নির্বাসন
শেষবার তার সাথে হাঁটলাম। আজ শেষ দেখা তাই কি এত সেজে সে আমার কাছে? কয়েকটা কবিতার ছেঁড়া পাতা ছড়িয়ে রয়েছে সারা রাস্তা জুড়ে। আমার একপাশে আমার প্রিয় মাতৃভূমি একপাশে নির্বাসন। মাথা আমার নিচু ছিলো। মাতৃভূমির কাছে তো মাথা নিচুই থাকবে। সে একবার দুবার বলার চেষ্টা করেছিলো, মানে বাধা দেবার। নির্বাসনে যেতে বাধা দেবার। আমি ইশারায় বুঝিয়ে দিয়েছিলাম সে চেষ্টা বৃথা। নির্বাসন আমার আজন্ম লালিত প্রেমিকা। তাকে জড়িয়ে ধরতে বাধা কিসের। হাঁটতে হাঁটতে মনে আসছিলো সেই সব অন্ধকার স্বাদ। যেদিন প্রথম আমার বন্ধু পিনাক কে তুলে নিয়ে গেল ফাঁড়িতে সেদিন প্রথম দেখেছিলাম রাত কত কালো। এমনিতে আমি ঘুমকাতুরে, একটু ফুল বিছানো মাটি পেলেই ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু সেদিন সারারাত ঘুম হয়নি আমার। পিনাক ফিরে ছিলো দিন পাঁচেক পর। তারপর থেকে ও খুঁড়িয়ে হাঁটে। আমার মনে আসছে ভাঙ্গা ছাদের জীবন, শিমুল ফুলে সাজানো টিলা ঘেঁষা রাস্তা, টালির চালের স্কুল ঘর, জীবন মাস্টারের কাছে অঙ্ক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ার দিন। অঙ্কে আমি বরাবর কাঁচা। তাই মেলাতে পারিনি নির্বাসন আর মাতৃভূমির অঙ্ক। ইতিহাস ঘেঁটে দেখলাম নির্বাসন এক প্রাচীন অঙ্ক। যে মানুষ বুঝেছে সে হেঁটেছে, হাজার বছর হেঁটেছে। হাজার হাজার পদক্ষেপ।
আলো কই?
চারিদিকে একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। মাংস পোড়া,জামা পোড়া, কিছু মন ও পুড়ে গেছে। দেবতা ঝুলছে পোড়া দেওয়ালে। দিন নেই, রাত নেই, ভারী বুটের শব্দ। খুব ক্লান্ত লাগছে। গত তিন দিন গ্রামে সূর্য ওঠেনি। উনুনে আগুন নেই তিন দিন। ভাতের গন্ধ ভুলতে বসেছে গ্রামবাসী। ভয় পাচ্ছে, আবার যদি পুড়ে যায় বালিশ বিছানা চাদর। মণ্ডল কাকা বলছে-কালো ভাত, থালায় শুধু কালো ভাত দেখছি।সাদা পাঞ্জাবি কিছু লোক আসছে, কিসব শক্ত শক্ত কথা বলছে,সাথে ক্যামেরার ঝলসানি। লাল নীল হলুদ সবুজ নানা রঙের কথা। পোড়া ভাতের পাশে কি সুন্দর মন ভালো করা রঙিন মাইক। এতে কান্না আরও তীব্র শোনায়, রাষ্ট্রের কানে সে কান্না পৌঁছায় কিনা তা যদিও জানা নেই। আর পৌঁছলেই বা কি! রাষ্ট্র তো কবে থেকেই কালা। রাষ্ট্রের হাত লাল থাকে সর্বদা। কখনও জমাট রক্তে মাছি ভনভন করে। কেনই বা রক্ত ঝরলে তুমি কাঁদতে আসো রূপালী পর্দায়?অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ভেসে আসছে। ঔদ্ধত্যর সামনে মাথা হেঁট করে আছে প্রাচীন বট। কিভাবে এই রাত কাটবে জানিনা। সামনে সূর্য দেখা যাচ্ছে কিন্তু আলো কই?
