রক্তিম ভট্টাচার্য
আমার স্থায়ী কোনও আস্তানা নেই। কোনওদিন ছিলও না। তবে একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল বারবারই। আমিই ঠাঁই গাড়তে পারিনি। প্রথমবার এক পাগল দালালের পাল্লায় পড়ে নিষিদ্ধ পল্লীর চুলোয়, আরেকবার এক দূর সম্পর্কের মাসির বদান্যতায় একটা পুড়ে-যাওয়া বস্তির আধখানা ঘর। কোনওটাই পোষায়নি। ঘুরে বেড়িয়েছি স্টেশনে-বাজারে। অস্থায়ী আস্তানার খোঁজ যে পাইনি তা নয়, তবে কোথাও থিতু হতে পারিনি। পার্কের বেঞ্চ, মন্দিরের চাতাল, পুরনো বাড়ির দাওয়া-কিছুই বাদ রাখিনি। তবু একটা অস্বস্তির বশে উঠে যেতে হয়েছে প্রতিবারই। স্থায়ী আস্তানা খুঁজে না পেয়ে নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে যখন সংশয়ের অবকাশ তৈরি হল, তখন এই ছায়াটুকুই খুঁজে পেলাম। একটা ভাঙা বাসের ছায়া। রোজ বেলার দিকে বাসি হয়ে যাওয়া রোদটাকে দুমড়েমুচড়ে ছায়াটা তৈরি হয়। তারপর আস্তে আস্তে বিছিয়ে যায় পাথুরে জমির অস্থায়ী কাদা-ঘাসের ওপর। বৃষ্টি হলে ঘেঁটে যায় আরও। তবে মোটের ওপর কাজ চলে যায়। চাকার কাছে মাথাটা গুঁজে দিই, বাকিটা ধরে যায় জাগতিক নিয়ম মেনেই। অবশ্য এটা প্রশ্ন উঠতে পারে, যে আস্ত বাসটা থাকতে আমি কেন ওর ছায়াটাকে বেছে নিলাম। আসলে, বাসটা আমার দু'চোখের বিষ। ওকে আমি সহ্য করতে পারি না। ড্রাইভারের সিটটা দেখলেই মনে হয় ক্যাঁত করে একটা লাথি মারি। বাসটাও আমাকে সহ্য করতে পারে না মনে হয়। ছায়াটাকে মেরে ফেলে আমি শুতে এলেই। রোদের সঙ্গে ষড় আছে-আমি নিশ্চিত। দুপুরের দিকে কলেজের দু'চারজন ছেলে-মেয়ে ভাঙা বাসের ভেতরটায় অস্থায়ী আস্তানা খুঁজে নেয়। আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখি। ওরা আমাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয় না। রীতিমতো রোয়াবের সঙ্গে বাসের ছায়াটাকে মাড়িয়ে বাসে উঠে যায়। তারপর কেউ বসে ড্রাইভারের সিটে, কেউ হয়ে যায় কন্ডাক্টর। মেয়েরা মূলত লেডিজ সিটেই বসে। তারপর বাস চলতে শুরু করে। ছায়াটাকেও এগোতে হয় অগত্যা। আর ছায়ার সঙ্গে লেপ্টে থাকি আমিও, ফলে ঘুম ফেলে ছুটে চলি নির্দ্বিধায়। বাস চলতে থাকে দুর্বার গতিতে। কখনও লাফায়। কখনও ওড়ে। লাফানোর সময় একটু অসুবিধা হয়। ছায়াটা আমার ভারে নত হয়ে হোঁচট খেয়ে বিরক্ত হয়ে ওঠে। আমারও বুকে-পেটে গোঁত্তা লাগে। কাশি হয়। ওড়ার সময় বেশ আনন্দ হয়। ছায়া তখন আমাকে ছেড়ে সূর্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতায়। আমি পাখিদের গল্প শুনি। একেকটাকে বাসায় আসতে বলি। বাসায় নয়, বাসে। কিন্তু কেউ আসে না। হয়ত উড়ন্ত বাসটাকে ভয় পায়। কারণ, ওড়ার সময় বাসটার কোনো ডানা থাকে না। যাত্রীরাই ওকে ওড়ায়। অবশ্য এই ওড়া বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিছু সময় পরেই বাস আবার তার জায়গায় ফিরে আসে। এত লাফানো-ওড়ার জন্য ছেলে-মেয়েদের পোশাক থাকে অবিন্যস্ত। ঠিকঠাক করে নেমে যায়। ভাড়ার ব্যাপারে কার্পণ্য নেই কারোরই। রেখে যায় জায়গায়, আমি কুড়িয়ে নিই সময়মতো।
হঠাৎ একদিন ওরা আসা বন্ধ করে দিল। বাসটারও নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল। আমার খুব খারাপ লাগতে শুরু করল। আসলে বাসটাকে আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি। বাসটা থেমে থাকলে আমারও যেন মনে হয়, চরাচর থেমে গেছে কোনো এক শূন্য সময়ের গতিতে। ভয় পাই। খুব ভয় পাই। সচেতন হতে শুরু করি। বাসটাকে পর্যবেক্ষণ করি চারপাশ দিয়ে। কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। ছায়াটাও কেমন বিষণ্ণ হয়ে শুয়ে থাকে। ছায়াটা মানুষ খোঁজে। অথচ আমি তার সঙ্গোপনের স্থায়ী আস্তানা হয়ে উঠতে পারি না।
একদিন ছায়াটার কোলে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছি, হঠাৎ দেখি একটা মেয়ে নাচতে নাচতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কোনো এক শাস্ত্রীয় নৃত্যের দুর্বার পারঙ্গমতা সে প্রদর্শন করছে, কিন্তু আমি তার কিছুই বুঝি না বলে ধরতে পারছি না। তার আঙুলের মুদ্রায় পৃথিবীটা কেমন দুলে দুলে ওঠছে। বাসটাও যেন কোনো মজার জিনিস পেয়ে গেছে হঠাৎ। সে হর্ন বাজাচ্ছে নিজস্ব ছন্দে। মেয়েটাও হর্নের তালে তালে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। আমার কেমন আনন্দ হতে শুরু করল। বাসটার খুশিতে আমারও নেচে উঠতে ইচ্ছে করল। আমি ছায়াটাকে একলা ফেলে উঠে পড়লাম। কিন্তু আমি নাচতে জানি না। কিচ্ছু পারি না। অগত্যা শুধু মাথাটুকু দোলাতে শুরু করলাম। অবশ্য, মেয়েটা দেখলাম যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। কারণ, আমাকে উঠতে দেখেই বুঝে নিয়েছে, যে আমি ওকে সঙ্গ দিতে চাই। ও নিজে থেকেই এগিয়ে এসে হাত ধরল আমার। নাচ কিন্তু বন্ধ হয়নি। বন্ধ হয়নি বাসের হর্নও। আমিও ওর সঙ্গে নেচে উঠতে শুরু করলাম। নাচের কিছুই পারি না, অথচ বেশ বুঝছি, যে চমৎকার নাচতে পারছি। কোনো গান প্রয়োজন হচ্ছে না, কোনো ছন্দ প্রয়োজন হচ্ছে না। আপন গতিতেই নাচছি। মেয়েটাই আমাকে দিয়ে নাচিয়ে নিচ্ছে।
হঠাৎ বৃষ্টি নামল। আমাদের নাচের গতি আরও বেড়ে গেল। মেয়েটা আমাকে নিয়ে বাসটার চারদিকে নাচতে শুরু করল। তার নাচের মুদ্রাতেও নানা পরিবর্তন এসেছে। কখনও সে আমাকে জড়িয়ে ধরে নাচে, তো কখনও আমার গায়ে উঠে পড়ে। আবার কখনও আমাকে চিত করে শুইয়ে আমার ওপর বসে নাচে। আমিও সমানতালে শরীর দোলানোর চেষ্টা করি। কখনও বুঝি, বেশ পারছি। আবার কখনও ব্যর্থ হই। বৃষ্টির গতি মেখে নিয়ে আমাদের নাচ বেড়ে চলে। বাসের হর্ন বাড়তে থাকে ক্রমশ।
কলেজের কিছু ছেলে-মেয়ে দৌড়ে চলে আসে তখন। বৃষ্টিতে আশ্রয় খুঁজতে চায় তারা। কিন্তু বাসটা আমাদের একান্ত স্থান। বিশেষত, মেয়েটা আসার পর।এখানে এখন অন্য কাউকে ঠাঁই দিতে আমার আপত্তি আছে। কথাটা মনে পড়তেই মনে হল, আমি কি বাসটার মালিক? আমিই কি বাসটাকে কিনে নিয়েছি? নাকি, আমিই জন্ম দিয়েছি এই যান্ত্রিক আস্তানার?
বাসটা আমার মনের কথা বুঝতে পারল বোধ হয়। হর্ন বাজানো থামিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কপালে ভ্রূকূটি। হর্ন বন্ধ হওয়াতে মেয়েটি নাচও বন্ধ করে দিয়েছে। ভাঙা ঘড়ির কাঁটার মতো একদম স্থির হয়ে আছে। আমার ভয় করতে শুরু করল। বাসের ছায়াটাও দেখতে পাচ্ছি না। বৃষ্টি শুরু হতেই সে পালিয়েছে। এখন বাস যদি আমায় তাড়িয়ে দেয়? আর এখানে থাকতে না দেয়? কোথায় যাব? কী করব?
ওদিকে কলেজের ছেলে-মেয়েগুলোর কোনো অসুবিধা নেই। ওরা দিব্যি বাসটাকে উঠে পড়েছে। জানলার কাচগুলো ফেলে দিয়ে আবার বাসটা স্টার্ট দেবার পরিকল্পনা কষছে। মেয়েটাও বোধ হয় ফিরে যাবার তোড়জোড় করছে। কেন জানি না, আজ আর আমার বাসটার সঙ্গে লাফাতে বা উড়তে ইচ্ছে করছে না।
কিছুক্ষণ পর বাসটা চালু হল। খানিক শব্দ করে, বা হয়ত আমার জন্য অপেক্ষা করে, সোজা চলতে শুরু করল। আমি তাকিয়ে রইলাম মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত। তারপর বসে পড়লাম ওখানেই।
মেয়েটাও এসে আমার পাশে বসল। মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমার কেমন ভালো লাগতে শুরু করেছে চারপাশটা। বৃষ্টিটাও অনেকখানি ধরে এসেছে। এখন মেয়েটাকেও আমার বেশ মা-মা মনে হচ্ছে। যেন মনে হচ্ছে, কত জন্ম পর কাউকে জড়িয়ে ধরে আমি একটু কাঁদতে পারব। জমানো কথা বলতে পারব। কিন্তু, আমার তো কোনো জমানো কথা নেই-ই। যা কথা জন্মায়, সবই তো উড়িয়ে দিই হাওয়ায়। কথা জমাতে না পারলে প্রয়োজনে বলব কী?
আমি মেয়েটার চোখে বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। বুঝতে পারছি না, আদৌ কী বলব। নাকি, এই পরিস্থিতিতে কিছু বলতে নেই। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বোধ হয় ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। ছটফট করছে। বোধ হয় ওর বাড়ি ফেরার তাড়া আছে। কিন্তু, ফিরতে তো অনেক আগেই পারত। এতক্ষণ বসেই বা রইল কেন?
এই তো! এতক্ষণে একটা কথা পেয়েছি বলার জন্য। এটাই জিগ্যেস করি বরং।
করলাম সাহসে ভর করে। মেয়েটা কোনো উত্তর দিল না।আমার আবার ভয় করতে শুরু করছে। বাসটাও ফিরছে না, অনেকক্ষণ হল। এত দেরি তো কোনওদিন হয় না। ঠোঁটটা কামড়ে ধরলাম অজান্তেই।
মেয়েটা হঠাৎ উঠে পড়ল। ও কি রাগ করল আমার কথায়? ও কি এবার চলে যাবে? আমি কি একা একা আস্তানাহীন হয়ে পড়ে থাকব? একটু পরেই এখানে অন্ধকার জমাট বাঁধবে। মশার স্তূপে ভরপুর হয়ে যাবে। নিজেকে আঁচড়ে-কামড়েও নিস্তার পাওয়া যাবে না।
বাসটার হর্ন যেন শুনতে পেলাম অনেক দূর থেকে। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না। মশার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি চারপাশে। আমাকে ঘিরে উল্লাস করছে তারা। একটু পরেই ওদের তাণ্ডব শুরু হবে। আমাকে শেষ করে ফেলবে অচিরেই। এদিকে আমি দিকশূন্য। আমি আশ্রয়হীন।
ঠিক এই সময়েই চাঁদের আলো চুঁয়ে পড়ল মাটিতে। বৃষ্টির পর আকাশ আবার পরিষ্কার। মেয়েটার গায়ে পড়ে হড়কে যাচ্ছে আলো। স্পষ্ট হয়ে উঠছে ওর মুখ, কপাল, ঠোঁট, চিবুক।
আমি কী এক অজানা টানে উঠে পড়লাম। মশারা এই হঠাৎ প্রতি-আক্রমণ আশা করেনি বোধ হয়। যদিও আমি আক্রমণ করিনি, উপেক্ষা করেছি নিঃশব্দে, নির্বিকারে। উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটার হাত ধরলাম। বিদ্যুৎচমকের মতো ছিটকে এলাম। আবার ধরলাম। এবার অতটা বোধ হল না। আস্তে আস্তে আরাম পেলাম। মেয়েটিও কেমন আমাকে মেনে নিতে শুরু করল। দুজনে ভেসে গেলাম চাঁদের আলোর খুনসুটিতে।
বাসের হর্নটা এখন আর পাচ্ছি না। মশাদের ভনভন ছাড়া আর কোনো শব্দও পাচ্ছি না। নিজেও ভেতরে-ভেতরে একটা মশা হয়ে উঠতে-উঠতে বেশ বুঝতে পারছি, আমার আপাতত আর কোনও আস্তানা খোঁজার দরকার নেই।