আত্রেয়ী চক্রবর্তী
আগের দিন রাতে গুছিয়ে রাখা হয়েছে ফিতে, পুতুলের জামা, নাকের নোলক। টিনের বাক্স উপচে পড়ছে কার্তুজগন্ধে। সীমানা পেরিয়ে যাবে সকাল, কলোনি থেকে কলোনি, ইতস্তত গাঁ-উজাড় কিশোরীরা। অথচ, প্রাচীন যুবকটিকে দেখিনি ভেবে, এইমাত্র বুকের ভিতর হুইসেল বাজিয়ে গেল ঠা-ঠা দুপুর, কোমলসারেঙ্গী, দু'টো দশের ঘাটশিলা লোকাল!
হাজামজা পুকুরের পাশে, ভেঙে পড়া দেওয়ালকে যৌথ পরিবার ভেবে এসেছি —বলেছিলে, এসব রোদ একদিন আমাদের হবে! আজ্ঞাচক্র হে, একপেট খিদে নিয়ে নারীজন্ম শিখছি তোমাদের রাঢ়ীয় স্টেশনে বসে। ভেসে যাচ্ছে ঋতুমন, দলাওঠা রক্তের তেজ, ভোরবাতাসে বিছানো খেজুররস। ইছামতীর কাঁচাপানি, ভেসে যাচ্ছে তাও। বেহেড কাঙালপনা, চিস্যা নারীমুখ মাঝে ব্যাথা জাগে, ব্যাথা খায়। জেগে থাকে ক্যাম্পের পোকাধরা চাল, গম, স্মৃতির জখমি দোক্তাপাতা। কাঁটাতারে গেঁথে যায় সেমিজের এ-ফোঁড় ও-ফোঁড়, কচি-স্তন। কবেকার ইশকুল পালানো বিবিসেলাইয়ে ঢুকে পড়ে হেমলতা, মণিপিসি, ফরিদপুরের রেহানা খাতুন। ছোপানো জ্বর, আবাদি ফসল, ব্ল্যাকে তোলা ঘামের ভিতর নিজেকে দেখি। মোটাসুতো, হাতেবোনা শাড়ির ফাঁক দিয়ে ভেসে আসে নারায়ণগঞ্জ। ''ও খুঠুন, ভাত খাবা না?"
ঠাম্মার জর্দাগন্ধ, ডালিম-নথ ছাপিয়ে মুজিবর কাকার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। "হেঁদুর মাইয়াডারে ভালবাসি। ফ্যালাই দিমু ক্যামনে?"...
সারা ঘরজুড়ে আলো, আলোর রোশনাই, নহবতে বাজে সালঙ্কারা সুর। ফকিরচাঁদ পেয়েছেন নব্যমুকুরমালা। "অ-ফকির, বাপ আমার সাইরেন বাজল বুঝি!" —এ-ডাকে আকাশ গুমরোয়। পড়ে থাকে থালা, গেলাস, গ্রামকে গ্রাম উপাধি প্রদান।
আমাদেরও দ্যাশ আছিল। দুগ্গাদালান, চণ্ডীমণ্ডপ, ঠাকরাইনের পালকিবাহকদের 'যথাজ্ঞা মা' ডাক। সন্তানদের মঙ্গলকামনায় ষষ্ঠী থেকে নিরমিশি। সপ্তমীর ভোর-ভোর, সূর্য ওঠার আগেই টুকি ফল দিয়ে পনেরোটা ফোঁটার আসর দরজার গোড়ায়, মায়ের থানে। রক্তচন্দন, গিরিমাটি, সিঁদুর, হলুদ আর দই। "দুর্গা দেবীং ইহ আগচ্ছ শুভয়াভবতু…"
এবার পিঁড়ি পেতে বসাও ছেমড়িকে। শ্মশান নিবাসী জামাইয়ের রোজগার নেই কিনা! গায়ে গত্তি লাগবে ক্যামনে! উপরন্তু, এতগুলান কাঁটাতারের ধকল। তাই, ঘরের যৎসামান্য আয়োজনে লুচি, সুজি, শাকভাজা, আলুভাজা, চচ্চড়ি, চিঁড়ে, মুড়ি, খই, নাড়ু, মিষ্টি। সারা পাড়া এসে "অ পাব্বতী, মুখখানা দ্যাহা দেহি…"
পাব্বতীর গলায় শুধু গাঁদার মালা। এ-বাড়ি, ও-বাড়ি ঘুরে গাছের ফুল৷ পরনে আলতাপেড়ে বা ছাপাশাড়ি। আড়ম্বরহীন সাজ, কিন্তু ভক্তি নিষ্ঠা, ভালোবাসা শতগুণ! দশমী আইলে, যাত্রামঙ্গল আওড়ায় ব্যোমকেশ ঠাকুর। "গচ্ছ গচ্ছ দেবী নিজালয়ে" —মেয়ের পা-দু'খানি ধরে হাউহাউ কান্না।
ইছামতী, তুমি বড় নিঠুর হে! দুইখান নৌকায় বসিয়েছ একচালা। আর সীমানা নাই। জড়ো হচ্ছে দুই বাংলার দুর্গা। মা, জেঠিমার গালে সিঁদুর। আবার আসিস মেয়ে — এ কান্নায় ডুবে যায় দেশ, কাঁটাতার, সীমান্ত পাড়ি দেওয়া লাবণ্যপ্রভা। আসন্ন মাঘীমাস, গানপুজো, নীলকণ্ঠ-নীলকণ্ঠ ডানা বুকে পার্বতী চললেন নিজগৃহে…
ভেসে যায় পুথি, এস্রাজ, তামায় মোড়ানো তবলা। গাঙে এসে ঠেকে জোড়া চণ্ডীমণ্ডপ, চন্দনকাঠ। আমি কি নিজেরে চিনি এই রাঢ়-ধুলোয়? কে যেন ফেলে গেছে আখরবাটে, দ্যাশ, দ্যাশভাগ। কলাবেণীর তিলোত্তমা, সুবর্ণলতা, হারিয়ে যাওয়া যাত্রামঙ্গল গান…
