দোঁহা

দেশভাগ কাঁটাতার ও চরের মানুষ

 



অমিত মজুমদার

দেশভাগ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রচুর উপন্যাস লেখা হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে', 'কেয়াপাতার নৌকো', 'পূর্ব পশ্চিম', 'সুপুরিবনের সারি' ইত্যাদির মতো কালজয়ী সব রচনা। দেশভাগের আঁচ মূলত বাংলা ও পাঞ্জাবের ওপর দিয়ে পড়েছিল। তাই বাংলায় লেখা এই সমস্ত উপন্যাসে দেশভাগের পটভূমি বলতে বাংলা ভাগ ও তৎকালীন প্রেক্ষাপটে মানুষের জীবনবৃত্তান্তই দেখবো এটাই স্বাভাবিক। লেখকের জীবন নিংড়ে উঠে এসেছে সেইসব কাহিনি। বাংলা ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে তৈরী হয় পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব পাকিস্তান। দুটো জায়গাই দুটো আলাদা আলাদা দেশের অন্তর্ভূক্ত হয়। অথচ দুই প্রদেশের ভাষাই বাংলা। দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে কাতারে কাতারে মানুষ নিজের চোদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসে ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে। এই উদ্বাস্তুবৃত্তান্ত বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। দেশভাগের কোপ যে সমস্ত পরিবারের ওপর পড়েছিলো উল্লেখিত উপন্যাসগুলো মূলত: তাদের নিয়েই লেখা৷ বেশির ভাগ উপন্যাসে দেখা যায় তাদের দেশত্যাগের কারণ আর দেশত্যাগের পরবর্তীতে উদ্বাস্তু জীবনের কথা। এখানে একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখলে দেখা যাবে পূর্ববঙ্গ থেকে একটা বড় অংশের হিন্দু ভারতে চলে আসলেও একটা অংশ হিন্দু কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানকেই নিজের দেশ মনে করে সেখানে থেকে গেছিলো। তারা কিন্তু পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে তখন চলে আসেনি। পূর্ব পাকিস্তানকেই নিজের দেশ মনে করে থেকে যাওয়া মানুষদের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার কথা নিয়ে খুব বেশী সাহিত্য রচনা হয়নি। তবে কিছু কিছু লেখা অবশ্যই হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যায় তৃষ্ণা বসাকের লেখা ‘চরের মানুষ’ উপন্যাসটির কথা। উপন্যাসের ব্লার্বে লেখা আছে, “১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এক বড় অংশ হিন্দু পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে এলেও কিছু মানুষ ভিটে আঁকড়ে থেকে যান, তাদের মধ্যে একজন টুনুর বাবা। পেশায় ডাক্তার মানুষটির নিজের ছেলে মুসলমানের হাতে খুন হলেও কিছুতেই মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাননি, থেকে গেছেন ময়মনসিংহে মাটি আঁকড়ে।”
        
উপন্যাসের ব্লার্বেই টুনুর সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেন লেখক। গোটা উপন্যাসটা মূলত টুনুর চোখ দিয়েই তিনি দেখিয়েছেন। টুনুর জন্ম থেকে গল্পের শুরু। তার জন্ম সাত মাসে হয়েছে বলে সবাই বলে তার বুদ্ধিও সাত মাসে ঠেকে আছে৷ উপন্যাসের শুরুই হয় টুনুর একটা কৌতূহল দিয়ে। সে তার এক দাদার কাছে জানতে চেয়েছিলো, “মনন্বর কারে কয়?” সেই বিষয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। সে কখনো অভাব জিনিসটা দেখেনি৷ তার ধারণা হয়েছিলো কলকাতায় মন্বন্তর আছে। তাই সেও কখনও নিজের দেশ ছেড়ে কলকাতায় যাবার কথা ভাবতেই পারেনি৷ এখানে উল্লেখ্য সাতচল্লিশে দেশভাগের আগেপিছে জড়িয়ে আছে দাঙ্গা, মন্বন্তর, ভিটেমাটি ছাড়ার যন্ত্রণা, খিদের কষ্ট, মৃত্যু৷ টুনু জন্মের পর থেকেই এই কথাগুলো শুনে আসছে। প্রতিটা কথা তার মনে এতটাই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যে কলকাতার নাম শুনলেই সে আতংকে ভোগে। এই সব কিছুর মূলেই ছিলো একটা কাঁটাতার যা মানুষকে মানুষের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো। ভূমিকার শুরুতে লেখক লিখেছেন, ‘কোমলগান্ধার’ সিনেমার একটা থেমে যাওয়া রেললাইন ছিল, যার আর কোনো জায়গা ছিল না যাবার। বুক ধক করে উঠেছিল এই দৃশ্যে, আর দেশভাগের বেদনা আমাকে পেড়ে ফেলেছিল।
        
উপন্যাসটা গভীর ভাবে উপলব্ধি করলে মনে হয় টুনুই যেন সেই থেমে যাওয়া রেলপথ। যার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। তাকে থাকতে হবে কাঁটাতার ঘেরা একটা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রের মধ্যেই। দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা দেখা দিয়েছিলো ভারতে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু এই উপন্যাসের পটভূমি যেহেতু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তাই উদ্বাস্তু সমস্যা যে এখানে প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ধরা দেবে না এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু একেবারেই যে আসেনি তাও নয়। টুনুর মেজদিদি বিয়ের পর স্বামী শাশুড়ির সঙ্গে অন্যান্য উদ্বাস্তু পরিবারের মতো কলকাতাবাসী হয়। কিন্তু সেখানে তার অবস্থা হয় ভয়াবহ। “তার মেজদিদি সেই দ্যাশে থাকে। বড় দুখিনি সে। টাউনের বড় দাকতারের মেয়ে। গিয়া পড়ল গণ্ডগ্রামে। জামাইবাবু কাপড়ের গদিতে খাতা লেখে। তবু সেই অল্প কামাই আর অন্ধ শাশুড়ি নিয়া তার মেজদিদির চলে তো যাচ্ছিলো। হঠাৎ একটা কালো মেঘ ধাওয়া করে এল। কাপড়ের গদিতে আগুন লাগল, অল্প বেতনের চাকরিটাও গেল জামাইবাবুর। অন্ধ শাশুড়ি, তারে মেজদিদি তোলা জলে স্নান দেয়, কে জানে কেন একলা পুকুরঘাটে যেতে গিয়ে পা পিছলে জলে ডুবে মারা গেল।” উল্লেখ করতে হয় সেলাই দিদিমণি পদ্মমাসীর কথাও। তার ছোটোবোনও স্বামীর সঙ্গে ভারতে চলে গেছে। সাঁইথিয়ায় থাকে। বাড়ির পাশে রেললাইন। সেই রেললাইনের চেয়ে থাকে তার বোন যদি কেউ আসে। কিন্তু কে আসবে? সে একটা অন্য দেশের বাসিন্দা। আসার মতোও তো কেউ নেই।
        
উপন্যাসে পটভূমির সময়কাল দেশভাগ পরবর্তী থেকে ১৯৭১ এর মুক্তযুদ্ধ। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের জীবনকালই এই উপন্যাসের বিস্তার। এই সময়ের মধ্য এখানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্মলগ্নে সেখানে ভারতের চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ ছিলো না। কিন্তু পরবর্তীতে নিষিদ্ধ হয়ে যায়৷ উঠে এসেছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে। উল্লেখ্য উপন্যাসের মূল চরিত্রেরা পূর্ব পাকিস্তানকেই নিজের স্বদেশ মনে করে থেকে গেলেও কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক উত্থান-পতনে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেনি। এমনকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নেয়নি অথচ নিজের অজান্তে জড়িয়ে গেছে এই যুদ্ধের পরিমণ্ডলে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছে পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড। অর্থাৎ এই উপন্যাসে লেখাই হয়েছে একেবারে সাধারণ মানুষের কথা। টুনু, সুরেশ ডাক্তার, লক্ষ্মীরাণী, অমর, তারাচরণ, পারুলবালা, আশালতা, জয়ন্তী, ডাক্তার বিরজাপ্রসাদ সাহা সব চরিত্রই যেনো একেবারে আশেপাশের বাড়ির মানুষ। প্রখ্যাত সাহিত্যিক অনিতা অগ্নিহোত্রী লিখেছেন, “ঢাকা ময়মনসংহের আঙিনা উঠোন, ধূপতারা আকুরটাকুরের খিড়কি পুকুর রান্নাঘর আর তার সঙ্গে নবাবপুর শাঁখারিটোলার রাজপথ হাসপাতাল ব্রহ্মপুত্র আর লৌহজঙ্গ নদীপথ দ্রুত নিয়ে চলে পাঠককে। রাজনৈতিক ঘটনাবলি অনায়াসে মিশে যায় ব্যক্তিগত জীবন কাহিনিতে।”
              
উপন্যাসটা একটা বড় ক্যানভাসের ওপর দঁড়িয়ে আছে। একের পর এক ঘটনার ঘনঘটায় টানটান গতিতে এগিয়ে গেছে প্রতি মুহূর্তে। এখানে প্রচুর চরিত্র। প্রতিটা চরিত্র সুন্দর ফুটে উঠেছে। টুনুর স্বামী অমর একজন ডাক্তার। তার আবার নারীদের প্রতি টান। এমনকি বাড়িতে স্ত্রী থাকতেও সে পরকীয়ায় জড়িয়ে যায়। তা সত্ত্বেও অমরকে কখনও খারাপ মনে হয় না। উপন্যাস এমন ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে অমরের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হয়। তার প্রতি কখনো ঘৃণা হলেও সেই ঘৃণা কখনও চিরস্থায়ী হয় না। টুনুকে অমরের মায়ের গঞ্জনা প্রতি মুহূর্তে সহ্য করতে হলেও সেই শাশুড়ির মানবিক মুখ আমরা দেখতে পাই অমরদের বাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারী আসার পর। উপন্যাসের ভাষা অত্যন্ত সাবলীল। কাহিনী নির্মাণে কোথাও অহেতুক জটিলতা নেই। দেশভাগ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত একটা মেয়ের এমন এক যাত্রাপথের শুরু যে পথের কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। হয়তো সেই যাত্রা কাঁটাতারবিহীন একটা স্বপ্নের খোঁজ।  ভূমিকা থেকে লেখকের সঙ্গে আমরাও বলে উঠতে পারি, “শুরু তো হলো যাত্রা। দেশহীন, আশ্রয়হীন মানুষের এক কাঁটাতারবিহীন পৃথিবীর স্বপ্নের দিকে।”


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন