সুনির্মল বসু
কলকাতার নামী নার্সিংহোম থেকে সকাল সকাল সুখবরটা এলো সুশোভনের কাছে। গত পরশুদিন স্ত্রী অন্তরাকে হাসপাতালে এডমিট করিয়ে এসেছিল ও। সকালে ফোন বাজতেই, সুশোভন ফোনটা তুললো, হ্যালো,
বলুন,
আপনি বাবা হয়েছেন, মিস্টার মুখার্জি। কনগ্রাচুলেশন্স,
থ্যাঙ্ক ইউ।
ফোনটা নামিয়ে রাখলো সুশোভন।
ও একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। সল্টলেকে সেক্টর ফাইভে ওর অফিস। কাছেই ওর নিজস্ব ফ্ল্যাট। ও আর অন্তরা এখানে একসঙ্গে থাকে। অন্তরাদের বাড়ি ধানবাদ। সুশোভন বিয়ের পর মাত্র তিন দিন বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিল। তারপর অফিসের দূরত্বের বাহানা দিয়ে সেক্টর ফাইভে বউকে নিয়ে চলে আসে।
সুশোভন বুদ্ধিমান ছেলে। বিয়ের আগেই এই নতুন ফ্ল্যাটটি কিনেছিল। ব্যস্ততার অজুহাত দিয়ে মা বাবার সঙ্গে সে সম্পর্ক প্রায় রাখেই না ইদানিং।
এখন সমস্যা হল, এক্ষুনি একবার নার্সিংহোমে যেতে হবে। ওর মা-বাবা থাকে নাকতলায়। ওদেরকে জানাতে হবে, সে ছেলের বাবা হয়েছে।
ওদের বিয়ে হয়েছে বছর চারেক। বাচ্ছা নিতে দেরি হল, কারণ, অন্তরার রিসার্চের কাজ চলছিল। এই মুহূর্তে একটা প্রবল ভালোলাগা সুশোভনের মধ্যে কাজ করছে।
উবের ট্যাক্সি ভাড়া করে ও নার্সিংহোম পৌঁছলো। সকালের দিক বলে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে সুশোভন অন্তরাকে দেখতে ভেতরে ঢুকলো।
ওকে দেখে অন্তরা একবার ম্লান হাসি হাসলো। সিজার করে বাচ্ছা হয়েছে। শরীরের উপর একটা বড় ধরনের ধকল গিয়েছে। ওর সন্তান মায়ের পাশে শুয়ে। ঘুমোচ্ছে।
সুশোভন বলল, তুমি ঠিক আছো তো,
হু,
বাবা মাকে জানাতে হবে।
জানাও।
বাবা আমার ব্যবহারে রেগে আছে।
মাকে বলো,
দেখছি।
সামান্য কথা বলে বাচ্ছার কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে সুশোভন ফ্ল্যাটে ফিরে এলো।
সকাল দশটা নাগাদ বিভাস বাবু আর নিনা দেবী চা খেতে বসেছিলেন। সাংসারিক খুঁটিনাটি কথাবার্তা হচ্ছিল। ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো। নিনা দেবী ফোন তুললেন, হ্যালো,
মা, আমি সুশোভন। আজ ভোররাতে তোমাদের একটা নাতি হয়েছে।
তাই নাকি, এত বিরাট খুশির খবর, আগে তো কিছু জানাস নি, আরে আমাদেরও তো কিছু দায়িত্ব থাকে।
সুশোভন কোন উত্তর দেয় না।
অবাঞ্চিত কথার মধ্যে সে যাবে না, আগে থেকেই সেদিকে প্রবল সতর্ক ও। তাছাড়া, সেন্টিমেন্টাল ভাবনা ওর জন্য নয়।
নিনা দেবী আবার বললেন, তোর বাবাকে বলছি। বিকেলে তোর ফ্ল্যাট হয়ে নার্সিংহোমে বৌমা ও বাচ্ছাকে দেখতে যাবো।
তাহলে ফোন ছাড়ছি মা,
ঠিক আছে।
বেলার দিকে বিভাসবাবুর বাড়িতে তাসের আড্ডায় এলেন সন্তোষ বাবু, ভুবন বাবুরা।
নিনাদেবী অন্যদিন চা-বিস্কুট দেন সবাইকে। আজ চায়ের সঙ্গে থালাভর্তি মিষ্টিও দিলেন।
সন্তোষ বাবু বললেন, কি ব্যাপার, মিষ্টি কেন, বিভাস দা,
বিভাস বাবু বললেন, আজ আমি দাদু হয়েছি।
ভুবন বাবু বললেন, ভেরি গুড নিউজ।
সন্তোষ বাবু বললেন, কই, আগে তো কখনো আভাস দেন নি,
বিভাস বাবু বললেন, আসলে, ছেলে বিয়ের পর বিশেষ যোগাযোগ রাখেনি।
ভুবন বাবু বললেন, অথচ বিয়ের আগে ওতো মায়ের আঁচল ধরা ছেলে ছিল।
সন্তোষ বাবু বললেন, যুগের হাওয়া, ব্রাদার।
নিনা দেবী বললেন, আপনারা মিষ্টিটা খেয়ে নিন।
অবশ্যই।
বিকেল বেলায় একটা হলুদ ট্যাক্সি ভাড়া করে বিভাস বাবু ও নিনাদেবী নাতির মুখ দেখতে গেলেন। যাবার পথে বউবাজারের একটা সম্ভ্রান্ত সোনার দোকান থেকে নাতির জন্য এক জোড়া বালা কিনে নিয়ে গেলেন। বৌমার জন্য কেনা ফলগুলো নিনা দেবী পাশের টেবিলে রাখলেন।
নাতিও ছেলের মত ফর্সা হয়েছে।
সুশোভন আজ বাবা-মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করছে। এই ব্যবহারের কতটা আন্তরিক, আর কতটা অভিনয়, সেটা বোঝবার উপায় নেই।
ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হলে, সুশোভন বাবা মার জন্য ট্যাক্সি ডাকে এবং ভাড়ার টাকা মায়ের হাতে গুঁজে দেয়।
রাতে বাড়ি ফিরে বিভাস বাবু স্ত্রীকে বলছিলেন, ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে কি না করেছি, ওকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন ছিল।
নিনা দেবী বললেন, আসলে কি জানো, আমাদের শিক্ষার মধ্যে গলদ ছিল।
কেন,
মনে আছে, বিয়ের পর তুমি মা বাবা ভাই বোন ছেড়ে চলে এসেছিলে,
নইলে আমাকে রাবণের গুষ্টি টানতে হতো,
তা ঠিক।
অথচ, আমার মা-বাবা ভাই-বোনের জন্য তুমি কি না করেছো,
সুশোভন পড়াশোনায় বরাবর ভালো। ও যদি বিয়ের আগে বর্ণালী নামের মেয়েটির কাছে ল্যাং না খেতো, তাহলে এমন হয়তো হতো না।
মানে,
অন্তরাকে পেয়ে ও এমন বউ ভক্ত হয়ে গেছে।
তুমিও কিন্তু এর জন্য দায়ী,
কেন,
ওর ফ্ল্যাট দেখে এসে তুমি বলেছিলে, ওর ফ্ল্যাটের ছাদ ব্রড স্ট্রিটে বড়দির কোটি টাকার বাড়ির চেয়ে বড়।
হ্যাঁ, বলেছিলাম।
যতসব বোকা কথা বার্তা,
হ্যাঁ, মানছি। তবে ছেলে তোমার মেয়ে দেখলে এমন হয়ে যাবে, সে কথা তো স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি।
বিভাস বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ওকে আমরা ইঞ্জিনিয়ার বানাতে পেরেছিলাম, মানুষ বানাতে পারিনি।
সেটা ঠিক কথা, আর আত্মীয়-স্বজনেরা সেই সব দিনে কেবল হাওয়া দিয়ে গেছে।
এরপর একদিন সুশোভন আর অন্তরা ওদের একমাত্র ছেলে তাতাই কে নিয়ে নাকতলার বাড়িতে একদিন এলো। বিভাস বাবু এবং নিনাদেবী একটু অবাকই হলেন। আবার ভালোও লাগলো।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সুশোভন মাকে বলল,
এই বাড়িটার অনেক বছর বয়স হয়ে গেছে। এই বাড়িটাকে বিক্রি করে তুমি আর বাবা আমাদের ফ্ল্যাটে চলে এসো।
নিনা দেবী চমকে উঠলেন, বললেন, কেন বাবা, কত দিনের স্মৃতি এই বাড়ি।
অন্তরা বলল, তাতাই বড় হচ্ছে। আপনারা থাকলে, ওকে মানুষ করতে সুবিধা হবে।
মাসখানেক বাদে এক প্রোমোটারের কাছে নাকতলার বাড়িটা বিক্রি করা হলো। টাকা পয়সা সুশোভন এর নামে ব্যাংকে রাখা হলো।
আজ তাতাইয়ের শুভ জন্মদিন। আজ ও পাঁচ বছর বয়স পূর্ণ করল। ওর জন্মদিনে বাড়িতে আজ অনেকে নিমন্ত্রিত।
আগে থেকে অর্ডার দেওয়া ছিল, সকালে নতুন ডাইনিং টেবিলের সঙ্গে তিনটে চেয়ার এসেছে।
রাতে অতিথিদের জন্য খাবার অর্ডার করা হয়েছে।
ক্লাব হাউসে সন্ধ্যেবেলায় অনুষ্ঠান।
দুপুরে খেতে এসে তাতাই প্রশ্ন করল, তিনটে চেয়ার কেন,
অন্তরা বলল, আমাদের তিনজনের।
দাদু ঠাকুমা কি সিঁড়ির তলায় খাবে,
অন্তরা ছেলের প্রশ্ন শুনে চুপ করে থাকে।
সুশোভন বলে, কি হয়েছে বেটা,
তাতাই বলে, বলছি, আমি যখন বিয়ে করবো, তখন তুমি আর মা কি সিঁড়ির তলায় থাকবে,
মাথায় হাত পড়ে যায় সুশোভনের।
ও ভাবতে থাকে, সেই যেদিন ও বাবা হয়েছিল, সেদিন ওদের আনন্দ ছিল সীমাহীন। এই মুহূর্তে
তাতাইয়ের প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ও। সুশোভন অনুভব করে, বাবা হওয়ার চেয়ে বাবা হওয়ার দায় রক্ষা করা, আরও কত কঠিন কাজ।
সুশোভন ফার্নিচার কোম্পানির মালিক রমেন মল্লিককে ফোন করে, বলে, কাল সকালে আরো দুটো চেয়ার ভেরি আর্জেন্টলি পাঠিয়ে দেবেন।
তারপর অন্তরাকে বলে, তাতাই আজ আমাদের গালে থাপ্পড় মেরে শিখিয়ে দিয়েছে, বাবা হওয়া কাকে বলে।