মহুয়া রায়
জঙ্গলে হৈচৈ। খোঁজ খোঁজ রব। কি হয়েছে? কি খুঁজছো? আরে, আগে খোঁজো তো। তারপরে শুনবে কি খুঁজতে হবে! কাকাতুয়ার গালে হাত—না জানলে খুঁজবোটা কি? কিন্তু সবাই এত দুশ্চিন্তায় যে, ভুলেই গেছে কি খুঁজতে হবে। তবুও খোঁজো। সবাই যখন খুঁজছে আমিও খুঁজি। সবার গম্ভীর মুখ, কপালে চিন্তার ভাঁজ। এখানে ওখানে উঁকি ঝুঁকি, কুয়োর মধ্যে, ঝোপঝাড় সরিয়ে খুঁজেই চলছে। কিন্তু কাকে, সেটা প্রায় কেউই জানে না। এমন সময় বুড়ো ভালুক এলো লাঠি ভর দিয়ে। খুব রেগে চোখ পাকিয়ে বলল, সবাই চুপ করো। এক জায়গায় দাঁড়াও। যদিও ভালুক মশাই বনের রাজা নন কিন্তু, বয়স আর অভিজ্ঞতার কারণে সবাই তাকে মান্যি করে। আরও মান্যি করে কারণ, সে কিছু বছর মানুষদের সঙ্গেও বাস করেছিল। গ্রামে শহরে ঘুরে ঘুরে খেলা দেখাতো। একবার সুযোগ পেয়ে পালিয়ে সোজা এই জঙ্গলে। কাজেই তার অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে একটু বেশি আর আলাদা। যাই হোক ভালুক দাদার কথা শুনে সবাই চুপ করে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে গুনগুন স্বরে কথা বলা কমে গিয়ে এক্কেবারে নিস্তব্ধ। যাকে বলে, একটা পাতা পড়লেও শোনা যাবে। বাঁদরে গা চুলকোচ্ছে না, সজারুরাও তাদের গায়ের কাঁটাগুলোকে সামনে শুমলে রেখেছে। পাছে ঝমঝম করে বেজে ওঠে। খরগোশ তার গাজর চিবোনো বন্ধ করে লাল লাল পুঁথির মতো চোখ তুলে চেয়ে আছে ভালুক জ্যেঠুর দিকে। জঙ্গলের সিকিউরিটি গার্ড চিল চক্কর দিচ্ছে আকাশময় আর বাজপাখি তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে নজর রাখছে চারিদিকে। মা পাখিরা তাদের ডানার তলায় ঢেকে রেখেছে তাদের বাচ্চাদের। মায়ের শরীরের ওমে তারা ঘুমিয়ে কাদা।
বুড়ো ভালুকের গলার স্বর বয়সের ভারে একটু কাঁপা কাঁপা হলেও গাম্ভীর্য এখনো কমেনি। মেঘ ডাকার মতো স্বরে বলে উঠলো, এবারে বলো তো কি হয়েছে, এত চেঁচামেচি কেন করছিলে? আবার সবাই হইহই করে উঠলো। কিছুই বোঝা গেল না। হারিয়ে গেছে, নিখোঁজ এই শব্দগুলোই উঠে এলো ভিড়ের মধ্যে থেকে। আবার ভালুক ধমকে উঠলো, চুউপ! একজন বলো। শিয়ালের দিকে তাকিয়ে বলল, "এই যে পন্ডিতমশাই বলতো দেখি কি হয়েছে"?
শিয়াল পন্ডিত একটু নড়েচড়ে এক টিপ নস্যি টেনে বললো—"আজ্ঞে, জঙ্গলের কিছু প্রাণী কয়েক দিন ধরে বেপাত্তা। মানে, ওই নিখোঁজ আর কি"!
—বেপাত্তা! আমি যতদূর জানি কোনও মানুষই তো এদিকে আসেনি। তাহলে! খোঁজ নেওয়া হয়েছে তারা কোন আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গেল কিনা?
—না না সেরকম কিছুই না।
—তাহলে একটা কাজ করা যাক। নিখোঁজ জীবজন্তুদের একটা তালিকা তৈরি করা হোক। এই যে বাদুড় বাবা সারাদিন তো গাছের ডালে উল্টো হয়ে ঝুলেই থাকো। কোন কাজকম্মোই করো না, এবার একটু সোজা চোখে জঙ্গল টাকে দেখতো।
মনের বিরক্তি মুখে প্রকাশ না করে বাদুড় ডানা ঝটপটিয়ে চোখ কচলে সোজা হয়ে বসলো। কাল সারারাত খাবার খুঁজতে খুব পরিশ্রম হয়েছে। সকালে কোথায় একটু ঘুমোবে তা না যত্তসব! এসব কথা তো আর মুখে বলা যায় না অগত্যা! বানর দু লাফে গিয়ে একটা এত্তো বড় একটা তালপাতা পেড়ে নিয়ে এলো। বাদুড় বেচারা তো ভালো করে জানেও না যে কারা কারা নিখোঁজ। সবার দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে চিঁচি করে বলল, "আসলে খুড়োমশাই আমি না ঠিক জানিনা, কারা কারা নিখোঁজ!"
আবার ধমক। তখন ভালুক মশাই হায়নাকে বলল, "এই যে, সারাদিন তো লোকের হাঁড়ির খবর নিয়ে বেড়াও! গ্রামেগঞ্জে হাঁস মুরগি খেতে যাও তুমি জানো কিছু"? হায়নার গাঁইগুঁই শুনে ভালুক আবার গর্জে উঠল–"ভেবেচিন্তে বলো"।
হায়না তখন চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ভেবেচিন্তে বলতে লাগলো, "আমাদের সবার রাজা প্রণম্য সিংহমশাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না নেংটিকেও। সব গর্তে খোঁজা হয়ে গেছে। পক্ষীরাজ ময়ূরকে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়াও আছে, পেঁচক, রাজহাঁস আর সাপ। তারপর, বাদুড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, পেঁচাকে তো তুমিও দেখনি তাইনা বাদুড় দাদা? তোমরা তো রাতে একসাথেই ঘুরে বেড়াও"।
ঝিমুনি কাটিয়ে বাদুড় বলে উঠলো, "ঠিক ঠিক"! ভালুক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই শিয়াল পন্ডিত বলে উঠলো "একটা বিষয়ে লক্ষণীয় যে বছরের একটা বিশেষ সময়ে এই সকল প্রাণীরা অদৃশ্য থাকে।
যাক গে, এখন তো এদের খোঁজ করা হোক।" নিখোঁজ জীবজন্তুদের তালিকা শুনে ভালুক মশাই একটু ভাবলেন, তারপর, আকাশের দিকে তাকালেন। লম্বা নাকটা আরো একটু লম্বা করে বাতাসে কিছু একটা গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করলেন তারপর হাসি হাসি মুখ করে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আকাশের দিকে তাকাও। সবাই অবাক! আকাশের দিকে? ওখানে তো কিছুই নেই! ঘন নীল আকাশে ভেসে বাড়াচ্ছে কিছু সাদা রংয়ের হালকা মেঘ আর বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ। সবাই চোখে একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে ভালুকের দিকে তাকালো। ভালুক মশাই একটু নড়েচড়ে বললেন—
"তাহলে শোনো আমারও এটা জানা ছিল না। মানুষদের সঙ্গে না মিশলে হয়তো জানাও হতো না। এই যে, বর্ষার পর আকাশের কালো রং পাল্টে নীল হয়ে যায় আর তার উপরে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের দল। তখন আমাদের জঙ্গলের পাশ থেকে বয়ে যাওয়া নদীটা, আরে, যেখানে আমরা জল খেতে যাই, সেখানে নদীর পাড়ে প্রচুর পরিমাণে সাদা ফুল ফুটে থাকে। তার নাম কাশফুল।
এগুলো যখন হতে থাকে তখন মানুষেরা তাদের কিছু দেবতাদের পুজো করে আর সেই দেবতাদের বাহন হয়ে তাদের সঙ্গে যায় এই সিংহ, ইদুর, ময়ূর, সাপ, পেঁচারা। আর জানো, এই সময় মানুষেরা যেন মাতাল হয়ে ওঠে। নতুন জামা কাপড়, নতুন জুতো পরে কি আনন্দে ঘুরে বেড়ায়! এই সময় তারা নতুন গান তৈরী করে, নতুন বই লেখে, নতুন ছবি বানায়। কয়েক মাস আগে থেকেই ধুন্ধুমার কান্ড শুরু হয়ে যায়"! সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে আর ভালুক বলতেই থাকে, "কত বড় বড় নকল বাড়ি বানায় সেগুলোকে ওরা বলে প্যান্ডেল। দেখে মনেই হবে না যে সেগুলো নকল। এগুলো বানাতে কত মানুষ কাজে লেগে যায়। সব থেকে বড় কথা কি জানো? মানুষেরা এই যে দেবী দুর্গার পুজো করেন তাকে তারা নিজের মেয়ে মনে করেন। ভাবেন, তাদের মেয়ে বৎসরের শেষে সন্তান-সন্ততি নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে।"
ভালুকের কথা থামতেই চায় না—" ভগবানকে নিজেদের কন্যা মনে করে পূজা করা বোধহয় এই মানুষগুলোই পারে"!
একটা বেশ সুখী পরিবারের ছবি ভেসে ওঠে সবার মনে। ভালুকের কথা শুনতে শুনতে অনেকের চোখের কোল ভিজে উঠল। সন্তানের থেকে দূরে থাকার কষ্ট তো তাদের মধ্যে অনেকেরই আছে।
এই পর্যন্ত বলে ঋক্ষরাজ থামলেন। মানুষদের সঙ্গে বসবাসের ফলে মানুষদের মনের কোমলতার কিছু ছায়া তার মনেও পড়েছিল। আনমনা ভাব কাটিয়ে উঠে তিনি বললেন, "তাহলে এবার পরিষ্কার হলো তো? ওই সকল প্রাণীরা কোথায় গেছে। কয়েকটি দিন অপেক্ষা করো সকলেই সুস্থ শরীরে ফিরে আসবে! তবে একটা কথা, তোমরা মহিষের কথা তো কেউ বললে না! যদিও ও আমাদের জঙ্গলের নয় তবুও বলি, মহিষেরও একটা ভূমিকা আছে। তবে, সে গল্প পরে কোনদিন শোনাবো।"
দাঁতাল শুয়োর একটু হর্তাকর্তা গোছের। ঘোঁত ঘোঁত করে বলল—"আচ্ছা বড়দা, আমাদের এই বন্ধু স্বজনরা যে এত ভালো একটা কাজ করে ফিরছে এদের একটু মালাটালা দেওয়া উচিত নয়"?
ভালুক বললেন, "সারা জীবন একটুও পড়াশোনা তো করলি না, ওটাকে বলে সম্বর্ধনা দেওয়া! হ্যাঁ, তা দিলে আর মন্দ কি! তোমরাই আয়োজন করো। ওরা তো এই ফিরলো বলে"!
ব্যস, আর দেরি কেন! সবাই মিলে বড় বড় উঁচু উঁচু মাটির ঢিবির আসন তৈরি করল কয়েকটা। সবুজ পাতায় মোড়া। সঙ্গে বনফুলের মালা আর খাবার দাবার। তাদের প্রবেশের পথে কোকিল ধরলো গান সঙ্গে গলা মেলালো পাপিয়া। তাদের উপর টুপটাপ ফুল ঝরাচ্ছিল বনের গাছেরা। ঐরাবত এসে শুঁড় উঁচিয়ে মালা তুলে নিল স্বাগত জানাবার জন্য। সকলের হাসিখুশীতে জঙ্গল আবার ভরে উঠল কলকাকলিতে। সবথেকে উঁচু আসনে বসে পশুরাজ সকলের অনুরোধে বলতে শুরু করলেন,
-"সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা..."