দোঁহা

সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান

 


দেবলীনা চক্রবর্তী 

আমাদের ছোটবেলা জুড়ে একটা ছাদ ছিলো, ছিলো একচিলতে চিলেকোঠা, আচার চুরি, ঘুড়ির লড়াই, শীতের মিঠে রোদের কমলালেবুর ভাগাভাগি, ছিলো লোডশেডিংয়ে তারা গোনা রাত আরও অনেক কিছুর মধ্যেই ছিলো পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রাখা কমিক সিরিজ। তখন ছিলো বন্ধুদের মধ্যে রেষারেষি কে কোন কমিক আর কোন সংখ্যা আনন্দমেলা, সন্দেশ, চাচা চৌধুরী পড়ে ফেললো এবং সেগুলো গোগ্রাসে পড়ে ফেলতেই হবে নাহলে বন্ধুদের মধ্যে গল্প আড্ডায় যোগ দেওয়া যাবে না যে! কিন্তু আরো একটা ভীষণ ভালো অভ্যাস ছিল আমাদের যে কেউ একজন এবং সকলেই কোন না কোন একটি বই কিনে সব বন্ধুরা মিলেমিশে বইগুলো শেয়ার করে পড়ে নিতাম আর সেই অপেক্ষার আনন্দ উত্তেজনাটা ছিল সাংঘাতিক রকমের। 

হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দি গ্রেট এই সমস্ত চরিত্র গুলো পড়ার সাথে থাকত গোয়েন্দা গল্পের সিরিজ আরো একটা বিষয় ভীষণ আকর্ষণ করতো সেটা হলো কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী। সে এক অন্য পৃথিবী, অন্য টান...

কল্পবিজ্ঞান...মনে পড়লেই চোখের সামনে ভেসে উঠে অদ্ভুত কিছু দৃশ্য। ভিন গ্রহের প্রানীর সাথে মানুষের যুদ্ধ, কিংবা রোবট নিয়ন্ত্রিত পৃথিবী...কল্পনার সাথে বিজ্ঞান মিলে এরকম সব অবিশ্বাস্য দৃশ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে এক একটি কল্পবিজ্ঞানের কাহিনী।

প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু মনে আছে তো? যিনি প্রোফেসর শঙ্কু নামে পরিচিত। একজন বৈজ্ঞানিক ও আবিষ্কারক। তাঁর বিজ্ঞানের সকল শাখায় তাঁর অবাধ গতি; তিনি ৬৯টি ভাষা জানেন ও হায়ারোগ্লিফিক পড়তে পারেন; এবং বিশ্বের সকল দেশ, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি ও বিশ্বসাহিত্য সকল বিষয়ে তাঁর ধারণা আছে। প্রোফেসর শঙ্কু তীক্ষ্ণবুদ্ধি, নির্লোভ, সৎ ও স্বদেশপ্রেমিক; ভারতের সনাতন ঐতিহ্য সম্পর্কে তিনি শ্রদ্ধাবান এবং একই সঙ্গে শ্রদ্ধা করেন সমগ্র বিশ্বের প্রাচীন সাহিত্য ও শিল্পকেও।প্রোফেসর শঙ্কু থাকেন, তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী বছর ২৪এর নিউটন নামে একটি পোষা বিড়াল ও তাঁর চাকর প্রহ্লাদকে নিয়ে। তাঁর মোট ৭২টি আবিষ্কারের কথা জানা যায়। যেমন, তাঁর আবিষ্কৃত রোবট বিধুশেখর সাধু ও চলিত বাংলায় কথা বলতে পারে; আবার তৃষ্ণানাশক বড়ির নাম ‘তৃষ্ণাশক বড়ি’। অন্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল বটিকা ইন্ডিকা, এয়ারকন্দিশানিং পিল, লিঙ্গুয়াগ্রাফ, লুমিনিম্যাক্স, সমুনলিন, রিমেম্ব্রেন, মিরাকিউরল, রোবু ও বিধুশেখর নামক দুটি রোবট, অ্যানাইহিলিন পিস্তল, শ্যাঙ্কোপ্লেন, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-শঙ্কু ফরমুলা ইত্যাদি। 
কি কিছু মনে পরছে ! 
এখানে সত্যজিৎ রায় রচিত বিখ্যাত কল্পকাহিনী প্রফেসর শঙ্কু সিরিজের কথা বলছি। 

 আজ সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে কিছু কথা বলব।
বিজ্ঞান কল্পকাহিনী আধুনিক কল্পকাহিনীমূলক সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা, যাতে ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত আবিষ্কার ও উদ্ভাবন এবং মানব সভ্যতাকে কেন্দ্র করে পটভূমি রচনা করা হয়। মানব সভ্যতা মধ্যযুগে থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশের সময় যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সৃষ্টি এবং তার প্রয়োগের ফসল বলা চলে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। ইংরেজিতে একে “সাইন্স ফিকশন” বলা হয়। 
আর্থার সি ক্লার্ক’কে বিবেচনা করা হয় সাইন্স ফিকশনের জনক হিসেবে। ‘Two Thousand One Space Odyssey’ ক্লাসিক গ্রন্থসহ প্রায় ১০০টি রহস্যগ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। সাইন্স ফিকশন রচয়িতা হিসেবে জুল ভার্নের নামও সমানভাবে উচ্চারিত হয়। তিনি তার সাবলীল লেখনির মাধ্যমে একজন প্রসিদ্ধ সাইন্স ফিকশন লেখক হিসেবে পরিচিতি। বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে মানুষের বিজ্ঞানমুখিনতা তাকে সাইন্স ফিকশনের প্রতি আকর্ষিত করেছে, বাংলা সাহিত্যেও এর প্রভাব দেখা যায়। উনিশ ও বিশ শতকের প্রথমদিকে ব্রিটিশ অধ্যূষিত অবিভক্ত ভারতে বাংলা ভাষার সাহিত্যিকরা বিভিন্ন বিষয়ে সাইন্স ফিকশন রচনা করেছেন। ১৮৭৯ সালে বিখ্যাত বাঙালি সাইন্স ফিকশন রচয়িতা জগদানন্দ রায় ‘শুক্রভ্রমণ’ রচনা করেন। জগদানন্দ রায় শান্তিনিকেতনের শিক্ষক ছিলেন। হেমলাল দত্ত ১৮৮২ সালে ‘দর্পণ’ পত্রিকায় ‘রহস্য উপন্যাস’ লিখে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। জগদীশ চন্দ্র বসুকে বাংলা সাইন্স ফিকশনের জনক বলা হয়। জগদীশ চন্দ্র বসু বহির্জাগতিক প্রাণের দেখা পাওয়ার বিশ্বাস থেকে ‘সাইন্স ফিকশন’ নির্ভর সাহিত্য রচনার শুরু। ১৮৯৬ সালে লেখা ‘নিরুদ্দেশের কাহিনী’ বাংলা সাইন্স ফিকশনের ইতিহাসের মাইলষ্টোন। তার ‘পালাতক তুফান’ সে সময় বেশ জনপ্রিয় হয়। 

প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম উপন্যাস ‘কুহকের দেশে’, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ‘মেঘদুতের মর্তে আগমন’সহ বেশকিছু রহস্য উপন্যাস সে সময় জনপ্রিয় হয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের উত্তরসুরী অদ্রিশ বর্মন সহ অনেকেই সাইন্স ফিকশন লিখতে শুরু করেন। কিন্তু প্রেমেন্দ্র মিত্র ছাড়া সবাই ‘সাইন্স ফ্যান্টাসি’ লেখক হিসেবে বেশি পরিচিতি পান। ১৯৬০ সালে সত্যজিত রায় ‘দি এলিন’ লেখেন। যেটি মি. অ্যাং নামে ব্যাপক পরিচিত পায়। ভারতের অন্যান্য লেখকদের মধ্যে লায়লা মজুমদার, সুনীল গাঙ্গুলী, কিন্নর রায়, শীর্ষেন্দু মুখার্জী, সমরেশ মজুমদার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অন্যতম। বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নারীদের অধিকার সচেতনার পক্ষে একটি অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম। “সুলতানা’স ড্রিম” ১৯০৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আহমেদের সাইন্স ফিকশনবিষয়ক প্রথম উপন্যাস ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’। এটি বাংলাদেশের প্রথম পূর্ণ সাইন্স ফিকশন উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত।

হুমায়ুন আহমেদের ‘তারা তিনজন’, ‘ইরিনা’ ‘অনন্ত নক্ষত্র বীথি’, ‘ফিহা সমীকরণ’ বাংলা সাইন্স ফিকশনে এক অনন্য সংযোজন। মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বাংলা সাইন্স ফিকশনকে আধুনিক ঘারানায় উপস্থাপন করেন , যা আধুনিক সাহিত্যে এক বিশেষ অবদানের দাবি রাখে। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ যতই বড় হোক না কেন তার ভেতরে শৈশব বেঁচে থাকে এবং এই সাহিত্যের ধরন আরও জনপ্রিয় হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তার প্রথম গল্প ‘ছেলেমানুষী’ ছাপা হয। ১৯৭৭ সালে তার প্রথম বই ‘কেপেট্রোনিক সুখ দুঃখ’ প্রকাশিত হয়। মুক্তধারা থেকে বইটি প্রকাশ হওয়ার পর বাংলা সাইন্স ফিকশন বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
 
 তবে সার্থক কল্পবিজ্ঞান কাহিনিতে বিজ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব আবশ্যিক নয় বলেই মনে হয়, যা আবশ্যিক তা হল বাস্তবিক বা কাল্পনিক বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমাজ সচেতনতা।

আমাদের প্রতিবেশী দেশের এমনই এক সমাজসচেতন সাহিত্যিকের কথা বলে শেষ করি। সিশিন লিউ এই মুহূর্তে চিনের সবচেয়ে জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক। তাঁর ‘রিমেমব্রেন্স অব আর্থ’স পাস্ট’ ট্রিলজি বিশ্ব জুড়ে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছে। সেই ট্রিলজির প্রথম খণ্ডের নাম ‘দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম’, যে গল্প শুরু হচ্ছে চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়। ১৯৬৬-৭৬, দশ বছর ধরে চলেছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লব, যদিও তার ভিত স্থাপন হয়েছিল আরও আগেই। লিউ-এর উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার শিকার। সেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বা হৃদয়বত্তা, কোনওটাই দর পায় না। ঘটনাচক্রে তার সঙ্গেই যোগাযোগ হয় ভিনগ্রহী প্রাণীর। তারা চায় নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মানবজাতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে পৃথিবীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটাতে। কিন্তু নতুন পৃথিবীর জন্য তাদের সাহায্য দরকার পুরনো পৃথিবী থেকেই। অসাধারণ দক্ষতায় লিউ তাঁর উপন্যাসে নিয়ে এসেছেন সমান্তরাল আর এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে।

আধুনিক কল্পবিজ্ঞানমূলক সাহিত্যে আধুনিক বিজ্ঞান সচেতনতার প্রভাব ও উত্তরণ স্পষ্ট। তাই আধুনিক পাঠক সমাজের কাছে এই রূপ সাহিত্যের চাহিদা ক্রমশ আকাশ ছোঁয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন