দোঁহা

অপারগ



শ্যামল ঘোষ

যখনই কেউ বলে, 'তোর কিচ্ছু হবে না'  আমি তখন ভীষণ উৎসাহিত হয়ে তাকে বলি, 'আমি এই করবো, সেই করবো।'  কিন্তু অবশেষে দেখা যায়, তার কথাই ঠিক। আমি কিছুই পারি না।

আর এই সত্যিটা নিয়ে যে কোনো সন্দেহ নেই, তা বুঝতে বাইরের লোকের প্রয়োজন হতো না, আমার বাড়িই যথেষ্ট। অবশ্য বাড়ির সবাই নয়, একমাত্র বাবা আর দাদাই, অতি সহজে আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে যে, কিভাবে একটা গোছানো ঘরের পরিষ্কার দেয়ালে-একটা বাঁকা ছবি হয়ে বিশ্রী বেমানান ঝুলে আছি দিনরাত।

এই কাত হয়ে ঝুলে থাকা ছবির আসলে যে কোনো সৌন্দর্য্য নেই, তা একটু একটু করে বেশ ভালই অনুভব করতে পারছিলাম। পারব নাই বা কেন? দাদা বলে, 'সুশান্ত, তুই শুধু পড়াশোনায় ডাল তা নয়, বোকামিতেও তোর জুড়ি মেলা ভার। পাঁচটা মাল আনতে বললে, একটা না একটা ভুলে যাস, বাজার করতে গেলে খারাপ জিনিস বেশি দাম দিয়ে আনিস, টাটকা আর পচা মাছের ফারাক বুঝিস না।' -সত্যি এগুলো আমারই দোষ বটে। মাছওয়ালা পচা মাছ বিক্রি করে টাটকা নগদ টাকাই নেবে, এতে তার কোন হেলদোল থাকবে কেন?

দাদা আমার সম্পূর্ণ বিপরীত। পড়াশোনায় রীতিমতো ব্রিলিয়ান্ট। ওর সবকাজেই বরাবর একটা ছন্দ বজায় থাকে। বস্তুত বাবা যে ওকেই ভালবাসবেন, এটাই স্বাভাবিক। ইদানিং একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, আমাকে বকাঝকা করতে করতে বাবাও কেমন যেন ক্লান্তি বোধ করেন, মুখে কিছু বলেন না ঠিকই, কিন্তু তার নীরবতার মধ্যেও এক আশ্চর্য শক্তি আছে। শুধু আমি নয়, সেই শক্তির সামনে আমরা সবাই পারতপক্ষে মাথা নিচু করেই থাকি। মেপে মেপে পরিমিত কথায় পারদর্শী দাদাও তার সামনে কেমন লজ্জাবতী হয়ে যায়। যাকে বলে রীতিমত রাশভারী, বাবাকে আমরা সবাই এভাবেই জানি।

 প্রতিদিনই দেখা যেত কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। এই যেমন বাবার নিয়মিত হাই প্রেশারের ওষুধ আনতে গিয়ে এমন হল যে, এক্সপায়ারি ডেটটার আর মাত্র দুদিন বাকি অথচ ওষুধটা মোট দশ দিনের। অভ্যাসমতো দাদাই সব খুঁটিয়ে দেখে। দেখাই উচিত। আর হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারি কী করতে হবে। উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওষুধের দোকানে গিয়ে বলি, 'না মানে, এটা তো প্রেশারের ওষুধ, ডেটটা দুদিন পরেই ফেল হয়ে যাবে, এটা খেলে বাবা হয়তো...'

সব কথা শুনে ফার্মাসিস্টদের একজন এক লহমায় বুঝে নেবেন যে কতখানি মারাত্মক ভুল তারা করেছেন। জায়গামতো পড়লে গণধোলাই তো বটেই এমনকি তাদের ড্রাগ লাইসেন্সও ক্যানসেল হতে পারে। নিমেষে পেশাদার মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বলবে, 'কে দিয়েছিস এটা? দেখিস নি? ভীষণ দুঃখিত ভাই!' -কিন্তু চোখের ভাষায় স্পষ্ট, যে মিলিয়ে না নিতে পারাটা সম্পূর্ণ  নিজের  দোষ আর তাছাড়া এটা একটা অতি সামান্য ব্যাপার, ঘটে থাকে।

বাড়ি এসে  ঠিক ওষুধটা বাবা আর দাদার সামনে মেলে ধরতেই, দাদা প্রথমেই এক ঝলক হাসে, তারপর আবার বাবার মত গম্ভীর হয়ে যায়। আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলে, 'মায়ের মাথা ঘোরার ওষুধটা আনিস নি?' বাবা এখনো কিছু বলবে না। চুপচাপ থাকবে। এরপর আমি বাবার পুরনো সাইকেলটা বার করব। আবার ছুটব ওষুধের দোকানে।

এই সাইকেলটা শুধু আমিই চালাই। দাদা  ছুঁয়েও দেখেনা। মাত্র একদিন দাদাকে আমার জায়গা নিতে হয়েছিল। সেই সাইকেল চালিয়ে, যেখানে যেখানে  সে গেছে, সেখানেই 'দড়াম' শব্দে  কাউকে না কাউকে কোথাও না কোথাও মেরে দিয়েছে। আসলে দাদা যে সাইকেল চালাতে পারে না তা নয়, সে জানতই যে আমাদের এই লরঝরে সাইকেলে কোনো ব্রেক থাকে না, বহুদিন ধরেই নেই, তাই বাতিল হয়েই পড়ে থাকে, একটু যত্ন নিয়ে চালাতে হয়। বাড়ি ফিরে এসে বাবাকে আমার নামে নালিশ করলে বাবা বললেন, 'সুশান্ত একটা অপদার্থ। তাই ওই সাইকেলটার মায়া কাটাতে পারে না।'

বাবা বেশি কিছু বলেন না, যেটুকু বলেন নিশ্চয় ভালোর জন্যই বলেন। তা না হলে এত ভুলভাল কাজ করা সত্ত্বেও সব কাজ আমাকে দেন কী করে?

 মা বলে, 'সুশান্ত তুই না থাকলে আমার সারাদিন রান্নাবান্নাই হত না রে।'

আসলে মা খুব সংসারী। অপচয় পছন্দ  করেন না। যা প্রয়োজন নেই তা আগে থেকে আনিয়ে জমিয়ে রাখতে চায় না।  তার চেয়ে আমি রোজ মোড়ের দোকানে আট দশ বার যাই আর এনে দিই। মায়ের সেই ভালো। দাদা অবশ্য রেগে যায়। বলে, 'সব একেবারেই তো এনে রাখা যায়।'

যে যাই বলুক ভালোই ছিলাম। কিন্তু ভালো শব্দটা খুব বেশিক্ষণ আমার সঙ্গে থাকে না। এইতো সেদিন দাদার জন্মদিন ছিল। আমরা বাড়ির সবাই দারুণ হৈ চৈ করে, সারা বাড়ি সাজিয়ে-গুছিয়ে, খাটে চার স্ট্যান্ডে বেলুন ঝুলিয়ে, দিব্যু একটা ছোটখাটো উৎসবমুখর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফেললাম। কিন্তু সেই আনন্দ সম্পূর্ণ মাটি হয়ে গেল তখন যখন দাদার কেক কাটার সময় হল। দিন তিনেক আগেই আমাকে কেকের টাকা দেওয়া হয়েছিল। সবার মুখের ভাব লক্ষ্য করে সেই মুহূর্তে তড়িঘড়ি বেরিয়ে একটা রেডিমেড কেক এনে হাজির করলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কেউ কিছু বলল না। জন্মদিন উপলক্ষে একটা বড় সাইজের রুইমাছ আনা হয়েছিল। সবাইকে বেশ বড় বড় পিচ দেওয়া হল। কিন্তু মা সমস্যায় পড়ল, যখন মাছের  মুড়োটা দেওয়ার  সময় হল। বাবার নির্দেশে সেটা শুধু দাদার পাতেই পড়ার কথা। কিন্তু মায়ের মন মানে না। তার কাছে সব সন্তানই সমান। তাই মুড়োটা দাদার পাতে দেবার সময় মা আর আমার মুখের দিকে তাকালো না। গর্ভধারণ থেকে আরম্ভ করে এই পর্যন্ত লালন-পালনের যাবতীয় স্নেহ ভালবাসা শুধুমাত্র এই অতি তুচ্ছ একটা  ঘটনাকে কেন্দ্র করে, তাকে যেন ঈষৎ নীরব করে দিল।

 বাবা আমাদের থেকে দূরে, একটা কাঠের চেয়ারে বসেছিলেন। ডান পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত বাঁ পায়ের উপরে রেখে, চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ভীষণ আনন্দে বললেন, 'খা রমেশ খা।  একটু ভালো করে খা। রাত জেগে কত পড়াশুনা করিস। একটু ভালো করে না খেলে হয়? সামনেই তোর আবার পরীক্ষা।'  ভ্রূক্ষেপহীন উদাসীনতায়, দিব্যু গপগপ করে, সশব্দে মুড়োটা দাদা একাই হজম করতে লাগলো। আমি মাথা নিচু করে এমনভাবে খাচ্ছিলাম যেন একটা মুড়োকে কেন্দ্র করে একটু আগেই অনেক বড় হয়ে গেছি। তাই নির্লিপ্ত নীরব হয়ে পাশে খেতে থাকা দাদাকে, মনে মনে বললাম, খা দাদা খা, আজ যে তোর জন্মদিন।

  জন্মদিনের উপহার স্বরূপ দাদাকে বাবা একটা কম্পিউটার দিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে দাদা সারাদিন মেতে রইলো। কিন্তু আমার বুদ্ধি দিয়ে দাদার অনুপস্থিতিতে সেটা একটু চালিয়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎই এক বিপত্তি  হয়ে গেল। দাদা তো রেগে ফায়ার। সোজা বাবার কাছে নালিশ।  যতই হোক নতুন কম্পিউটার তো। বাবা রাতে আমাদের সবাইকে ডাকলেন। সবার সামনেই আমাকে বললেন, 'সুশান্ত তুই কখনো রমেশের জিনিসে হাত দিবি না, তাছাড়া ওটা চালাতে যথেষ্ট আইকিউ লাগে, তুই কিছুই পারিসনা।'

দিন শেষে রাত এল। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। বাবার সবশেষে বলা, 'তুই কিছুই পারিসনা' কথাটা প্রায় সর্বক্ষণ কানের কাছে চাক ভাঙা মৌমাছির মতো গুঞ্জন করতে লাগল।

ভোরের দিকে চুপি চুপি একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। তাতে দু'চারটে জামা প্যান্ট ও মায়ের দেওয়া টিফিনের জমানো কটা টাকা, ব্যাস। নিঃশব্দে যখন বেরিয়ে পড়লাম তখন ভালো করে ভোরের আলো ফোটেনি। চারদিকে মাটি-মাটি আবছা অন্ধকার। দুচারটে পাখি কিঁচির মিচির করছে। কয়েকজন মানুষজন বেরিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম স্টেশনে।

 কিছুক্ষণ পরই ট্রেন এসে গেল। ভোরের ট্রেন একটু ফাঁকাই থাকে। প্লাটফর্মে খুব বেশি যাত্রী নেই। জানলা দিয়ে সিটের উপর ব্যাগটা রাখলাম। ট্রেন ছাড়ার এখনো দেরি আছে। আমার চেয়ে ছোট  একটা ছেলে চায়ের কেটলি নিয়ে পিছনে এসে বলল, 'চা খাবেন?'

পকেটে হাত দিলাম। অল্প কটা খুচরো পয়সা আছে। বললাম, 'না'। ছেলেটা চলে গেল।

 মায়ের মুখটা ভীষণ মনে পড়লো। মনে হল মার দুচোখ বেয়ে টপটপ করে জলের ধারা নেমে আসছে। থেকে থেকেই আমার ঘরে গিয়ে আমার ব্যবহারের সমস্ত জিনিসপত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন আর আকুলভাবে পথের দিকে চেয়ে আছেন। বাবার প্রেশারের ওষুধটা মনে হয় গতকাল শেষ হয়ে গেছে। মায়ের মাথা ঘোরার ট্যাবলেটটা দুদিন পরে ফুরিয়ে যাবে। আর দাদা, ওকে উপর থেকে দেখে যতই শক্ত মনে হোক, ভেতরটা কিন্তু তালশাঁসের মত নরম। তা না হলে মেলায় গিয়ে যেবার হারিয়ে গিয়েছিলাম, ওর সেকি ফুলে ফুলে কান্না, যেন আমার থেকেও ছোট একটা বাচ্চা ছেলে।

এরই মধ্যে সশব্দে ট্রেনটা নড়ে উঠলো। আমি চমকে উঠলাম! বাইরে থেকেই চেঁচিয়ে বললাম, 'কেউ আমার ব্যাগটা  দিন!' কিন্তু নাহ, ট্রেনটা ততক্ষনে চলতে শুরু করেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন