দোঁহা

অমর্ত্য দত্তের গুচ্ছ কবিতা

 


আমি, কুসুম ও ক‌বিতা

(এক)

তোমার উচ্ছ্বাস নিয়ে আজ অব‌ধি এক‌টিও ক‌বিতা লি‌খতে পা‌রি‌নি আ‌মি।
বহুবছর সমুদ্রে যাওয়া হয়‌নি আম‌াদের।

সাইকেলের‌ বেলের মতো মাঝে মাঝে সুখ বেজে ওঠে আমাদের ‌ধাতব শরীরে।
এত ভিড়! এত ‌আবর্ণ! এত স্থিরতা! এত দৃ‌ষ্টিহীন...
রোজ সকালে বাজার যেতে ভালোলাগে না আমার।
ভালোলাগে না হাহাকার। দুঃস্বপ্ন। ব্যর্থতা। বন্ধ্যাত্ব...

আমি এই প‌রি‌স্থি‌তি পাল্টে দিতে চাইছি, কুসু‌ম।

কিন্ত‌ু, তু‌মি আমার ক‌বিতার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে ব‌লছো;
-রঙ নেই। খুশবু নেই। ছন্দ নেই। টান নেই। আশ্রয় নেই।  
শুধু বা‌লি। বালিয়া‌ড়ি...

‌বিশ্বাস করো, আমি তোমার মধ্যে থেকে সূর্য ওঠা দেখতে চেয়ে‌ছিলাম।


(দুই)

এসো, দরজায় কড়া নাড়ার আগে ভুলে যাই-শিশু চিত্রল‌টির মৃত্যুদৃশ্য, মুখোশের ইতিহাস ও দাঁতের ওজন।

এসো, আয়না ভাঙার শব্দের মধ্যে লু‌কিয়ে রাখি পৃ‌থিবীর অকীক রঙের অসুখ। হায়নার জিভ। প্রজাপ‌তিদের কান্না।

বড় শহরের সরু গ‌লিতে ভুল করে ঢুকে প‌রা বাবুদের জু‌ড়ি গা‌ড়িটি‌কে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিই বসন্ত্-বাহার অব‌ধি।

কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া ঘ‌ড়ির ডায়ালের ওপর ‌লি‌খি আমাদের সম্ভাব্য প্রয়োজনীয়তা, স্বপ্ন ও ঈশ্বর
আর আমরা হাসতে হাসতে ঢুকে প‌ড়ি কষ্টের গর্তে।
ওহ্ রা‌ত্রি...
এসো শুশ্রূষা।
এসো কুসুম, এসো আনন্দময়ী ক‌বিতার মতো।


(তিন)

আকাঙ্খা। নির্মোচন। প্রবণতা ও বন্ধন লেখার পরে ঘুম আসে।
তারপর পৃ‌থিবী নিশ্চুপ...তু‌মি মুখ ঘু‌রিয়ে নাও সুগন্ধের দিকে।
‌কোনো এক ‌দৈববলে ক‌বিতার হা‌ত-প‌ায়ের বাঁধন খুলে যায়।
বৃ‌ষ্টির তু‌লি দিয়ে শহরের ছ‌বি আঁকে যুবক চিত্রকর।
অন্ধকার ঘর, সিঁ‌ড়ি, সদর পে‌রিয়ে ক‌বিতা রাস্তায় নামে।

তু‌মি আমাকে ডাকো...আ‌মি বাগানের দিকে এগিয়ে যাই।
স্বপ্নের মধ্যে ইমনকল্যাণ...আলাপের কাছে এসে দেখি-শ্বেতপাথর বে‌দির ওপর  নিখিল ব্যানা‌র্জি বসে আছেন, তাঁর হাতে ধরা সবুজ আলোর সেতার। সারা শরীর জুড়ে সংসা‌র। ‌বিমুগ্ধতা। লাবণ্য। সহবাস...
আর ঘাসের ওপরে আমরা তিনজন-তোমার এক কাঁধে মাথা রেখে বসে আছি আমি, অন্য কাঁধে ক‌বিতা।
কুসু‌ম বলো, এমন মেহ‌ফিল ছেড়ে উঠে আসা যায়?

(চার)

হুবহু স্বপ্নের মতো এক‌টি ক‌বিতার মধ্যে ঢুকে পড়ে‌ছি আমরা।
অচেনা পাহা‌ড়ি জনপদ। পথের দু‌'ধারে আপেল বাগান।
যত সামনের দিকে এগো‌চ্ছি প্র‌তি‌টি পদক্ষেপের সাথে আমাদের জীবন থেকে মুছে যাচ্ছে সীসার দাগ, ডেট‌ল-গন্ধ, দেওয়ালের চিৎকার
আর ঘাম হচ্ছে না আমাদের।

দেবদারু গাছের সা‌রি পে‌ড়িয়ে বেগুনী নদীর তীরে নেমে যা‌চ্ছি ঘোড়াদের জল খাওয়া দে‌খতে।
তু‌মি অরণ্য রঙের গান গাইছো। নদীর ঢেউ লেগে লেগে ধুয়ে যাচ্ছে এতকাল ধরে ময়লা জমে থাকা চোখের পাতা।
বহুদূর থেকে ভেসে আসছে কাঠকুড়ানিদের সংসা‌র-শব্দ আর মনে‌ষ্ট্রির গং।

পা‌খিদের ডাকের ওপর‌ দিয়ে ছুটতে চাই‌ছি আমরা দু'জনেই।
কনকচুর মা‌খিয়ে দিতে চাই‌ছি পরস্পরের গায়।
এই দ্যাখো, সমস্ত ইচ্ছেই কেমন মিলে যাচ্ছে আমাদের আজ।
এই দ্যাখো, কুয়াশায় কেমন অদৃশ্য হয়ে গ্যাছে ‌ফেরবার রাস্তা।

হুবহু ক‌বিতার মতো এক‌টি স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ে‌ছি আমরা।

আর একটু পথ হাঁ‌টতে হবে কুসুম। আর একটু পথ...
ওই তো...
ওই সাঁকো‌টি পার করলেই আমাদের ডানা হবে।


(পাঁচ)

সা‌ন্নিধ্যের ক‌বিতাকে শ্রাব‌ণ-ছন্দ ‌দিতে হয় অথবা বসন্ত রঙের শব্দ।
এই সব না পারার জন্যে আজও আমার ‌পাহাড়ি নদীর শৃঙ্গার দেখা হলো না।
‌দেখা হলো না রডডেনড্রনের যৌন আবেদন।

অথচ, কুসুম তোমার ক‌বিতার প্রথম পং‌ক্তিতেই এত মেঘ।
‌দ্বিতীয় ও তৃতীয় লাইনের ম‌ধ্যিখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঋষিখোলা।
তুমি কমলা রঙের শা‌ড়ি পরে কাঠের সাঁকোর ওপর দাঁ‌ড়িয়ে আছো।
সারা ক‌বিতায় অঝোর বৃ‌ষ্টি...
সারা উপত্যকায় ডেন্ড্রো‌বিয়‌ামের সুগন্ধ...
সারা ক‌বিতায় আনন্দলহরী...

ষষ্ঠ পং‌ক্তি থেকে তোমার স্নানের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে চার বছরের লেপচা বালক‌টি।
‌দেখো, ও বড় হয়ে ক‌বি হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন