সুমি দত্তগুপ্ত
'রূপকথার মতো তুমি শুয়ে থাকো সারারাত,
আমি পাতা ওল্টাই…পাতা ওল্টাই…পাতা ওল্টাই'
আশি, নব্বই দশকের দিনগুলোতে ইন্টারনেট এভাবে আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েনি, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল সারা বিশ্বটাকে এভাবে মুঠোয় পুরে ফেলেনি। 'যে জীবন দোয়েলের, যে জীবন ফড়িংয়ে'র সেই জীবনে বিস্ময় ছিল, চমক ছিল, একাত্মতা ছিল আর ভালোবাসা ছিল অগাধ, উপকরণ ছিল সামান্য।
সকালবেলায় ঘুম ভাঙতো মায়ের সূর্য স্তবে, 'ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং'। বিভিন্ন বাড়ি থেকে গানের রেওয়াজ ভেসে আসতো, রবিবার গুলোতে তার সাথে দালদায় ভাজা লুচির গন্ধ, দুপুরের দিকে প্রেসার কুকারে সিটির শব্দ আর তার সাথে পাঁঠার মাংসের গন্ধ। এরপরেই ম্যাগি বাজারে চলে এলো, অনেক বাড়িতেই চটজলদি জলখাবার হিসেবে ম্যাগির অনুপ্রবেশ ঘটলো। ছোটবেলায় আরেকটি আকর্ষণ ছিল ফ্রায়ামস্ কারণ ওর সাথে খেলার ডিস্ক পাওয়া যেত। ছুঁড়ে ছুঁড়ে ডিস্ক খেলতাম আমরা।
আমাদের কাছে বেশ মজার খেলা ছিল ফেরিওয়ালার ডাক নকল করা। লক্ষ করি, আশির দশক থেকেই পাড়ার ফেরিওয়ালার ডাকেও কেমন পরিবর্তন হতে থাকে। দুপুরবেলা কালো টিনের বাক্সে কেক, প্যাটিস, সোনপাপড়ি, চিনা সিঁদুর, শিল কাটাও, শাঁখারি আসতো তার বাক্সভর্তি শাঁখা, পলা নিয়ে; শাঁখের আংটিও থাকতো তাদের কাছে। ঝাঁকামুটের মাথায় কাঁসার বাসন চাপিয়ে কাঁসারী আসতো একহাতে কাঁসার বাসন বাজাতে বাজাতে, বইয়ের বোঝা নিয়ে বাড়ি বাড়ি বই বিক্রী করতে আসতো বইওয়ালা। এরপরে আসতে শুরু করলো গুজরাটি বৌয়েরা, গুজরাটের কাঁচ বসানো চাদর বেডকভার, বাঁধনীর শাড়ি, সালোয়ার কামিজ সেট, গুজরাটের চুড়ি, হার নিয়ে চমক সৃষ্টি করতো।
ঘন্টা বাজিয়ে বুড়ির চুল বিক্রি, কাঁচি ধার, গরমকালে সন্ধেবেলায় বেলফুল এই আওয়াজগুলো আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। ৯০'এর দশক থেকে মহিলা শাড়ি বিক্রেতা, বিকেল হলেই ঘটি গরম, টং টং শব্দে পাড়ায় ঢুকতো ধোসার গাড়ি, গরমের সন্ধেবেলায় কুলফি মালাই তখনও ছিল। গরমের দুপুরগুলো অপেক্ষায় থাকতাম, কখন কোয়ালিটি আইসক্রিমের গাড়ি ঢুকবে। কোয়ালিটি তখনও কোয়ালিটি ওয়ালস্ হয়নি।
কোয়ালিটির কথা মনে পড়তেই কোয়ালিটি ফুডের কথা মনে পড়ে গেল।মনজিনিসের ৮০'র দশকে জন্ম হয়নি, ক্যাথলিন, নাহুমস্ আর ফ্লুরিস এর ডোনাট, কেক, পেস্ট্রিরই সমাদর ছিল, তবে জলযোগের পানকেক, বাখরখানি ও খুব খেতাম। আস্তে আস্তে তখন কলকাতায় মোগলাই পরোটাকে সরিয়ে এগরোল সাম্রাজ্য বিস্তার আরম্ভ করেছে। তখনও বাঙালী চপ, কাটলেট, ডেভিল, ফিশ কবিরাজিতেই মজে ছিল। পিৎজা, হটডগ, সাবওয়ের স্যান্ডউইচ বাঙালী রসনায় সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। আর ছিল আমাদের সব থেকে প্রিয় ফুচকা আর তার দোসর চুড়মুড়। ভেলপুরী, বাটাটা পুরী মাঝে সাঝে মুখ বদলান।
এতক্ষণ 'টা' নিয়ে গপ্পো করতে করতে চায়ের কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম। পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকানে রাজনীতি, ফুটবল পায়ে দৌড়োনো, আজহারের ইডেনে ঝড় তোলা সবই ছিল। কিন্তু কফি হাউসের আবেদনটা আলাদাই।
তাই কফি হাউসের আড্ডাটা রয়েই গেছে। বন্ধুদের নিয়ে ছাপোষা মধ্যবিত্তের ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারার এমন জায়গা আর কি আছে? বারিস্তা নব্বইয়ের দশকে রেঁস্তোরার বাঙালির আড্ডা-মানচিত্রে ঢুকে পড়েছে, তবু কফির পেয়ালায় তুফান তোলার জন্য 'ইনফিউশন'ই বোধহয় এগিয়ে থাকলো কাপুচিনোর থেকে। 'মাস' আর 'এলিটে'র লড়াই আর কি!
আমার ছোটবেলাটা কেটেছে বড়িশায়। বড়িশার গা থেকে তখনও শহরতলির গন্ধ মুছে যায় নি, তখনও রাতে শেয়াল ডাকে পুকুরপাড়ে, মাঝদুপুরে পুকুরের ধারের সজনে গাছটায় মাছরাঙা চুপটি করে বসে থাকে মাছ শিকারের আশায়, চুবড়ি হাতে শৈলবুড়ি পুকুরপাড়ে আগাছার জঙ্গল থেকে বনকলমি, হিঞ্চে, সুশনি শাক তোলে। দোল, দুর্গোৎসবের অনুষ্ঠানে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ঠাকুরদালান আটচালায় সবাই জমায়েত হয়। এই পুজোই সবার পুজো।
শরৎ মশেষে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার শেষে, বড়িশাবাসীর সম্বৎসরের প্রতীক্ষা পৌষের চন্ডীমেলা। চোখ ফুটেই এই মেলা দেখা। কখনও মায়ের হাত ধরে পুতুলনাচের আসরে ভিড় জমানো। পুতুলনাচ যে কি ভালো লাগতো, সেই ভালোলাগা থেকেই পরে যখন জয়পুর এবং গুজরাটের ভূজে যাই তখন ওখানকার কাঠপুতলি নাচ দেখতে একটুও ভুলিনি। আর আকর্ষণ ছিল দীপক মৈত্রের সাপের খেলা, সাপকে যে এভাবে পোষ মানানো যায়, ভালোবাসা যায় তা অবাক চোখে দেখতাম। ৭২ ঘন্টা ধরে একটা লোক কিভাবে একটা কূপের মধ্যে মোটর বাইক চালিয়ে যাচ্ছে, দেখতাম। মেলায় অনেক খাবার জিনিস পাওয়া গেলেও মা কিছুটি খেতে দিত না। শুধু জৈন শিল্প মন্দিরের ডালিমের হজমি কিনতাম। চন্ডীমণ্ডপের পেছনে দশরথ চাচার লন্ড্রি ছিল। মেলার আগে চাচা ওর মুলুক বেনারস যেত, আর কি সুন্দর সুন্দর কাঁচের বেলোয়ারী চুড়ি নিয়ে আসতো। তার আকর্ষণ নেহাত কম ছিল না। মা কিনতো, আর আমার হাতের মাপে পাওয়া না গেলেও, ওই রঙীন কাঁচের ঝকমকে দ্যুতি শিশুমনেও ভালোলাগা তৈরী করতো।
তারপরে চলে এলাম সল্টলেক; দূরে দূরে বাড়ী, সরকারি বাস চলে, ব্লকে ব্লকে মার্কেট, বাড়ি বাড়ি যারা কাজ করে তারা তখনও বলে বালুর মাঠ, সে কবে ভেড়ি ভরাট করে বালি ফেলে সল্টলেক তৈরী হয়েছে, নাম চলে আসছে। তখনও জল খুবই নোনতা স্বাদের। উল্টোডাঙ্গা থানার কল থেকে জ্যারিকেনে জল নিয়ে যেত মাসমাইনের লোকেরা, নাহলে ডাল সেদ্ধ হতো না।
উল্টোডাঙ্গাই তখন ছিল সল্টলেকের প্রাণকেন্দ্র, সবকিছুর জন্য নির্ভর করতে হত। উল্টাডাঙ্গা থেকে এয়ারপোর্ট যাবার ভিআইপি রোড আজকের মতো এতো সাজানো, গোছানো ছিল না। কিন্তু রাস্তাটা ছিল সবুজে সবুজ, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, গুলমোহর গাছেরা পুরো রাস্তাটা জুড়ে চাঁদোয়া তৈরী করেছিল। বাঁদিকে দক্ষিণদাড়ি পেরোলেই একের পরে এক নয়ানজুলি, নয়ানজুলির পাশেই ইস্টার্ন পেপার মিল। রাতে দূরে দক্ষিণদাড়িতে বার্ড কোম্পানির আলো জ্বলতো, কেমন স্বপ্নময় লাগতো গোটা পরিবেশটা।
ভোরবেলা ভিআইপি রোড ছিল জাতীয় দলের অ্যাথলেটদের প্র্যাক্টিসের জায়গা। দৌড়তেন আল্ট্রা ম্যারাথনার তীর্থকুমার ফণী, গিনেসে ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী। জাতীয় সাইক্লিং দলের খেলোয়াড়েরা ভোরের আলো ফোঁটার অনেক আগেই ওখানে অনুশীলন করতেন। শীতের এক সকালে পেছন থেকে ট্রাক এসে রিক্তা মন্ডল জাতীয় দলের অধিনায়িকা সহ কয়েকজন খেলোয়াড়কে পিষে দিয়ে চলে যায়। ভোর রাতে একা রাজপথ সাক্ষী থাকে এই মর্মান্তিক করুণ পরিণতির।
সারা বছর জুড়ে পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল, ক্রিকেট টুর্নামেন্ট লেগে থাকতো। তখনও মানুষ বোকা বাক্সবন্দী, মুঠোফোনে আত্মসমর্পণ করেনি। বিকেল হলেই মাঠমুখো হত ছেলের দল। কলকাতা ফুটবল লীগের ধারাবিবরণী শোনার জন্য ছুটতে ছুটতে বাড়ী ফিরতাম। মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল নিয়ে সীমাহীন পাগলামি ছিল। মহামেডান স্পোর্টিং এদের সাথে পাল্লা দিত। মার্চ এপ্রিলে দলবদল নিয়ে সমর্থক ও কর্মকর্তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা চরমে ছিল।
তখনও কলকাতা ময়দানে পয়লা বৈশাখের দিন বার-পুজায় সমর্থকেরা প্রিয় দলের শুভকামনায় বিরাট সংখ্যায় উপস্থিত হতেন। ওয়ান ডে ক্রিকেটের রমরমা তখনও টেস্ট ক্রিকেটের আভিজাত্যকে ম্লান করতে পারেনি। শীতের দুপুরে, রোদে পিঠ রেখে পুষ্পেন সরকার, অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্যের শুনলেও, ইচ্ছে করতো না কিশোর ভিমানীর ইংরেজি ধারাবিবরণী মিস করতে। দূরদর্শন তখন ১৯৮৩ সাল থেকে ফুটবলের পাশাপাশি ক্রিকেটের সম্প্রচার শুরু করে দিলেও, আমার ফুটবলের ধারাবিবরণী শুনতেই বেশী ভালো লাগে।
বিশ্বকাপ নিয়ে উত্তেজনা বোধহয় তুঙ্গে হল ১৯৭৮ থেকে, তখন অতশত বুঝতাম না। তবে মারাদোনা জ্বরে কাঁপতে দেখলাম কলকাতা শহরকে ৮৬'তে। ৮৬'র বিশ্বকাপ, মারাদোনার বিশ্বকাপ, কিন্তু ৮২'র বিশ্বকাপে রাত জেগে ব্রাজিলভক্ত কলকাতা দেখেছে কিভাবে স্পেন বিশ্বকাপে জিকো, সক্রেতিসকে ম্লান করে পাওলো রসি এবং ইতালি শিরোনামে উঠে এলেন।
বাবা আমার ফুটবল প্রীতি দেখে, সল্টলেক স্টেডিয়ামে নেহরু কাপে মালয়েশিয়া-ভারত ম্যাচ দেখাতে নিয়ে গেলেন। সেই ম্যাচে খুব সম্ভবত ৩-২ গোলে ভারত জেতে, কিন্তু কৃশানু দের সেই অনবদ্য খেলা, বাঁ পায়ে ইনসাইড আউটসাইড ডজে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারকে নাস্তানাবুদ করে তীরের ফলার মতো বিপক্ষ রক্ষণভাগে ঢুকে পরে সেন্টার করা, দূর থেকে হাফ ভলি করে গোল করা আজও ভুলতে পারি না |
শুধুই কি খেলা আর খেলাই ছিল? তা তো নয়! পাড়ায় পাড়ায় সংস্কৃতিচর্চা তখনও পুরোদমে ছিল। জৈষ্ঠের শনিবারের সন্ধেয় পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যার আয়োজন হত। সারাদিন ধরে উত্তেজনা, স্টেজে ওঠার ভয়, সকালবেলা একবার রিহার্সাল সেরে নেওয়া, বিকেল হলেই সাজো সাজো রব। সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে, ঝুপ্পুস করে লোডশেডিং হয়ে যেত, সমবেত চিৎকার উঠতো 'জ্যোতিবাবু গেলেন'। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরেও কারেন্ট না আসায়, পরের সপ্তাহের জন্য অনুষ্ঠান মুলতবি হয়ে যেত। তবে বিকেল থেকে কালো মেঘের আনাগোণা, তারপরে সন্ধে হতে না হতেই তুমুল কালবৈশাখীর দাপটে অনুষ্ঠান পন্ড হয়ে যাওয়ার ঘটনাও বিরল ছিল না।
কখনও কখনও পাড়ার মাঠে বড়ো পর্দা টাঙিয়ে সাতদিন ধরে সিনেমা দেখানো হত। বাড়ি থেকে সেটা দেখার অনুমতি মিলতো না। কিন্তু গণনাট্য সংঘের নাটকের পক্ষকালব্যাপী শো বাবা-মায়ের সাথে দেখতে যেতাম। এভাবেই 'পদ্মা নদীর মাঝি', 'টিনের তরোয়াল' দেখেছিলাম, বলাবাহুল্য, একটুও বুঝতে পারিনি, ভালোও লাগেনি। পরে উৎপল দত্তের ওই অভিনয় দেখার সুযোগ আর পাইনি।
পাড়ায় পাড়ায় সংস্কৃতিচর্চার সাথে সাথে সাহিত্যচর্চারও পরিবেশ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরিতে তখনও সন্ধেবেলায় পাঠকদের জমায়েত ছিল। বাগবাজার রিডিং লাইব্রেরির পাঠকসংখ্যা ছিল ঈর্ষণীয়। অভিজাত, বিদগ্ধ পাঠকেরা ভিড় জমাতেন সেখানে। গরমের ছুটির দিনগুলো কি আনন্দেরই না ছিল! গরমের ছুটিতে দূরদর্শনের 'ছুটি ছুটি' প্রোগ্রাম অবশ্যই দেখতাম, 'বাড়ী থেকে পালিয়ে', 'চারমূর্তি', সত্যজিৎ রায়ের সব সিনেমা বারবার দেখতাম, তবুও পুরনো হত না। দুপুরবেলা অঙ্ক কষার পরে ছাড় পাওয়া যেত গল্পের বই পড়ার জন্য, দেব সাহিত্য কুটির থেকে মোটা মোটা পূজোসংখ্যা বেরোত, এছাড়া শুকতারায় সুধীন্দ্রনাথ রাহার গল্প, বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ, কিশোর ভারতীর রুণু ও ভাবার কাহিনী, আনন্দমেলায় সমরেশ বসুর গোগোলের কাণ্ডকারখানা, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস, শৈলেন ঘোষের লেখায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। তবে লীলা মজুমদারের লেখার অন্যরকম আমেজ ছিল। আসলে রায়চৌধুরী পরিবারের সবারই লেখার মধ্যে এতো সহজ, সুন্দর সাবলীল গতিময়তা ছিল যা হৃদয়কে খুব সহজেই স্পর্শ করতো। বিভূতিভূষণের 'পুঁইমাচা' শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' পড়ে খাটের তলায় লুকিয়ে খুব কেঁদেছিলাম। প্রতিবছর সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মের জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম।
সারাবছর রবিবারে পড়াশুনা থেকে ছুটি মিললেও, কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস থেকে নয়। রবিবারের সকালে আমরা যখন গানের স্কুলে যেতাম, দূর থেকে ভেসে আসতো, বি আর চোপড়াদের 'মহাভারত'...দেখতে ইচ্ছে হলেও উপায় ছিল না। রবিবারে রাতে অনুমতি মিলতো 'সুরভি' অনুষ্ঠানটি দেখার। খুব ভালোবাসতাম অনুষ্ঠানটি দেখতে, সিদ্ধার্থ কাক আর রেণুকা সাহানে অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। ভারতবর্ষের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতি, পরম্পরাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই অনুষ্ঠান সারা ভারতকে, 'মিলে সুর মেরা তুমহারা' এই সূত্রে গ্রন্থিত করতে পেরেছিল।
'কহী তো হ্যায় স্বপনা,
অউর কহী ইয়াদ/কহী তো হসে হ্যায়
কহী ফরিয়াদ/পলছিন পলছিন
ইয়ে হি বুনিয়াদ'
রাতে বাড়ি বাড়ি থেকে ভেসে আসতো এই সুর, পড়তে পড়তেই বুঝতে পারতাম আটটা বাজলো। গতবছর লকডাউনের দিনগুলোতে 'ব্যোমকেশ বক্সী', 'বুনিয়াদে'র পুনঃ সম্প্রচারে ফিরে গিয়েছিলাম সেই দিনগুলোতে। 'চিত্রহার' বুধবার হত, কিন্তু কোনোদিনই দেখতে পাইনি। বুধবারে হত 'দর্শকের দরবারে', হাসি হাসি মুখে তপন রায় প্রধান, চৈতালি দাশগুপ্ত দর্শকদের চিঠির জবাব দিতেন। তখন একাদশ-দ্বাদশে পড়ি, চৈতালি দাশগুপ্তের সাজ, মাথায় ফুল দেওয়া, আর দুজনের সহজ, সরল বাচনভঙ্গী খুব আকর্ষণ করতো। রবিবারের বিকেলে 'মালগুডি ডেজ্' অবশ্যই দেখতাম।
'নীল রঙা আকাশের গায় /তুলো যেন মেঘ ভেসে যায়'
ষাটের, সত্তরের দশকের ড্যাঞ্চি বাবুদের মতো বাঙালী আর পুজোয় হাওয়াবদলের জন্য গিরিডি, মধুপুর, শিমুলতলা, ম্যাকলাস্কিগঞ্জে ভিড় জমায় না। তার পায়ের তলার সর্ষেদানা তাকে টেনে নিয়ে চলে দূরে আরো দূরে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকায়, মেঘালয় থেকে গুজরাতে।
পূজোর গানের লংপ্লেয়িং রেকর্ডর জায়গা নেয় ক্যাসেট। রেকর্ড প্লেয়ার রেডিগ্রামের বদল ঘটে টেপ রেকর্ডারে। রেডিও ৮০ র দশকেও স্বমহিমায় বিরাজ করতো। 'কলকাতা ক' এর শুক্র, শনিবারের নাটকের শ্রোতা কম ছিল না। শ্রাবন্তী মজুমদারের হৃদয়গ্রাহী পরিবেশনায় 'বোরোলিনের সংসার' খুবই জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। রবিবারের বিকেলে গল্পদাদু পার্থ ঘোষ তার আসর জমিয়ে বসতেন। আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান ছিল আধুনিক গানের অনুরোধের আসর। কালজয়ী বাংলা গান মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্লা, সন্ধ্যা ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে'র কণ্ঠে, শোনার অসংখ্য অনুরোধ আসতো।
এই সময়ই বাংলা গানের জগতে অভূতপূর্ব পরিবর্তন নিয়ে এলো জীবনমুখী গান। সত্তরের দশকে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের 'মহীনের ঘোড়াগুলি' দিয়ে এই গানের যাত্রা শুরু হলেও, ছায়াছবির গানের সাথে প্রতিযোগিতায় এই গান টিঁকে থাকতে পারেনি। কিন্তু সুমন চট্টোপাধ্যায় ১৯৯২ সালে নতুন আঙ্গিকে নিয়ে এলেন জীবনমুখী গান। তিনি নাগরিক জীবনের কবিয়াল, তাঁর গানে তাই ফিরে ফিরে এলো নাগরিক জীবনের দুঃখ, যন্ত্রণা। 'তোমাকে চাই', গেয়ে তিনি আসরে নামলেন, তারপরে একে একে এলো পেটকাটি চাঁদিয়াল, গানওয়ালা, একটা নাইলন স্ট্রিঙের আকুইস্টিক গিটার হাতে জোরালো প্রতিবাদে ঝংকার তুললেন 'নিষিদ্ধ ইসতেহারে' সুমন এলেন, জয় করলেন, নতুন দিশা দেখালেন। তাঁরই দেখানো পথে নচিকেতা সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন, 'তার ও ডাক্তার,বৃদ্ধাশ্রম', গানে। আবার তিনিই গাইলেন সমকালের গান 'নীলাঞ্জনা', যখন সময় থমকে দাঁড়ায়। এলেন অঞ্জন দত্ত, গড়ে উঠলো চন্দ্রবিন্দু, ভূমি, ক্যাকটাসের মতো বাংলা ব্যান্ডের দল।
'মন মাতাল সাঁঝ সকাল কেন শুধুই কাঁদে' কিংবা 'বধূয়া আমার চোখে জল এনেছে হায়, বিনা কারণে' কিম্বা 'মনের জানলা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে...'
শুরু হলো পুরনো বাংলা গানের রিমেক, হারিয়ে যাওয়া বাংলা গান অখিলবন্ধু ঘোষ, মুকেশ, হেমন্ত, মহম্মদ রফি, জগণ্ময় মিত্র, গীতা দত্তের গাওয়া সেসব গান শ্রোতাদের দরবারে আবারও নিয়ে এলেন শ্রীকান্ত আচার্য, ইন্দ্রনীল সেন।
'প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে/কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে'
ছেলেমেয়ের মেলামেশায় অনেক স্পষ্টতা আসায় প্রেমের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এলো, দেখা সাক্ষাতের জায়গাগুলোতে প্রেমিক যুগলের দেখা মিললো। নীল, সবুজ এসেন্স মাখানো চিঠির কাগজের জায়গা নিল অর্চিসের কার্ড ভিন্ন ভিন্ন উপলক্ষে৷ পাড়ার আলো-আঁধারিতে, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করার গোপনতা থেকে মুক্তি মিলল অবশ্যই, কিন্তু গোপনীয়তার সৌন্দর্য হারাল। ওইসময়ে একটা মজার জায়গা ছিল বিধান শিশু উদ্যান ও তার কেন্দ্রবিন্দু আমাদের সবার দাদু অতুল্য ঘোষ৷ তিনি তখন রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। রাজনীতি নিয়ে একটি কথাও বলতে চাইতেন না, খুদেদের সাথেই দিন কাটাতে চাইতেন। ওঁকে কেন্দ্র করে বিধান শিশু উদ্যানে শুধু সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া বিষয়ক কর্মকান্ড চলতো না, চলতো পড়াশুনাও, তিনি স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের ডেকে নিয়ে আসতেন কিশোর সদস্যদের নিয়ে কর্মশালা, সেমিনার, বক্তৃতার আয়োজন করার জন্য। এইভাবেই খুব কাছ থেকে দেখেছি গৌরকিশোর ঘোষ, মতি নন্দী, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, আরতি সাহা, রেবন্ত গোস্বামী, মন্দার মুখোপাধ্যায়দের। প্রতিবছর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম কুড়িজনকে সংবর্ধনার আয়োজন ও দাদু করতেন।
ভারতবর্ষ কোনোদিনই কাগজে কলমে ঠান্ডা লড়াইয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পক্ষই অবলম্বন করেনি। কিন্তু সোভিয়েত যে স্বপ্ন দেখিয়েছিল পূর্ব ইউরোপ সহ সমাজতন্ত্রী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে, ভারত ও তো সেই স্বপ্ন দেখেছিলো, তাই গড়ে উঠেছিল এক পাকাপোক্ত মৈত্রীবন্ধন।
৮০' র দশকেও ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীবন্ধন অটুট ছিল। ভারতবর্ষের চায়ের সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েতের সর্বহারার একনায়কতন্ত্র সারা বিশ্বের সাথে সাথে সমাজতন্ত্রী ভারতবর্ষকেও আকৃষ্ট করেছিল। বাংলার বাড়ি বাড়ি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত নারী পত্রিকাগুলো আসতো। মানুষ শ্রেণীবৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল।
ভারতবর্ষের বলিউডি সিনেমার ভালো বাজার ছিল সোভিয়েতে। রাজ কাপুর, ইন্দিরা গান্ধীর জনপ্রিয়তা ওদেশে খুব বেশিমাত্রায় ছিল। শাড়ি পরা ভারতীয় ললনা দেখলেই ওরা 'ইন্ডিয়া গান্ধী, ইন্ডিয়া গান্ধী' বলে চিৎকার করে উঠতো ইন্দিরা আর ইন্ডিয়া ওদের কাছে সমার্থক ছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর কথা মনে হলেই মনে পড়ে যায় রাজীব গান্ধীর কথা। সুদর্শন, হাসিমুখ, ভারতের তরুণ প্রধানমম স্মৃতি উসকে দিল একটি ওয়েব সিরিজ।
লকডাউনের দিনগুলোতে ওয়েব সিরিজের দারুণ জনপ্রিয়তা সেদিন বসে বসে দেখছিলাম ফ্যামিলি ম্যান', মনোজ বাজপেয়ী, সমান্থা আক্কিনেনি আর শারীব হাশমির দুরন্ত অভিনয় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সেই দিনগুলোতে যেদিন চেন্নাই শহর থেকে অনেকদূরে পেরুমপুদুরে তামিলনাড়ু কংগ্রেসের সভাপতি জয়ন্তী নটরাজনের ডাকা নির্বাচনী জনসভায় উপস্থিত হয়ে এল টিটি ইর আত্মঘাতী বাহিনীর সদস্য তেনমোঝি রাজারত্নম ওরফে গায়ত্রীর মানববোমায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ভারতবর্ষের তরুণতম প্রধানমন্ত্রী, ১৯৯৯ সালের উও শে মে যিনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম নেতা হিসেবে তখন নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছিলেন।
আট বা নয়ের দশকে নকশাল আন্দোলন তখন স্তিমিত, কিন্তু মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। বামমনোভাবাপন্ন কোনও মানুষই বোধহয় এই আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হন নি, এমন কথা হলফ করে বলতে পারব না। মানুষের মধ্যে প্রত্যাশার পারদ অনেকখানি ঊর্ধমুখী হয়েছিল। তাই আন্দোলন শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা, এবং রাজনীতি বিমুখতা দেখা দিয়েছিল |
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের শাসনে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা এবং প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর পৃষ্ঠপোষকতায় ৭৩তম সংশোধনী আইন অনুসারে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা এবং স্যাম পিত্রদার পরিকল্পনায় টেলি কমিউনিকেশন ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটে।
খুব মনে পড়ে, প্রবীর ঘোষের উদ্যোগে গড়ে ওঠা অন্ধবিশ্বাস, বুজরুকি, জ্যোতিষচর্চা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ ও অবৈজ্ঞানিক মনোভাব, অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে যুক্তি ও বিচারবুদ্ধিকে হাতিয়ার করে মানুষের শুভবুদ্ধিকে জাগ্রত করার চেষ্টা চালায়। গণেশের দুধ খাওয়া, কিংবা জলপড়া, চালপড়ার, ওঝার ভূত ঝাড়ানো, সাপে কামড়ানো রুগীর বিষ তোলা এইসবের অযৌক্তিকতা, অবৈজ্ঞানিকতা যুক্তিবাদী চিন্তাধারার মাধ্যমে মানুষের সামনে প্রমাণ করে।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পট পরিবর্তন হয়। গরবাচেভ ক্ষমতায় আসার পরে গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রইকা নীতির সূচনা করেন। অর্থনীতিতে ওকে বাজার অর্থনীতির সূচনা করে। ভেঙ্গে পড়তে থাকে একের পর এক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর গণতন্ত্র। বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তির পতনে মুখ থুবড়ে পড়ে তৃতীয় বিশ্বের উন্নতিকামী দেশগুলির আশা ভরসা। ভারতের বামপন্থী দলগুলির মতবাদ ও তত্ত্বের আশু সংশোধন প্রয়োজন হয়ে পড়ে কিন্তু তার বদলে নিজেদের বহুধাবিভক্ত হয়ে তারা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিজেদের কর্মদ্যম ও সংহতি বিনষ্ট করে। শুরু হয়, ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের সূচনা করে।
মন তো একটা চেতনা প্রবাহ, অনুভূতির প্রবাহমান ধারা তাই, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতির প্রেক্ষাপট পরিবর্তন মানুষের মনোজগতেও বিরাট পরিবর্তন আনে। সম্পর্কগুলো অনেক স্পষ্ট হয়, স্বীকৃতি পায়, আইন আদালতের সিলমোহরও লাভ করে। 'বনমালী তুমি, পরজনমে হইও রাধা অন্তরে নারী, বহিরঙ্গে পুরুষ, কিংবা ঠিক তার উল্টো এই যে যন্ত্রণাবোধ আগেও ছিল, অসহায়তা ছিল লুক্কায়িত, কিন্তু তারা এবার প্রকাশ্যে দ্বিধাহীন হয়। মনোজগতে পরিবর্তন সমাজপরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ হয়। আজ যা অন্যায়, কাল তা ন্যায়। যুগ, সমাজের পরিবর্তনে দৃষ্টিভঙ্গীর ও পরিবর্তন। কাল যা চোখ দেখতে অভ্যস্ত ছিল না, আজ তা দেখে। ভালোমন্দের বিচারও পাল্টায়। কোনোকালেই সবটুকু ভালো, সবটুকু মন্দ হয় না। সমাজ বদলের সাথে নিজেকে বদলে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া গেলে স্থবির হতে হয় না, ব্যাকডেটেড হতে হয় না। তবে সব কিছু বদলে দেওয়াই যে সবসময়েই খুব ভালো হয়, এমন কথাও তো বলা যায় না। তবুও চরৈবেতিই হোক জীবনের মন্ত্র। তবে মূল্যবোধটুকু সাথে রাখতে হবে, সমাজ জাতির এগিয়ে যাওয়ার পথে ওটা খুবই দরকার যে।
চলার পথে আমরা সবাই হবো 'ওয়ান্ডারার্স', কূপমণ্ডুক হবো না। অতীত কে সাথী করে বর্তমানকে মান্যতা দিয়ে ভবিষ্যতের ভিত গড়ব। কি পারি, কি পারব তা নয়। স্বপ্ন তো দেখতেই হবে।
এভাবেই দিন যায়, রাত যায়, নতুন দশকে পা রাখি, পুরনো দশকের স্মৃতিরা থেকে যায়। মনে পড়ে, লীলা মজুমদারের হলদে পাখির পালকের ওই দুটি লাইন, 'ভাবতে ভালো লাগে ঝগড়ুর বুকে পোৱা দুমকা আসলে মন কেমন করা এক হারানো শৈশবের দেশ। ভালোবাসার জিনিসকে তো সঙ্গে করে বয়ে বেড়ানোর দরকার নেই, সে থাক না মনের একান্ত কুলুঙ্গিতে তোলা দুর্লভ কোনো পিদিমের মতো।