দোঁহা

নলিনী

 



শিখা নাথ

রাইত তো শ্যাষ হইয়া গেলো গো, তুমার গল্পটা তো
শ্যাষ করলা না। চুপ, চুপ, দেখ চাইয়া গাঙের পাড় দিয়া করা জানি আসতাছে, হারিকেন নিভা।
 আকাশ ভরা পূর্ণিমার চাঁদের আলোর ফোয়ারা, জলের
ছোট ছোট ঢেউ এর মাথায় চিক চিকে হিরে মতি। নৌকোয় বসে আছে, হারান মাঝি আর মুনিবের ছেলে নলিনী। নলিনী শরৎ কবিরাজের প্রথম পক্ষের সন্তান।
জন্মের পরই মা মারা যান। হারান মাঝির নিঃসন্তান বউ দুলি যত্নে নলিনী কে বড়ো করে। আদর করে ডাকে নীলু।
কিছু মানুষের জন্ম হয় যন্ত্রণার সঙ্গে আপোষ করে দিন
পার করার জন্য, নীলু তেমনই একজন। ছোট থেকেই অনেক না বোঝা তাকে বুঝিয়ে ছিলো জীবনের সত্যিকার মানে। নীলু বুঝতনা স্বদেশ, বুঝতনা বিপ্লব, বুঝতনা স্বাধীনতা। গ্রাম্য শিশু বুঝতো সবুজ ক্ষেত,সরষে ফুলের
হলুদ রঙ, প্রজাপতির উড়ে বেড়ানো, পুকুরে জাল ফেললে
মাছেদের পাড়ে তোলার কৌশল, আর দুলি মায়ের আদর।
জল ঢালা ভাত, এক কামড়ে পেঁয়াজ দিয়ে খেয়ে উদর
পূর্তি, কখনো গরম ভাতে হারান মাঝির আনা মাছের ঝোল ভাত। বাবা শরৎ কবিরাজ মাঝে মাঝে নীলুর জন্য
কিছু করার কথা ভাবলেও মুখরা স্ত্রী সুমনার মুখ ঝামটায় কিছু করতে পারতেন না, মনে মনে ভাবতেন
হারাণের কাছে ছেলেটা আছে থাক। হারান কবিরাজ কে নিয়ে নদী পেরিয়ে এ গ্রাম সে গ্রামে নিয়ে যেতো, কবিরাজ
হারানের কাছে ছেলের খবর নিতো, কিছু টাকা দিতো লুকিয়ে। শহরে গেলে হারান যেতো সঙ্গে।

আজ পূর্ণিমা। হারান মাঝি জলে চাঁদের জোৎস্না স্নান দেখাতে নিয়ে এসেছে নীলুকে। ঘাটে নৌকা বাঁধা, দুজনে বসে গল্প করছে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে হঠাৎ বেশ কিছু পায়ের আওয়াজ, দূর থেকে দেখে হারান। রাতের অন্ধকারে কোনো মানুষের দেহ টেনে এনে ভাসিয়ে দেয়
নদীতে, শান্ত জোৎস্না ঘেরা মায়াময় নদী এক ঝলক রক্ত ধুয়ে ডুবিয়ে নিলো নিজের বুকে। ওরা কারা বুঝলোনা
নলিনী। ভয়ে কাঠ হয়ে রইলো কিছুক্ষন। হারান বলে, চল বাপ ঘরে যাই। এহানে থাকা এহন ঠিক না। চারিদিকে
চর টহল মারে ডর লাগে বাপ, কারে ফালায় দিয়া গেলো জানিনা, কারা ফালাইলো তাই বা বুঝুম কেমনে। চল রাইত বাড়ে, পরে একদিন তরে লইয়া আসুম। হারান ভাবে, এমন দিন আইবো কখনো ভাবিনাই, গরীবের
সংসার তাও আনন্দ আছিলো, কি এক কালা সময় আইলো, মাইনসের মনের ভাব পাল্টাইয়া গেলো। যাই
তাড়াতাড়ি ঘরে কি ঘটে এখন বোজন যায়না।

ব্রিটিশ রাজ, চারিদিকে থমথমে আবহাওয়া ভয়ে ভয়ে থাকে মানুষ, চারিদিকে গুপ্ত মিটিংয়ের খবর হাওয়ায় ভাসছে। নেতারা মিটিং করছেন। গুপ্ত সভার নির্দেশ মেনে চলত বিপ্লবীরা। প্রতিটি রাত ছিলো নির্ঘুম।
শরৎ কবিরাজের দ্বিতীয় পক্ষ নীলুকে ভালো চোখে দেখেনা। ফাই ফরমাস খাটানো কাজে ভুল হলে না খেতে দেওয়া এসব তো ছিলোই। নীলুর বয়স যখন আট, পাশের বাড়ির বিপিন নীলু কে দিয়ে একটা চিঠি পাঠায় সুবলের কাছে গুপ্ত মিটিংয়ের খবর দিয়ে। ছোট্ট নীলু খাল পার দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে চলেছে গান গাইছে আপন মনে। রাস্তায় দেখা হারাধন নায়েবের সাথে
-ও বাবা নীলু যাও কই। হাতে ওইডা কি? কার কাছে যাও বাপ।
-চিঠি চিঠি,
-দেখাও বাবা আমার দাও।
-না না এই চিডি  তুমার না গো জ্যাঠা, যার চিডি তারেই দিতে হইবো।
-কেডা দিছেরে বাপ, পোলাপান মানুষ তুমি, বুঝবানা চারিদিকে গণ্ডগোল দেখাও আমায়।
-সহজ শিশুর হাত থেকে চিঠি কেড়ে নিতে সময় লাগলোনা হারাধনের।
-তুমি ঘরে যাও বাপ একা বাইর হইয়ো না। তোমার বাপের কাছে যামু আমি।

হারাধনের নিজের মনে গজরাতে গজরাতে চলে,
শরৎ ডা এক্কেরে ভেরুয়া, নীলুডারে দেখেনা। আইজ এক ডা হেস্ত ন্যস্ত করা লাগবো। এখন তো যাই চিডি খান থানায় পৌঁছায় দিয়া আসি। বিপ্লবী হওয়া বাইর করতাসি।

সন্ধ্যায় আসে হারাধন, হাঁক দেয়-শরৎ আছস ঘরে? বাইর হ। তোর লগে কথা আছে।
শরৎ কবিরাজ ঘর থেকেই বলেন আসেন দাদা ঘরে আসেন।
না বসুম না বুঝসই তো দ্যেশের পরিস্থিতি ভালো না তোকে কয়ডা কথা একটু জানায়ে যাই। ছেলে ডারে একটু দেখ
পোলাপান মানুষ ওকে দিয়া বিপ্লবীরা চিডি আদান প্রদান করে, কোনদিন বিপদ হইবো তগো সে খেয়াল রাখিস।
যত্ন যা করে তা হারান। তুই ওর বাপ, ওরে দেখবিনা?
তুই কি মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়া বৌমার সেবা করিস।
সতীন পুত, তাকে বৌমার দেহা উচিত না। টেহা পয়সা তো কম নাই। বিচার বুদ্ধি খোয়াই লি কেমনে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে শরৎ কবিরাজ।

আড়াল থেকে শোনে সুমনা, ঘুমন্ত ছেলেকে টেনে তুলে মারতে মারতে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। সুমনা এমনটাই সুযোগ খুঁজছিলো। আজ সে সফল। দুলি সুমনার রান্নাঘর সামলায়। রান্না করে খাবার গুছিয়ে রেখে ঘুমন্ত নীলু কে খাইয়ে বাড়ি ফেরে। যা রান্না হয় তার থেকে দুলিও ভাগ পায়, তাই দিয়ে ওদের দুটো পেট চলে যায়। সব শুনতে পেয়ে ছুটে আসে দুলি, নীলু কে জড়িয়ে ধরে।

-কেন মারেন দিদি। ও কি বোঝে, ভালো মন্দ। ছোডো মুখে বড়ো কথা দিদি উপরতলার মাইনসে নরম বিছানায় শুইয়া স্বপন দেহে, টেহার। ভুইলা যায় স্নেহের টান কার কয়। ভুইলা যায় ভালোবাসা। দুই চোখ ভর্তি অহংকার।
এই টুক বাচ্ছা, কি বুঝে হেই সবের।

-অতই যদি নিয়া যাও না রাখো নিজের কাছে, নিজে তো বাঁজা, সন্তানের তো মুখ দেখলানা, অত বড়ো বড়ো
কথা কইও না।

-দিদি সময় তুমারও যায় নাই। দুই বছর হইয়া গেলো
তুমি এহনও মা হও নাই। ঈশ্বর আছেন, বিচার তাঁর হাতে।

শরৎ চিৎকার করে বলেন,

থাম তুমরা।

-বৌ নীলুরে লইয়া যাও।
-হারান নীলুর সব দায়িত্ব তরে দিলাম তুই আর বউ ওর দেখা শোনা করিস।

ঘুম চোখে কাঁদতে কাঁদতে দুলির সাথে হারানের ঘরে পাকাপাকি ভাবে চলে আসে নীলু। সেই রাতেই। যত্নে
বুকে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে ঘুমায় দুলি।

দেখতে দেখতে নীলু বড়ো হতে থাকে।গ্রামের রতন মাস্টারের পাঠশালায় ভর্তি করে দেয় হারান, বড়ো মানুষের
ছেলে পড়াশুনা না করলে চলবে কেনো। নীলু অত্যন্ত মেধাবী। পাঠশালার পাঠ শেষ করে নীলু। রতন মাস্টার গ্রামের হাই স্কুলে ভর্তি হবার জন্য, প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি চক্রবর্তীর কাছে নিয়ে যান। শ্যামল বাবু রতন মাস্টারের বাল্য বন্ধু, স্কুলে ভর্তি হতে বেশি বেগ পেতে হয়নি নীলুর। কিন্তু এতো দূরে রোজ যাতায়াত করা মুস্কিল। ওই গ্রামেই শরৎ কবিরাজের বোন রমার শ্বশুর বাড়ি বেশ সচ্ছ্বল অবস্থা। সে কথা মনে হতেই নীলু কে নিয়ে যায় হারান। রমার নীলুকে থাকতে দিতে আপত্তি।  ছোট বয়সে যে ছেলে বিপ্লবীদের চিঠি চালা চালি করে সে এখন যে করবেনা এমন ভাবনা তাকে চালিত করছিলো। রমার ছেলে নীলুর বয়সী। সেও ওই স্কুলে পড়ে। হারান কিছু না বলে ফেরত আসে পাঠশালার রতন মাস্টারের কাছে। রতন সব শোনে। মনেমনে ভাবে নীলুর কি ব্যবস্থা করবে সে? পড়া বন্ধ হয়ে যাবে?  রতন মাস্টার, পরদিন সকালে নীলু ও হারান কে  সঙ্গে নিয়ে শ্যামলের কাছে যায়। ঘটনা সবিস্তারে জানায়, শ্যামল তার বাড়িতেই নীলুকে থাকতে দেয়। নীলু শান্ত স্বভাবের। হারান ও রতন মাস্টার ফিরে আসে গ্রামে। পরদিন কবিরাজ কে নিয়ে বুড়ি গঙ্গার ওপাড়ে যায় হারান। কলেরায় মরক লেগেছে। যেতে যেতে হারান নীলুর স্কুল ভর্তির কথা জানায়। শরৎ মাথা নেড়ে সায় দেয়। শরৎ বলে, বাপ হইয়া কিছুই করতে পারলাম না, তুই অরে দেখিস হারান। তুই ওর বাপ।

শ্যামল মাস্টার অকৃতদার। মা, আর বাল্য বিধবা  চোদ্দো বছরের বোন মিনু কে নিয়ে সংসার। স্কুলের পর গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছেলে পড়ান বিনা পয়সায়, তাতেও ছেলে মেয়ে তেমন আসেনা, নীলু থাকবে জেনে তাঁর মনে কিছুটা আশা জাগে, ভাবেন এই ছেলেটিকে দিয়ে গ্রামের উন্নতির কাজ করানো যাবে। মায়ের কাজেও লাগবে, হারান নীলুকে রান্না করার সামান্য জিনিস দিয়ে যায়।
নীলুর সহপাঠী রমেশ, ফরিদ, রফিক অনির্বাণ, মলয় মাঝে মাঝে আসে, এই ভাবেই চলছিলো। ফরিদের আম্মা, নীলুকে ডেকে খাওয়ান।
 
ভেতরে ভেতরে বিপ্লব, একদিকে কলেরা, অন্য দিকে দুর্ভিক্ষ, সব নিয়ে নৈরাশ্যের জীবন, শ্যামল স্যার বেশ
কিছুদিন যাবৎ ঘরে আসছেন না, বিধবা বোন মিনু নীলুর দরজায় এসে দাঁড়ায়,
-চাল আছে আপনার? একটু দিবেন? মা পাঠাইলেন। দাদায় কতদিন হইলো বাড়ি নাই, ঘরে কিছু নাই, বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
নীলুর যেটুকু চাল ছিলো দিয়ে দিলো, -বোন ঘরে আর কিছু নাই, এইটুক তুমি নাও।
-আপনে কি খাইবেন সব দিয়া দিলেন।
-নীলু হাসলো,
একটু পরে মিনু এসে জানায়, আপনি আমগো লগে ফ্যান ভাত খাইবেন? মা আপনেরে ডাকছেন।

নীলু একটু অপেক্ষা করে ভেতরে যায়।

মাসিমা আমি নীলু,
-আসো বাবা, মিনু  আসন পাত, জল দে,
-মা আপনেরা খান, আমি আইজ বাড়ি যামু দেখি যদি কিছু পাই,

-তুমি না খাইয়া থাকবা, আমরা খামু, হেইডা হয়না বাপ।

-কাল কি হইবো জানিনা, আইজ তোমার দয়ায় দুইটা খাইতে পারতাসি।
খাওয়া শেষ  করে নীলু গ্রামে ফেরার কথা ভাবে।
যদি কিছু জোগাড় করতে পারে এনে দেবে শ্যামল স্যারের
মাকে।

-মাসিমা আমি গ্রামে যামু, মাস্টার বাবু আইলে কইয়া দিবেন।

এতো রোদ বাবা ছাতা আছে? সাবধানে যাইও।

নীলু বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। পথে দেখা ফরিদের সাথে,

-কৈ যাস রে?
-বাড়ি, স্কুল তো হয় না, কি করুম ক, চারিদিকে যা অবস্থা, দেখি গিয়া ঘরে সবাই কেমন আছে।
ফরিদ আরো খানিক পথ নীলুর সাথে আসে।
-শোন নীলু রাতে বাইর হইস না, চারিদিকে ফেউ ঘুরতাছে

-যাই আমি,
-সাবধানে যাস।

নীলু গ্রামে ফিরে দেখে সে খানেও হা হা কার। শরৎ কবিরাজ অসুস্থ, হারান সেবা করে, দুলি কবিরাজের ঘরের কাজ  সামলায়। গ্রামে মড়ক লাগার ভয়ে অসুস্থ শরৎ কে ফেলে সুমনা বাপের বাড়ি মাগুরায় চলে যায়,
বাপের অবস্থা ভালো। সংসারে এমন নিদর্শন খুব কমই পাওয়া যায়।

নীলু বাড়ি ফেরাতে, শরৎ বাবুও নিশ্চিন্ত।ঘরে ঘরে মৃত্যুর হা হা কার। দারিদ্র, অনাহার, সহ্য করা যায় না।
তারই মধ্যে নীলুর মন পরে আছে শ্যামল মাস্টারের বাড়িতে, ওদের সংসার কি ভাবে চলবে, অল্প বয়সী
মিনু পূর্ণ যৌবনা, গ্রামের মুরব্বির নজর আছে। নীলু ভয় পায়, নীলু  দুলি কে বলে,
-মা, মাস্টার বাবুর বাড়ির খুব খারাপ অবস্থা, মাস্টার বাবু, ঘরে নাই আইজ বহুদিন, আমারে কিছু চাল আর
আনাজ দিবা আমি লইয়া যামু দিয়াই আবার গেরামে ফিরুম দাও না মা,

-বাপ তুমি যে লইবা, রাস্তায় কেউ দেখলে তোমারে মাইরা লুট কইরা লইয়া যাইবো,

-না মা সাবধানে যামু তুমি দাও আমারে।

সামান্য কিছু চাল আনাজ এই নিয়ে রওয়ানা হলো নীলু
প্রায় সন্ধ্যা হয় হয় গিয়ে পৌঁছয়, মাস্টারের বাড়ি।

খুব লাজুক নীলু ঘরের দরজায় এসে ডাকে,

-মাসিমা সামান্য কিছু আনাজ আর চাল আনছি। রাখেন।

শ্যামল মাস্টারের মা কাপড়ের খুঁটে চোখ মোছেন।
সেই রাতেই ফেরেন শ্যামল মাস্টার, নীলুকে ডেকে বিপ্লবীদের পাঠ পড়াতে থাকেন নীলুকেও সঙ্গে নিতে চান।
নীলু মাথা নিচু করে বলে,

-ক্ষমা করবেন স্যার আপনের মা বইন কষ্টে আছেন। ওনাদের সাথে থাকলে কিছু খাবার,প্রয়োজনীয় জিনিস
পত্র জোগাড় দিতে চেষ্টা করুম।
-আচ্ছা তুমি তাগো দেইখ্য।

রাতের অন্ধকারে আবার ফিরে যায় মাস্টার। দেশ ভাগের নামে ব্রিটিশ চাল দেয়, হিন্দু মুসলিম ভেদ এক সাথে থাকার আনন্দের দিন শেষ, গ্রামে গ্রামে সন্ধেহ
গুপ্ত হত্যা, এক নিশুতি রাতে আবার আসে মাস্টার। ইংরেজের তাড়া
খেয়ে। সবাই তখন ঘুমিয়ে খুব ধীরে দরজায় টোকা,
 নীলু দরজা খোলে ভয়ে, মাস্টার খানিক দম নিয়ে বলে
-সাবধান, বোনরে দেখিস,
কিছু চাল, ডাল সবজি রেখে, মাস্টার মায়ের সাথে দেখা করে রাতেই বেরিয়ে পড়ে।
দু একজন করে গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে নিরুদ্দেশের পথে, রায়ট লেগেছে। দেশ ভাগ হবে, হিন্দু, মুসলমান একে অপরের ওপরে চড়াও, মাস্টার যাওয়ার দুদিন পর মাঝ রাতে দরজায় ধাক্কা।

-দরজা খোল, বাঁচতে চাইলে দরজা খোল, হেই মাস্টারের মা মিনুরে বাইর কইরা দে। মুরুব্বী নিয়া যাইতে কইছেন,
মিনু মাকে জড়িয়ে ধরে, এবার ধাক্কা নয় দরজায় সজোরে
লাথি, হালকা দরজা ভেঙে পরে। মায়ের হাত ছাড়িয়ে মিনুকে টান মেরে নিয়ে যায়, নীলু লাঠি হাতে বেরোলেও
সেই লাঠির ঘায়ে নীলুকে মেরে মাথা ফাটিয়ে শাসিয়ে যায়, সাবধান তোরও সমন আসতাছে।
মুরুব্বীর দাওয়ায় মিনু। হেই বেডি, ক তোর দাদা মাস্টার কোথায়?
-জানিনা
-জানিনা মানে ডা কি? আইছিল তো, কয় নাই?
-না
প্রবল জোরে এক থাপ্পর মারে সালেম মিঞা। হতো ভাগী ভালো চাস তো এখনও ক, নইলে তোর দেহটা কুত্তারে খাওইমু, পারভিন বিবি এসে মিনুকে বাঁচায়।

কি হইতাসে কি, ও কি কইরা জানবো, কেন আনছ ওরে ধইরা। ভোগের বাসনা এহনো কমে নাই। খবরদার
ওর গায়ে হাত দিয়া দেখ, আমার মত শত্রু তুমি জীবনে দেখনাই।
-তুমি ভিতরে যাও। বাইর হইছো ক্যান।
-চুপ যাও তুমি, গুনাহ কোরো, এতটুকু ডর নাই তুমার।
-চল মিনু ঘরে চল।
পারভিন ঘরে নিয়ে গিয়ে বসান।

বামুন ঘরের বিধবা সেই অন্ধকার রাতে ঈশ্বর পারভিনের রূপ ধরে এসে বাঁচালেন।
-পারভিন আপা বাঁচাও আমারে, মিনু কেঁদে ওঠে। পারভিন বলে
ভয় পাসনা, সেই ছোডো বেলা থিক্যা দেহছি তোরে। বিয়া হইয়াও ঘর করতে পারলিনা কলেরায় বর মরলো কান্দিস না আমি আছি।
পারভিন খেতে দিলো, পাশের ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলো, কিন্তু মিনু বাঁচল না। ঘুম হীন রাত মিনু জেগে বসে রইলো। পারভিন যখন ঘুমিয়ে, মুখ হাত বেঁধে টেনে নিয়ে গেল জঙ্গলে মুরুব্বীর পোষা কুকুর গুলো, দেহটাকে ছিন্ন ভিন্ন করে খেয়ে ফেলে দিল বুড়ি গঙ্গায়। রাত না পোয়াতে মিনুর উলংগ শরীর টা জলে ভেসে উঠলো। মা সহ্য করতে পারলেন না, বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন।
এদিকে দলে দলে নিরন্ন মানুষ সহায় সম্বল ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েছে অনির্দিষ্ট যাত্রায়। নীলুও আর
দেরী করলো না। দুলি মা হারান মাঝি, বাবা, শরৎ কবিরাজ সবাইকে ছেড়ে, মাস্টারের মা কে নিয়ে এক কাপড়ে সন্ধ্যে নাগাদ বেরিয়ে পড়ল। যাবার পথে ফরিদের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো এক মুহূর্ত, মনে পড়লো ফরিদের আম্মার মুখ
কতো আদর করতেন। বাড়ির খবর নিতেন, দেখা না করেই চলে যাবে? আর তো কখনো দেখা হবেনা। দুলি মা, হারান মাঝির জন্য মনটা খুব খারাপ। আর দেখা হলোনা।
ফরিদের এক কাকা থাকে, ওদের গ্রামেই, হারান মাঝির বন্ধু। নীলু দুলি মার কাছে চিঠি লেখে।

শ্রী চরণেষু,
                 মা
তুমি হারান মাঝি প্রণাম নিও, বাবাকে প্রণাম জানিও।
তোমাদের সাথে আর আমার দেখা করা হলোনা, আমি খুবই বিপদের মধ্যে পড়ে দেশ ছাড়ছি, কোথায় যাবো জানিনা, সঙ্গে মাস্টার বাবুর মা আছেন, মাস্টার বাবুর বোন কে মেরে ফেলেছে, আমায় আশীর্বাদ করো মা গো।
জানিনা, দেশ ভাগ হলে কি ফেরা যাবে? সাবধানে থেকো।
                                                      ইতি                                               তোমার নীলু।

মনে মনে ভেবেই ছিলো যদি ফরিদ এই চিঠিটা একটু পৌঁছে দেয় হারান মাঝি কে।ধীরে ধীরে ফরিদের বাড়ির দিকে এগোয় নীলু। দরজায় গিয়ে হালকা টোকা দেয়,
-ফরিদ,  আমি নীলু, একটু দরজা খোল ভাই। ফরিদ ভয় পায় দরজা খুলতে,
-না ভাই দরোজা খুলুম না, তুই আমার বন্ধু ঠিকই কিন্তু তোর পিছনে ফেউ নাই বুঝুম কেমনে। না ভাই মাপ কর।
আমি দরজা খুলুম না।
-আমি যাই ভাই আর কখনো দেখা হইবনা। একবার দরজাটা খোল, ভয় নাই, আমি আর মাস্টারমশাই এর মা।
চাচীরে প্রণাম কইরা যাই। আর কুনো দিন দেখা হইবো না।
-আমারে ভুল বুঝিস না  সাবধানে যা যেখানেই থাকিস
ভালো থাকিস ভাই। দেরী করিস না। রওয়ানা দে দরওয়াজা খুলতে পারুম না।
ভেতর থেকে সব কথা শোনে ফরিদের আম্মা আমিনা,
ঘর থেকে কিছু মুড়ি, আর গুড় আনে, ফরিদ কে বলে
-সর তুই যা হয় হউক, আমি ওর লগে দেখা করুম।
-বাপ একটু খাড়া,
ফরিদ কে ঠেলে সরিয়ে দরজা খোলেন, আমিনা বিবি।
নীলু প্রণাম করে, বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে
ওঠেন আমিনা। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হাতে দেয় ছোট্ট ঝোলা,
-অল্প মুড়ি আর গুড় আছে খাইও বাপ। যেখানেই থাকো ভালো থাইক্কো। হায় হায় রে আল্লা। এ কেমন দিন দ্যাখলাম। দোয়া মাঙি ওদের জানি বিপদ নাহয়।
আর দেরি করিস না, যা বাপ রওয়ানা দে, কোন শত্রু খাড়া আছে কে জানে।
-চাচী আমার এই চিডি খান ফরিদের চাচার বাড়ি যদি কোনো সময় যান আমার দুলি মায়েরে একটু দিয়া দিবেন।
-আচ্ছা দিমুনে, আর এহানে থাইক্য না, রওয়ানা দাও।

চোখের জল মুছতে মুছতে মাটি কে কপালে ছুঁয়ে অনির্দিষ্ট পথে চলতে থাকে নীলু, আর মাস্টারের মা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন