দোঁহা

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কমিক্সে অতিমানব চরিত্রঃ একটি ভাবনা

 


শরণ্যা মুখোপাধ্যায়

আধুনিক যুগের শুরু ঠিক কবে থেকে সেটা ঐতিহাসিকরা একটা সময়কাল ধরে বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দর্শনগত দিক দিয়ে একটি বিশেষ দিনে বিশেষ সময়ে ঘণ্টা বাজিয়ে কোনো যুগাবসান হয় না। “আধুনিক” কথাটার ব্যাপকার্থও ক্ষেত্রবিশেষে প্রণিধানযোগ্য। ইউরোপে প্রাক ও উত্তর-রেনেসাঁ সময়ও আধুনিকই। তবে বর্তমান প্রবন্ধে যে সময়কালের উপর আলোকপাত করা হচ্ছে সেটি হলো ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। সালটা ১৮৫৯। প্রকাশিত হলো ডারউইনের যুগান্তকারী গ্রন্থ On the Origin of Species। এই বইটি বিবর্তনবাদের যে তত্ত্ব আনল তা প্রসারিত করল আরেকটি বাঁধভাঙা চিন্তকের প্রকাশ পথঃ ফ্রয়েড, বার হলো, The Interpretation of Dreams সালটা ১৮৯৯। এই দুটি গ্রন্থকে, আমাদের তথাকথিত আধুনিক সমাজের মাইলফলক বলা যেতে পারেঃ সভ্যতার “হীনত্ব”কে (LESSNESS) এই দুটি বই প্রাথমিকভাবে যেরকম প্রকাশ করেছে তা অভাবনীয়। প্রথমটি মধ্যযুগীয় চার্চ অধ্যুষিত ধর্মান্ধ-চৈতন্যহীণ জনসমষ্টিকে ধাক্কা দেয় দৈববিহীণ এক পার্থিব জৈবতত্ত্বের দ্বারা আর দ্বিতীয়টি বিণির্মাণ করেছে উত্তর-রেনেসাঁ ব্যক্তি-মানুষের একক সত্তার অপরা-জয়ধ্বনিকে। ইদ, ইগো ও সুপার-ইগোয় খণ্ডিত মানুষ ততদিনে হারিয়ে ফেলেছে বেঁচে থাকার নৈতিক-প্রাসঙ্গিক মাপকাঠিগুলি (Metanarratives)ঃ শ্রদ্ধা, সততা, প্রেম, বিনয়, বিদ্যা থেকে শুরু করে দিনগত পারস্পরিকতাটুকুও। শিল্পবিপ্লব যে সমাজের জন্ম দেয় তা পুরোটাই ছিল অর্থকর ও অর্থনির্ভর (cash-nexus based)। ফলে অনর্থ হতেও বেশি সময় লাগেনি। নায়কোচিত ব্যক্তিত্বের অভাব সমাজে এবং তার দর্পণ সাহিত্যে, প্রতিফলিত হতে শুরু করল। তিরিশের দশকের মহামন্দার সময় এই বিষয়টি কমিকসের মত জনমুখী লেখনীতে প্রভাব ফেলল।

 

                             বায়ুস ট্যাপেস্ট্রি (একাদশ শতাব্দী)

 কমিক্স অর্থাৎ পরপর সংযুক্ত কতকগুলি বাক্যসহ অর্থপূর্ণ চিত্র কিন্তু রোমে ট্রাজানের স্তম্ভেও আছে যা কিনা খ্রীষ্টপূর্ব ১১০ শতকে রচিত হয়েছিল ডেসিয়ান যুদ্ধে সম্রাট ট্রাজানের জয় উদযাপনের সময়। এছাড়াও ঐতিহাসিকরা বেয়ুস ট্যাপেস্ট্রি (Bayeux Tapestry) বা কাপড়ে বোনা ইংল্যাণ্ডে নরম্যান বিজয়গাথাকেও কমিক্সের আদি পিতা বলে মানেন। তবে ছাপা-অক্ষরে কমিক্স কবে শুরু হয়েছিল সেটা নিয়ে ইউরোপীয়, আমেরিকান আর জাপানের সংস্কৃতিতে ভিন্নমত রয়েছে।বলা হয়, ইউরোপীয় রোডোলফ টপার, (আনুমানিক ১৮২৭) আমেরিকান রিচার্ড আউটকল্ট (আনুমানিক ১৮৯০)আর জাপানের হকুসাইয়ের (উনিশ শতক) ঐতিহ্যকে যথাক্রমে অণুসরণ করেছেন পরবর্তী সময়ের দেশীয় শিল্পীরা।মোটামুটিভাবে উনিশ শতকের শেষ ও কুড়ি শতক প্রায় পুরোটাই কমিক্সের স্বর্ণযুগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে সভ্যতার ঊষরতম অধ্যায়ে জন্ম হয় ব্রিটিশ “ডেসপারেট ড্যান” (১৯৩৭) চরিত্রটির। স্রষ্টা ডাডলি ওয়াটকিন্স প্রথমে চরিত্রটিকে একটি আইন-অবমাননাকারী দুর্বৃত্ত হিসাবে এনেছিলেন। ড্যান জন্মগ্রহণ করে একটি অতিমানব ধরণের পরিবারে, যেখানে সকলেই অসাধারণ কোনো শক্তির অধিকারী। সম্ভবত সায়েন্স ফ্যান্টাসিতে মিউট্যান্ট-এর ধারণা গড়ে ওঠার সময়কালেই এই চরিত্রের অবতারণা। এই ড্যান রাস্তায় মারামারি ও অসামাজিক কাজকর্ম করা একটি ভিলেইন জাতীয় চরিত্র থেকে হিরো বা নায়কোচিত চরিত্রে রূপান্তরিত হয় ক্যাক্টাসভিলে তার পিসি/ কাকিমার (গল্পে আন্ট বলা হয়েছে) অ্যাগির কাছে থাকতে এসে এই কাকিমা তার বাড়ির লোকেদের মতো বিরাটাকার চিবুক ও চেহারার অধিকারী ছিলেন না (সম্ভবত বিবাহসূত্রে তিনি ড্যানের কাকিমা হন, পারিবারিক সূত্রে নয়)। এই আন্ট-এর কাছ থেকেই শক্তির সঙ্গে আসা দায়িত্বের ধারণা পায় ড্যান এবং তারপরেই সে ধীরে ধীরে একটি মহানায়কোচিত অতিমানুষ(superhero) সহানুভূতি-কাড়া চরিত্রে রূপান্তরিত হয়, যে কিনা জগতের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ। যে একহাতে একটি গরু তুলে ফেলে, যার মাথার বালিশ কংক্রিট-বোঝাই, যে দাড়ি কামাতে ব্যবহার করে রাংঝাল-নল (blow-torch)! এই ২০১১ সালেই ডেসপারেট ড্যান অতিমানুষ-ভোটে দ্বিতীয়স্থান অধিকার করে, প্রথম হয়েছিলেন ব্যাটম্যান। বোদ্ধা পাঠক এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন আমাদের ভারতবর্ষীয় কোন চরিত্র এই ড্যানের আদলে তৈরীঃ হ্যাঁ, “বাঁটুল দি গ্রেট”। ষাটের দশকে নারায়ণ দেবনাথের এই অমর সৃষ্টি প্রথম প্রকাশেই জনমানসে আলোড়ন ফেলে। দেবনাথের বন্ধু বিখ্যাত শরীরচর্চাকারী মনোহর আইচও অণুপ্রেরণা ছিলেন এই কমিক্সের।

 

                            ডেসপারেট ড্যান (১৯৩৭)

সুপারম্যান এসেছেন ১৯৩৭-৩৮ সাল নাগাদ। ফ্যান্টম আরো একবছর আগে, ১৯৩৬। চার্লি ব্রাউন চলেছেন ৫০-৫৫ বছর অবদি। মিকি মাউস বা ডোনাল্ড ডাকের বয়স সত্তরের ওপর। এই তালিকায় আলাদা এক সংযোজন ড্যান। ডেসপারেট ড্যান এই সময়েরই নায়ক। সেই খ্যাতির সমান্তরালে আমরা পেয়েছি বাঁটুলকে। বাংলায় কিন্তু প্রথমেই এতটা শক্তিশালী ছিল না বাঁটুল। তুমুল জনপ্রিয়তা পাবার পর বাংলাদেশ তথা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে শুকতারা-সম্পাদকের অনুরোধে তিনি বাঁটুলকে অপরাজেয় এক চরিত্রে পরিণত করেন যে একহাতে পৃথিবী তুলতে পারে, বুলেট ঠিকরে যার শরীরে লেগে, যে কংক্রিট দেওয়াল ভেদ করে যেতে পারে, আবার যেকোন অপরাধীর রাতের ঘুমও কেড়ে নিতে পারে। তবে বাঁটুলের সঙ্গে ড্যানের একটা বড় তফাত হলো ড্যানের একটি বান্ধবী চরিত্র ছিল। যার নাম লিটল বিয়ার। বাঁটুলের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো চরিত্র আনা হয়নি। যদিও বাঁটুল মূলত ছোটোদের জন্য লেখা একটি চরিত্র এবং তার কাণ্ডকারখানাও সেরকমই। কিন্তু ছোটোদের জন্য লেখা গল্পে নারী চরিত্রের অবতারণাই হতে পারে না, এমন কথাও মেনে নেওয়া একটু কঠিন বইকি। এক্ষেত্রে সময়ের প্রসঙ্গ আসবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সে সময়ে তো এ বিষয়ে তেমন কথা উঠেছে বলে জানা যায় না? তাহলে? এই ন্যারেটিভই কি গ্রহণ করেছেন সবাই? তৎকালীন সমাজ ও তাতে নারীদের ভূমিকা বিষয়ে আলোকপাত করলে হয়ত এই অনুপস্থিতির একটা হদিশ পাওয়া যেতেও পারে। তবে এ প্রসঙ্গে একটু অন্য এক ধারণার কথা বলা যাকঃ


তাত্ত্বিক Jeffery Schrank একটি বিশেষ ধারণার কথা বলেছেন, ‘Pseudo-Choice’ বা ছদ্মপছন্দ। কী বলেছেন তিনি, দেখা যাকঃ “In Pseudo-Choice the world is a multiple-choice test. We are free to answer questions only in terms of the options presented. A real-choice test would have only blank spaces for our answers…A multiple choice test offers…only an illusion of freedom.”

ড্যান কেবলমাত্র একটি বিশেষ্য থেকে বিশেষণে উঠে এসেছিল (ডেসপারেট ড্যান) যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেটি ছিল ভারোত্তোলনের। সেখানে সে পৃথিবীর শক্তিশালীতম মানুষের খেতাবটি পেয়েছিল তার অন্য সমস্ত প্রতিযোগীদের তাদের ভারসহ একসঙ্গে তুলে। এই চূড়ান্ত শক্তিশালী চরিত্রটিও যাঁকে মেনে চলত তিনি একজন নারী। যদিও তাঁর উপস্থিতি গল্পে খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। বাঁটুলের ক্ষেত্রেও পিসিমা জাতীয় চরিত্র এসেছে, সেখানে বাঁটুলও সম্মান প্রদর্শনই করেছে, কিন্তু গল্পে তার দৈর্ঘ্যও বেশি নয়। অবশ্যই তা প্লটের খাতিরে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় হলো গল্পের এই প্যাটার্ন সততই পুরুষমুখী। অর্থাৎ ছোটো কোনো মেয়ে যখন এই চরিত্রগুলি পড়বে, তার চয়েস বা পছন্দের তালিকায় সে খুব বড় করে কোনো নারী চরিত্রকে চাইলেও রাখতে পারবে না। এই চয়েসের বা পছন্দের যে সীমাবদ্ধতা, তাকেই বলা হচ্ছে ছদ্মপছন্দ। যেখানে অতিমানব হিসাবে পুরুষ চরিত্রকেই পছন্দ করতে হবে। এও একটি দিক এবং শুধুমাত্র কমিকসের ক্ষেত্রেই নয়, যে কোনো গল্পের ক্ষেত্রেই এ কথা কমবেশি প্রযোজ্য হতে পারে। তবে  এ কথা সত্য যে এই কমিক্সগুলোকে পুরনো পৃথিবীর মূল্যবোধ, মানবতার শাশ্বত সত্যও ধরা পড়েছে, প্রভাবিত করেছে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। তাই ড্যান নাজিদের বিরুদ্ধে লড়ে, বাঁটুল অপরাধের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে সাহায্য করে পুলিসকে।

                            ফ্যান্টম/ অরণ্যদেব

জটিল সময়গুলিতেই বারবার অতিমানবদের প্রয়োজনীয়তা ধরা পড়েছে। ভয় যদি আদিম প্রবৃত্তিগুলির মধ্যে একটি হয়, সমর্পণ দ্বিতীয়। বাঁটুল বা ড্যান চরিত্রের তাৎপর্য তাদের শক্তির শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রয়োগে নিহিত। এই নৈতিক-প্রাসঙ্গিক মাপকাঠি বর্তমান উত্তর-পরবর্তী শূণ্যদশকের ছদ্ম-আধুনিক যুগে এ গ্রহটির প্রকৃত উদ্বর্তনহেতু একান্ত প্রয়োজন।


বই সারণী

১। Schrank, Jeffrey. Snap, Crackle and Popular Taste: The Illusion of Free Choice in America. New York: Delacorte Press, 1971. Print.(১২)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন