দোঁহা

‘অব্যক্ত উচ্চারণের উদযাপন’, জন ফসে’র নোবেল ও অবচেতন

 

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়


'অব্যক্ত উচ্চারণের উদযাপন', এই অনুবাদ একান্ত ভাবেই আমার মস্তিষ্কপ্রসূত। হয়তো বা তাতেও আসল বক্তব্যটি ‘অব্যক্ত’ থেকে গেল।

সরকারি ভাবে নোবেল কমিটি তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে “for his innovative plays and prose which give voice to the unsayable”… ঠিক এই কারণেই ২০২৩ এর নোবেল সাহিত্য পুরষ্কারে সম্মানিত হলেন নরওয়ের সাহিত্যিক জন ফসে। বিনীত ভাবে স্বীকার করব সাহিত্যিকের সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় শূন্য। বরং প্রতিবারেই এমন পুরষ্কার ঘোষণার পরবর্তী সময়ে আমি শিক্ষানবিশ হিসেবে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে চেষ্টা করি। কিঞ্চিৎ পড়াশোনার প্রয়াসে একটু একটু করে যখন বিশ্বসাহিত্যের দরবারে উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করি, ঝোঁক বাড়ে কলমের আয়নাতে পৃথিবীর চালচিত্রটাকে প্রতিফলিত হতে দেখার, ততই সর্বাগ্রে অনুভব করি বিশ্বসাহিত্যের বিরাট বিস্তৃতির ভিতর কোথাও যেন অনেক গভীরতায় মূল একটি ঐক্যের সুর সদাপ্রবাহিত, সদা বিরাজমান। সেই শব্দকে কান পেতে শুনতে হয়। সেই শব্দ বড় নিবিড়, বড় একান্ত আর একই সঙ্গে বড় স্তব্ধ। সকল সময়ে তার হদিস মেলে না।

এই আলোচনার উদ্দেশ্য সাহিত্য নাকি পুরষ্কার, সঠিক করে বলতে আমি অপারগ। বরং বলতে পারি, হয়তো বা কলমের যাতায়াত চলবে এই দুই প্রান্তবিন্দুতেই। কারণ, নিশ্চিত ভাবে মনে করি সাহিত্যের বিচার কখনই তার পুরষ্কারের মাপকাঠিতে নয়। যেমন ভাবে একবারের জন্য নোবেল-ভূষিত না হয়েও, মেধার আকাশে তবু উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের একজন হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং, অথবা শান্তি-আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক হিসেবে চির-ভাস্বর হয়ে বিরাজিত রয়েছেন মহাত্মা মোহনদাস, তেমনই সাহিত্যের অঙ্গনেও এমন অনেক উদাহরণ, বিতর্ক ও পালটা যুক্তি, বিশ্লেষণের প্রসঙ্গ রয়েছে। আমরা বরং উন্মুক্ত পরিসরে সাহিত্য, নোবেল ও তার পরবর্তীতে উদ্ভূত (অথবা মনোমধ্যে বিশ্লেষিত) কিছু আলোচনা, প্রতিক্রিয়া, চিন্তার বিবিধ বিন্দুকে নিয়েই নিজেদের অবচেতনকে প্রশস্ত করতে চেষ্টা করি।

'অব্যক্ত উচ্চারণের উদযাপন', ও অবচেতন-ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় জন ফসে’র সাহিত্য অথবা সাম্প্রতিক একাধিক নোবেল-বিজয়ী সাহিত্যিক যাঁরা, তাঁদের সাহিত্যের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যকে যদি উল্টিয়ে দেখা যায়, তাহলে সেই সমস্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে দেখা যাবে ‘minimalist’ অথবা ‘বক্তব্যের স্বল্পীকরণ’ এর এক বিশেষ ভাবনা বা পরিকল্পনাই আর সবকিছুকে ছাড়িয়ে সেখানে প্রতিভাত হয়ে উঠতে পেরেছে। ‘বক্তব্যের স্বল্পীকরণ’ অথবা ‘minimalist’ ভাবনার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিকে যদি সহজ কোনও উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে আমি সাহিত্যের প্রধান অঙ্গন থেকে প্রথম পরিচয়ে সামান্য একটু সরে আসতে চাইব। চলচ্চিত্র-পিপাসু পাঠক যাঁরা, তাঁরা অনেকেই হয়তো ইরানের চলচ্চিত্র পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি অথবা তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র জাফর পানাহির কোনও না কোনও কাজের সঙ্গে পরিচিত। কিয়ারোস্তামির একাধিক স্বল্প দৈর্ঘ্যের সৃষ্টিকে আপনারা ইউটিউব মাধ্যমে এখন অনায়াসে দেখে ফেলতে পারেন। শিল্পীর পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিগুলির চেয়ে আমার এই ছবিগুলির কথাই বিশেষ করে মনে হল কারণ, ‘বক্তব্যের স্বল্পীকরণ’ অথবা ‘minimalist’ ভাবনার সবচেয়ে উপযোগী উদাহরণ হিসেবে এগুলিকেই বোধহয় সর্বাগ্রে পেশ করা চলে। যেমন ধরা যাক ছোট ছবি ‘হমসরায়াঁ’ অথবা ইংরেজিতে ‘The Chorus’, কিয়ারোস্তামির এই কাজটিতে কানে খাটো এক বৃদ্ধের জীবন নানান শব্দের মাধ্যমে তুলে আনা হয়েছে। ছবিটির বিশদ বর্ণনায় যাব না। কেবল বলব খুবই সামান্য কোনও ঘটনা, রোজকার দুপুর এবং তারই সঙ্গে রোজকার জীবনে বয়ে চলা একেকটি শব্দের ব্যবহার, তার চেয়েও ক্ষুদ্র পরিসরে আদতে বাইরেকার এক বৃহত্তর বিস্তৃতির অস্তিত্ব, এমন এক বিপ্রতীপ ধারণাকেই ছবিটি আশ্চর্য এক স্বল্পতায় তুলে ধরতে চেষ্টা করে। সেই বিস্তৃতি সময়ের তো বটেই, জীবনের, প্রজন্মের, এমনকি মানসিক উপলব্ধিরও বোধহয়। একই ধরণের ছবি ‘সিগালের ডিমগুলি’ বা ‘Seagull Eggs’, অথবা ‘রাস্তা’, ইংরেজিতে ‘Roads’, সবকটিই কিয়ারোস্তামির অবদান। এগুলি থেকেই আমার অন্তত প্রথম ‘minimalist’ অথবা ‘বক্তব্যের স্বল্পীকরণ’এর যে বিশেষ শিল্পগত ধারণা, তার পাঠ নেওয়া শুরু। সাহিত্যে এর উদাহরণ আমি এর পরবর্তীতে লক্ষ্য করেছি।

২০১৮ সালে সাহিত্যের নোবেলে ভূষিত হন পোলিশ লেখিকা ওলগা তোকার্চুক। তাঁর উপন্যাস ‘উড়াল’ অথবা ‘Flights’, সেই বছরেরই ম্যান বুকার পুরষ্কারে ভূষিত হয়। বইটিকে যখন পড়তে শুরু করেছিলাম, একদিকে বিরাট পরিসরের উপন্যাস বলে মনে হলেও, ক্রমশই উপলব্ধি করেছিলাম আবারও সেই ‘বক্তব্যের স্বল্পীকরণ’। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে একবিংশ শতাব্দী অবধি সেই উপন্যাসের প্রেক্ষিত বিস্তৃত হলেও, আদতে তা বিভিন্ন আকারের বিভিন্ন খণ্ডের ‘উড়াল’ বা যাত্রার সমাহার। যে একেকটি যাত্রাতে যাত্রীরাও নিজেদেরকে হারিয়ে ফেলে সময় অথবা স্থানগত প্রেক্ষিতে। এক মাত্রা থেকে আরেক মাত্রায় তাদের অভিজ্ঞতার ‘উড়াল’ সাহিত্যিকের কলমে বর্ণিত হয়। একটি, দুটি অথবা তিনটি নয়, এমন ১১৬টি খণ্ডিত ‘উড়াল’এর বর্ণনায় সাহিত্যের অঙ্গনে খণ্ডিত উপন্যাসের এক নতুনতর ধারণাকে সাহিত্যিক উন্মোচিত করেন। এই ১১৬টি বর্ণনায়, স্থান, কাল, চরিত্র যেমন ভাবে পাল্টেছে…এই কথাকে বলতে বলতেই আমার আবারও মনে পড়ছে ‘নোম্যাডল্যাণ্ড’এর উদযাপন। সাহিত্য থেকে আবারও চলচ্চিত্রের পরিসরে ফিরে যাওয়া। ২০২০ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি ২০২১এর অস্কার প্রতিযোগিতায় সেরা ছবি, সেরা পরিচালক-সহ মোট তিনটি পুরষ্কারে সম্মানিত হয়। সেখানেও এক যাত্রার বর্ণনা রয়েছে। তফাত কেবল সেখানে একজনই যাত্রী। এক মহাদেশেরই নির্দিষ্ট এক সময়কালের গণ্ডিতে, তাঁর সেই যাত্রাপথ। কিছুটা হলেও যা পূর্ব-নির্ধারিত। তবুও সেই যাত্রার ব্যঞ্জনায় উঠে আসে এক বৃত্ত-ধর্মী পরিণতির উদযাপন। এক বছরের পর যাত্রা ক্রমশ ফিরে আসে আরেক বছরের পূর্ণতায়। অথবা অবশেষ-বিন্দুতে এসে দাঁড়ায়। বৃত্তের কোনও শুরু বা শেষ নেই। বৃত্তের কোনও একটি বিন্দুকে সূচক অথবা অন্তিম বলে নির্দিষ্ট করা চলে না। ‘নোম্যাডল্যাণ্ড’ সেই বক্তব্যকেই তুলে ধরে, আবারও এক আশ্চর্য ‘স্বল্পীকরণ’এরই স্বচ্ছতায়। একই বৈশিষ্ট্য উঠে আসে ২০২২ সালের বুকার পুরষ্কারে সম্মানিত হিন্দিভাষী বিশ্বখ্যাত গদ্যকার গীতাঞ্জলি শ্রী’এর উপন্যাস ‘রেত সমাধি’ অথবা ‘Tomb of Sand’এর বর্ণনায়। কিছুভাবে কি সেই একই বৈশিষ্ট্যকে আমরা খুঁজতে চেষ্টা করি ও’ হেনরি পুরষ্কারে সম্মানিত অমর মিত্রের গল্প সংকলন ‘গাঁওবুড়া ও অন্যান্য গল্প’এর একেকটি চিত্রণেও? ‘স্বল্পীকরণ’এর বৈশিষ্ট্য বোধহয় কামু, সার্ত্র, অথবা কাফকা’র গদ্যকে ছাড়িয়ে বহুদিন ধরেই বিশ্বজনীন হয়ে পড়তে পেরেছে।

ফসে’র গদ্যকে বিশেষজ্ঞেরা ‘ধীরগদ্য’ বা ‘slow prose’এর অভিধাতে ভূষিত করেছেন। তাঁর লেখাতেও বিশেষ ভাবে উঠে এসেছে ‘স্বল্পীকরণ’এর বৈশিষ্ট্য, ইবসেন অথবা দেরিদা’র সৃষ্টির সঙ্গে যা তুলনীয় বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু যে আরেকটি বিষয় আমাদের নজর কেড়েছে, বিগত বেশ কিছু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, (এবং বোধহয় দীর্ঘ ইতিহাসেও) নোবেল প্রাপকেরা তাঁদের মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রেই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। ফসে’র ক্ষেত্রে এই ভাষার বিষয়টি আরও এক ব্যঞ্জনা পেতে পেরেছে, তার কারণ নরওয়ের সাহিত্যিক হলেও সেদেশের সরকারি ভাষা হিসেবে বহুলপ্রচারিত বোকমাল বর্ণমালাকে ফসে তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেননি। তিনি এর বিপরীতে বেছে নিয়েছেন আরেক সরকারি ভাষা ‘নিনর্স্ক’কে, যে বিশেষ ভাষা অথবা বর্ণমালাটিকে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনে নরওয়ের মোট জনসংখ্যার ১০% এর চেয়েও কম মানুষ ব্যবহার করেন। ঠিক একারণেই নোবেলপ্রাপ্তির পর প্রথম প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে ফসে জানান, এই স্বীকৃতিকে আদতে লুপ্তপ্রায় ভাষাদের স্বীকৃতি হিসেবেই তিনি দেখতে চান। ‘ধীরগদ্য’, অবচেতন ও তারই সঙ্গে এক লুপ্তপ্রায় ভাষা-সংস্কৃতির মাধ্যমে 'অব্যক্ত উচ্চারণের উদযাপন';' ২৩-এর সাহিত্য-নোবেল এই কারণগুলিতেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এবারে আসা যাক সামান্য অনুযোগের প্রসঙ্গে। অন্য অনেকেরই মতো আমিও আশা করেছিলাম, এইবারে অন্তত নোবেল মঞ্চে বেছে নেওয়া হবে সলমন রুশদিকে। কেবল ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলেই নয় (আমাদের দেশ, তথা বাংলা সাহিত্যের একাংশের ক্ষেত্রে, যৌনতা, পরকীয়া এবং ‘নস্টালজিয়া’কে নিয়ে যে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি চলে, আমি তার ঘোরতর বিরোধিতা করি), সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বকীয়তা ও সামাজিক সাহসিকতার যে দুরন্ত মেলবন্ধন রুশদি দেখিয়েছেন, তারই স্বীকৃতি হিসেবে নোবেল বোধহয় অনেক দিন ধরেই তাঁর জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু নোবেলের বিষয়টিকে দেখলে, সাহিত্যেরই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনও নির্দিষ্ট, বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা উপাদানকেই যদি সেই পুরষ্কার ঘোষণার ক্ষেত্রে একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করা হয়, তাহলে কিন্তু সলমন রুশদির পাশাপাশি হারুকি মুরাকামি, মার্গারেট এ্যাটউড, স্টিফেন কিং অথবা অন্যান্য আরও অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিককে নিয়েই এই সময়ে বিতর্ক তোলা চলে। মিলান কুন্দেরার মতো বহুল আলোচিত সাহিত্যিক নোবেল সম্মানে সম্মানিত হননি। পাঁচবারের জন্য নোবেল-মনোনীত হয়েও ম্যাক্সিম গোর্কিকে নোবেল দেওয়া যায়নি। জীবনানন্দ দাশ একবারের জন্যেও নোবেল মনোনয়ন না পেলেও, বাংলা থেকে আমার মত অনুসারে তুলনাত্মক বিচারে অনেক পিছিয়ে থাকা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল মনোনয়নে জায়গা পেয়েছিলেন। আসলে বোধহয়, বিশেষ একেকটি পুরষ্কারের নিরিখেই কেবল সাহিত্যের জাত বিচার অসম্ভব। নিঃসন্দেহে নোবেল থেকে শুরু করে এমন সমস্ত পুরষ্কারের ক্ষেত্রেই রাজনীতির জটিলতর বিন্যাস অনেক সময়েই নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তারও মধ্যে রাজনীতির রসে জারানো সিদ্ধান্ত হলেও সাহিত্য কি সবসময়েই পিছনের সারিতে গিয়ে দাঁড়ায়? এমনটা নিশ্চয়ই বলা সাজে না কারোর।

আলেকজাণ্ডার সলঝেনিৎসিন অথবা বরিস পাস্তেরনাক সোভিয়েত বিরোধিতার প্রশ্নেই সাহিত্যের নোবেলে সম্মানিত হয়েছেন, একথা বোধহয় কেউই মানতে অস্বীকার করবেন না। কিন্তু গোর্কির নোবেল না পাওয়া, অথবা ‘ডক্টর ঝিভাগো’র নোবেল সম্মান-দুই প্রজন্মের দুই সাহিত্যিক অথবা তাঁদের নিজস্ব সাহিত্যের যে স্বকীয়তা – সেই বিষয়ে কি সত্যি করেই এই পুরষ্কার পাওয়া অথবা না পাওয়ার নিরিখে, কোনও চুলচেরা বিপ্রতীপ বিশ্লেষণ সম্ভব? সলঝেনিৎসিন, পাস্তেরনাক অথবা মিখায়েল শোলোকভের সাহিত্য, সত্যিই কি তাঁদের নোবেল-প্রাপ্তির কারণেই স্মরণীয় কেবল? বামপন্থী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, অথবা দক্ষিণপন্থার প্রতি সহানুভূতিশীল নরওয়েরই আরেক নোবেল-জয়ী সাহিত্যিক ন্যুট হামসুন, মতাদর্শের নিরিখে একেবারে বিপ্রতীপের বাসিন্দা হলেও, সাহিত্যের প্রশ্নে তাঁদের স্বীকৃতি কি সত্যিই বিতর্কের বিষয়? শ্বেতলানা এ্যালেক্সেইভিচের সাংবাদিকতা-ধর্মী সাহিত্য বাম-বিরোধী বলেই কি কেবল নোবেলপ্রাপ্তির পথে সেগুলি তাঁর সহায়ক হয়ে উঠেছে? ২০১৯-এর পিটার হাণ্ডকে’র সার্বিয়া-বিষয়ক মন্তব্যগুলি বহুল সমালোচিত হলেও, তাঁর সাহিত্য কি একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো বিষয়? এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণাঙ্গ সাহিত্যিকদের মধ্যে ল্যাংস্টন হিউজ অথবা মায়া এ্যাঞ্জেল্যু’র মতো একেকজন, কখনই নোবেল-মঞ্চে সম্মানিত হতে পারেননি। অন্যদিকে আব্দুর রজ্জাক গুর্নাহ বুকার পুরষ্কারে সম্মানিত না হয়েও নোবেল-প্রাপকদের অলিন্দে জায়গা করে নিয়েছেন।

বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মধ্যে নোবেল না পাওয়া মানুষদেরই যদি তালিকা দেখতে হয়, সেই ক্ষেত্রেও চোখ কপালে উঠতে চাইবে। ১৯০৪ সাল অবধি বেঁচে ছিলেন আন্তন চেখভ। নোবেল তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি। হোর্হে ল্যুই বোর্গেস, গ্রাহাম গ্রিন, জর্জ অরওয়েল, ফ্রানজ কাফকা, ডি এইচ লরেন্স, আর্থার মিলার অথবা হেনরিক ইবসেন, নোবেল জয়ীদের সোনার তালিকায় এঁরা জায়গা করে নিতে পারেননি। নোবেল পেয়েছেন হ্যারল্ড পিন্টার, ওরহান পামুক। কিন্তু এখনও অবধি নোবেল অধরাই থেকে গিয়েছে সলমনের। এর পিছনে কি তাহলে বৃহৎ পাশ্চাত্যেরই কোনও subtle তোষণ-তত্ত্ব আড়ালে কাজ করে চলেছে? সে সব বিতর্ক বরং অন্য কোনও পরিসরে আলোচিত হোক। আসল বক্তব্য হল, সাহিত্য অথবা সাহিত্যিককে উদযাপনের প্রশ্নে কোনও পুরষ্কারের প্রয়োজন পড়ে না। আরেকটি কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলেই নয়।

এক বরিষ্ঠ ও বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিকের তরফে লেখা নোবেল পুরষ্কার বিষয়ক এক সাম্প্রতিক নিবন্ধে দেখলাম, কেবল যে রুশদির নোবেল-অপ্রাপ্তি নিয়েই সেই নিবন্ধে হা হুতাশ করা হয়েছে তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের একশো বছর পর আবারও কোনও ভারতীয়ের নোবেল-হাতছাড়া, এই ধরণের আলগা বক্তব্যই তাতে প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। তারই সঙ্গে এসেছে রুশদির সাহিত্যে যৌনতার প্রসঙ্গ, তাঁর বিবাহ-বিচ্ছিন্না স্ত্রী কিভাবে রুশদির সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছেন, সেই বক্তব্য। এক জায়গাতে দেখলাম তিনি লিখেছেন, যতই দিন যাচ্ছে রুশদির সাহিত্য নাকি ততই ‘জটিল থেকে জটিলতর হয়ে’ আরও ‘সুন্দর’ হয়ে উঠছে। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ‘Midnights Children’ (১৯৮১), ‘Two Years, Eight Months and Twenty Eight Nights’ (২০১৫) এবং ‘Victory City’ (২০২৩), এই তিনটি উপন্যাসকেই যদি বিশেষ করে তিনটি দীর্ঘ সময়কালের নিরিখে বিশ্লেষণ করা হয়, আমার পাঠ-অভিজ্ঞতা অনুসারে রুশদির যে বিবর্তন, বিশিষ্ট সাহিত্যিকের সেই আগের বক্তব্যের বিপ্রতীপে তা একেবারেই উল্টো বলে মনে হয়েছে। যতই সময় এগিয়েছে রুশদি যেন আরও সুন্দর হয়েছেন, সহজ হয়েছেন। সবসময় কেবল জটিলতাতেই সৌন্দর্যের অন্বেষণ অর্থহীন বলে বোধ হয়। রুশদির নোবেল যখনই আসুক, চাইব তা আসুক কেবল তাঁর সাহিত্যিক উৎকর্ষেরই কারণে। অহেতুক সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যকে জুড়ে দিয়ে, অথবা অন্য কোনও বিষয়কে নিয়ে মাতামাতি করে তাঁর ‘নোবেল-প্রাপ্তির দাবি জানানো হলে’, তা কেবল তাঁর সাহিত্যের প্রতিই অপমানকর হয়ে দাঁড়ায়।

হয়তো ফসে’কে নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনার পরিসর ছিল, প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নিজের অক্ষমতাকে অকপটে স্বীকার করে নিয়ে কেবল সাহিত্য, নোবেল, সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য, ও পুরষ্কারের ক্ষেত্রে রাজনীতি ও সমাজের প্রভাব, এই সমস্ত কিছুকে মিলিয়ে মিশিয়ে তুলে ধরতে চাইলাম। আদতে এই পুরষ্কার তো কেবল একজন সাহিত্যিকের উদযাপন নয়, এই পুরষ্কার আদতে গোটাগুটি ভাবে চর্চার বিষয় হিসেবে ‘সাহিত্যের উদযাপন’। অন্তত সেই ভাবেই আমরা বরাবর তাকে উপভোগ করে এসেছি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন