প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
"তোমরা আমাকে স্মরণ কর,
আমিও তোমাদের স্মরণ করব।"
আল বাকারা (২:১৫২)
হজরত মইনুদ্দিন চিশতির 'শাহী দরবারে' দাঁড়িয়ে বার বার এই আয়াত'টির কথা মনে পড়েছে৷ পরম করুণাময়, 'গরীব নওয়াজ'ও একই কথা মুমিন'দের স্মরণ করিয়েছেন, 'তবু মনে রেখো'...
দু'দিনের সফর, দিল্লি থেকে ছুটে এসেছি রাজস্থান, অজমেঢ় শরীফে। প্রায় সাড়ে চারশো কিমি পথ উজিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী 'দরবার শরীফে' মাথা ছোঁয়াবেন, এই প্রথমবার অজমেঢ়-এ আসা তাঁরও। সে উপলক্ষেই আবারও বেরিয়ে পড়া, অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট-এ, অজমেঢ় ও পুস্কর।
দিল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে পরিচয় জনাব আকিল আহমেদ চিশতির সঙ্গে। পুরো নাম সৈয়দ আকিল আহমেদ চিশতি, চিশতিয়া সম্প্রদায়ের প্রাণপুরুষ সুফি সাধক হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতির বংশধর, অজমেঢ় শরীফ দরগার অন্যতম প্রধান খাদিম তিনি।
দিল্লি ছাড়ার আগে ফোনে একাধিক বার কথা, বহু প্রশ্নের অনর্গল জবাব দিয়েছেন, বিরক্ত হননি, স্থান মাহাত্ম্য নিয়ে যা কিছু জিজ্ঞাস্য, ধীর শান্ত গলায় তা জানিয়েছেন৷ বলেছিলেন, 'খাজা বাবার ইচ্ছা, তা-ই আসছেন। নির্ভাবনায়, নিশ্চিন্তে আসুন। উনিও তো অপেক্ষা করছেন।'
অবাক লেগেছিল কথাগুলি শুনে৷ অজমেঢ় যাচ্ছি শুনে বাবা খুব খুশি৷ তিনি নিজেও গিয়েছিলেন বার দুয়েক। 'ভাল করে, মনখুলে প্রার্থনা করিস, কেমন! ওই দরগার হাওয়ায় জাদু আছে'-বাবা বলেছিল। মা বলেন, 'খুব যাওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার-ও। তুই ভাল করে ঘুরে এলে, আমারও ঘুরে আসা হবে।' এ সব ভাবতে ভাবতে সারারাত গাড়ি ছুটিয়ে অজমেঢ় পৌঁছেছি যখন, ভোরের আকাশ তখন ফজরের রঙ মেখে প্রার্থনায় বসেছে, পাখিরা শুরু করেছে তাদের কলমা-আয়াত পাঠ...
এর পর দু ঘন্টার 'পাওয়ার ন্যাপ' আর পুরি-সবজি দিয়ে পিত্তরক্ষা সেরে, অজমেঢ়-এর বিখ্যাত 'গলিয়া মহল্লা' পেরিয়ে যখন দরগার প্রধান দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়েছি, হাসিমুখে এগিয়ে এসে 'খুশামদিদ্' জানিয়েছেন জনাব আকিল চিশতি। সঙ্গে তাঁর পুত্র, আইনের ছাত্র, সপ্রতিভ চেহারার 'আরাফাত'। তাঁকে দেখলে আইনজীবী কম, কবি বেশি মনে হয়৷
'আকিল ভাই'য়ের হাত ধরেই 'শাহী দরবারে' প্রবেশ, প্রার্থনা, ফুল ও চাদর চড়ানো৷ দরগার প্রতিটি অংশ, খুঁটিনাটি চেনালেন আমাদের, জানালেন বহু অশ্রুত ইতিহাস। অবাক হয়েছি তাঁর মুখে ঝরঝরে 'বাংলা' শুনে৷ তিনি হেসে বলেছেন-'অবাক হবেন না। এই দরগায় বাঙালিরা-ই সবচেয়ে বেশি আসেন। বাংলা আপনা-আপনি শিখে গেছি।'
বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই, যে দরগাটি সুবিশাল। দরগা চত্ত্বরে চার-চারটি মসজিদ, তিনটি বানিয়েছেন আকবর, শাজাহান ও ঔরঙজেবের মত মুঘল বাদশাহ-রা৷ প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো দরগায় না জানি কত ইতিহাস লুকিয়ে আছে। কতশত মানুষ এসেছেন অন্তরের শ্রদ্ধা, প্রার্থনা জানাতে। আকিল ভাই বললেন, 'এখানে বসেই মইনুদ্দিন চিশতি তাঁর অতীন্দ্রিয় গুরু আবদাল্লা আনসারির অবিস্মরণীয় রচনা-'তবাকত অল সুফিয়া'য় নিমজ্জিত হয়েছেন, খুলে গেছে সুফিবাদের এক অনন্য দিগদর্শন। এসব ইতিহাস আজকাল কে আর চর্চা করে।'
দ্রুত সময় কাটতে থাকে৷ যথাসময়ে 'ম্যাডাম চিফ মিনিস্টারে'র আগমন, তাঁকে ঘিরে উন্মাদনা, হইচই, ঢক্কানিনাদের মধ্যেই মনে ঘুরতে থাকে নিজাম গেট, জন্নতি দরওয়াজা, সন্দালি মসজিদ-সহ আকবরী মসজিদ, জামি মসজিদ, আকবরী ডিগ, লঙ্গরখান আর অহত-এ-নূরে। ম্যহফিলখান ছাপিয়ে তখন কানে আসছে কওয়ালির সুর। ফিরে আসার পথে 'ঝালারা'য় হাত-মুখ ধুয়ে নিই, অদ্ভুত ঠাণ্ডা জল।
সৈয়দ আকিল আহমেদ চিশতি শাহজাহানি গেট পর্যন্ত এগিয়ে আসেন। একটু আগেই তাঁর 'বেগমি চবুতরা'র দালান-কোঠায় বসে 'ইলাইচি চা' আর 'মিঠা গজক' খেয়ে এসেছি। সে স্বাদ এখনও মুখে লেগে। যাওয়ার আগে হাতে তুলে দিয়েছেন প্রসাদি ফুল, মিষ্টির প্যাকেট আর হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতি ও এই দরগার উপর লেখা বাংলায় একটি বই। 'আল্লা হাফিজ' জানানোর সাথেই অপেক্ষা করছিল প্রগাঢ় আলিঙ্গন। কাঁধে হাত রেখে বলেন, 'গরীব নওয়াজের দরবারে কেউ একবার আসে না, আবারও ফিরে আসতেই হয় এখানে। আপনারাও আসবেন, অপেক্ষা থাকবে। পরবর-দিগার সর্বদা আপনাদের মঙ্গল করুন।'
হাত নেড়ে বিদায় জানানোর সময় আকিল আবারও মনে করিয়ে দেন, 'তাঁকে মনে রাখবেন, তিনিও মনে রাখবেন আপনাকে।' আমরা হাসি, মাথা নাড়ি, আর তক্ষুণি জনসমুদ্র আছড়ে পড়ে শাহজাহানি গেটে। প্রবল ভিড়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে আসার সময় সেই আয়াত আবারও মনে পড়ে যায়-
"সুতরাং আমায় মনে রেখো, আমিও তোমায় ভুলব না।"
মনে পড়ে যায়, ১৮৮৭-এ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির ২৬ বছরের এক দিব্যোন্মাদ তরুণ লিখছেন অনবদ্য এক জীবনদর্শন। অভূতপূর্ব সেই আকুতি, আমাদের আজও 'মনে রাখা'র অর্থ শেখায়-
"যদি থাকি কাছাকাছি,
দেখিতে না পাও ছায়ার মতন আছি না আছি-
তবু মনে রেখো..."
রবীন্দ্রনাথ কী মইনুদ্দিন চিশতির কথা জানতেন? পড়েছেন কী তাঁর লেখা? জানা নেই। শুধু জানি, দুই ভিন্ন কালখণ্ডে অধিষ্ঠিত দুটি মানুষ, দুই কবি-সাধক ও দার্শনিক বিশ্বাস করতেন এ-ই জাগতিক -'মনে রাখা'র তত্ত্বে, মরমীবাদে।
আকিল ভাই দিল্লি এলে এই গানটি ওঁকে শোনানোর ইচ্ছা রইলো।
বাকিটা 'গরীব নওয়াজে'র ইচ্ছা...ইনশাল্লাহ!
*
"কুরুক্ষেত্রং গয়া-গঙ্গা-প্রভাস-পুষ্করাণিচ
পুণ্যান্যেতানি তীর্থানি তর্পণ-কালে ভবন্তি"
ছোটবেলায় কতবার শুনেছি এই মন্ত্র। মহালয়ার ভোরে বাবার হাত ধরে গঙ্গার ঘাটে যেতাম। কোমর জলে নেমে বাবা তর্পণ করতেন, আর আমি গামছা জামাকাপড় হাতে দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘাটে। পুরোহিত মন্ত্রোচ্চারণ করতেন, বাবা কোশাকুশি হাতে ধ্যানস্থ, আর পূর্বজন্মের স্মৃতির মত ঢেউগুলো ভেঙে পড়তো ঘাটের সিঁড়িতে।
বাড়ি ফেরার পথে বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম, এসব শ্লোকের অর্থ৷ বাবা মৃদু হেসে যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তখনই প্রথমবার জানতে পারি এই 'আদিতীর্থে'র নাম। পবিত্র হ্রদের শহর, মন্দির নগরী, ভারতের অন্যতম প্রাচীন জনপদ, ব্রহ্মদেব মন্দির-পুস্করের পরিচয় বিবিধ৷ সেই শহরেই এসে পৌঁছেছি কয়েকঘন্টার জন্য৷
অজমেঢ় সফরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য -পুষ্কর। দরবার শরীফ ঘুরে মুখ্যমন্ত্রী যখন সার্কিট হাউসে, সে সুযোগে আমরাও তড়িঘড়ি হোটেলে ফিরে এসে নাকেমুখে সামান্য কিছু গুঁজে, ফের বেরিয়ে পড়েছি মহাভারতে বর্ণিত প্রাচীনতম এই শহরের উদ্দেশ্যে। অজমেঢ় থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার, পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে চলে।
পথে অগুনতি ময়ূর আর বুনো উটের দল। 'সোনার কেল্লা'য় লালমোহন বাবুর সেই আদিঅকৃত্রিম প্রশ্ন মনে পড়ে-'কাঁটা কী এরা বেছে খায়?' পশ্চিম দিক বলে আরাবল্লীতে তখনো ঝকঝকে আকাশ। রুক্ষ, ধূসর পাহাড়ি অলিগলিতে বার দুয়েক ধুলোটে রাস্তা হারানোর পর, অবশেষে নামি পুস্করের বিখ্যাত ব্রহ্মা মন্দিরে। একদল স্থানীয় সাংবাদিক বন্ধু পরমানুগ্রহে আমাদের পথ বাতলে দেন।
লোকশ্রুতি অনুযায়ী, সারা বিশ্বে একমাত্র পুষ্করেই প্রজাপতি ব্রহ্মার মন্দির রয়েছে। পদ্মপুরাণের মতে, দেবী সরস্বতীর অভিশাপে কোথাও পুজো পান না ব্রহ্মা। পরে দেবতাদের প্রার্থনায় পুষ্করকেই ব্রহ্মার আরাধনার স্থান হিসেবে নির্বাচন করেন বীণাপানি। ব্রহ্মা স্বয়ং এখানে সাধনা করেছেন। ব্রহ্মার 'কর' অর্থাৎ হাত থেকে খসে পড়া 'পুষ্প' অর্থাৎ ফুল থেকে উৎপন্ন হওয়ায় ব্রহ্মা এই স্থানটির নামকরণ করেন 'পুষ্কর'। কথিত আছে, এই মন্দিরের পবিত্র হ্রদ, ব্রহ্মকুণ্ডে স্নান না-করা পর্যন্ত তীর্থযাত্রা সম্পন্ন হয় না। এই স্থানটি আবার ব্রহ্মার নিবাসস্থল হিসেবেও খ্যাত। মন্দিরের পাশেই অবস্থিত পুষ্কর হ্রদ বা ব্রহ্মকুণ্ড। প্রায় সারাবছরই অসংখ্য শ্রদ্ধালু, তীর্থযাত্রীরা এখানে ছুটে আসেন পুণ্যার্জনের জন্য। যদিও এই কলিযুগে পবিত্র হ্রদে ডুব দিয়ে পুণ্য কামানো কতটা সম্ভব, সে নিয়ে সন্দেহ আছে।
আধঘন্টার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর ডিউটি শেষ করে চলে আসি হ্রদের ধারে, ব্রহ্ম ঘাটে। প্রায় অর্ধচন্দ্রাকৃতির মত গোটা হ্রদ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য ঘাট, পুরোহিত, পাণ্ডাদের যত্রতত্র ব্যস্ত আনাগোনা। এখন বুঝি অফ্ সিজন, তা-ই ভিড়ভাট্টা অনেকটাই কম। অরিন্দমদা তর্পণ করবেন বলে মনস্থ। পণ্ডিত রাজেন্দ্র দীক্ষিত-জি'কে জিজ্ঞেস করলাম, তর্পণ না-ই করতে পারি, পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে জলদান করতে পারি কী? উনি হেসে সম্মতি দিলেন। ঘাটে বসে জলদানের পাশাপাশি চললো মঙ্গলাচার, প্রার্থনা।
"ওঁ যেহবান্ধবা বান্ধবা বা যেহন্য জন্মনিবান্ধবাঃ
তে তৃপ্তিমখিলাং যাস্তু যে চাস্মত্তোয়কাঙ্খিণঃ।”
পুজো সেরে এগিয়ে আসি হ্রদের কাছে। এখনও জল দেখলে বুকের ভিতর টান দেয় কিছু৷ হ্রদের জল এখানে সুগভীর। আগে ছিল কাকচক্ষু, এখন দূষণ আর দৈণ্যতার ছাপ সর্বত্র। তার মধ্যেই উড়ে বেড়াচ্ছে সারস, পায়রার মত অসংখ্য পক্ষীকূল প্রতিনিধি৷ জলে নামি, হিমশীতল তার স্পর্শ। কিছুক্ষণ দাঁড়াই, প্রাণভরে বাতাস টেনেনি ফুসফুসে। সন্ধ্যে নেমে আসার সাথেসাথে ঘাটে জ্বলে ওঠে আলো। গোধুলীবেলায় পুস্করের ঘাটে সূর্যাস্ত দেখা এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। লিখে বোঝানো দুস্কর।
এবার ফেরার পালা৷ গাড়িতে ওঠার আগে ব্রহ্মার মন্দির দর্শন। অপলক দৃষ্টিতে 'প্রজাপতি' তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে৷ প্রণাম জানাই সৃষ্টিকর্তার প্রতি। টুকিটাকি কেনাকাটি আর আরাবল্লীর গায়ে একচিলতে চায়ের দোকানে চা খেয়ে গাড়িতে চাপি৷ সূর্য তখন অস্তাচলে। পুস্কর পিছনে ফেলে গাড়ি ছুটে চলে অজমেঢ় এর দিকে, রাস্তার ধুলো উড়িয়ে।
মনে পড়ে, পুরোহিত রাজেন্দ্র দীক্ষিতের কথাগুলি-'সম্ভব হলে আবারও আসবেন, এ জায়গার পিছুটান বড় মারাত্মক।' গায়ে হ্রদের জল ছিটিয়ে বলেন, 'মূর্খ মানুষ আমরা, ভাবি, জল গায়ে দিলে বুঝি পাপক্ষয় হয়৷ আমাদের মনের গভীরে যে কালো, সাহেব, সে পাপ কোন জলে ধোবেন?' উপবীত গুটিয়ে দক্ষিণা পকেটস্থ করে বলেন, 'প্রত্যেক মানুষের ভিতর কিন্তু একটা পবিত্র হ্রদ, ব্রহ্মকুণ্ড রয়েছে, ভাইসা! সময় তাতে চরা ফেলেছে; যেদিন সেই হ্রদের জল স্বচ্ছ হবে আর এই পুস্করে আসার প্রয়োজন হবে না...'
অদ্ভুত সুন্দর কথা বলেন দীক্ষিত জি৷ সত্যিই বুঝি আমাদের অন্তরে একটা ব্রহ্মকুণ্ড থাকে? তার জল বুঝি অস্বচ্ছ, ঘোলাটে? কবে তা পরিস্কার হবে? কিভাবে তা সম্ভব? উত্তর মেলে না, যদিও তা মোটে অজানা নয়, কারণ জানি কিছু প্রশ্নের আবরণ বুঝি নিজেকেই অনাবৃত করতে হয়, সঙ্গোপনে...
বাকি যা-কিছু আড়াল, নিজস্ব গোপনীয়তা তা শুধু 'ব্রহ্মাই জানেন!'