দোঁহা

অতএব দেশভাগ মানে…



আরাত্রিক ভদ্র

দেশভাগের বাহান্ন বছর পর আমার জন্ম। আমি দেশভাগ দেখিনি, দেশভাগের গল্প শুনেছি কেবল। এই যেমন সেদিন দিল্লির ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে বসে এক ভদ্রলোকের কাছে একটা গল্প শুনছিলাম। রাষ্ট্র যখন দুই দেশের মধ্যে ১৯৪৭ সালে দাগ টেনে দিয়েছিল, তাঁর মায়ের দিকের পরিবার করাচি যাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। স্টেশনে প্রচুর ভিড়। ডিসকভারি চ্যানেলে যেমনটি দেখায়- আফ্রিকার বৃহৎ প্রান্তে সিংহের তারা খেয়ে যেমন পালে-পালে বাইসন ছুটতে থাকে, তেমন গাড়ি আসতেই পরিবারের সকল সদস্য ছুটে উঠে পড়েন ট্রেনের কামরায়। অত ভিড়ে সুবিধে করতে পারলেন না এক মেয়ে আর তাঁর বাপ। গাড়ি স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। তারা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন আরেকটা ট্রেন আসবে, তাদের পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যাওয়ার জন্য। শকুন্তলা যেমন করে দুষ্মন্তের জন্য বৃথা অপেক্ষা করেছিলেন, তেমনই পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করে রইলেন বাবা এবং মেয়ে। সময় সময়ের নিয়ম মেনে চলে গেল-ট্রেন এলো না। তারা থেকে গেলেন ভারতবর্ষে। এর পর কি? তারা রয়ে গেলেন ভারতীয় নাগরিক-এই ঘটনার ছিয়াত্তর বছর পরেও তাদের দেশপ্রেম প্রমাণ করে চলতে হচ্ছে।

একটা ট্রেন ঠিক করে দিল দুজনের নাগরিক পরিচিতি।

সত্যি বলতে কি, ভারতবর্ষ এবং পশ্চিম পাকিস্তান-এর ভাগাভাগি নিয়ে যত আলোচনা জাতীয় স্তরে ঘটে, তেমনটা পূর্ব পাকিস্তান, বা পরবর্তীকালের বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতবর্ষের ভাগাভাগি নিয়ে ঘটেনা। এ বিষয়ে বলতে গেলে, অনেকের মতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধর ঘটনাটা ইতিহাসে এমন প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছে বাঙ্গালীদের কাছে, সেই স্মৃতির কাছে কিছুটা হলেও দেশভাগের প্রসঙ্গ খর্ব হয়েছে। আজ একজন চব্বিশ বছরের তরুণ হিসেবে বলতে পারি, দেশভাগের কঠোর স্মৃতি, তার যন্ত্রণার ইতিহাস, অনেকটাই আমাদের প্রজন্মের কাছে অজানা।

আমরা দেশভাগ সম্পর্কে কি জানি? আমাদের প্রজন্ম দেশভাগ সম্পর্কে কতটা জানে? আমাদের প্রজন্ম দেশভাগের স্মৃতি কতটা বহন করে নিয়ে চলেছে?

চলচ্চিত্র বিদ্যার ছাত্র হওয়ার দরুন ঋত্বিক কুমার ঘটকের ছবির আলোচনা করতে গিয়ে কিছু উপলব্ধি করতে পেরেছি। এছাড়া সেদিনই দিদুন কে জিজ্ঞেস করেছিলাম-বললেন ফরিদপুরে থাকতেন, স্বাধীনতার আগে, “সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে আরও জঘন্য হবে”, এমনটা আন্দাজ করে তার বাবা তাকে নিয়ে সাতচল্লিশ-এর আগেই এ দেশে চলে আসেন।

এমন টুকরো টুকরো কথা, শিল্প, সাহিত্য পড়েও কি এক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সামগ্রিক চেহারার কথা আন্দাজ করা যায়? যেমন করে বিয়াল্লিশ-এর মন্বন্তর চার্চিল কর্তৃক ছিল, তেমনটাই তো দেশভাগ! ভগবৎ গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বারবার করে বলেছেন, এ শরীর একটি বাড়ির মতো, তাঁর ভিতরে বাস করে জীবাত্মা। মৃত্যু হলে তবে সে নতুন শরীর, অর্থাৎ নতুন গৃহে প্রবেশ করে। কিন্তু এ চালনা প্রকৃতির নিয়মে-জোর করে উচ্ছেদ করা তো এক রকমের খুন, তাই নয় কি? এমনটা নিয়ে কৃষ্ণের বক্তব্য শুনতে আমি উদগ্রীব। অন্তত তিনি যদি জানতেন, তাঁর নামেই আমিনাকে ছেড়ে আসতে হবে তাঁর ছোটবেলার খেলার ঘর, লক্ষ্মীকে ছাড়তে হবে তাঁর তুলসী মঞ্চ, তাহলে তিনি কখনই খুশী হতেন না।

যাইহোক, দেশভাগ নিয়ে আমার কি কথা, তাই নিয়েই এই নিবন্ধ রচনার পরিকল্পনা। আমি আমার সময়ে দাঁড়িয়ে, আমার রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দেখতে চাই এই দেশভাগের কি প্রভাব! বর্তমানে আমাদের দেশে এবং রাজ্যে (পশ্চিমবঙ্গে) একটি দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ব শক্তির উদ্ভব হয়েছে। দুহাজার উনিশের লোকসভা নির্বাচন থেকেই বোঝা গেছে যে বাঙালি মধ্যবিত্ত উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা বাইরে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সম্প্রীতির কথা বলে চললেও, তাদের ভিতরে কোথাও লুকিয়ে আছে গভীর মুসলমান বিদ্বেষ- যার প্রকাশ মাঝে মধ্যেই ঘটে ছোট বড়ো কথায় কথায়।

 -পার্ক সার্কাসে দেখেছ কি দৌরাত্ম্য!
-ওদের জন্যেই তো চলে আসতে হয়েছে আমাদের।

এই আমরা-ওরা-র সাম্প্রদায়িক বিভাজনই আমার কাছে দেশভাগের বিকৃত রূপ প্রতিবিম্বর মতো তুলে ধরেছে।

আজ যখন সারাদেশের বিভন্ন প্রান্তে ধর্ম এবং জাতিকেন্দ্রিক বিভাজন আলোচনার মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন আমাদের কিছু প্রশ্ন করা অতীব জরুরি। হয়তো আজ পিছনে তাকিয়ে দেশভাগের যন্ত্রণার কথা আমাদের প্রত্যেককে সাংঘাতিক পীড়া দেয়, তবুও এমন ঘটনার কারণ অন্বেষণ করতে গেলে বারবার শাসকের রাজনৈতিক অভিসন্ধির কথা বিপুলভাবে ভেসে উঠবে। আমাদের অজ্ঞ্যাতবস্থায় প্রাপ্ত পরিচিতি এবং জ্ঞ্যাতবস্থায় নির্মিত বিশ্বাস কেন আমাদের বিভেদের মূল হয়ে দাঁড়াবে? এর কারণ আজকের দিনে দাঁড়য়ে দেখতে গেলে মনে হয় আমরা অন্তরীণ করে নিয়েছি স্বার্থপরতা। নিজের অজানা স্বার্থ চরিতার্থ করার মূল নিদর্শন দেশভাগ। তবে এই স্বার্থের সাথে আত্মমর্যাদার সংজ্ঞা গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবেনা। স্বার্থ যদি দেশভাগ নিয়ে আসে, তবে আত্মমর্যাদা এনেছে বাংলাদেশ-একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

এতগুলো এলোমেলো কথা লেখার কি প্রয়োজন?
তবু বলা কিসের জন্য?

আজ বিশ্বের দিকে তাকালে দেখবো, যে দুই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের প্রভাবে ধ্বংস হয়েছিল পূর্ব থেকে পশ্চিম, তার ভয়ানক স্মৃতি বহন করে আজও প্রবলভাবে সেই যুদ্ধ এবং তার পরিণাম নিয়ে কথা হয়ে চলেছে মূল স্রোতের মধ্যেই। অথছ আমাদের দেশে কি বিশ্বযুদ্ধের মতো হিংসার অভাব কখনও ঘটেছে? দেশভাগ থেকে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা- ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ঘটনাগুলো বিস্মৃতির অন্ধকূপে হারিয়ে গিয়েছে।

সবাই চুপ-কেউ কথা বলছেনা। বিজয় তেন্ডুলকারের নাটক কে অন্যরকম নামাঙ্কন করে বলতে হয়-'চুপ! গণতন্ত্র চলছে!'

শাসকের খুন যেমন অপরাধ, তেমনই অপরাধ সব কিছু ভুলে যাওয়া। যন্ত্রণা মনে রাখা কঠোর পরিশ্রম হতে পারে, তবু তা জরুরি-জরুরি কারণ আমাদের সেই যন্ত্রণার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হবে।

অতএব দেশভাগ মানে আমার কাছে একটি রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের উদাহরণ, যার থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সাম্প্রদায়িক হিংসাকে নির্মূল করতে হবে- করতে হবেই। চুপ করে থাকা মানে আবার দেশভাগ- ভাগ হবে মানুষের-ভাগ হবে চেতনার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন