মৌমন মিত্র
১
চায়ের শেষ অংশটুকু গলায় ঢেলে মোহনার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল সাগর, ‘তার পর? সৈকত কী বলছে?’ মোহনা তখন দূরে বসা এক আদুরে কাপলকে মন দিয়ে দেখছে। সাগরের প্রশ্নে ঠোঁটে মুচকি হাসি। বলল, ‘তেমন কিছু নয়। দেখা হয় কতটুকু?’
সাগরের চোখেমুখে অশান্তির ছাপ। মনের মধ্যে যেন ঝড় বইছে। কেন? মোহনা বুঝতে পারছে না। কাফের বিল মিটিয়ে সাগর উঠে দাঁড়াল, ‘চলো, যেতে যেতে কয়েকটা কথা বলছি।’
লাঞ্চের পর মোহনা আজ অফিসের সেকেন্ড হাফটা ছুটি নিয়েছে। সপ্তাহ দুই আগে সাগর বলেছিল, ‘একটা দুপুরে লাঞ্চ করবে আমার সঙ্গে?’ আজ রনির সকার ক্যাম্প, কাল অফিসের ডেডলাইন, পরশু ইচ্ছের অফিস ট্যুর। একের পর এক চলতেই থাকবে। এরই মধ্যে আজ অফিস থেকে সময় বার করল, মোহনা। সময় বার করলই-বা কোথায়? শেষমেশ ছুটিই নিতে হল। আজ দেখা না-করলে সাগর ঠোঁট ফুলিয়ে এক মাস মোহনার ফোন ধরবে না। অথবা, মোহনাকে ফোন করবে, তার পর চুপ করে বসে থাকবে। বলবে, ‘ডোন্ট সে, তোমার সব ক'টা হার্ট বিট শুনতে দাও, প্লিজ।’ এ সব পাগলামির চেয়ে অফিস কামাই করা ঢের ভাল। যদিও মনে মনে সাগরের সব রকম পাগলামি মোহনা প্রচন্ড ভালবাসে।
কাফের বাইরে এসে দু'জনে দেখে মেঘে মেঘে আকাশ ভার। গাড়িতে উঠে, ‘হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম,’ টার্নপাইকের প্রথম বাঁক নিয়ে সাগর ফের কথা শুরু করল। গাড়ির স্পিকারে ফোন বেজে ওঠে। সাগরের মায়ের নম্বর। বেজে চলেছে। বেজে চলেছে। মোহনা অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘কাকিমার কলটা ধরো।’
‘না। আজ সবাই জানে আমি দুপুর থেকে রাত ন'টা পর্যন্ত ব্যস্ত। অনর্থক কল করলে ধরব কেন?’
এই কথার উত্তর খুঁজে পেল না, মোহনা। এও মনে হল সাগরকে এক্ষুনি জাপটে ধরবে। আদর চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘রাত ন'টা? দেরি হয়ে যাবে না।’
সাগরের সোজাসাপটা উত্তর, ‘হোক। একটা দিন দেরি হলে কিছু হবে না। সৈকতের কথাটা বলতে দেবে?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। বলো। ছেলেটার কথাবার্তায় বেশ রঙিন মানুষ মনে হচ্ছে।’
‘আমি বলেছিলাম না, হি কামস উইথ আ ব্যাগেজ?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু ব্যাগেজ বলতে কী বোঝাতে চাইছ?’
সাগর গলা চড়িয়ে বলল, ‘কাম অন, মোহনা! সায়েন্সের স্টুডেন্ট হয়ে লজিক্যালি ভাববে না? ব্যাগেজ মানে বুঝতে পারছ না? ও কতগুলো রিলেশনশিপে ছিল ধারণা নেই তোমার। আমি সেটাই বলতে চেয়েছি।’
‘আমার ধারণা নেই। ধারণা হবে কীভাবে? এক মাস হল পরিচয় হয়েছে। তা ছাড়া ওর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর সৈকতকে তোমার নাম বললাম, ও বলল তোমাকে চেনে। তার পরে প্রথমদিনই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম...’
মোহনার কথা মাঝপথে থামিয়ে সাগর বলল, ‘হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করেছিলে। সেদিনও আমি একই কথা বলেছিলাম। হি কামস উইথ আ ব্যাগেজ। ও আমার পাড়ার ছেলে, আমি জানি।’
মোহনা মনে মনে বিরক্ত বোধ করছে এখন। ভুরু কুঁচকে সাগরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইউ আর টু মাচ! ব্যাগেজ শব্দটার অনেক রকম অর্থ হতে পারে। এ সব আগে জানলে ওকে হয়তো গানের দলে নিতামই না।’
দু'জনের কথোপকথনের মাঝে আবার সাগরের দু'তিনবার ফোন এল। সাগর ফোন নম্বরগুলোর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। এই বিষয়টা মোহনাকে ভাবায়। ইচ্ছের সঙ্গে সাগরকে কখনও তুলনা করে না সে। তাদের বিবাহিত জীবন তেরো বছর কেটে গেছে। এখন ইচ্ছে যেমন মোহনার জীবনের এক চৌখুপিতে দায়িত্বশীল স্বামী, সঙ্গী। সাগর অন্য চৌখুপিতে দুরন্ত প্রেমিক। প্রতিটি অভিসার মুহূর্ত সাগর কোন অজানা অপূর্ব রোদ ছায়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
মোহনার সঙ্গে সাগরের আলাপ হয়েছিল একটা ফটো শুটিংয়ে। লম্বাটে ব্যাকইয়ার্ডের এক কোণে মোহনা অফিসের জন্য ফ্যাশন ফটোগ্রাফি করছে। পিছনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা বেঞ্চে হোঁচট খেয়ে সাগরের বুকে ধাক্কা খেয়েছিল মোহনা। আলাপ শেষে ফোন নম্বর নিলেও সাহস করে ফোন করতে পারেনি সাগর। মোহনা মনে মনে ভেবেছিল, ‘যোগাযোগ করবে না, ঢং করে নম্বরটা নিয়েছিল কেন?’
দু'বছর পর ব্রিজওয়াটারের এক সান্ধ্য পার্টিতে মোহনা আবার সাগরের মুখোমুখি। সাগর সেদিন ব্লু ডেনিমের ওপর বেজ শার্ট পরেছিল। চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা। সেই সন্ধ্যায় মধ্য পঁয়ত্রিশের ছেলেটার চোখে বিশ্বের সমস্ত মায়া ভর করেছিল।
মোহনার পরনে ছিল ওয়াইন রঙা শিফন। সেই পার্টিতে বিহাইন্ড দ্য স্ক্রিন ভিডিও শুট করতে বলা হয়েছিল মোহনাকে। শুক্রবারের রাতে মোহনার পেশাগত গ্ল্যামার দেখে টানা ড্রিঙ্ক করেছিল সাগর। ভাগ্যিস, অফিস পার্টিটায় সেদিন ইচ্ছে সঙ্গে ছিল না। সাগরকে ওয়েস্টফিল্ডের বাড়িতে ড্রপ করে মোহনার বাড়ি ফিরতে রাত পৌনে তিনটে হয়ে গেছিল।
আজও তেমনই হতে পারে। একা বাড়িতে মোহনার গলায় একটানা গান শুনবে সাগর। বলবে, ‘মোহনা, আর-একটু গাইবে? তুমি গাইলে শান্ত হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে তোমার কোলে সব দুঃখ ঢেলে কাঁদি। আমি তো তোমার মতন ব্যালেন্সড নই।’
হয়তো সাগর একটা ড্রিঙ্ক হাতে মোহনাকে ‘উল্লাস’ বলবে। হয়তো ঠোঁটে ঠোঁট মিশে তৈরি হতে পারে সুরেলা নেশার ক্যানভাস। যাকে এড়াতে চায় না মোহনা। সাগরের স্ত্রী, অনিতা মেয়েকে নিয়ে এখন কলকাতায়। দিন সাতেক পর ফিরবে।
জেনেবুঝেই মোহনা আজ এখানে। সাগরের বেসমেন্টে।
নানা ভাবনার মধ্যিখানে চোখের সামনে ফোন স্ক্রিনে সৈকতের নম্বর ভেসে উঠল। একবার। দু'বার। তিনবার। ঘড়িতে রাত সাড়ে ন'টা। আড়চোখে মোহনার ফোনের দিকে তাকিয়ে সাগর বলল, ‘সুইচ ইট অফ!’ মোহনা থমকানো গলায় বলল, ‘এই নিয়ে তিনবার কল করল ছেলেটা। একবার কথা বলে নিই।’
সাগর উঠে সেলারের দিকে চলে যাচ্ছে। মোহনাকে কথা বলার স্পেস দিয়ে গেল কি? নাকি সে ছেলেটাকে ফোন করবে বলে রেগে গেল সাগর? মোহনা দোনামনায় কল করল সৈকতকে। চারপাশে তখন মাঘের জ্যোৎস্না। পর্দার আড়ালে চাঁদের আলো উঁকি দিচ্ছে। আকাশে ফোঁটা ফোঁটা মেঘ।
ওপার থেকে সৈকত কাঁপা গলায় অস্ফুটে বলল, ‘তুমি আজ সাগরের সঙ্গে লাঞ্চে যাবে বলেছিলে। ও কী বলছে?’
মোহনা যে সাগরের অনেক বছরের বন্ধু, সৈকত জানে। সেন্টার টেবিলের উপর রাখা ওয়াইন গ্লাসের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে মোহনা উত্তর দিল, ‘তুই এগুলো জানতে চাইছিস কেন? তুই বুঝবি না।’
ছটফটে গলায় সৈকত চেঁচিয়ে বলল, ‘আমি তোমার চেয়ে চার বছরের ছোট, সেইজন্য বুঝব না? বলো? সাগরও ছোট। আমি আর সাগর এক বয়সি।’
‘তুই ফোন রাখ।’
‘রাখছি। কিন্তু এটুকু জানবে এরকম পাগলের মতো তোমাকে কেউ ভালবাসবে না। কেউ না। কেউ না।’ শেষের ‘কেউ না’ টুকু ধীরে ধীরে মোহনার কানে ফেড হয়ে যায়। গানের শেষ লাইনের মতো।
বাড়ি ফিরতে হবে, অনেক রাত হয়ে গেল। ফোনটা রেখে মোহনা সবে উঠে দাঁড়াবে, এমন সময় পিছন থেকে এসে সাগর জড়িয়ে ধরল মোহনার ছিপছিপে কোমর। জড়ানো গলায় মোহনা বলল, ‘তোমার প্রেমে জোর নেই? সৈকতের প্রেমিক সত্ত্বাকে ভয় পাও কেন?’
সাগর এক ঝটকায় পেশাদার ফটোগ্রাফার মোহনাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘তোমার ঠোঁটে আমার ওয়াইন ভেজা ঠোঁট নাও। মাঝ সাগরে ডুবলে সৈকত অনেক দূরে চলে যায়। তা ছাড়া সৈকত তো অদিতিকে ভালবাসে। সম্পর্কে হারানোর ভয় স্বাভাবিক, মোহনা। অথচ কে না জানে, সম্পর্কের নেশাটাই ভয়ংকর।’
২
মেটাচেনের একটা আট তলা বিল্ডিংয়ের চার তলায় মোহনার স্টুডিও। ছোটবেলা থেকেই ক্যামেরা ও শুটিংয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল। বাবার দেওয়া পকেটমানি দিয়ে ক্যামেরার রোল কিনত। টুকটাক ছবি তুলতে ভালবাসত। অথচ মোহনার পড়াশুনোর বিষয় ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।এমবিএ করে মার্কেটিংয়ে। দিল্লির একটা বহুজাতিক কম্পানিতে ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টেন্ট হিসেবে চাকরি করতে করতে ইচ্ছের সঙ্গে আলাপ, প্রেম। একমাত্র মেয়ের যে-কোনও সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন মোহনার মা-বাবা। বিয়ের পর ইচ্ছের চাকরিসূত্রে আমেরিকায় চলে আসতে হয়। মোহনার মা বলেছিলেন, 'নিজের শখ, প্যাশনগুলো বিসর্জন দিও না।'
আমারিকায় ইচ্ছে এবং মোহনার প্রথম শহর ছিল মিশিগান। ইচ্ছের এক বন্ধুর একটি প্রজেক্টের জন্য ফটোগ্রাফার খুঁজছিল। একটি বহুজাতিক সংস্থার ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে ছবিগুলি। ওটাই ছিল মোহনার প্রথম ক্লায়েন্ট অ্যাসাইনমেন্ট। এরপর দু-'একজন ফটোগ্রাফারকে নিজের কাজ দেখাতে শুরু করে মোহনা। তখন ডিএসএলআর কেনার সামর্থ্য ছিল না। ক্রমশ সে ওয়েবসাইট ডিজাইনিং এর কাজ শুরু করল। নিজস্ব ব্লগও ছিল। যা কাজ করত, ওখানেই আপলোড করে দিত। পরিশ্রম করতে করতে অবশেষে সম্পূর্ণ নিজের উপার্জনে তৈরি করেছে এই স্টুডিওটি। এখন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট হোক কিংবা নিজের প্রজেক্ট, ওর ছবি তোলার মুনশিয়ানা সকলের নজর কাড়ে! একাধিক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের হয়ে ছবি তুলেছে, মোহনা।
আজ ফটো এডিটিং করতে অনেক রাত হয়ে যেতে পারে। ইচ্ছেকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে মোহনা, ‘রনিকে সাঁতার থেকে পিক আপ করে ডিনার দিয়ে দিও। তুমিও খেয়ে নেবে। আজ আমার ফিরতে অনেকটাই রাত হবে, মনে হয়।’
কাজের ফাঁকে ফাঁকে চোখ তুলে ফোন স্ক্রিন দেখছে মোহনা। সৈকতের ন'টা মিসড কল। ফের বেজে উঠল। শান্ত স্টুডিওর পরিবেশে সৈকতের রিং টোন এলে ভালই লাগছে। দরজায় ঠক ঠক শব্দ। মোহনা চমকে বলে, ‘ইয়েস...’
সৈকত। মোহনা আরও চমকে উঠে দাঁড়াল।
‘একি! তুই?’
‘কী করব? ফোন ধরছ না। চিন্তা হয় না? ভাবলাম বাড়ি ফেরতা একবার তোমার ষ্টুডিওতে ঢুঁ মেরে যাই।’
মোহনা উল্টোদিকের ঘুরন্ত চেয়ারটা দেখিয়ে সৈকতকে বসতে ইশারা করল, ‘ব্যস্ত ছিলাম। বোস। চা খাবি?’
ও মাথা নিচু করে বলল, ‘খাব। দু'মিনিটের জন্য ফোন ধরা যায় না?’
সৈকত বসামাত্র মোহনা উঠে গটগট করে হেঁটে গেল ঘরের কোণে রাখা টেবিলের দিকে। কেটলিতে জল বসিয়ে বলল, ‘একটা চিপ মেয়ের সঙ্গে তোর নাম জড়িয়ে আছে। আমি তোর সঙ্গে প্রেম করতে পারব না। সরি।’
এই প্রথম সৈকত অবাক চোখে রাগি মোহনাকে দেখছে। ধরা গলায় প্রশ্ন করল, ‘কার কথা বলছ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’
মোহনা চামচে জোরে জোরে শব্দ করে চায়ে চিনি মিশিয়ে বলল, ‘দ্যাট বিচ! অদিতি! এর ওর পোস্ট নকল করবে। কোনও ক্রিয়েটিভিটি নেই।’ আর-একটু রাগি গলায় বিদ্রূপের হাসি ঝুলিয়ে মোহনা বলে, ‘আর ওর সাজ পোশাক? আলতো নেভাল বাটন, সামান্য ক্লিভেজ, ঠিক আছে। কিন্তু অদিতি? সারাক্ষণ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায় নগ্ন হয়ে লাইক চেয়ে বেড়ায়। পিউর স্লাটিশ লুক! যাকে তোদের ভাষায় ‘সেক্সি’ মনে হয়।’
‘তোমাকে কে বলল আমি অদিতির ঘনিষ্ঠ বন্ধু?’
মোহনা ধমকের সুরে বলে, ‘কে বলল ইজ নট ইম্পরট্যান্ট। ছবি দেখেছি। সেটা মিথ্যে?’
‘কোন ছবি?’
মোহনা নিজের চেয়ারে ফিরেছে। চায়ের কাপটা সৈকতের হাতে ধরিয়ে বলে, ‘শোন, ধরে নিচ্ছি, ছবিটাও ফেক। কিন্তু তুই যে মেয়েটাকে চিনিস, এটাই আশ্চর্য লাগে! মেলাতে পারিনি। প্রথম প্রথম মনে হত ইউ আর নট ক্রাউড।’
‘অদিতির কথা সাগর বলেছে? মিথ্যে বলছে ও।’
‘সাগরই বলেছে এমনটা ভাবছিস কেন?’
ডান হাতের প্রথম আঙুলটা সৈকত কাপের গোল রিমে ঘুরিয়ে বলল, ‘একটি কুঁড়ি, দুটি পাতা। কী মহিমা! তোমার হাতের চায়ে জাদু আছে, মোহনা। প্রতিদিন এক কাপ চা দেবে আমাকে?’
মোহনা চা শেষ করে সৈকতের কাছে এসে দাঁড়াল। রাগি গলায় বলল, ‘না, তুই চা শেষ করে চলে যা। আমার এখনও ঘন্টাখানেক কাজ করতে হবে।’
মোহনার প্রেমিকরা ওর চেয়ে বয়সে ছোট হয়। এমনটা মোহনাই পছন্দ করে। বয়সে ছোট প্রেমিককে ধমক দিতে পারে, শাসন করা যায়, ইচ্ছেমতো আদর শেখাতে পারে। প্রেমিকের চোখে বিস্ময় হওয়ার মধ্যে একটা চাপা তৃপ্তি লুকোনো থাকে। কিন্তু, মোহনা প্রেমিকের থেকে বয়সে ছোট হলে তখন প্রেমিক হয়ে যায় মোহনার বিস্ময়। তাতে নিরলস আনন্দ নিহিত থাকলেও বিস্ময়ের পরিতৃপ্তি কম। অনেকটাই কম।
এখন সৈকতের চোখের সেই বিস্ময় হয়ে উঠতে চাইল, মোহনা।
সৈকত তড়াং করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। কাছে গিয়ে মোহনার ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, ‘আমাকে তছনছ করে দিয়েছ তুমি! সাগরকে কাটাও। জানো না বুঝি, 'অধিকন্তু ন দোষায়'! ও একটা ঘোস্ট প্রেমিক। প্রেমিকাদের সঙ্গে ঘোস্টিং করে। আমিও সাগরের মতো মিউজিক ভিডিও বানাতে পারব তোমার জন্য।একটা চান্স দাও।’
বাঁ-হাতে সৈকতকে সরিয়ে ভুরু কুঁচকে মোহনা জানতে চাইল, ‘ঘোস্টিং মানে?’
‘ঘোস্টিং মানে, ধরো, কল, ই-মেল অথবা কোনওরকম যোগাযোগ ছাড়াই কারও জীবন থেকে তুমি অদৃশ্য হয়ে গেলে। ডেটিং জগতের খুব সাধারণ ঘটনা।’
সাগর সম্পর্কে এরকম কথা শুনতে ভাল লাগছে না, মোহনার। সে ঝাঁজিয়ে বলে উঠল, ‘শোন সৈকত, আমি ওল্ড স্কুল, এ সব বুঝি না। তা ছাড়া সাগরকে আমি প্রায় পাঁচ বছর চিনি।’
টেবিলের উপর ফোনের ঝংকার। সাগরের নম্বর ভেসে উঠল।
‘এত রাতে সাগর ফোন করে তোমায়?’ প্রশ্ন করে মোহনার দিকে স্থির তাকিয়ে রইল সৈকত।
মোহনা কোনও উত্তর দিল না। হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলল। সাইলেন্ট করে উল্টিয়ে ফের টেবিলের উপর রাখল।
‘তুই এখন যা, সৈকত। আমার ভাল্লাগছে না।’
‘না, আমি যাব না।’ বলে মুখ গোঁজ করে সৈকত বসে রইল। ফোন সাইলেন্ট মোডে কেঁপে কেঁপে ওঠে কতবার। যতবার কাঁপে ততবার সৈকত মায়া চোখে তাকায় মোহনার দিকে।
মোহনার দৃষ্টি পড়তে পারছে না সৈকত। কখনও মনে হচ্ছে সে কাতর, কখনও আদুরে, কখনও ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। মুখ হাঁড়ি করে চুপচাপ বসে আছে।
‘তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ? খুব কষ্ট হচ্ছে, মোহনা, প্লিজ বোঝো…আমি অদিতিকে ভালবাসি না। আই জাস্ট নো হার।’
সৈকত কথা শেষ করার আগেই দরজা খুলে ইচ্ছে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল।
মোহনা নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি?’
সৈকতের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছে ফুঁসে উঠল, ‘কেন? আসা বারণ? ফোনটা তুলে দ্যাখো। সেভেন মিসড কল। রনির খেলতে খেলতে হাঁটু ছোঁড়ে গ্যাছে। আমি সিভিএস এসেছিলাম ওষুধ কিনতে। ভাবলাম তোমাকে বলে যাই।’
সৈকত অপ্রস্তুত গলায় বলে, ‘আমি তা হলে আসি, মোহনা। ফাইলগুলো মিলিয়ে নিও। ছ’টা পোস্টার সাইজ, আর বাকিগুলো ফোর বাই সেভেন।’
সৈকত চলে যাওয়ার পর স্টুডিওর মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে মোহনার।
‘লেটস গো। রনি নিশ্চয়ই গাড়িতে অপেক্ষা করছে। অনেকটা কেটে গেছে, না?’
ইচ্ছে ঘাড় নেড়ে বলে, ‘শরীরের ক্ষত মিলিয়ে যাবে। মনের ক্ষত জমলে...’ ইচ্ছের কথা থামিয়ে মোহনা বলল, ‘আমাকে অপরাধী ভাবানোর চেষ্টা করবে না। কাজে ব্যস্ত থাকব বলেই ফোনটা সাইলেন্ট মোডে রেখেছিলাম। কীভাবে বুঝব রনির ব্যথা লাগবে?’
ইচ্ছে দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করে বলল, ‘ভাগ্যিস সাইলেন্ট রেখেছিলে ফোনটা। আজ সৈকতের সঙ্গে দ্যাখা হয়ে গেল।’
মোহনার কানে এসেছে কথাটা। না-বোঝার ভান করে সে দৌড়ে বেরিয়ে গেল রনিকে দেখতে।
রনি গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ছেলেকে আদর করে মোহনা নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। পিছন থেকে ইচ্ছে ডাকল, ‘একসঙ্গেই চলো। তোমার গাড়িটা এখানেই পার্ক করা থাক। কাল সকালে আমি অফিস যাওয়ার পথে তোমাকে স্টুডিওতে ড্রপ করে দেব।’
মোহনা ঘুরে তাকায়। হেসে বলে, ‘থাক, তুমি বেরিয়ে যাও। আমার সঙ্গে অনেকরকমের ব্যাগ, অগোছালো কাগজপত্র। তোমার গাড়িতে বসলে সব মিসপ্লেস হয়ে যাবে।’
ইচ্ছে কথাটা না শোনার ভান করে আবার ডাকল, ‘চলে এসো না...’
‘নাহ। অনেক ব্যাগেজ হয়ে গেছে, ইচ্ছে। আমার গাড়িতেই সুবিধে। আমি আমার মতো সামলে নেব।’ বলে মোহনা দরজা খুলে গাড়িতে উঠে বসল। স্টিয়ারিংয়ে হাত দেবে। তখন হোয়াটস্যাপে টুং টাং। চমকটা পেল দিনের শেষে। মেসেজ খুলে দেখে পোড়া একটা আঙুলের ছবি।
মোহনা লিখল, ‘একি! কী করে পুড়ল?’
উত্তর এল, ‘সিগারেট।’
মোহনা লিখল, ‘মানে?’
‘সন্ধেবেলা তোমার স্টুডিওতে পৌঁছে দেখি সৈকতের গাড়ি। বুঝলাম কোনও ছুতোয় ব্যাটা চলে এসেছে। এও মনে হল, তুমি ডাবল টাইমিং করছ, একটু হলেও আমাকে কিছুটা অবহেলা করছ। গাড়িতে বসে প্রতারিত প্রেমিকটি একটি সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ পর দেখি আঙুলের মাঝখানটা ভয়ংকর জ্বলছে!’
মোহনা এখন নিস্তব্ধ রাতের আকাশের তলায় একা বসে ভাবছে। সাগরের পোড়া আঙুল, রনির হাঁটুর চোট, ইচ্ছের সন্দেহ চোখ, সৈকতের অঢেল পাগলামি, কোন ব্যাগেজ তাকে ভিতরে ভিতরে একই সঙ্গে নিঃস্ব এবং পুলকিত করতে পারে? যাতে সেটা আর কখনও ব্যাগেজ বলে ভাবতে ইচ্ছে করবে না। কোনও ব্যাগেজ যেন মোহনার আত্মশ্লাঘায় আঘাত না-করে।
প্রথম দুই আঙুলে কপাল টিপতে টিপতে মোহনা ভেবেই চলে, ‘মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে! সাগর না সৈকত? কে মোহনার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিতে পারবে? আমার যাবতীয় ত্রুটিবিচ্যুতির ব্যাপারে জানার পরও আমার পাশে থাকবে? কে হতে পারে মোহনার একমাত্র প্রেমিক-কাম-বন্ধু? এক কাপ চা হলে, মাথার ভার খানিকটা কমত। একটি কুঁড়ি দুটি পাতার অনবদ্য রসায়ন!'