়ে নদীর মধ্যে হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষা করেছে। ইন্দ্র এসে তাকে উদ্ধার করার পর নতুন দার প্রথম প্রশ্ন, "আমার পাম্প সু?"
বাঁটুল চুঁচুড়া স্টেশনে নেমে বাস ধরে, নিত্যযাত্রী। দরজার কাছের সিটে বসে। মাথার উপর বাঙ্ক নেই। মাথায় ঠোকা লাগবে না। লাস্ট স্টপেজে নামবে। আট টাকা ভাড়া। কন্ডাক্টর উঠতেই বাড়িয়ে ধরলো একশো টাকার নোট। টিকিট আর দু টাকা ফেরত দিয়ে কন্ডাক্টর বললো নব্বই টাকা দিচ্ছি। পাঁচ মিনিট পর বাঁটুল ফেরতটা চাইলো। "হ্যাঁ দিচ্ছি" ছোট্টো জবাব। বাঁটুল আবার, আবারও চাইলো। একই জবাব। বাঁটুল বললো, "এরপর ভুলে নেমে যাবো যে"। কন্ডাক্টরের রসিকতা, "কোথায় আর ভুলছেন দাদা" বলে নব্বই টাকা ফেরত দিলো। বাস ভর্তি লোকজনের হাস্যরোল।
![]() |
কার্টুনিস্ট: সুরেন্দ্র |
কিন্তু হাসিটা তো এখানে থামতে পারে না। উনি যে বাঁটুল দি গ্রেট। উনি শেষ হাসিটা হাসবেন। লাস্ট স্টপেজে নামছে বাঁটুল, "দাদা, আমার টাকাটা?" কন্ডাক্টর অবাক। "আপনাকে ফেরত দিলাম যে !" কয়েকজন যাত্রী বললো, "হ্যাঁ ঠিকই, ফেরত দিয়েছে তো। "বাঁটুল দ্যা গ্রেট পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখলো খুচরো নব্বই টাকা। ঠিক আছে। আমি আগেই বলেছিলাম, আমি ভুলে যাই।" বলে সহাস্য একটা চাপড় কন্ডাক্টরের পিঠে। "ওয়াকক", আদরের আতিশয্যে কন্ডাক্টরের প্রাণ ওষ্ঠাগত। নামতে গিয়ে বাঁটুলের মাথাটা বাসের গেটে "ঠকাং" ঠুকে গেলো। কোনও টেরই পেলোনা বাঁটুল দি গ্রেট। মলিন মুখ কন্ডাক্টর দেখলো পরশু গ্যারেজে লাগিয়ে আনা, গেটের ওপর স্টিলের হাতলটা খুলে গেছে।
কমিকস ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে। শুধু বুঝে নিতে হবে কোনটা হাঁদা, কোনটা ভোঁদা, কোনটা বাঁটুল। জঙ্গলে দুই সরকারি কর্মীকে এক জঙ্গি গোষ্ঠী কিডন্যাপ করলো। বুদ্ধিমান পুলিশ মন্ত্রী সাংবাদিকদের বললেন, টু গভর্নমেন্ট অফিসিয়ালস আর কিলড্ বাই...অপহৃত খবর ছিল, কিন্তু মৃত এটা তো পুলিশ জানায় নি। পরিবারে কান্নাকাটি। পরদিন সাংবাদিক সম্মেলনে মন্ত্রী বললেন কিডন্যাপড বলতে গিয়ে কিলড্ হয়ে গেছে। ইনি কামু কাফকা নেরুদা লোরকা পড়তেন নিয়মিত।
![]() |
কার্টুনিস্ট: মনসুর নকভি |
আগে নেতাদের ভাষণের স্ক্রিপ্ট লিখে দিতো তার সচিবরা। এখন কানে লাগানো মেশিনে ভাষণটি প্রমট হতে থাকে, টেলি প্রমটার। নাটকের স্টেজে উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে যেমন একজন প্রমট করে। তো হলো কি, কাম্যু কাফকা পড়া সেই বুদ্ধিমান সবজান্তা মন্ত্রী প্রমট স্ক্রিপ্ট ছাড়াই সায়েন্স সিটি তে ন্যাশনাল সায়েন্স কংগ্রেসের উদ্বোধনী ভাষণে বললেন, অ্যাস্ট্রোনমি ইজ নট অ্যাট অল এ সায়েন্স। ইট ইজ পিওরলি এ সুপারস্টিশন। সভা নিশ্চুপ নীরব। পরদিন সংবাদপত্রে হইচই, গেলো গেলো। শেষে তিনি সাংবাদিকদের বললেন, অ্যাস্ট্রোলজি বলতে গিয়ে ভুল করে অ্যাস্ট্রোনমি বলে ফেলেছি। গলতনামা, ভুলের পাহাড়।
একটা বহু ফসলি উর্বর জমি শিল্পের জন্য নিতে গিয়ে গেঁড়ো, আটকে গেলো। শিল্প হলো না। শিল্পমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ মহলে গল্পের ছলে বললেন, বাই রোড বর্ধমান থেকে কলকাতা যাবার পথে বাঁ দিকে বিরাট জমিটা দেখে মহাকরনে অফিসারদের বলেছি। অফিসাররা কলকাতা থেকে বাই রোড গেলো। বাঁ দিকের জমিটা দেখলো। ডান বাঁ উল্টে সব ভন্ডুল হয়ে গেলো। কি শিশুর সারল্য। মনে পড়ছে হাঁদা ভোঁদা পিসেমশাইয়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ টাকা নিয়েছে সরস্বতী পুজো করবে। পিসেমশাইয়ের কড়া নির্দেশ হিসেব দেখাতে হবে। কদিন পঞ্চাশ টাকায় খুব ফূর্তি হলো। ভোঁদার চিন্তা কি হিসাব দেখাবে, পুজোই তো হলো না। হাঁদা ডিক্টেট করলো, আর ভোঁদা হিসেবের খাতায় লিখলো : প্যান্টের পকেটে টাকা ছিল। পুকুরে নাইতে গিয়ে ভেসে গেল। হাঁদা সাঁতার কেটে ধরে ফেললো। জানালায় ভেজা টাকা শুকোতে দিলাম। একটা কাক এসে টাকা নিয়ে উড়ে গেছে। এখনও কাকটাকে ধরতে পারিনি।
![]() |
কার্টুনিস্ট: মঞ্জুল |
কে কার চেয়ে কম যায়! ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে বাঁটুল দি গ্রেট ভাষন দিচ্ছেন। বাঁটুল হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। কানে গোঁজা টেলি প্রমটার। বাঁটুল দারুণ সুবক্তা। বক্তৃতার মাঝে যন্ত্র কিছু কমান্ড দিলো। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি অবলীলায় সেগুলো আউড়ে গেলো "সরি, সাম টেক্সট আর মিসিং...ইউ প্লিজ কন্টিনিউ ইওর স্পীচ উইথ ইয়োর ওন স্টাইল..."সবটাই বাঁটুল হাত নেড়ে নাটকীয় ঢঙে আউড়ে গেলো। হাততালিতে ফেটে পড়লো সভাগৃহ। বাঁটুল জানে প্রথমত, কেউ বক্তৃতা শোনে না। দ্বিতীয়ত, ইংরেজিতে ভুল বলা যায় না। বাঁটুল হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।
হাঁদা আর ভোঁদা সিনেমা হলে লাইন দিয়েছেন। খুব ভীড়। ব্ল্যাকারদের গোলমাল। ভোঁদা পুলিশের লাঠি খেয়ে আপাতত পুলিশ ভ্যানে। আর হাঁদা লাঠিধারী পুলিশ কে বললো, "আই অ্যাম এ স্টুডেন্ট। ইন আওয়ার ডেইলি লাইফ উই হ্যাভ টু পারফর্ম..."। ভোঁদা বুঝতে পারলো না, এরপর হাঁদা কি কি বললো। পুলিশ টি অল রাইট, ভেরি গুড বলে হাঁদাকে পিঠ চাপড়ে ছেড়ে দিলো। ভোঁদা পুলিশের ভ্যানে। আর হাঁদা বাইরে দাঁড়িয়ে সিনেমার টিকিট কেটে আইসক্রিম খাচ্ছে। হাঁদা কি এতো বললো? পরীক্ষার জন্য হাঁদা একটাই essay মুখস্থ করেছিল, ডিগনিটি অফ লেবার। সেটাই গড়গড় করে আউড়ে গেছে। কারন হাঁদা জানে ইংরেজিতে ভুল বলা যায় না। কেউ ইংরেজি শোনে না।
কিন্তু শতং বদ মা লিখ। হাঁদা বা বাঁটুলের শিক্ষা প্রয়োগ করতে গেলো ভোঁদা লিখিত ভাবে। একটা অফিসে ভোঁদা জেনারেটর চালায়। পিসতুতো বোনের বিয়েতে সাত দিনের ছুটির দরখাস্ত করলো। সাতদিন পর ভোঁদা জয়েন করতে গেলো। শুনলো, অফিস নতুন লোক নিয়ে নিয়েছে। খুব অন্যায়। ভোঁদা পিসেমশাইকে নিয়ে গেলো। পিসেমশাই দেখেন ভোঁদা ইংরেজিতে একটা রেজিগনেশন লেটার দিয়েছে ব্যাঙ্ককে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাই নতুন লোক কাজে নিয়েছে। ভুল ইংরেজি বলো, কিন্তু লিখো না।
![]() |
কার্টুনিস্ট: রাহুল |
ছাত্র ছাত্রীদের প্রশ্ন, পৃথিবীর উষ্ণায়ন বাড়ছে। সরকারের ভবিষ্যৎ ভাবনা কি? ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে জবাব, গরম যেমন ছিল তেমনই আছে বেটা। আসলে বয়স বাড়ছে, রক্ত ঠান্ডা হচ্ছে, তাই বেশি গরম লাগছে। এটা ছিল পৃথিবীর উষ্ণায়নের ব্যাখ্যা। যে কোনো কমিকসকে হারিয়ে দিতে পারে। ধর্ষিতা সাত মাসের অন্তসত্ত্বা, সে গর্ভপাতের অনুমতি চায়। বিচারপতি বলছেন মনুস্মৃতি পড়ো বেটি। অনেক কুমারী মায়ের নাম জানতে পারবে।
কমিকস কার্টুন আসমান থেকে আসে না। কমিকস আমাদের চারপাশে। কার্টুন চরিত্র ছড়ানো আছে। শুধু কুট্টি, আর কে লক্ষ্মণ, চন্ডি, নারায়ণ দেবনাথ এরা কেউ নেই।