দোঁহা

সংকটে আত্মপরিচয়




মালবিকা মিত্র
 

রোমের ট্রেভি ফাউন্টেইন, ইটালিয়ান ভাষায় ফন্টানা ডি ট্রেভি। ১৭৩২-১৭৬২, দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে নির্মিত। নিকোলা সালভি ছিলেন এর প্রধান নকশা নির্মাতা। ৮৬ ফুট উঁচু ও ১৩১ফুট ব্যাস যুক্ত ঝরণা ধারা। এটি ইটালির বৃহত্তম ও বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত। হাজার হাজার পর্যটক জড়ো হয়। একাধিক ফটোগ্রাফার কিছু ফুল সমেত ব্যস্ত পায়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। নব্য প্রেমিক যুগল থেকে শুরু করে বৃদ্ধ দম্পতি এখানে এসে ছবি তোলে, পরস্পর পুষ্প অর্পনের ছবি । ছবির ব্যাক গ্রাউন্ডে থাকবে সুপ্রশস্ত ফন্টানা ডি ট্রেভি।

ভদ্র পরিশীলিত মার্জিত লোকজনের ভিড়ে কোথাও বুঝি ছন্দ পতনের শব্দ। বয়স্ক এক দম্পতির অনুমতি ছাড়াই এক ফটোগ্রাফার তাদের হাতে ফুল ধরিয়ে ছবি তুলে এবার টাকা চাইছে।
-"আমি তো ছবি তুলতে বলিনি। তুমি কেন তুললে?" দম্পতির যুক্তি।
-"এখানে সবাই এই ছবি তুলে নিয়ে যায়। এটাই রেওয়াজ।" ফটোগ্রাফারের আত্মপক্ষ সমর্থন।

আসলে অতিরিক্ত সমস্যা হলো ভাষা সমস্যা। কে বুঝবে কার কথা। বেগতিক বুঝে আমি দোভাষী হিসেবে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে গেলাম। এই সুযোগে বলে রাখি, আমি ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্কলারশিপ নিয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে এসেছি। তদুপরি ফটোগ্রাফার কাম ফুল বিক্রেতাকে নির্ভেজাল বাঙাল বলেই বুঝতে পারলাম। আর ওই দম্পতি ডাচ। ডাচ ভাষায় আমি মোটামুটি কাজ চালিয়ে নিতে পারি। হল্যান্ডে গ্রনিংগেন ইউনিভার্সিটিতে আমি বেশ কিছু দিন কাটিয়েছি। আশ্চর্যজনক ভাবে দেখলাম, ডাচ ভাষায় ওই দম্পতিকে থামতে বলে আমি যেই বাঙাল উচ্চারণে ফটোগ্রাফারকে সম্বোধন করলাম "ভাইডি, ব্যবসা করতে আইছেন, মাথা খান ঠান্ডা রাখোন লাগবো তো?" ব্যাস, ধাঁআআ। ফটোগ্রাফার পয়সা কড়ি না নিয়ে পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়লো। আমি আমার স্বজন কাঠ বাঙাল পেয়ে কোথায় একটু মনের সুখে গল্প করে নেবো, সেই সুযোগ হাতছাড়া। "ভাইডি শোনেন শোনেন খাড়ান, আমি আপনের স্বজাতি, বাঙ্গাল, দ্যাশ ফরিদপুর।" ভাইডি আর ত্রি সীমানায় নাই। এই ঘটনা কাঁটার মতো ফুটতে থাকলো। প্রবাসে দৈবের বশে স্বভাষী মেলে। সে কেন আমাকে দেখে মুখ ফেরালো। বলা যায় পালিয়ে বাঁচলো। এই অপমান হজম করা সহজ নয়।

বিদেশে থাকলে বন্ধু মিত্রের ধারণা পাল্টে যায়। "বিনা স্বদেশী ভাষা মেটে কি আশা" কথাটার যথার্থ উপলব্ধি বিদেশেই সম্ভব। সেই সাথে দ্বিতীয় সত্য জানা "বিনা স্বদেশী খানা মন ভরে না"। তবে স্বদেশী শব্দটি আর আক্ষরিক থাকে না। বাঙালির দেখা মিললে সর্বোত্তম। হিন্দিভাষী, পাঞ্জাবী এমনকি পাকিস্তানি কেও মনে হয় স্বদেশী। ভাষায় ওখাদ্যে নিকটজন। বাংলাদেশ হলে তো কথাই নেই। গ্যাটিংগেনে পড়তে এসে আমার এমনই নিকটজন, পাকিস্তানি মোস্তাক আফ্রিদি। ওর সাথে আলাপ হবার আগে জাতি হিসেবে আফ্রিদি ইউসুফজাই নাম শুনেছি মাত্র, যোদ্ধা জাতি। ও হ্যাঁ, শাহিদ আফ্রিদির নাম শুনেছি ক্রিকেটার হিসেবে, ব্যাটে বলে দক্ষ।

ওকে দেখে যোদ্ধা জাতি হাসবে। সুন্দর লম্বা ছিপছিপে গড়ন। একটা পিঁপড়ে মারতেও কষ্ট পায়। বলে আমি তো স্রষ্টা নই, আল্লাহ হলেন স্রষ্টা। তাহলে আমার কোনো অধিকার নেই কোনও সৃষ্টি বিনাশ করার। "কিসিকো কোই হক নেহি এক ভি জান কো ছিন লেনে কা" যোদ্ধা জাতি একথা শুনলে হাসবে না? সব আফ্রিদি ক্রিকেট খেলবে, আফ্রিদি হলেই যুদ্ধ করবে এরকমই তোমরা ভাবো, তাইনা? মোস্তাক বলে আর হাসে। ওর কাছে শুনলাম কতো কথা। আইয়ুব আফ্রিদি, মাদক সম্রাট ও আফগানিস্তান হেরোইন ব‍্যবসার প্রতিষ্ঠাতা আন্ডার ওয়ার্ল্ড বস্। রিয়াজ আফ্রিদি, পাকিস্তান জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ক্রিকেটার, এছাড়াও উমর গুল, শাহিদ আফ্রিদির নাম সকলের জানা। এগুলোর সাথে আফ্রিদি মানানসই তাইনা?

এরপর মোস্তাক শোনালো, কবি খাতির আফ্রিদির নাম। অসংখ্য প্রেমের কবিতার স্রষ্টা। দশ বছর টিবি রোগে ভুগছিলেন, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মারা যান। পাশতুন কবি, পাশতুন ভাষায় গজলের স্রষ্টা।

"যে মানুষটা কথার ছলে
মান অভিমান জেনে নিতো রোজ।
তাকে কখনো যায়না ভোলা
হারিয়ে সাকিন আজ সে নিখোঁজ।"

আমি এই দুই পঙক্তি শুনে অভিভূত। এতো নিছক প্রেমের কাব্য নয়। বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবারে উপেক্ষিত সেই চরিত্র। যার একমাত্র সমব্যথী বাল্যবিধবা ঠাকুমার মৃত্যু যন্ত্রনা। বুঝি বা ইন্দির ঠাকুরনের মৃত্যুর পর দুর্গার এমনই সকরুণ আর্তি। মন ছূঁয়ে গেলো। শুনলাম এমনই প্রেমের কবিতা কিন্তু বিষাদ ময় আরও দুই পঙক্তি-

"ভেবে বলো দেখি,
আমি এই দুনিয়ায়
যদি কোনোখানে না থাকি
কার কিবা আসে যায়?"

সময় সুযোগ পেলেই মোস্তাক শোনাতো। একটি স্কুলে বাগানের মালির কাজ করতেন। কোনো দিন স্কুলে পড়াশোনা করেন নি। প্রথম জীবনে কিছু অসাধারণ গান রচনা করেন ও খ্যাতি অর্জন করেন। এরপরে তিনি পোয়েট্রি সোসাইটির সদস্য হয়ে হামজা শিনোয়ারি ও নাজির শিনোয়ারির সাহচর্যে আসেন। এরা দুজনেই পাশতুন কবিতার প্রাণপুরুষ। এরপর খাতির আফ্রিদি অসংখ্য স্মরনীয় গজল রচনা করেন। হামজা শিনোয়ারি তার গজলের পরম ভক্ত ছিলেন। কবির একমাত্র সন্তান ও এক সম্পর্কিত ভাই তার দুর্লভ সৃষ্টি একত্রিত করে সংকলিত করে।

মোস্তাকের সাথে বন্ধুত্বের শুরুটাও তো কম আকর্ষণীয় নয়। সেটা ছিল ২০১২ সাল। হঠাৎই মোস্তাক আমাকে ডেকে নিয়ে বললো,
"আরে ইয়ার, ইঁয়হা তো জার্মানি মে কোই কিরকেট নেহি পহচানতা, কোই তো চাহিয়ে দিল কি বাত শেয়ার করনা। টুডে সিক্সটিনথ্ মার্চ! ঢাকা মে এশিয়া কাপ কা বড়িয়া ধামাকা, আজ তেন্ডুলকর কা হান্ড্রেডথ সেঞ্চুরি করনে কা গ্রেট মওকা! বইঠ না ইয়ার ইধর, থোরি সি বাত কর না শেয়ার।" আমি বিস্ময়ে হতবাক। আমি মনেই রাখিনা শচীন তেন্ডুলকরের খবর, ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের খবর। আর খোদ পাকিস্তানি সে খবর রাখে। এটাই ছিল হৃদ্যতার শুরুয়াৎ। এরপর মাঝে মাঝেই আমাদের বাটি চালাচালি চলতো। আমার রান্না ওর কাছে স্বদেশী, ওর রান্নাও আমার কাছে ঘরোয়া। খাদ্যে, ভাষায়, ভালোবাসায় ঘনিষ্ঠতা বেড়ে চললো।

ইউনিভার্সিটি প্রায় মাসখানেক ছুটি। অতএব মনে দ্বিধা কিন্তু যদি ঝেড়ে ফেলে আমি আমার X-Calibre 8 বাইসাইকেল নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লাম। মোস্তাক বললো, "আরে দোস্ত, হামে ভি সাথ বুলা লে, হাম ভি হ্যায় আকেলে। দেশওয়ালী নেহি, পড়োশী তো হ্যায় জরুর"। অতএব সঙ্গী জুটে গেল। দুজনেই দুটি বাইসাইকেল চেপে ইউরোপ ঘুরতে বেড়িয়ে পড়লাম। এই সুদীর্ঘ সময়ে কতোনা অন্তরঙ্গতা, ভাব ভাবনার বিনিময়।

প্যারিসে ৮.২ হেক্টর জমিতে বৃটিশ কায়দায় নির্মিত পার্ক মঁসিউ। ছোটোদের খেলার সামগ্রী, তার সাথে বিখ্যাত ব্যক্তিদের ব্রোঞ্জ ও মার্বেল পাথরের মূর্তি বিখ্যাত ভাস্কর নির্মিত, চিনা দূর্গের নকল, করিন্থিয়ান স্তম্ভের নকল, ডাচ উইন্ডমিলের নকল ইত্যাদি নানাবিধ সুদৃশ্য উপকরনে পার্কটি সুসজ্জিত। সেখানে অ্যামব্রোস থমাসের মূর্তির পাদদেশে শ্বেত শুভ্র জ্যোৎস্নালোকে মোস্তাক আর আমি বিনিদ্র রজনী আড্ডা। এই অ্যামব্রোস থমাস ছিলেন কনজারভেটরি ডি প্যারিস এর মিউজিকের ছাত্র। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ মিউজিক পুরস্কার প্রিঁ ডি রোম লাভ করেন। ১৮৩৭ সালে তিনি তার প্রথম অপেরা কম্পোজ করেন La double échelle, এই স্মরনীয় মুহূর্তে আমরা পাশাপাশি শুয়ে দুই প্রতিবেশী শত্রু দেশের যুবক। মোস্তাক বলে তোমার দেশের মানুষ ভাবে পাকিস্তানের মানুষ রাঁধে না, খায় না, ঘুমায় না। ভারতের দিকে বন্দুক তাক করে বসে থাকে। তারা হাসে না, কাঁদে না, ভালোবাসে না, কেবলই জেহাদি উল্লাস করে। আমাদের দেশেও ভারত সম্পর্কে এমনই কথা ভাবে। বলা ভালো ভাবানো হয়। বিদেশে এসে আমাদের দুজনেরই পছন্দ বাংলাদেশী রেস্তোরাঁ। অথচ বাংলাদেশ হলো পাকিস্তানের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ।

গোটা ভ্যাকেশন চড়কি পাক খেয়েছিলাম ইউরোপের আনাচ কানাচ, দিবা রাত্রি নিদ্রা হীন। পরম বিস্ময় আর আনন্দ ফূর্তি অপার। তবু কি এক অভাব বোধ হয়। কিসের অভাবে সব বিস্বাদ রসহীন মরুময়। দিন কয় পরে, রোমে, ভাবনা চিন্তা না করেই ভুলক্রমে, গিয়েছি ঢুকে মিনেপলিস, মিনেসোটায় একটি রেস্তোরায়, নাম দেখে নয়, ঢুকেছি খিদের জ্বালায়।
খাবারের স্বাদ ওয়েটার ম্যানেজারের চেনা ভাষা যত্ন আহ্লাদ বুঝিয়ে দিল, এতদিন কোথায় বিস্বাদ। মিনেপলিস বোধ হলো ওয়েসিস। বেরিয়ে দেখি লেখা নাম শেফ তৌসিফ মেহমুদ “পাক ইন্ডিয়ান ফুড”।এরপর আর ভুলক্রমে না, খুঁজে নিতাম ভারত বাংলাদেশ বা পাকিস্তানী খানা, একই দেশি ঘরানা।
পরবাসেও মিলে যেত ঘরের ঠিকানা। শুধু রোমের ট্রেভি ফাউন্টেইন বা ফন্টানা ডি ট্রেভিতে হিসেব মেলেনি, বোধহয় সব হিসেব মেলেনা। ইউরোপীয় সহপাঠীদের ক্ষেত্রে এর কারন বুঝতে অসুবিধা হয়না।

অস্ট্রিয়ার এক সহপাঠীর বাড়ি গিয়েছিলাম প্রায় জোর করে। ছুটি পেলেও ওকে বাড়িমুখো হতে কমই দেখেছি। ওর নাম ডেভিড বোগেন। জোর করে গেলাম একরাত কাটিয়ে পরদিন ফিরে এলাম। ওর কিছু ব্যক্তিগত কাজ ছিল। তাই ব্যস্ত ছিল। ওর বাবাই আমাকে নিয়ে এধার ওধার ঘুরিয়ে বেড়িয়ে আনলেন। দেখালেন বাজারে একটা মাছের দোকান। সেখানে ১৬ বছর বয়সে ডেভিড কাজে ঢুকেছিল। প্রায় আড়াই বছর কাজ করেছে। ওদেশে ষোড়শ বয়ঃক্রম অতিক্রম করলেই পিতামাতা সন্তানকে চড়ে খেতে শেখায়। আক্ষরিক অর্থেই "বেঁধে বেঁধে রাখিও না ভালো ছেলে করে...দাও সবে গৃহ ছাড়া লক্ষ্মী ছাড়া করে"। নিজের খরচ পাতি নিজেই উপার্জন করে নিত। সকলেই তাই করে। এরপর স্কলারশিপ জোগাড় করে সে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সামলায়। কাকাবাবু, মানে ডেভিডের বাবা বললেন, তারা স্বামী স্ত্রী নানান কাজকর্ম গল্প আড্ডা দিয়ে ভালোই কাটিয়ে দেন। সমস্যা হয় বুড়ো বা বুড়ি কেউ একজন চলে গেলে। কথা বলার মানুষ থাকে না। এভাবে অনেক বছর বাঁচলে একসময় ভাষাটি ভুলে যায়।

বেশ বুঝতে পারছি, কথা বলতে না পারার কারণে একটু সুযোগ পেয়েই কাকাবাবু আমার সাথে অনর্গল কথা বলছেন। ওনার উদ্যোগে দর্শন করলাম এক ঐতিহাসিক রেস্তোরাঁ, সেন্ট্রাল কাফে। ১৮৭৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। এটা ছিল ভিয়েনার " Key meeting place"... পিটার আলটেনবার্গ, আলফ্রেড অ্যাডলার, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, অ্যাডলফ হিটলার, লিও ট্রটস্কি প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তি এখানে নিয়মিত আসতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা বসতেন, আলোচনা করতেন। ভিয়েনা শহরে একটি "Y" আকৃতির রাস্তায় ত্রিভূজ আকৃতির বাড়ি। রাস্তাটি সেন্ট্রাল কাফের দুপাশ দিয়ে প্রসারিত। ১৯১৩ র পর এখানে প্রধানতঃ আসতেন যোশিপ ব্রজ টিটো, ফ্রয়েড স্তালিন ও লেনিন। গল্প আছে, এই কাফের টেবিলে অষ্ট্রিয়া হাঙ্গেরির বিদেশমন্ত্রী কাউন্ট বের্খটোল্ড এর উগ্র যুদ্ধ বাদি মতের বিরোধিতা করে ভিক্টর অ্যাডলার বলেন এখন কোনো যুদ্ধ হাবসবার্গ সাম্রাজ্যে না হলেও রাশিয়ায় বিপ্লব ডেকে আনবে। বের্খটোল্ড সেই কথার খেই ধরে কাফের অন্য একটি টেবিলে আঙুল দেখিয়ে বলেন, সেই বিপ্লব কে নেতৃত্ব দেবেন ওই ভদ্রলোক, মিস্টার ব্রনস্টেইন ওরফে লিও ট্রটস্কি। কাফের গুরুত্ব বোঝো তাহলে। এইসব গল্প শোনালেন কাকাবাবু। ডেভিডকে ছাড়াই ভাল আড্ডা জমেছিল। পরদিনই ডেভিডের সাথে গ্যাটিংগেন ফিরে এলাম।

ফিরে আসি বাই সাইকেলে ইউরোপ ভ্রমণের গল্পে। আমি, বলা ভালো আমরা আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে এসেছি। আমাদের স্কলারশিপের টাকা নিতে প্রতি মাসে ব্রাসেলসে যেতে হয়। আর পরের সেমিস্টারে সুইডেন যেতেই হবে। তাই ভ্রমণের রুট ঠিক হয়েছিল জার্মানি ফ্রান্স স্পেন সুইজারল্যান্ড ইটালি অস্ট্রিয়া হয়ে রাশিয়া যাওয়া। শেষে পোল্যান্ড হয়ে জার্মানিতে ফিরে আসা। এবারের ভ্রমণে পরিকল্পনা ছিল অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় আলপাইন পর্বতের চূড়া, সুদৃশ্য আলপাইন লেক, আর পর্বতের গায়ে অসংখ্য ছোটো ছোটো গ্রাম দেখবো। মনোরম আলপাইন প্রকৃতি। হলস্টাট শহর জনপদের বর্ণময় প্রাকৃতিক শোভা শুনেছি স্বর্গীয় অনুভূতি জাগায়। Salzkammergut ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। সেখানে লেক ও পাহাড়ে বিচরণ শুনেছি এক বিরল অভিজ্ঞতা। এই সবই এবারের ভ্রমণ সূচিতে আছে।

বেড়াতে হলে মোস্তাক সত্যিই আদর্শ সঙ্গি। থাকা, খাওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহন, সিদ্ধান্ত পরিবর্তন সব বিষয়ে সহমত। মোস্তাককে জানালাম সেই বাংলাদেশী ফুল ওয়ালা ফটোগ্রাফারের আচরণ আমার মনে একটা স্থায়ী ক্ষত ও বেদনা সৃষ্টি করেছে। কোনো সদুত্তর পাচ্ছি না। তাই অস্ট্রিয়া ভ্রমণের আগে ভিয়েনায় ডেভিডের বাবা কাকাবাবুর মতামত জানবো। শুধুই কথা বলবো, কোনো সময় নষ্ট করবো না। মোস্তাক সম্মতি জানালো। অতএব আমাদের যাত্রা সূচী পূর্বাহ্নে কাকাবাবুর গৃহে গমন। কাকা কাকিমা দুজনেই খুবই খুশি। ছেলের খবর, জলখাবার সেরে সরাসরি আমার সমস্যা জানালাম। কাকাবাবু সব মন দিয়ে শুনে তারপর একটা সম্ভাবনার কথা বললেন।

ইটালিতে সাধারণ বাংলাদেশী মানে জীবিকা সন্ধানীরা সাধারণত লিবিয়া হয়ে ইটালি ঢুকে থাকে। আইনী ও বেআইনি অনুপ্রবেশ এপথেই ঘটে। বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া একটি দালাল চক্র সক্রিয়। বেকার বাংলাদেশী যুবক মোটা টাকা দিয়ে ভাগ্যের দরজা খুলতে চায়। প্রশ্ন হলো লিবিয়া কেনো? লিবিয়া ১৯১১ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইটালির উপনিবেশ ছিল। ভূখণ্ডটি আগে অটোমান সাম্রাজ্যের দখলে ছিল। ১৯১১ এর পরে ইটালো-তুর্কি যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে তুরষ্ক ইটালিকে দুটি অঞ্চল ছেড়ে দেয়। ফলে ইটালির দুটি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল: ইতালীয় ত্রিপলিটানিয়া এবং ইতালিয় সেরেনাইকা। 1934 সালে, তারা এই দুটিকে একটি উপনিবেশে একীভূত হয়েছিল, ইতালিয়ান লিবিয়া। ইটালি লিবিয়া যাতায়াত অনেক পুরনো।

যারা এখানে কাজ খুঁজে পায়, হোটেল রেস্তোরাঁ, ট্যুরিস্ট স্পটে ব্যবসা, ফেরি করা, সেলুন পার্লারে; এরা যা উপার্জন করে সেটা ভারত বাংলাদেশের মুদ্রার সাপেক্ষে অনেক বেশি। এরা ইউরোপে কোনো মতে দিন গুজরান করে অধিকাংশ টাকা বাড়িতে পাঠায়। বাড়িতে বলে, ইউরোপে চাকরি করে, ব্যবসা করে। বাড়িতে নিজের দুঃখ কষ্টের কথা জানায় না। এই ছেলেটি যখন কোনো স্বদেশী স্বভাষীকে দেখতে পায়, আতংকিত ও আশংকিত হয়। যদি চেনা জানা সূত্র প্রকাশ পায়। দেশের বাড়িতে ও অঞ্চলে মানুষ তার সত্য জীবিকা জেনে ফেলে, একটা ভয়। এমনটা হয় শুনেছি।

কাকাবাবুর কথা শুনে বুঝলাম, গণতান্ত্রিক ইউরোপে কর্ম বা জীবিকা নির্বাহের কৌলীন্য বিচার হয়না। তাই কতো সহজেই আইনজীবী পিতা সন্তানের মাছের দোকান দেখাতে পারে। কিন্তু ইউরোপের উপনিবেশে শাসক প্রভুর বাহ্যিক আধুনিকতা সমাদৃত হয়েছে। প্রভুর আদব কায়দা, ঠাটবাট, চালচলন পূজিত হয়েছে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষকের আত্মপরিচয় এবং বিদেশের মাটিতে ফুটপাতের হকার, রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের আত্মপরিচয়ে অনেক ফারাক। স্বভাষী বা স্বজাতি হলেও আমার পরিচয় ভাইডির চোখে অন্য, অপর।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন