বর্ণালি মৈত্র
‘ঈশ্বর যদি থাকেন তবে আমার বুদ্ধি তাঁরই দেওয়া সেই বুদ্ধি বলিতেছে যে ঈশ্বর নাই। অতএব ঈশ্বর বলিতেছেন যে ঈশ্বর নাই।'
(চতুরঙ্গ উপন্যাস, ২য় পরিচ্ছেদ)
১.
এ বাক্য শচীশের জ্যাঠা জগমোহনের। ‘চতুরঙ্গ' উপন্যাসে তাঁর পরিচয় নামজাদা নাস্তিকের। ঈশ্বর বিশ্বাসীদের তিনি বলতেন, ‘তোমরা তাঁর মুখের উপর জবাব দিয়া বলিতেছে যে ঈশ্বর আছেন। এই পাপের শাস্তিস্বরূপে তেত্রিশ কোটি দেবতা তোমাদের দুই কান ধরিয়া জরিমানা আদায় করিতেছে।’ আর শচীশকে বলতেন, ‘দেখ্ বাবা, আমরা নাস্তিক, সেই গুমরেই আমাদিগকে একেবারে নিস্কলঙ্ক নির্মল হইতে হইবে। আমরা কিছুকে মানিনা বলিয়াই আমাদের নিজেকে মানিবার জোর বেশি।’
খানিকটা এমনই, অথবা এমনের কাছাকাছি আর একখানি সংলাপ পাওয়া যাবে জীবনের একেবারে প্রান্ত ভাগের ‘রবিবার’ গল্পে। সেখানে অভীক বিভাকে বলছে, ‘পরের ধন হরণ করা অনেক ক্ষেত্রেই পুণ্যকর্ম, পারিনে পাছে অপবাদটা দাগা দেয় পবিত্র নাস্তিক মতকে। ধার্মিকদের চেয়ে আমাদের অনেক বেশি সাবধানে চলতে হয়, আমাদের নেতি দেবতার ইজ্জত বাঁচাতে।’
ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম হলেও এবং জন্মসূত্রে অপৌত্তলিকতার গন্ডীতে বাহ্যিকভাবে জড়িয়ে পৃথিবীতে এলেও রবীন্দ্রনাথ নিজেকে ক্রমাগতই ছাড়িয়ে নিতে পেরেছিলেন সেখান থেকে, পেরেছিলেন সহিষ্ণুতা, গ্রহীষ্ণুতার এক স্বাবলম্বন তৈরী করতে নিজেরই ভেতরে। যে অবলম্বনে অনেক কিছুর মতই-ঈশ্বর উপাসনাও ছিল এক উদার, উন্মুক্ত জীবন ধর্ম। মহিমচন্দ্র সরকারের প্রথমা কন্যা কাদম্বিনী দেবীকে অক্টোবর, ১৯০৩ চিঠিতে (চিঠিপত্র ৭ম) লিখছেন,
'সাকার নিরাকার একটা কথার কথামাত্র। শুধু ঈশ্বর কেন, আমরা প্রত্যেকেই সাকারও বটে, নিরাকারও বটে। আমি এসকল মতামত লইয়া বাদ বিবাদ করিতে চাহি না। তাহাকে রূপে এবং ভাবে, আকারে এবং নিরাকারে কর্মে এবং প্রেমে সকল রকমেই ভজনা করিতে হইবে। আকার আমাদের রচনা নহে, আকার তাহারই।'
দুর্গার দশ হাত-তোলা প্রতিমা যখন দেশের সমস্ত আবালবৃদ্ধবনিতাকে সাময়িক ভাবে মাতাল করে দিচ্ছে আনন্দের জোয়ারে, মহালয়ার সুর শুনে মুচড়ে উঠছে পাঁজর, পক্ষকাল আগে থেকেই বাতাসে ভাসছে মহিষাসুরমর্দিণীর স্তব আর আলোয় ভরে উঠছে বাঙ্গালীর একঘেঁয়ে প্রাত্যহিক দিন গুলো-সেখানে রবীন্দ্রনাথ দেখছেন অমৃত ধারা! যে ধারায় মিশে আছে প্রবাসী প্রাণের ঘরে ফেরার সুর, যে ধারা দয়িতের জন্য দুচোখে প্রতীক্ষা জ্বেলে নিয়ে বহমান। সাকার-নিরাকারের, ‘পুতুল খেলা’ র তকমা – সবই ধূসর হয়ে যায় এই শারদ সকালে।
২.
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আমার বাল্যকাল’ বইয়ে লিখছেন,
'আমাদের বাড়ি দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী এই দুই পুজা হত। দুর্গোৎসব মহাসমারোহে সম্পন্ন হত। আমাদের উঠানের উপর সামিয়ানা খাটান আর তিন দিন আমরা যেন কল্পনাপ্রসূত এক নতুন রাজ্যে বাস করতুম। নূতন দেশ, নূতন ঋতু, আলো বাতাস সব নূতন। প্রথমে যখন প্রতিমার কাঠাম নির্মাণ আরম্ভ হত তখন থেকে শেষ পর্যন্ত সমুদায় নির্মাণ কার্য আমরা কৌতুহলের সহিত পর্য বেক্ষণ করতুম।'
অন্যত্র ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইতে সরলাদেবী চৌধুরাণী লিখছেন,
'এ বাড়ির ১১ই মাঘের উৎসব এবং ও বাড়ির পূজায় একটা কিন্তু বড় রকম পার্থক্য ছিল ছেলেমেয়েদের পক্ষে-নতুন কাপড় পরা না পরায়। ১১ই মাঘে আমাদের নতুন কাপড় পরার কোন রেওয়াজ ছিল না, ভাল সাজগোজ করা হত এই পর্যন্ত। একমাস আগে থাকতে ঘুরে ঘুরে ‘পুজোর বাজার’ করে করে বাড়ির প্রত্যেক লোকটির হাতে নতুন কাপড় জামা উপহার দেওয়ার জন্যে সমগ্র বাঙ্গালী জাতি যে নিযুক্ত থাকে, কোলকাতার রাজপথে সেই সময়ে বড়মানুষদের ঘর থেকে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যে পুজোর তত্ত্ব বাহিত হয়-আমাদের বাড়িতে সে সবের কিছুই ছিল না।'
প্রায় সম্পূর্ণ বিপরীত দুখানি ছবি। এদের আনুমানিক সময়ের পার্থক্য হতে পারে বছর তিরিশেক। সত্যেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রনাথ ও সারদাসুন্দরীর দ্বিতীয় সন্তান। তাঁর ছোটবেলায় পাঁচ ও ছ নম্বর বাড়ি মিলিয়ে ছিল এক বিরাট সংসার। যে সংসার ভাগ হল ত্রিপুরাসুন্দরী যখন গিরীন্দ্রনাথের কনিষ্ট পুত্র গুণেন্দ্রনাথকে দত্তক নিতে চাইলেন এবং দেবেন্দ্রনাথ তাতে আপত্তি জানিয়ে হাইকোর্টে মামলা আনলেন (১৮৫৯) এবং আর একটা বড় কারণ ১৮৬১ সালে যখন দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মমতে হোমযজ্ঞ এবং শালগ্রাম শিলা বর্জন করে তাঁর দ্বিতীয়া কন্যা সুকুমারীর বিয়ে দিলেন, তখন থেকেই পাকাপাকিভাবে দুই পরিবারের বিচ্ছেদ সম্পন্ন হল। ছ’নম্বর বাড়ি হল ব্রাহ্ম আর পাঁচ নম্বর বাড়ি আগেকার মতই রক্ষণশীল হিন্দু রয়ে গেল। অতএব সত্যেন্দ্রনাথ তখন ১৮৬১ তে কুড়ি বছরের তরুণ। বাল্যকাল আর নেই। সেই দুর্গা পুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো, সরস্বতী পুজো কিছুই আর নেই। এই যাবতীয় না-পুজোর মধ্যেই বড় হয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথের ভাগ্নী, স্বর্ণকুমারী দেবী ও জানকীনাথ ঘোষালের দ্বিতীয়া কন্যা সরলাদেবী চৌধুরাণী। যাঁর জন্ম ১৮৭২-এ। এ ঘটনা তো অবসম্ভাবী! কারণ, বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ভাব ধারা তার পুত্রদের মধ্যেও যে একরকম কাজ করছে-তার প্রমাণ ও সত্যেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় পাওয়া যায়,
'যাকে ইংরেজিতে বলে Iconoclast আমি তাই ছিলুম-তার কারণ পৈত্রিক সংস্কারই বল-আর যাই বল এক সময়ে আমাদের বাড়ি সরস্বতী পূজা হত। মনে আছে একবার সরস্বতীর প্রতিমা অর্চনায় গিয়েছি-শেষে ফিরে আসবার সময় আমার হাতে যে দক্ষিণার টাকা ছিল তাই দেবীর উপরে সজোরে নিক্ষেপ করে দে ছুট। তা যে দেবীর মুকুট ভেঙ্গে পড়ল...'
৩.
প্রত্যাখ্যানের এমন ভঙ্গী অবশ্য বাল্যবয়সেই থাকে। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান যে কত নির্মম অথচ ঋজু হতে পারে, তার উদাহরণও বিস্তর। যে দেবেন্দ্রনাথ চোদ্দ পনের বছর বয়সে স্কুলে যাবার পথে প্রতিদিন ঠনঠনিয়ার সিদ্ধেশ্বরী কালী মূর্তি কে প্রণাম করে যেতেন, সেই দেবেন্দ্রনাথ হঠাৎই বদলে গেলেন মনে মনে ১৮৩৮-এ একুশ বছর বয়সে পিতামহী অলকা দেবীর মৃত্যুর পর। লক, হিউমের জড়বাদী দর্শন তাঁকে এই বিশ্বাসে নিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ যে, প্রতিমায় ঈশ্বর নেই! প্রত্যাখ্যান আর একটু দৃঢ় হল উপনিষদ পাঠে, প্রতিষ্ঠা হল তত্ত্ববোধিনী সভা ১৮৩৯ সালের শেষ দিকে। প্রত্যাখ্যান করবার চরম উদাহরণ উপস্থিত হল ১৮৪৬ এ দ্বারকানাথের মৃত্যুতে। দেবেন্দ্রনাথ প্রচলিত রীতিতে শ্রাদ্ধানুষ্টান করলেন না। আনন্দচন্দ্র বিদ্যাবাগীশকে ডেকে বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে নিজের মতে, নিজের পথে শেষকৃত্য সমাধা করলেন। তুলসী কুশ, গঙ্গাজল কিংবা নারায়ণ শিলা কোনোটাই ছিল না তার সেই স্বনির্বাচিত পথে।
স্বাভাবিক নিয়মেই এই ঘটনা দেবেন্দ্রনাথকে নিয়ে গেল আত্মীয়স্বজন থেকে অনেক দূরে এক নিজস্ব একান্ত প্রকোষ্টে। এর বছর দেড়েকের মধ্যেই দ্বাকানাথের ব্যবসা এবং ব্যাঙ্ক দুটোরই হল ভরাডুবি। কী হবে এবার? দেবেন্দ্রনাথ ফিরবেন কি সেই অতীতে, যেখানে পাঠের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে তিনি বর প্রার্থনা করতেন শালগ্রাম শিলায়? যে অতীতে তাঁর বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরই শালগ্রাম শিলা? ঈশ্বরই দশভূজা দুর্গা? কিংবা ঈশ্বরই চতুর্ভূজা সিদ্ধেশ্বরী? আর্থিক এই ভয়ঙ্কর সংকট কি তাকে কোনোভাবে সাকার তত্ত্বে ফেরাবে?
না। দেবেন্দ্রনাথ নিজেকে মানলেন, শালগ্রাম শিলাকে নয়। ঋণ পরিশোধের জন্য নিলেন এক দৃঢ় পদক্ষেপ। ঠাকুরবাড়ির ভেতরে অবশ্য প্রাত্যহিক কিছু সাশ্রয় হতে থাকল। চাকরের ভিড় কমিয়ে দেওয়া হল, গাড়ি-ঘোড়া সব নিলামে চলে গেল, খাওয়া দাওয়া যথাসম্ভব ব্যয়-সংকোচ করা হল–দেবেন্দ্রনাথ ঘরে থেকে সন্ন্যাসী হলেন। আর বাইরে দৃঢ় সিদ্ধান্তের ফলাফল হিসেবে ১৮৪৮ সালের ৪ঠা এপ্রিল কোম্পানীর পাওনাদারদের সভায় দেবেন্দ্রনাথের সর্বস্ব পণ করে ঋণশোধ করবার কথা ঘোষণা করলেন গর্ডন। বছর দুয়েক পর ১৮৫০ সাল থেকে ঠাকুরবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো উঠে গেল; কিন্তু নগেন্দ্রনাথ এবং বাড়ির অন্য সদস্যদের ঘোরতর আপত্তিতে দেবেন্দ্রনাথ দুর্গা পুজো তুলতে পারলেন না কিছুতেই। তবে অনুপস্থিত থাকতেন প্রতিবছর পুজোর সময়। বেরিয়ে পড়তেন দেশভ্রমণে। বছর কয়েক পর অবশ্য তিনি গৃহ দেবতা লক্ষ্মীজনার্দন শিলা স্থানান্তরিত করে দেন-বাড়িতে আর পুজো আচার একেবারেই রাখবেন না জানিয়ে। গুণেন্দ্রনাথের মাতা, গিরীন্দ্রনাথের বিধবা পত্নী যোগমায়া দেবী দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে চেয়ে নেন এই লক্ষ্মীজনার্দন শিলা।
৪.
কিন্তু দেবেন্দ্রনাথের হাত থেকে যোগমায়া দেবী যে লক্ষ্মীজনার্দনের শিলা নিলেন, তাদের আদি নিবাস? দ্বারকানাথের পূর্ব পুরুষ নীলমণি পাথুরিয়াঘাটার বাড়ির যে অংশ তাঁর, সে অংশের পরিবর্তে এক লক্ষ টাকা নিয়ে উত্তর কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলে কলকাতার আদি বাসিন্দা শেঠ বসাকদের ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণের কাছ থেকে লক্ষ্মীজনার্দনের শিলার নামে জমি নেন। এই নীলমণিরই দত্তক পৌত্র দ্বারকানাথ। ঠাকুরবাড়িতে পুজো আচ্চার যাবতীয় উদ্যোগ দ্বারকানাথেরই। শুধু লক্ষ্মীজনার্দনের সেবা করেই তিনি ভক্তির পথ, মোক্ষের পথ তৈরী করতে চান নি, জগদ্ধাত্রী, দুর্গা, কালী, সরস্বতী-কেউই তাঁর তালিকার বাইরে থাকেননি–শুধু পশুবলি ছাড়া। এখনকার ‘শারদ সম্মান’ সেকালে জাঁকিয়ে বসেনি ঠিকই, কিন্তু দাঁ বাড়ির দুর্গা পুজোর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মত ঘটনা বিরল নয়। এহেন দ্বারকানাথ বন্ধু রামমোহন রায়ের সংস্পর্শে এসেও নিজের হাতের ঘরের পুজো বন্ধ করেননি। সেই দ্বারকানাথই বিলেতে ইংরেজদের সঙ্গে ওঠাবসা শুরু করার পর বন্ধ করলেন নিজ পুজোপাঠ। কী অদ্ভুত সমাপতন! নিষ্ঠাবান এই বৈষ্ণবের পর থেকে পুজো, হোম, তর্পণ ইত্যাদি প্রতিটি আচার পালনে নিযুক্ত করলেন আলাদা আলাদা বেতনভোগী ব্রাহ্মণ পুরোহিত। এই আঠারো জন ব্রাহ্মণ পুরোহিত যখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি সাড়ম্বরে পুজোপাঠ করছেন – তখন দূরে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন একলা, পূজারী দ্বারকানাথ। অথচ বিদেশে গিয়েও প্রথম প্রথম কিন্তু গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা থেকে শুরু করে যাবতীয় ধর্মীয় আচার জড়িয়ে রেখেছিলেন নিজের অস্তিত্বে।
তবে সমস্তটা যে বিলেতে ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশার করার কারণ, তা অবশ্য বলা যায় না। বৈষ্ণব ধর্ম থেকে তিনি কার্যত সরে যাচ্ছিলেন রামমোহন রায়ের বন্ধুত্বকে ভালোবেসে। আর সেই সরে যাওয়া একেবারে চুড়ান্ত রূপ পেল দ্বারকানাথ বসতবাটীর পরিবর্তে বেলগাছিয়ায় একটি নতুন বাগানবাড়ি কিনে দাস দাসী আসবাবপত্রে সে বাড়ি সাজিয়ে যখন সেখানেই তাঁর পানভোজন –নাচগানের আসর বসালেন। কাজেই এক সময়ের নিষ্ঠাবান আস্তিক বৈষ্ণব জীবনের উত্তরভাগে সমস্ত নিষ্ঠাই সঁপে দিলেন ব্যবসাপত্র আর আনুসঙ্গিক আমোদে। দেবেন্দ্রনাথ যখন সতেরো বছরের কিশোর-তখন প্রথম দ্বারকানাথ তাকে ব্যবসায় সঙ্গে নিলেন ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সহকারী কোষাধ্যক্ষ করে, বলাবাহুল্য পুত্র তাঁর এই ব্যবসায়িক বুদ্ধির যথার্থ উত্তরাধিকারী ছিলেন না, কেবল দ্বারকানাথের দূরদর্শিতাই ঠাকুরবাড়ির বৈভবকে টিকিয়ে রেখেছিল তার মৃত্যুর পরেও আরও প্রায় তিনপুরুষ।
৫.
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামের বেতার অনুষ্টানটি যখন বাণীকুমার, পঙ্কজ মল্লিক আর বীরেন্দ্রকষ্ণ ভদ্রের জাদুকরী পরিকল্পনায় প্রথমবার অর্জন করেছিল অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা, তখন রবীন্দ্রনাথ সত্তরোর্ধ প্রবীণ। সাল ১৯৩২। মালকোষ ভৈরবীর অসামান্য কেমিস্ট্রি পৌছচ্ছে তখন তার কানে, মনে পড়ছে নিশ্চয়ই তাঁর মানব ললিত-বিভাস-ভৈরব-কেদার -বড়ারী-বসন্ত ও ধানশ্রীর কথা – যে আটটি রাগের মন্ত্রে স্নান করান হত দেবী দুর্গাকে?
আর কি মনে পড়ছে? তেরো বছর দশ মাস বয়সে যে মাকে হারিয়েছেন, এমন কী তার আগেও খুবই ক্ষীণ যোগাযোগ ছিল যে মায়ের সঙ্গে সেই মাকে মনে পড়ে যাবে না এই ভোরে এই বৃদ্ধটির? যে ‘আলোর বেনু’ বেজে উঠছে সে আলো তো স্মৃতির দরজাতেও ছায়া দিচ্ছে বুক তোলপাড় করে পাঁজর গুঁড়িয়ে দিয়ে অতল বিস্মৃতি থেকে উঠে আসেন ‘মা’।
'স্তিমিত প্রদীপের অস্পষ্ট আলোকে ক্ষণকালে জন্য জাগিয়া উঠিয়া হঠাৎ বুকটা দমিয়া গেল, কিন্তু কী হইয়াছে?
ভাল করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না। প্রভাতে উঠিয়া যখন মা’র মৃত্যু সংবাদ শুনিলাম, তখন সে-কথাটার সম্পূর্ণ অর্থ গ্রহণ করিতে পারিলাম না...কেবল যখন তাহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া যা আর একদিন ও তাহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসন টিতে আসিয়া বসিবেন না।' (‘জীবনস্মৃতি’)
‘বসন্ত’ রাগে গেয়ে ওঠা ‘আমল কিরণে ত্রিভুবন-মনোহারিণী’ আস্তে আস্তে এসে মিশে যায় সাতচল্লিশ বছর বয়সে লেখা ‘জননী, তোমার করুণ চরণখানি’তে এসে।
১৩১৫ বঙ্গাব্দ। বছর খানেক আগেই মৃত্যু হয়েছে দেবেন্দ্রনাথের। একই সঙ্গে শুরু হয়েছে বঙ্গভঙ্গের কাল। গীতাঞ্জলি পর্ব। লেখা হচ্ছে ‘গোরা’ উপন্যাস-যেখানে আছেন আনন্দময়ী। উপনিষদের প্রভাব তখন অনেকটাই স্তিমিত। ১৪ জুন ১৯৩১ তারিখে হেমন্তবালাদেবীকে লিখছেন একটি চিঠিতে,
‘আমার ঠাকুর মানুষের মধ্যে – সেখানে ক্ষুধাতৃষ্ণা সত্য, পিত্তিও পড়ে, ঘুমেরও দরকার আছে।’
কিন্তু জীবনের প্রথম চারদশক তাঁর ‘ঠাকুর তো ঠিক এমনটা ছিলেন না! সেই ঠাকুরের নির্মাণ তখন নরম মাটিতে হচ্ছে। তাঁর জন্মের আগেই জোড়াসাঁকোয় যাবতীয় পারিবারিক পুজো বন্ধ হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু আশেপাশের দালানবাড়িতে প্রতিমার শেষ মুহূর্তের সাজ, প্রবাসী মানুষদের ঘরে ফেরার দৃশ্য এসবই বালক এবং কিশোর রবীন্দ্রনাথকে পর্যায়ক্রমে মুগ্ধ করেছে। শুধু কলকাতার বাড়ি নয়, শিলাইদহে কুঠিবাড়ির জানলা থেকেও দেখছেন ঘাটে নৌকা এসে লেগেছে প্রবাসীদের, মুখে তাদের ঘরে ফেরার টান।
'বিদেশে থেকে যে লোকটি এইমাত্র গ্রামে ফিরে এল তার মনের ভাব, তার ঘরের লোকদের মিলনের আগ্রহ এবং শরৎকালের এই আকাশ, এই পৃথিবী, সকাল বেলাকার এই ঝিরঝিরে বাতাস এবং গাছপালা, তৃণগুলা, নদীর তরঙ্গ, সকলের ভিতরকার একটি অবিশ্রাম সঘন কম্পন – সমস্ত মিশিয়ে বাতায়নবর্তী এই একক যুবকটিকে সুখে দুঃখে এক রকম অভিভূত করে ফেলেছিল।’ (ছিন্নপত্র)
এই কাঁপুনি তাঁকে গহন আশ্লেষে সামিল করেছিল নানা আনন্দের উপলক্ষ তৈরীতেও। বিজয়ার প্রীতি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিন আত্নীয়বন্ধুকে, ভাইফোঁটা নিয়েছেন স্বর্ণকুমারী দেবীর হাতে, নতুন পোষাকে মুড়ে দিতে চেয়েছেন প্রিয়জনকে। যদি কখন সে কাজে অর্থের টানাটানি হয়েছে, সামলাতে চেষ্টা করেছেন নিজের বইয়ের কপিরাইট বিক্রি করে।
'আমার কপিরাইট বিক্রি করার কথাটা চিন্তা কোরো এবং পারোতো চেষ্টাও কোরো। গ্রন্থাবলীর মধ্যে বিসর্জনই ও রাজা ও রাণী স্বততন্ত্র আকারে বাজারে আছে এবং বর্ত্তমান সংস্করণ গুরুদাস কে বিক্রয় করেছি-তেমনি কণিকা থেকে ক্ষণিকা পর্যন্ত পাঁচখানি সম্পূর্ণ নতুন বই আমার হাতেই আছে এবং ব্যবস্থা করে বিক্রি করতে পারলে পূজার কাছাকাছি কিছু করে আসবার সম্ভব।' (চিঠিপত্র, অষ্টম খন্ড, প্রিয়নাথ সেনকে লেখা)
কিন্তু যাবতীয় এই আপাত কোমল সাংসারিকতায় ভরা মনখানিতে ভোরের নরম আলো সরে গিয়ে দুপুরবেলার তপ্ত আঁচ এসে পড়ল ১৯০৫-এ। গ্রামের পাশ দিয়ে যে নদী বয়ে যাচ্ছিল, সে বাঁক বদল করল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন অসুরদলনী দুর্গার যে ছবি আঁকালো রবীন্দ্রনাথের কলমে, তা এইরকম-
'ডানহাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বা হাত করে শঙ্কাহরণ
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুন বরন...
ও গো মা, তোমায় দেখে দেখে আখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।'
কলকাতার জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের জন্য সুর দিলেন ‘বন্দেমাতরম’ গানটিতে। এই তাপ কমে গেল গীতাজ্ঞলি–গীতালী–গীতিমাল্যে।
‘আমি কোনো দেবতা সৃষ্টি করে প্রার্থনা করতে পারিনে, নিজের কাছ থেকে নিজের যে মুক্তি সেই দুর্লভ মুক্তির জন্য চেষ্টা করি। সে চেষ্টা প্রত্যহ করতে হয়, তা না হলে আবিল হয়ে ওঠে দিন। আর তো সময় নেই, যাবার আগে সেই বড় আমিকেই জীবনে প্রধান করে তুলতে হবে, সেইটেই আমার সাধানা।’ (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ)
এই ‘দুর্লভ মুক্তির’ সাধনায় পূর্ণ ১৫৭ টি কবিতা নিয়ে ‘গীতাঞ্জলি’র প্রথম প্রকাশ ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে। অতএব এবার ‘ঈশ্বর’ খোঁজা নিজেরই ভেতর। আমরা এইবার ফিরে যাব এই লেখার একেবারে শুরুতে। ‘অতএব ঈশ্বর বলিতেছেন যে ঈশ্বর নাই। (‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাস, ২য় পরিচ্ছেদ)
‘চতুরঙ্গ’, ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে মুদ্রিত হয়েছিল ১৩২১ বঙ্গাব্দে অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন সংখ্যা পর্যন্ত। অনেকটা এই সময় থেকেই বলাকা পর্বের সূচনা। রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনের সবচেয়ে বড় পালাবদল। ঈশ্বর নয়, দেব দেবী নয়, অলৌকিক আধ্যাত্মিক কোনো বাস্তবাতিরিক্ত সত্ত্বা নয়, সোজাসুজি মানুষ। এই মানুষের পথই চলে গেছে ‘অরূপরতন’ ‘মুক্তধারা’, ‘রক্ত করবী’, ‘ঘরে বাইরে’র পৃষ্ঠা ধরে ধরে। মানুষের ভেতরে যে ঈশ্বর আছেন, তাকে আসন পেতে দিচ্ছেন শ্রীনিকেতনের পরিকল্পনায়, পল্লীসংগঠনের কর্মোদ্যমে, সমবায়ের উদ্যগে। এসে পৌঁছেছেন ব্যক্তিমানুষের আত্মউৎসর্জনের প্রতি অটল বিশ্বাস সঙ্গে করে জীবনের শেষ দশকে। শুনছেন, সাগির খাঁর সুরারপিত ভৈরবীর সমাহিত সুর, 'শান্তি দিলে ভরি দুখ রজনী গেল তিমির হরি।'
‘শারদোৎসব’-এর শেষ গান লিখছেন,
'আমার নয়ন ভুলানো এলে!
আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে!
শিউলিতলার পাশে পাশে
ঝরা ফুলের রাশে রাশে
শিশির–ভেজা ঘাসে ঘাসে
অরুণ রাঙা চরণ ফেলে
নয়ন ভুলানো এলে!'
তখন সত্যিই ধানের ক্ষেতে খেলে যাচ্ছে রৌদ্রছায়া, চরাচর জুড়ে মুক্তির ডাক। তোলপাড় হচ্ছে বাল্য–কৈশোর। ঘরে ফিরতে চাইছে মন। বলছে, আর তো সময় নেই–এবার রশি খুলে দেবার পালা, ওপারের পানে বেয়ে যাবে নৌকো খোলা হাওয়ায়।