দোঁহা

আলোয় ফেরা

 


 সুদেষ্ণা সেনগুপ্ত

দিনটা ছিল একদম ওদের মত। মেঘ রোদ্দুরের লুকোচুরি। বর্ষা শেষ হলেও চলে যেতে নাছোড়। শরৎও  বীরবিক্রমে তৈরি। ওদের সাথে দেখা করার আগে শুধুই কিছু টুকরো টুকরো ধারণা ছিল মনে। দেখা পাওয়া মাত্র ওরা ওদের রঙে রাঙিয়ে দিলো আমাকে।
 
ছোট্ট প্রাণগুলোর প্রবল জীবনীশক্তি, নিষ্পাপ আনন্দ আর উদ্দীপনা ছিনিয়ে নিয়েছিল প্রাণঘাতী মাদক। পাঁচ বছর থেকে দশ-বারো বছরের এইটুকু শিশুদের বাড়ি ঘর বলতে আসলে যা বোঝায় তা কিছুই নেই। মা-বাবা-ভাই-বোন-আত্মীয় স্বজন সবই এক অপরিচিত জগৎ এদের কাছে। এদের জন্ম শিয়ালদা-হাওড়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, ঝুপড়িতে, ফ্লাইওভারের তোলার কুঁড়ে ঘরে। মা বাবা থেকেও নেই। দুর্ভাগ্যবশত তারাও মাদকের করালগ্রাসে। তাই এদের শৈশবও শুরু হয়েছিল মাদকের বিষাক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিয়ে। হয়তো এই বিষই নরম এই শরীরগুলোকেও চুষে নিত ধীরে ধীরে। কিন্তু আঁধারের পর আলোর মতো এদেরও অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা শুরু হয় এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে। এই সব শিশুদের পথের ধুলো থেকে তুলে প্রত্যেকটা শরীরকে বিষমুক্ত করার কাজটা আমার এই শব্দবন্ধনের মতো সহজ ছিল না। আরও কঠিন চ্যালেঞ্জ, আবারও সেই আঁধারের কালো হাতের কবল থেকে ছোট্ট প্রাণগুলোকে আগলে রাখা। ওদের এমন একটি জীবন দেওয়া, যা ওদের জন্মগত অধিকার। সেই সব সুযোগ সুবিধা ওদের দেওয়া যা আমি আমরা পেয়েছি। আলো হাওয়া জল আর পরম মমতায় কচি দুপাতার চারা গাছ থেকে মহীরুহ গড়ে তোলার এই সফর সত্যিই এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।

বিগত বেশ কয়েক দশক যাবৎ মাদক সেবনের দরুন তরুণ-যুব সমাজের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ অস্বস্তিতে ফেলেছে গোটা পৃথিবীর তাবড় শক্তিধর দেশগুলোকেও। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। শুধু পথশিশুদের মধ্যেই নয়, আমার আপনার পরিবারের মধ্যেও পরম যত্নে বিলাসিতায় বড় হতে থাকে শিশুরাও পার পাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষায় মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার গুলোতেও পারিবারিক উত্থান পতন অশান্তি প্রভাব ফেলে শিশুমনে। মা বাবা বা পরিবারে অন্যান্যদের মধ্যে বিবাদের ফলে ধীরে ধীরে একাকীত্ব গ্রাস করে শিশুদের। তাদের ভালোবাসা খুঁজে ফেরা মনগুলোকে সহজেই বিষিয়ে ফেলে মাদক দুনিয়ার ব্যাপারী। আবার কখনো মা বাবার অতিরিক্ত নজদারি দাপট আর শাসন শিশুসুলভ সারল্যের অন্দরে ছড়াতে থাকে বিষ। পালানোর জন্য আকুল হয়ে ওঠা মনগুলো খুঁজে নিতে চায় এক অলীক সুখের বুদবুদ। যেখানে কেউ তাদের শাসনের বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলবে না। মা বাবার অর্থ শুধুই রক্ত চক্ষু নয়। বন্ধুত্ব পেতে চাওয়া মনগুলোকে সহজেই নিজেদের কথার বুননে গেঁথে ফেলে মাদক ব্যাপারীর দল। নির্ভর করার চরম মূল্য চোকাতে হয় প্রাণের বিনিময়ে।

মাদক আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভাগ কিরে নিয়ে তমিস্রাজিত ব্যানার্জী জানান, কিভাবে আটপৌরে জীবন যাপন করা পরিবারের ছেলেমেয়েরাও একসময়ে তাদের তথাকথিত ভালো বন্ধুদের সঙ্গতে মাদক সেবনের প্রথম ধাপে পা রাখে। তারপর এক পা, দু পা করে এগিয়ে যায় সর্বনাশা অন্ধকারের পথে। তখন তাদের সামনে রঙিন জগৎ, নেশায় মেশা তুরীয় আনন্দ আর যৌবনের স্রোতে ভেসে বেড়ানোর আহ্বান। অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে কিংবা নিজেদের নিয়ে মত্ত থাকা মা বাবারা বুঝতেও পারেনা, কখন তাদের স্নেহ সত্যিই অতি বিষয় বস্তু প্রতিপন্ন হয়েছে তাদের নারিছেঁড়া ধনের কাছে। নিজে প্রত্যক্ষ না করলে হয়তো বুঝতামই না কিভাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিষিয়ে উঠছে আমাদেরই অজান্তে।

বিশেষজ্ঞদের সমীক্ষায় এও জানা যায়, এক প্রকারের মানসিক অস্থিরতা এবং তার প্রভাব নিয়ে কিছু শিশু জন্মায়। ডাক্তারি পরিভাষায় যা 'obsessive compulsive disorder'। অন্তৰ্মনে এই ধরণের লুক্কায়িত স্থিতি সহ বড়ো হতে থাকা শিশুরা স্বভাবগতভাবেই একটু বেশি আগ্রহী, কল্পনাবিলাসী, ভাবুক হয়। যা তাদের সময়ে সময়ে হঠকারী করে তোলে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় একধরণের অ্যালার্জী ফ্যাক্টর, যা শিশুদের শরীরে একবার মাদক প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। দুর্ভাগ্যক্রমে একের পর এক সময়ে ঘন ঘন মাদক শরীরে প্রবেশ করতে থাকলে শরীর সেই বিষ গিলতে থাকে। আর একটা সময়ের পর সেই বিষই গিলে নেই সমস্ত শরীর। 

শিয়ালদা স্টেশনের দূরপাল্লার ট্রেনগুলোর দুরন্ত গতিতে প্লাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ক্লান্তিকর প্রবেশের মধ্যেই বারমাস্যা বিশু-দীপ-সুমঙ্গল-লোকনাথদের। ওদের প্রত্যেকের কুল বংশ জাত ধর্ম একটাই। ওরা ভিখারি। পথশিশু। আরো একটা বড় মিল ওদের। ওরা মাদকাসক্ত। বয়স বড়জোর তেরো চোদ্দর মধ্যে। লেখা পড়া শিক্ষা বহুদূরগামী হলেও এরই মধ্যে একটা শব্দের সাথে ওর সুপরিচিত-'ড্রাগস'। ওদের জীবন যেমন ট্রেনের অন্ধকার কম্পার্টমেন্টে খালি জলের বোতল কুড়িয়ে পাওয়ার মতোই অনিশ্চিত তেমনি বোতল বিক্রির টাকায় ড্রাগের পুরিয়া কেনার মতোই নিশ্চিত। উদাহরণটা বোধহয় পাঠকদের খানিক গোলমেলে লাগবে। কিন্তু ওদের জীবনসত্য সত্যিই এমন দিশাহীন। এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে ওরা দুবেলা পেটভরে খেতে পায়। অবশ্য মাদক ওদের খিদে কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিকাশ। ওদের এখন পরম মমতায় যারা শিয়ালদা স্টেশন লাগোয়া স্পাইস হোটেলে বসে খাওয়ায় তারাও একসময়ে ছিল ওদের দলে। সর্বহারা। সর্বনাশা ড্রাগের হেফাজতে। একদিন এই কার্তিক রায়, রাম মণ্ডলকেও ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অন্য দাদারা ভরপেট খাইয়ে ওদের বন্ধু হয়ে ওদের হাত ধরে নিয়ে গেছিল হোমে। সেখানেই ধীরে ধীরে ওদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা লড়াই লড়তে লড়তে। ওরা জিতেছে। আর ওরা জিতেছে বলেই ওরা ওদের মতোই আরো যারা দুর্বিষহ যন্ত্রণার শিকার, তাদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি নিয়েছে। কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অন্যতম কর্তা প্রশান্ত বাড়ুই মনে করিয়ে দিলেন, মাদকের করালগ্রাস থেকে বেরিয়ে আসা যেমন কঠিন তেমনি বেরিয়ে আসার পর আবারও সেই অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পরও মাদকাসক্তরা সেই দিকেই পা বাড়ায়। নিশির ডাকের মতোই যেন মাদকও হাতছানি দেয় তাদের। সবথেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ সেই ডাক অগ্রাহ্য করে নিজেকে সুস্থ রাখা। আরো একটা বিষয় আবাক করে। ওই শিশুদের মধ্যে যতজন ছেলে, মেয়ের সংখ্যাও তেমনি। রাম আর কার্তিকের সাথে কথায় এই প্রসঙ্গ উঠতেই ওরা আরো অনেক ভয়ঙ্কর সত্যের মখুমখি দাঁড় করিয়ে দিল। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা-এর মত এই মাদকশক্তি মেয়েদের নিয়ে যায় দেহব্যবসার জগতে। নেশার খোরাক জোগাতে এদের কাছে তখন দেহব্যবসাই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। হু হু করে মৃত্যুর থাবা বাগিয়ে তেড়ে আসে এইচআইভির মতো রোগ। তারপরর একদিন কানাগলির কোনো বাঁকে এরা হারিয়ে যায়। তথাকথিত সভ্য সমাজের তা খোঁজ রাখার দায় থাকে না। 
 
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও কলকাতা পুলিশের যৌথ উদ্যোগে মাদক নিষ্কৃতি ক্যাম্পে দেখা মিলল ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারেই মা বাবাদের। কিভাবে নিজেদের ছেলে মেয়েরা একসময় মাদকাসক্ত  হয়ে পড়েছিল আজও তারা বুঝে উঠতে পারে না। যে ছেলে মায়ের আঁচলের গন্ধ না পেয়ে হাঁফিয়ে উঠত সেই ছেলে কিভাবে সর্বনাশা ড্রাগের খপ্পরে পড়লো তা ব্যাখা করতে গিয়ে গলা বুজে আসে গায়েত্রী দেবী ও তার স্বামী প্রভাতবাবুর। তাদেরই পাশের চেয়ারে বসে শূণ্য দৃষ্টি নিয়ে শুধু মাঠে নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন সুভাষবাবু ও গৌরীদেবী। তাদের একমাত্র মেয়ে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে আজ নিজেই চিকিৎসাধীন। মাদকের নিশিডাক তাকেও যেন কখন ডেকে নিয়ে গেছিল। বুঝতে পারেনি বলে আজ নিজেদেরই দোষী সাব্যস্ত করেন শুধু। তবে তারা লড়ছেন। তাদের সন্তানকে ফিরিয়ে আনার কঠিন লড়াই দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন।
 
কলকাতা পুলিশের নারকটিক্স বিভাগের এক ইন্সপেক্টরের সাথে কথায় কথায় উঠে এলো এমন আর এক প্রসঙ্গ। যা প্রতিদিন ধীরে ধীরে সমাজের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে মারণ রোগের মতো। দেশের শান্তি ভঙ্গকারী জঙ্গি দল গুলো তাদের জঙ্গি কার্যকলাপের টাকার জোগান অক্ষুন্ন রাখতে মাদক ব্যবসাকে কাজে লাগাচ্ছে। দেশের যুব সমাজের শরীরে বিষ মিশিয়ে শত্রু দেশের মদতে চলছে narco terrorism। যুব সমাজকে রক্ষা করার অন্যতম উপায় হলো তাদের সচেতন করা। তাই কলকাতা পুলিশের পক্ষ থেকে চলছে প্রতিটি স্কুলে কলেজে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ। 
 
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হোম থেকে বেরিয়ে আসার পথে আমার পিছু পিছু হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে এলো বিশু-দীপ-সুমঙ্গল-লোকনাথ। পাশাপাশি রুকসানা ঝুমাও। খানিক আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশ জুড়ে মিঠে রোদ্দুর। ছোটবেলায় পড়া একটা কবিতার লাইন বড়ো মনে পড়ছিল-"এ পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো..."



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন