দোঁহা

মুহূর্ত-সুখ (অথবা শীতার্ত রাত!), যে শ্রদ্ধার্ঘ্য ফিওদরের




অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

দুপুরটাকে এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারি। শরতের রোদ ছিল সেদিন। মেঘ ছিল।

আমাদের ছোটবেলায় কোন এক ছোটদের গল্পে পড়েছিলাম, শরতকালেরই বিষয়ে এক প্রাচীন লোক-সংলাপ:

“রোদ হচ্চে, পানি হচ্চে, খ্যাঁকশেয়ালির বিয়ে হচ্চে!”

কানে এখনও ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে। চিরকালীন সাহিত্য নয়, নয় কোনও বিরাট কালজয়ী উপাখ্যান।

সামান্য কয়েকটি শব্দ মাত্র, সামান্য ঝঙ্কার কেবল। শরতের আকাশ এর চেয়ে সহজ ব্যাখ্যাতে কেউ বোধহয় কোনদিন তুলে ধরতে পারেনি।

আজকে তাই দিনের আলোর চেয়েও স্পষ্ট করে মনে পড়ছে, সেই মেঘ-রোদ্দুরের সময়…

বাজার নিয়ে ফিরছিলাম। যাওয়ার সময় আকাশে মেঘ ছিল। টিপটাপ বৃষ্টিরও আভাস পেয়েছিলাম। ছাতা থাকলেও খুলতে ইচ্ছে করেনি। এই বৃষ্টি গায়ে মেখে নেওয়ার। কেউ কেউ আবার ইলশেগুঁড়ি নাম দিয়েছে তার। গলির শেষ মাথায় একেবারে ছোট্ট ঘুপচি এক চায়ের দোকান। কাগজের কাপ অথবা মাটির ভাঁড়ের হিসেবে চায়ের ব্যবস্থা। মাটির ভাঁড় থেকে চা খেলে সেই চায়ের মৌতাতে এক বিশেষ গন্ধ পাওয়া যায়। ইলশেগুঁড়ির আবহে তার স্বাদ আরও জমাট হয়ে ওঠে। চারপাশের বাড়িগুলোকে ভিজতে দেখছিলাম। একেকটা বিন্দুর মতো, জলছাপ দেওয়ালে পড়ছে। সে ছিল এক বিশেষ দিন। সুন্দর এক মুহূর্ত।

বাজারের কাজ মিটতে সময় লাগেনি। বাড়ির জন্য অল্প মিষ্টি নিয়েছিলাম। হাতের প্যাকেট দোলাতে দোলাতে আবারও সেই গলির মুখটাতেই এসে দাঁড়িয়েছি। চড়চড়ে হয়ে রোদ উঠে গেছে তখন। আরেক ভাঁড় চা নিলাম। ভেজা এ্যাসফাল্ট এইটুকু সময়েই শুকিয়ে খটখট করছে। প্রতিটি খোয়ার দাগ সেই রোদে শোকানো রাস্তার উপর স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। যেন বা কোনও মিনিম্যালিস্ট ছবিরই অনুকরণ, নিখুঁত বিন্যাস তাদের। মনে মনে সেই বিন্দুগুলোকে জুড়ে চলতে ইচ্ছে হয়। এই রাস্তা তৈরির সময় অসাবধানতাবশত: কারোর পায়ের ছাপ রাস্তার এক কোণে এ্যাসফাল্টের উপর মূর্ত হয়ে থেকে গিয়েছে। হয়তো বা কোনও শ্রমিক। অথবা কোনও পথচারীরও হতে পারে বোধহয়। জুতোর ছাপ দেখে গোয়েন্দাগিরির বয়স আমরা পেরিয়ে এসেছি। ভাঁড়টাকে জঞ্জালের বালতিতে ছুঁড়ে দিলাম। দাম মিটিয়েছি আগেই। গুনগুন করতে করতে হাঁটছিলাম। গান গাইছিলাম।

গান গাইতে আমার ভালো লাগে। সবসময় এই দুঃস্থ, অসুন্দর পৃথিবীটাকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগে না। মাথার উপরে, দুপাশে তাকালে, চওড়া অথবা অসম্ভব রকমে শীর্ণ যে সমস্ত বারান্দাগুলোকে চোখে পড়ে আমার, যে সমস্ত ছাদের দিকে তাকাই, আমি জানি, সেই প্রতিটি ইঁটের ফোকরে, প্রতিটি কংক্রিট-স্তব্ধ ভবনে, প্রতিটি চিলেকোঠায় অথবা ছাদের শূন্যতায়, আরও অন্ধকার, আরও গভীরতর শূন্যতার উৎসেরা মুখ বুজে গুম হয়ে আছে। শরতের আকাশে হঠাৎ, ধেয়ে আসা মেঘেদের মতোই তাদের গুমরোনো হাবভাব যত। এতটুকুও স্পর্শসুখ পেলেই, ঝরঝরে জল হয়ে ঝরে পড়বে সে সব। কিন্তু যতক্ষণ অবধি না বৃষ্টির সময় আসছে, ততক্ষণ অবধিই এই ভ্যাপসানো গরম, এই আর্দ্রতা, এই দমচাপা টবের বারান্দাতেই, তাদের অটুট অস্তিত্ব চিরন্তন।

তখনই মেয়েটা পিছনে ফিরে তাকালো। হলুদ কামিজ পরনে। আমার চেয়ে উচ্চতায় খানিক খাটো হবে বোধহয়। শ্যামলা রঙ। হাতে অল্প বাজার রয়েছে। কাঁধে ঝোলানো একটি ব্যাগ। কোথাও থেকে সে কাজ সেরে ফিরছে বলে মনে হল। সে আমার দিকে তাকালো। রাস্তায় চলতে চলতে গান গেয়ে বেড়ায়, এমন মানুষ বোধহয় সে কমই দেখেছে। ভাবলাম হাসবে। কিন্তু সে হাসল না। বরং সটান এগিয়ে এল। সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর জিজ্ঞেস করল,

"আচ্ছা, আমরি হাসপাতাল এখান থেকে কিভাবে যেতে হয় বলতে পারেন?”

আমি প্রথমে তার প্রশ্নটা সঠিক বুঝতে পারিনি। গান থামিয়ে আবারও তার দিকে তাকালাম। চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম,

"মাপ করবেন, কি বললেন আরেকবার?”

প্রশ্নটা সে আবারও করল। তার চোখেমুখে তেমন ক্লিষ্টতার ছাপ না থাকলেও, একটা ক্লান্তির আভাস রয়েছে। তবু তার চোখদুটো শান্ত, উজ্জ্বল। লক্ষ্যের অভিমুখে স্থির। সে তাকিয়ে রয়েছে। আমি বললাম,

“এই তো, সামনের মোড় থেকেই অটো বা বাস, যা কিছুই নিতে পারেন। গোলপার্কে যাওয়ার যে কোনও বাস বা অটোতে উঠলেই-আপনি যদি ঢাকুরিয়া ব্রিজ পেরিয়ে নামেন, পঞ্চাননতলা বাসস্টপ,” তারপরেই খটকা লাগল, “কিন্তু আপনি তো উলটোদিকে হাঁটছেন, আপনাকে তো ওই গলির মোড়টা থেকেই বাস ধরতে হত,” মেয়েটি হাসল।

“না না, এখন নয়। আমাকে চারটের সময় যেতে হবে। একটু জিজ্ঞেস করে নিলাম আর কি। অনেক ধন্যবাদ।”

আমি বললাম, “ওহ! আচ্ছা। আচ্ছা, আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারিনি। স্বাগত আপনাকে।” মেয়েটি হাসিমুখে তাকাল। তারপর আবারও হাঁটতে হাঁটতে এগুল। আমি ইচ্ছে করেই দাঁড়িয়ে রইলাম খানিক। কয়েক কদম সে এগিয়ে যাক। আমারও মনের ভিতরে আজগুবি চিন্তারা ভিড় করে এসেছে। আমি আবারও হাঁটতে শুরু করি।

ভাবনাগুলো মনে দল পাকায়। অযাচিত ভাবনারা ভিড় করে আসতে থাকে। চারটে বলতে অধিকাংশ হাসপাতালেই তখন ভিজিটিং আওয়ার্স, রোগীর সঙ্গে আত্মীয়দের দেখা করার সময়। হয়তো মেয়েটির পরিচিত কেউ সেখানে ভর্তি রয়েছে। হয়তো বা কোনও দূরের আত্মীয়, অথবা খুব কাছের কেউ। কিন্তু, তাহলে তো সে হাসপাতালে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করত না। অথবা, এমনও হতে পারে-একটু আগেই সে খবর পেয়েছে। তাও তো হতে পারে বোধহয়। আচ্ছা, সম্পূর্ণ কোনও অন্য কারণও তো হতে পারে। হাসপাতাল বলতেই আমরা অসুখ, ডাক্তার, রোগী, এই সমস্ত চিন্তা করব কেন? ইদানীং কি আমরা বড় বেশি করেই নৈরাশ্যবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি? আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি। বিকল্প আরও একটি ভাবনাও আমার মস্তিষ্কে ফিনিক দিয়ে ওঠে হঠাৎ। আমি আমার মনকে বিশ্বাস করতে চাই।

সে ছিল এক বিশেষ দিন। সুযোগ থাকলে, বিশেষ এই দিনগুলোয় পৃথিবীর ক্যানভাসে আমরা একগুচ্ছ রঙিন মুহূর্তকে অপলক ফুটে উঠতে দেখি। নীল আকাশের বুক চিরে চলে যাওয়া, উড়ন্ত বিমানের পিছনে ফেলে যাওয়া, জেট ইঞ্জিন থেকে উৎপন্ন ধোঁয়ার সেই তীক্ষ্ণ, শুষ্ক, সমান্তরাল, চিরপরিচিত রেখা দুখানিরই মতো, শান্ত-নির্নিমেষ। কিন্তু, ক্রমশ ব্যাপন ক্রিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যে, সেই আকাশ চিরে চলে যাওয়া ধোঁয়ার আঁচড়ের মতো রেখাগুলি, বিলীন হয়ে আসতে থাকে। বিস্তৃত হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন হয়ে আসে। আকাশে ছড়িয়ে যায়।

দুপুরের ঠা ঠা রোদে লোকটা ঘাড় নীচু করে ল্যাম্পপোস্টের নীচে বসেছিল। বাউল নয়। বৈষ্ণব। গলায় কণ্ঠি রয়েছে। মাথার চুল পেকে ধবধব করছে। লোকটির বয়স হয়েছে। ন্যুব্জ হয়ে রয়েছে সে। খঞ্জনীদুটো পাশে নামিয়ে রাখা। গান গায়। এখন গাইছে না। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তার একটি চোখ অন্ধ। সাদা, ফ্যাসফ্যাসে এক শূন্যতা। আমার বাড়ি এখান থেকে কাছেই। ঠা ঠা রোদ্দুরে লোকটা মাথা নামিয়ে রয়েছে।

বাড়িতে এসে বাজার নামিয়ে রাখলাম। ফ্রিজ খুলে দেখলাম, ঠিক যা ভেবেছিলাম। গতদিনের আনা সন্দেশ, চন্দ্রপুলি, মিষ্টি-এখনও বেশ কয়েকটা সাজানো। প্লাস্টিকের কৌটোতে দুখানি সন্দেশ, আর একখানি চন্দ্রপুলি ভরে নিলাম। সঙ্গে নিলাম শুকনো চিঁড়েভাজার আরও এক প্যাকেট। রাস্তায় সেই লোকটার পাশে নামিয়ে রাখলাম। লোকটা ততক্ষণে একটু উঠে বসেছে। চোখ খুলে দুদিকে তাকিয়ে কিছু যেন বুঝতে চেষ্টা করছে। আমার দিকে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞেস করল, “কি – এগুলো?” আমি বললাম, “খাবার, আপনার জন্য।” লোকটার কোনও ভাবান্তর হল না। কাঁপা কাঁপা হাতে জিনিসগুলো ছুঁয়ে দেখল একবার। আমি হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলাম। উঠে দাঁড়ালাম। চলে আসছি যখন, পিছনে ফিরে দেখলাম লোকটা একটা সন্দেশ বের করে ভেঙে ভেঙে খাচ্ছে। ওপাশের রাস্তায় আরও একটা দৃশ্যের দিকে চোখ পড়ে গেল। তার কথা আবারও যথাস্থানে আসবে। আমি তখন সিঁড়ি বেয়ে দোতলাতে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এলাম।

‘শীতার্ত রাত’, শিরোনামটাকে সত্যিই ভালো লাগছিল।

আমি এখন একাডেমি অব ফাইন আর্টসের সামনে দাঁড়িয়ে। ‘শীতার্ত রাত’। ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘হোয়াইট নাইটস’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, এই শহরেরই কোনও নাট্যদল আজ একাডেমি মঞ্চে এই নাটক মঞ্চস্থ করতে চলেছে। বড় প্রিয় গল্প। আজকের এই বিশেষ মুহূর্তে, সেই গল্পটাকেই কেন জানি না আমার মনে পড়ছিল। অবশ্য বহুবার করেই গল্পটিকে মনে পড়ে আমার। নাস্তেঙ্কাকে, আমি ভালোবাসি...পরিচিত চায়ের দোকানে এক ভাঁড় চা চেয়ে নিলাম। আস্তে আস্তে সেই চায়ে চুমুক দিই। চোখ পড়ে গেল।

ঠিক তখনই আমি আবারও সেই মেয়েটিকে দেখলাম। আমার চেয়ে অল্প দূরে আমারই দিকে মুখ ফিরিয়ে সে কথা বলছে একটি ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি আমার চেয়ে উচ্চতায় বড়। রোগা, কিন্তু নমনীয় চেহারা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আমার দিকে পিছন ফিরে ছিল বলে মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু কথাগুলোকে শুনতে পাচ্ছিলাম।

“বেশিক্ষণ নয়, মাত্র কুড়ি মিনিট!” মেয়েটা বলছিল। তার মুখে এখনও ক্লান্তির ছাপ। পরনে এখনও সেই হলুদ কামিজ। কিন্তু তার চোখদুটিতে উজ্জ্বলতা বেড়ে গিয়েছে। সে হাসছে। আগের চেয়ে অনেক সহজ ভাবে হাসছে। আমি মাটির দিকে চোখ নামাই।

দশমাস আমিও এই অবস্থায় ছিলাম…

"আঠেরো মাস, আর টিউশনি নিয়ে ভাবতে হবে না আমায়,” মেয়েটি দু’হাত নেড়ে বলছিল। আমি কান পেতে শুনছিলাম।

সেই দশ মাসের যে তিন শতাধিক রাত আমি কাটিয়েছি, কত না বার মনে হয়েছে এখনই উঠে দাঁড়াই। ভেঙে চুরমার করি আশপাশের সমস্ত আসবাব-খাট-কাজের-টেবল, ইত্যাদি সবকিছুই। শেষ হোক এই অপেক্ষা, এখনই হোক। যেভাবে হোক। আমি নিষ্ফল আক্রোশে হাত মুঠো করি। তারপর, এমনই একদিন।

তখনও চাকরির চিঠি হাতে পাইনি। এভাবেই কলকাতার রাস্তায় একাকী হেঁটে গিয়েছিলাম। এক বন্ধুর চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম, ঠিক এইখানে দাঁড়িয়েই আমি আবারও চাকরির কথা বলব। আমি বুক ফুলিয়ে সবাইকে শোনাব, আমি বেকার নই। আমার হাতে এখন একটা বাঁধা চাকরি রয়েছে। চোখ ফিরিয়ে রাস্তার ওপারে তাকিয়েছিলাম। আঠেরোতলা যে সুউচ্চ বাড়িটাকে প্রথম চোখে পড়েছিল, কংক্রিটের ফলকে সেই বাড়িটার গায়ে একসময়ে তার নাম ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, সেই অনেককাল আগেই। আজ সেই অক্ষরগুলির একটি ভেঙে পড়ে গিয়েছে। তবুও বাকি অক্ষরগুলোকে সাজালে নামটিকে আন্দাজ করে নিতে অসুবিধে হয় না। অস্ফূটে আমি সেদিন উচ্চারণ করেছিলাম, ‘বেহেস্ত!’ অথবা প্যারাডাইজ, অনন্ত স্বর্গের হদিস। আমি বর্তমানে ফিরে এলাম।

“আঠেরো মাস, আর টিউশনি নিয়ে ভাবতে হবে না আমায়,” মেয়েটা বলছিল। ঠিক যা ভেবেছিলাম।

কোনও চাকরির জন্য ইন্টারভিউ ছিল তার, বিকেল চারটের সময়। আমরি হাসপাতালে। হয়তো বা কোনও সামান্য চাকরি, কিন্তু এই মেয়েটির কাছে তার মূল্য অনেক। তার বন্ধুর কাছেও। দুজনে আরও একটু কাছাকাছি সরে এসেছে। আমি ভালো করে একটিবার ভেবে দেখতে চেষ্টা করি। দুপুরে মেয়েটির হাতে হয়তো বা মার্কশিট দেখেছিলাম। অথবা তার প্রতিলিপি। কিছু না কিছু দেখেছিলাম। যার জন্য আমার মনে হয়েছিল, হোক না হাসপাতাল। মেয়েটি হাসপাতালে রোগীর আত্মীয় হিসেবে যাচ্ছে না। কিছুতেই না। সে কিছু পেতে চলেছে। কিছু পাবার আশায় চলেছে। সেই প্রাপ্তি রোগমুক্ত মানবজীবন নয়। সেই প্রাপ্তি মানবজীবনে নিরাপত্তার প্রাথমিক অধিকার। অনেকদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে। আজ সেই অপেক্ষার অবসান হল। মেয়েটির সঙ্গে আমার চোখে চোখ পড়ে গেল। আমি প্রায় উচ্চারণ করে ফেলেছিলাম, “নাস্তেঙ্কা! আমার…অভিনন্দন তোমাকে!” মেয়েটি চোখ নামিয়ে নেয়।

মেয়েটি আমাকে চিনতে পারেনি। আমিও চাইনি সে চিনুক।

আমার সেই রোদ-জ্বলা দুপুরের শেষ দৃশ্যটাকে মনে পড়ছিল। বৃদ্ধ সেই বৈষ্ণবকে যখন পিছনে ফেলে ফিরে আসছিলাম, গলির ওপাশে লাফাতে লাফাতে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল ছোট্ট জলপরীর মতোই একটি মেয়ে, পরনে তার ঝকঝকে হলুদ পোশাক। লাফাতে লাফাতে গুটি কেটে সদ্য বেরুনো প্রজাপতির মতোই সে এগিয়ে আসছিল। কলকল করে কথা বলছিল। হয়তো বা সে সোনিয়ার মেয়ে, রাসকলনিকভেরই বংশধর। আমি মাটির মধ্যে, রোদের মধ্যে গলে বিলীন হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি পৃথিবীর পাঠশালায় তখন হাঁটছিলাম...

মেয়েটি চোখ নামিয়ে নিয়েছে। মেয়েটি অনেক দূরে হেঁটে বিলীন হয়ে গিয়েছে। পাশে তার সহযাত্রী বন্ধু।

আমি দু’হাত নেড়ে তাদেরকে এগিয়ে যেতে বলছিলাম…

আমি ফিসফিস করে তখন আবৃত্তি করছিলাম,

“একপলকের বৃষ্টিতে যে সুখ,
সারা পৃথিবীতেও তার হদিস মেলে না,
অথবা একফালি বসন্তের বিকেল,
একখানি প্রশ্নের জবাবে,
হাসিমুখ আরেক,
জীবন আটকিয়ে থাকে, ওইটুকু সময়েই,
চিরন্তন,
এই ভাবনা আমার তো নয়,
চুরি করেছি দুইশত বছরেরও বেশি,
আগেকার এক ঔপন্যাসিকের থেকে,
দস্তয়েভস্কি নাম তাঁর,
মানুষকে তিনি বলেছিলেন,
দরাজ এক ভঙ্গিমায়,
দুহাত ছড়িয়ে,

আহ! মানবতা,

এক মুহূর্তেরও যে সুখ,
তাই কি গোটা এক জনমেরই জন্য যথেষ্ট নয়?”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন