দোঁহা

নর্দমা

 


আরাত্রিক ভদ্র 

অতএব সাগ্নিকের আজ ছুটি। সকালবেলায় কোথায় আরেকটু ঘুমিয়ে নেবে, তা না, মা’র প্রবল বকুনিতে তাকে দোকানে যেতেই হবে। এমনই ফরমান! বোধহয় আজ জন্মাষ্টমী বা কিছু একটা, মা পায়েস রান্না করবেন। পায়েস খেতে তার মোটেও ভালো লাগেনা, আর কেনই বা লাগবে? চকোলেটের স্বাদ সেই যে একবার পেয়েছে, তারপর তার মন অন্য কিছুতে যেতেই চায় না। অথচ একবার মামার থেকে চকোলেট চেয়ে কী বিপদেই না পড়তে হয়েছিল বারো বছরের সাগ্নিককে।

“চকোলেট খাবি ভালো কথা, বল তো চকোলেট কেমন করে তৈরি হয়?”

আশ্চর্য! খেতে গেলে যদি উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে হয়, তাহলে তো অর্ধেক জিনিস খাওয়াই চলে না। মামা যদিও ভাগ্নেকে তাঁর আদর্শে প্রেরিত করার তাগিদেই অমনটা করেছিলেন। মামার বক্তব্য, যেকোনো খাবার উৎপাদিত হয় ক্ষেতে, চাষিরা করেন। শ্রমিকরা কারখানাতে সেগুলোকে আরেকটা রূপ দেন-কিন্তু বিজ্ঞাপন এবং প্যাকেজিং এমন এক মায়া বিস্তার করে, যে সমগ্র পরিশ্রমের ছবি মুহূর্তের মধ্যে ঢাকা পড়ে যায়। 

কিন্তু তাই বলে বারো বছরের ছেলে? ক্লাস সিক্স এ পড়ে, প্রচণ্ড শীর্ণকায়। ঈশ্বর তাকে মেদ দেয়নি ঠিকই, কিন্ত বয়সের তুলনায় মেধা দিয়েছিল। আসলে, সাগ্নিকের বড়ো হয়ে ওঠার মধ্যে একমাত্র সম্বল তাঁর মা। মা ইস্কুলে পড়ান। ছোটোবেলা থেকে মায়ের সঙ্গে থেকে থেকে, সাগ্নিকেরও বাইরের জগত সম্পর্কে প্রবল আকর্ষণ। তাই চকোলেটের উৎপত্তি তখন না জানলেও, আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে পরে কোনো অন্তর্জালীয় অনুসন্ধানের মাধ্যমে ঠিক জেনেছে।

তারা মামাবাড়িতে থাকে। এক দাদু, এক অসুস্থ মামী, এক মা আর এক মামা। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র আর্থিক সহায়তা জোগান সাগ্নিকের মা-শোভা। দিনেরবেলায় শিক্ষকতা, সন্ধ্যাবেলায় হোম-ডেলিভারি। শুরুর দিকে তার ভাই শুভই বাড়ি-বাড়ি যেত খাবার দিতে। ইদানিং নির্বাচনের কাজ এসে পরায় সেই কাজে বিঘ্ন ঘটেছে। তবে এই অনলাইনের জুগে কোনও সমস্যা নেই, সব কিছুর সমাধান রয়েছে। অনলাইন আদেশ যোগে বাইক এসে দিব্য খাবার নিয়ে যায়, নিয়ে আসে।

যাইহোক, পুরাণ অনুসারে, দ্বাপর যুগে শ্রী কৃষ্ণ অবতার নিয়ে বৈকুণ্ঠ ধাম থেকে সোজা নরলোকে অবতীর্ণ করেন শ্রীবিষ্ণু। তাঁর আগের অবতারের জন্মস্থান নিয়ে ভারতীয় হিন্দুদের যতো না আবেগ, তার থেকেও দ্বিগুণ আবেগ নিয়ে শোভা কৃষ্ণের জন্মোৎসবে তার জন্য পায়েস রন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। তার জন্য যা প্রয়োজন, সবকিছু একটা সাদা পাতায় লিখে নিয়ে রওনা দিলেন সাগ্নিক। পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, কেন শোভা এটাও তার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আনিয়ে নিলেন না-তার উত্তর শোভাই দিতে পারবেন।

সাগ্নিক তার উদ্দেশ্য সাধনে উদ্যোগী হল। দোকান, বাড়ির থেকে কিছু দুরেই- বেশিক্ষণ লাগার কথা নয়। এখানে একটা মজা আছে। শোভার এতদিন ভয় ছিল, তার প্রাক্তন জীবনসঙ্গী বোধহয় তাদের ওপর নজর রাখছে-যেন জর্জ অর‍্যেলের “বিগ ব্রাদার”! সুযোগ পেলেই তার একমাত্র পুত্র সন্তানকে নিয়ে একেবারে ধাঁ হওয়ার পরিকল্পনা ওই ষড়যন্ত্রীর। আসলে বিচ্ছেদের সময় থেকেই এক ভয়ানক মানসিক ভয়ে তিনি সদাই ভীত। কয়েক দিন আগে এক খবর মারফত তিনি জানতে পারেন এক বাস দুর্ঘটনায় তার পূর্ব-সঙ্গীর মৃত্যু হয়। তিনি ভয় মুক্ত হলেন- অথচ কি কারণে জানি, তিনদিন খুব কেঁদেছিলেন, কারোর সাথে কথা পর্যন্ত বলেন নি। একদিন বোধহয় সব ক্ষমা করে দুঃখে কেঁদেছিলেন, একদিন ভয়ঙ্কর রাগে- তাকে এতো কষ্ট দিয়ে এত সহজে চলে গেল কি করে? শেষ দিন বোধহয় করুণা বা মায়া গোছের একটা আবেগ ছিল।
এই ভয়ের কারণেই এতোদিন একা-একা বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ ছিল সাগ্নিকের। এখন যখন তার জীবনে তাসের দেশের শেষ গানের মতই সমস্ত নিষেধাজ্ঞার বাঁধ ভেঙেছে, তখন বাইরের পৃথিবীকে দেখবার একটা নতুন ইচ্ছে প্রকাশ হয়েছে তার মনের গভীরে। তাই সে কখনই সোজা পথে দোকানে গমন করেনা। আঁকা-বাঁকা পথ ধরে বাঁশির সুরের মতন তার ভ্রমণ। সময়ে বাড়ি ফেরার ভয়ও আছে-তাই অনেকটা সময় অপচয় করলে চলবেনা-দ্রুত তার এই নতুনের প্রতি জিজ্ঞাসার সাথে অভিসার শেষে, লক্ষ্যভেদ করে বাড়ি ফিরতে হবে। 

যে গলি পেরিয়ে রোজ সে দোকানে যায়, সেখানে তিনটি ম্যানহোল বা নর্দমা রয়েছে। সে কখনো আলাদা করে সেগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করেনি। আজ তিনটেই খোলা। নর্দমার ব্যাপারে সে যে কখনো কল্পনা করেনি তা নয়। বৃষ্টির দিনে স্কুলে থেকে ফিরে বহুবার মায়ের আদেশ মাথা পেতে নিতে হয়েছে।

“পা ভালো করে ধো। রাস্তায় জল জমেছিল-সব নর্দমার জল!”

সত্যি অত্যাধিক দুর্গন্ধ। বাঁশি কবিতায় রবীন্দ্রনাথ কিনু গোয়ালার গলির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন বৃষ্টির সময় "গলিটার কোণে কোণে জমে ওঠে, পচে ওঠে আমের খোসা ও আঁটি, কাঁঠালের ভূতি, মাছের কানকো, মরা বেড়ালের ছানা, ছাইপাঁশ আরও কত কি যে!” সাগ্নিক কবিতাটা বোধহয় একবার পড়েছিল- এমনটাই তো তার গলি। “আরও কত কি যে” র মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মতো নন্দনতাত্ত্বিক মানুষ যা এড়িয়ে গিয়েছেন- সেটাই আরও বেশি করে দেখতে পেত সাগ্নিক। তার তালিকা করলে পশু পাখি মানুষের মল মূত্র, কাদা, বমি-আরও কত কি। 

আজকাল মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ে-আজও পড়তে পারে। কিন্তু এত ভাবনা তার মাথা থেকে কোথায় দূরে পালিয়ে গেলো। প্রজাপতি ব্রহ্মার কথায় ভরত মুনি যখন নাট্যশাস্ত্র লেখেন, তখন তাতে স্থায়ী, সঞ্চারি ভাবের সাথে ন-টি রসের কথা বলেছেন। তার মধ্যে বীভৎস রসের উদাহরণ সাগ্নিকের থেকে কেউ ভালো করে দেখিয়েছিল বলে আমার বিশ্বাস হয়না-এমনটা ঘটল এক দৃশ্য দেখে। যেই নর্দমার মধ্যে মানুষের পায়খানা, পেচ্ছাপ, ইঁদুর, ছুঁচো, মাকড়শা, আরশোলার বাস, সেইখানে তিনজন মানুষ নেমেছে? বারো বছর বয়েসে এই প্রথম সে দেখছে এই দৃশ্য-একেবারে প্রথম। সে কল্পনাও করতে পারছেনা এমন টা হতে পারে। সে কার্টুনে, সিনেমায়, ইউটিউবে অনেক কিছু দেখেছে-কত হিরো হাত থেকে মাকড়শার জাল বার করতে পারে, কতো হিরো আকাশে উড়ে বেড়াতে পারে-কিন্তু এমন দৃশ্য সে কোথাও দেখেনি। 

তিনজন রয়েছে-দুজন একটু বড়, আরেকজনের বয়েস হবে পনেরো- সাগ্নিকের থেকে তিন বছরের বড়। তাদের গায়ে জামা নেই, প্যান্টে কাদা লেগে তার নীল রঙ ধুসর হয়ে পড়েছে। একটু ঝুঁকে সাগ্নিক বুঝতে পারলো, একজন ওই নোংরা জলের মধ্যে ডুব দিয়েছে, আরেকজন তার বাঁশের মতো লম্বা লাঠি ধরে তাকে অবলম্বন যোগাচ্ছে-আর এই তৃতীয় ছেলেটি-তার থেকে কিছু বড়, সে নিচ থেকে আসা জমে যাওয়া কাদা জাতীয় কিছু একটা নীল প্লাস্টিকের ভীতর সযত্নে চালান করছে। 

নীল সাগরে ডাইভ করে সাঁতার সে রিলে দেখেছে, সেই স্পষ্ট নীল জল-যেখানে কোনও অস্বচ্ছতা নেই। ঢাকুরিয়ায় স্কুল তার-ফেরার পথে কখনো সাঁতারের জলের ক্লোরিনের গন্ধ তার নাকে ভেসে এসেছে- কিন্তু এমনটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। তার দেখে মনে হচ্ছিল-এ যেনো তার নিজের পায়খানার কমোডের মধ্যে কেউ নেমেছে-অত্যন্ত অসহ্য, দুর্বিষহ গন্ধ- আর ততাধিক বিকৃত কল্পনা ডানা বাঁধল তার মাথার মধ্যে-সে যেন কোনো লুকিয়ে থাকা নরকের দেখা পেয়েছে। তার গা গুলিয়ে উঠল, সে সেখান থেকে দৌড়ে পালাতে চায়। কিন্তু এত কিছু তার মাথার ভীতরে চলছে, সে যেন কিছুতেই সেখান থেকে যেতে পারছেনা। হঠাৎ করে পেটে কেমন একটা করতে আরম্ভ করল। সে বড্ড বেশী ভাবছে ব্যাপারটা নিয়ে।

কাজে মগ্ন থাকা ওই তৃতীয় ছেলেটি হঠাৎ দেখতে পেলো তাকে। ওই গলিতে একমাত্র ওই বুঝতে পারলো সাগ্নিকের অস্বস্তিটা। ছেলেটির নাম গোপাল। কোন দূরে এক গ্রামে তার জন্ম হয়েছিল। তার বাবা তার নাম রাখতে চেয়েছিল 'ভীম', মায়ের আদেশে তার নাম রাখা হয়েছিল 'গোপাল'। বাবা তার মারা গিয়েছে বহুকাল আগে। গ্রামের এক বড় কারুর বাড়ির গোয়ালে সব থেকে বয়স্কা গরু মারা যায়, সেই গোমাতার নশ্বর পার্থিব দেহ বস্তা করে নিয়েই যাচ্ছিল-তার নিষ্পত্তি করার হেতু, কারা যেন তাকে ঘিরে ধরে তার ঘারে গো-হত্যার পাপ চাপিয়ে দিল। গণপ্রহারে তার বাবা মারা যায়। মা তারপর থেকেই নিরুদ্দেশ!

গোপাল তার কাকার বাড়িতে অতি যত্নে বড়ো হয়েছে-স্কুলে গেছে, আনন্দ করেছে, মাঠে বন্ধুদের সাথে খেলে বেড়িয়েছে, গাছে চড়েছে, গান বেঁধেছে-কোন দুঃখ সে পায়নি। নর্দমাটাও তার কাছে এমন ভয়ঙ্কর কিছু নয়-এত খুবই সাধারণ; দৈনন্দিন কর্মযোগ।

গোপাল, সাগ্নিকের কষ্ট দেখে, তার দিকে এগিয়ে যেতেই সাগ্নিক ছুট মারল-কোথায় তার কৃষ্ণ? তার দিকে ধাবমান গোপাল- কৃষ্ণ, কৃষ্ণের পায়েস, মায়ের আদেশ সব কোথায় অদৃশ্য। কি জানি, বোধহয় সাগ্নিক ভেবেছিল, তাকে এসে গোপাল আলিঙ্গন করবে-বা তার গায়ের গন্ধ তাকে সহ্য করতে হবে-সেটা সেই জানতো।

বাড়িতে ফিরেই সে চলে গেলো বাথরুমে। বেসিনের ওপর উপুর হয়ে বমি করল। বাজারের ব্যাগ, ফর্দ বাইরে পড়ে রইল। মা ছুটে এলেন রান্নাঘর থেকে। রোদের মধ্যে কি ছেলের শরীর খারাপ করল? এই কদিন আগে জ্বর থেকে উঠেছে সে। কিন্তু রোদ তো তেমন নেই। আশঙ্কার মধ্যেই, বাথরুম থেকে দৌঁড়ে বেড়িয়ে গেলো ছেলে। সোজা গেলো ঠাকুরঘরে। 
যুগে যুগে মানুষ বিপদে পড়লেই ঈশ্বররে শরণাপন্ন হন। কৃষ্ণের আগে, মৎস, বরাহ, নর-সিংহ, বামন, কচ্ছপ-এমন বহু অবতারে আবিষ্ট হয়েছিলেন নারায়ণ। গীতায় তিনি বলেও ছিলেন, “যখনই মর্তে অধর্ম দেখা দেবে, আমি তখন ই আসব, সাধুদের রক্ষা করবো, দুষ্কৃতের বিনাশ করবো। সাগ্নিক অত জানে কিনা জানিনা, তবে সে এইটুকু ভালো ভাবে জানে, যে বিপদে পড়লে ঠাকুর রক্ষা করবে।
সে হাত জোর করে নমো করল। পিছনে এসে মা দাঁড়িয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন কিছু একটা ঘটেছে, কারণ কিছু ঘটলেই সাগ্নিক ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে এসে এমনটা করে। 

“কিছু হয়েছে রাস্তায়? দোকানে যাসনি? এতক্ষণ কোথায় ছিলি?”

উদ্বেগগ্রস্ত মায়ের প্রশ্নবানের সামনে ভীত সাগ্নিক উত্তরের জায়গায় মায়ের দিকে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।

“রাস্তায় কি দেখেছি জানো মা? ওই নর্দমার ওখানে?”

“কি?”

বহু পুরাণকালে, পঞ্চম বেদ বলে যাকে অনেকে উল্লেখ করেন, সেই বৈদিক সমাজের নাট্যশাস্ত্রের সেই বীভৎস রসের প্রতিচ্ছবি আরও একবার উদ্ভাসিত হল ছোট্ট সাগ্নিকের মুখে। ওই ছোট্ট ছেলে, মায়ের দিকে তাকিয়ে সভয়ে বলে উঠল,

“অসুর”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন