অরূপ চক্রবর্তী
এই সময়ের বিকেল গুলো অন্যরকম হতে শুরু করে।
সবার চোখে পড়ে না সেই বদল।
ছাদে বসার জন্য সখ করে লাগানো কালো পাথরের সিট, জায়গাটায় বসতেই মরা রোদ্দুরের গরম, শরীরের মধ্যে বেশরমের মত লেগে গেল, কিন্তু একটু একটু করে মিলিয়ে গেল শরীরময় সেই রম্য উষ্ণতা।
নড়বড়ে একতলার ছাদে বিছানো থাকত পিচচট পাছে বৃষ্টি ছাদ ফুটো পেয়ে নীচে না হানা দেয়।
সেই একতলা ভেঙে চুরে পড়ে রইল বেশ কয়েকমাস, যা হয়, সুযোগ বুঝে আগাছারাও একটুখানি জায়গায় এসে দাঁড়ায়, তারপর ছড়িয়ে পড়ে পুরো জমির ওপর, দ্রুত গ্রাস করে নেয়, পড়ে থাকা জানলা দরজার আনাচ কানাচ।
একদিন একরাশ শক্ত পোক্ত বেশ কিছু হাঁসি ঠাট্টায় ভরা শ্রমিক এর দল এল, হাতে তাদের ঝুড়ি কোদাল।
কেঁপে উঠল আগাছায় ছেয়ে থাকা চরাচর, প্রায়ই পাশের পুকুরের ডাকপাখি সন্তস্ত্র পায়ে, এদিক ওদিক দেখতে দেখতে টুক করে সে জমিতে ঢুকে পড়ত, ভোর ভোর আর থাকত কয়েক টা শালিক, চড়ুই আর ছটফটে টুনটুনি গুলো।
আজ এদের দেখে কেউ আর আসেনি।
দিন কয়েকের মধ্যে ভাঙা ছাদ, কড়ি বরগা সব সাফ, শুধু মধ্যে এক দুটো গাছকে বাঁচতে দিল ওরা। মুখ টিপে হেসে কাজের মাসি জানাল ওটা যে গাঁজার গাছ, পাকা ছেলে ছবি তুলে গুগুলের কাছে জানতে চেয়ে দেখল, তথ্য সঠিক।
কদিন উত্তেজনা রইল, তবে সে গাছটি ও মুড়ালো, নটের মত অত দ্রুত না হলেও।
একে একে তোলা উঠতে লাগল, নীচের ঘরে, ওপরের ঘরে কমে গেল রোদ্দুর, দূরের ঘোষ বাড়ির পায়রাদের বিকেলের ঘরে ফেরার দৃশ্যটা অদৃশ্য হয়ে গেল চতুর্থ তল নির্মাণের পরে।
এবার আর উঠছে না, সেই গরম ভাপ লাগা সিটে বসে দেখছি, অচেনা কিছু পাখি ফিরে যাচ্ছে, না কি পথ হারাল, কেমন ছটফটে ওড়ার ধরনে মন খারাপ করে।
ধান উঠতে আরো বাকী, রোয়ার পথের শেষ খানে কাশের ফুল এবার তৈরি হচ্ছে, দুবছর আগে ভিনদেশে কাজে গিয়ে আর ফিরতে পারেনি রফিক, ওর বুড়ি মা রাবেয়া বিবি ও চলে গেছে রফিকের খোঁজে গতবছর।
কাশফুলের দল সে খবর রেখেছিল, শূন্য বাড়িতে ওরা এসে ভরিয়েছে এবার।
তখন শিয়ালদহ দিয়ে কাজে যেতাম, বাজনাসহ ঢাকিরা অপেক্ষা করে আছে বায়নার জন্য, কাঁসি বাজানোর জন্য বরাবরের মত বাড়ির বাচ্চাদের আনে এরা।
অমন এক বাচ্চা হাঁ করে নতুন জামা জুতো পরা তারই বয়সের একটি ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখছে অনেকক্ষণ ধরে, তার বাবার কিনে দেওয়া আইসক্রিম মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে, আমার চোখে সেই না আইসক্রিম পাওয়া খালি গা খালি পায়ের ছেলেটির চোখ পড়তেই আমার গা ময় ফোস্কায় ভরে গেল।
বেঁচে থাকা দৃশ্যে পড়ে আছে খানিকটা নারকেল গাছের মাথা, তাতে কিছু টিয়া এসে বসে, মনুয়াদের পোষা টিয়াটাকে টিটকিরি দেয়, সে বেচারার খাঁচা ভাঙার মুরোদ হয় না, শুধু সাড়া দিয়ে জানান দেয় সেও টিয়াই।
এসব এর তলায় তলায় একদিন শরৎ এর আকাশ তৈরি হয়ে বেরিয়ে আসবে তার সাদা ধপধপে মেঘেদের নিয়ে, তলায় সেসব মেঘ পড়ে কাশফুল হয়ে ফুটে উঠবে।
সেই ঢাকীরাও নিশ্চয়ই এতদিনে জামা জুতো পরা বাচ্চা নিয়ে আসবে এবার, সে কম দামী হোক না কেন।
ষষ্ঠীর দিনের সেই মনখারাপের বার্তা এসেছিল আমার কাছে, সেটা এই ঝাপসা বিকেলের শেষে সন্ধ্যা নামার আগে, বহুদিন আগে ট্রেন মিস করে একেবারে একলা, ওভারব্রিজ এর দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছেলেটির দূরে চোখে পড়ে গৃ্হস্থের বাড়িতে তুলসীমঞ্চের প্রদীপ দেওয়া দৃশ্য, তখন তার একাকীত্ব আর নি:সঙ্গতার সাথে তুলনীয় হয়ে তাকে এক রমণীয় কষ্টসুখে তৃপ্ত করে রাখে।
সন্ধ্যা আর অপেক্ষা না করে নেমে আসে। নিশ্চিন্তে সূর্য পৃথিবীর অন্যদিকে উদিত হয়, কালচক্রের আরেকটা অধ্যায় সম্পূর্ণ হয়।
