ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
সম্প্রতি এক যুগলের যৌনগন্ধী হোয়াটস্যাপ কথোপকথন ব্যক্তি পরিসরের বেড়া ডিঙিয়ে জনসমক্ষে আসে এবং ফেসবুকে তা আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে ভাইরাল হয়ে যায়। ভার্চুয়াল মিডিয়ার আগমনের পর থেকে এরকম ঘটনা একেবারেই নতুন বা ব্যতিক্রমী নয়। ব্যক্তিগতর বেড়া আসলে ঠিক কতটা পলকা, তার প্রমাণ নিত্যনৈমিত্তিক ভাবে সমাজমাধ্যমে আসতেই থাকে। অগুনতি আইনি বেআইনি পর্নোগ্রাফিক সাইট রয়েছে যেগুলির প্রধান 'কন্টেন্ট'ই হল মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত যৌনমুহূর্তের ভিডিও। এইসব ভিডিও সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক ব্যক্তির সম্মতহীনভাবে, এমনকি অজ্ঞাতসারেও আপলোড করা হয়ে থাকে। কথোপকথন, ছবি, কল রেকর্ডিং এসব তো নেহাত বালখিল্যতার পর্যায়ে পড়ে এসব উদাহরণের সামনে। এককথায় বলতে গেলে, ব্যক্তিগতর সর্বজনীন হয়ে যাওয়াটাই গা-সওয়া, দস্তুর হয়ে গিয়েছে আজকাল।
আমাদের খেয়াল করা বা না করার পরোয়া না করে, আরো অনেক কিছুর মতোই এই বিষয়ের উপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে অতিমারী। অতিমারীর সময়ে অফিস, স্কুল কলেজ সবাইকেই বাধ্য হয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমের শরণাপন্ন হতেই হয়েছিল। অতিমারীর আগে অবধি যে 'ঘর' আর 'বাহির' এর সীমানা ছিল, সেটা ২০২০ র পর থেকে সংকুচিত হতে হতে একেবারে সরু সুতলিতে পরিণত হয়েছে। বিষয়টা শুধু ঘর পরিষ্কার করতে করতে অফিস করায় আটকে থাকে না। 'ঘরের' আব্রু বাঁচায় যে দেওয়াল, তারই মধ্যে ঢুকে পড়ল এক ক্যামেরা। 'ঘরের' যা কিছু মানুষ নিজস্ব গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতো, তার প্রায় সবটাই 'বাহিরের' সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল। ক্যামরা পণ্যটি বিলাসিতা থেকে 'প্রয়োজন'-এ পর্যবসিত অনেক আগেই হয়েছিল, নিত্যদিন তার ডাক পড়ে বলে মোবাইলে ক্যামেরার আবির্ভাবও আগেই হয়েছিল, এমনকি চরম আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে সেলফির জন্মও অতিমারীর আগেই-কিন্তু এইভাবে প্রায় চব্বিশটা ঘন্টা ক্যামেরার সামনে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে আগে কখনো হয়নি। ফলতঃ যা হওয়ার তাই হল। গত বছর কুড়ি ধরে ভার্চুয়াল মিডিয়া এমনিতেই ব্যক্তির নিজস্ব খড়িগণ্ডিকে একটু একটু করে মুছে ফেলছিল, এক্ষণে তা গন্ডিটাই তুলে ফেলে একবারে ভিতরে এসে পড়ল। যথেচ্ছ হ্যাকিং, ছবি বিকৃতিকরনেই মতো সাইবার ক্রাইমের বাড়বাড়ন্ত বুঝিয়ে দেয় যে, ভার্চুয়াল মিডিয়ার প্রভাবকে একুশ শতকের মানুষ প্রথম থেকেই ভালোভাবে সামলাতে পারেনি; অতিমারী সেই বেহাল দশাকে কয়েক গুন্ বাড়িয়ে দেয়। অতিমারী শুরুর পর থেকেই নিয়মিত ভাবে সমাজমাধ্যম জুড়ে একের পর এক ব্যক্তিগত মুহূর্তের উঠে আসার ঘটনাগুলো এই পরিস্থিতির প্রমান দেয়।
কিন্তু বিষয়টা শুধুমাত্র ভার্চুয়াল মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত নতুন দুনিয়াতে আমাদের মানিয়ে না নিতে পারার মধ্যে আটকে থাকেনা। একটা নব্য-উদারবাদী সমাজের নিয়মমাফিক আর সবকিছুর মতো এই ইস্যুটিও পন্যায়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। উদারবাদী অর্থনীতি 'ব্যক্তিগত' ব্যাপারটাকে স্রেফ পণ্যে পরিণত করেই ক্ষান্ত হয়নি, সেই পণ্যকে ব্যবহার করে ভার্চুয়াল মিডিয়া নামক আস্ত বাজারটা তৈরী করেছে। কয়েক বছর আগে স্টিভ জোবসের সংস্থা এই মর্মে তাদের নতুন মোবাইলের বিপণন করেছিল যে, তাদের মোবাইল ব্যক্তি পরিসরকে রক্ষা করতে বিশেষ দক্ষ। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা নিজেরাই ভার্চুয়াল মাধ্যমকে বাজারে আনল, বৈদ্যুতিন পণ্য (ফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব) বিক্রয়কারী অন্য সকল সংস্থা সেই ভার্চুয়াল মাধ্যমকে আমাদের 'উপভোগের সামগ্রী' থেকে 'প্রয়োজনের সামগ্রী'তে পরিণত করল; আর তার ফলস্বরূপ যখন ব্যক্তিপরিসর বিপন্ন হল, তখন তারই সুরক্ষার লোভ দেখিয়ে নিজেদের পণ্যাদি আমাদের হাতে গছানো হল। সোজা কথায়, যে ব্যক্তিপরিসর বিনামূল্যে আপনার নিজের ছিল, তা এখন আপনাকে পয়সা দিয়ে কিনতে হল। ব্যক্তিপরিসর আর আপনার নিজস্ব সম্পত্তি বা অধিকার কোনোটাই নয়, তার উপর একখানা চকচকে প্রাইস ট্যাগ লাগানো রয়েছে। আর সেই প্রাইস ট্যাগে আমার আপনার অনেকেরই মাসের মাইনে লেখা থাকে। অতএব, শ্রেণিবৈষম্যের সঙ্গে ব্যক্তিপরিসরের সম্পর্ক সমানুপাতিক। আপনার 'ব্যক্তিগত'কে বিপন্ন না করলে এসব হত?
সময় যত কাটলো, ততই আমরা বুঝলাম যে বহুজাতিক সংস্থার এসব প্রতিশ্রুতি আসলে সোনার পাথর বাটি। আপনি ওই প্রাইস ট্যাগ সামলাতে পারলেও, তার বিনিময়ে আসা পণ্যটি বেহুলার বাসরঘর। আর তাতে ছিদ্র রেখে দিয়েছেন স্বয়ং নির্মাতারা। কারণ, ব্যক্তিপরিসরকে সত্যিই সুরক্ষিত করে দিলে, এত বিক্রয়যোগ্য পণ্যটা হাতছাড়া হয়ে যাবে যে! উক্ত সংস্থার এহেন কার্যকলাপকে আপনি অযত্নে করা মেরামতি বলবেন নাকি বাণিজ্য পরিকল্পনা, সে তা আপনার ব্যাপার; তবে এই কিছুটা গোলমাল রেখেই যন্ত্র সারানোর উপরেই ব্যক্তিপরিসরের পণ্যায়ন দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিবিসি-র 'শার্লক' সিরিজে মরিয়ার্টি এক জায়গায় বলছেন-"আই ঔন প্রাইভেসি"। এই সকল সমাজমাধ্যমের স্বত্বধারী কর্তৃপক্ষরা বাস্তবেই এই কথা বলে চলেছেন।
অর্থনীতি আমাদের শেখায় যে, চাহিদা আর যোগানের সম্পর্ক আপেক্ষিক। এর মধ্যে কে যে আগে এসে আরেকজনকে প্রভাবিত করেছে, তা বলা অনেক সময়ই মুশকিল। কখনো দেখা যায়, যোগান বাজারে আসার ফলেই চাহিদা তৈরী হল, তো কখনো দেখা যায় সুপ্ত চাহিদা ছিলই, কোনো একটি বিক্রয়কারী ফার্ম তাকে কাজে লাগিয়েছে মাত্র। ব্যক্তিপরিসরের পণ্য হয়ে ওঠার বাজার সমীকরণ বিশ্লেষণ করলেও এই সূত্রই মেলে। যেসব পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটের কথা শুরুতে উল্লেখ করলাম, তারা নিজেদের বিপণনই এই মর্মে করে, যে তারা অন্যান্য সাইটের মত পেশাদার পর্নোগ্রাফি কর্মীদের সম্মতিক্রমে বানানো ভিডিও রাখে না। তারা বিশেষভাবেই অপেশাদার মানুষের ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও, সংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক জনের সম্মতিহীনভাবে ও অজ্ঞাতসারে বাজারীকরণ করে থাকে। বুঝতে অসুবিধা হয়না যে পণ্যের এহেন বিশেষীকরণ চাহিদার বিশেষীকরণ থেকেই আসছে। পণ্য ভোগকারী আমজনতার মধ্যে এই বিশেষ ধরণের পণ্যের চাহিদারই প্রতিফলন এইসব ওয়েবসাইট। পর্নোগ্রাফি মানুষকে যে যৌনসুখ দেয়, এক্ষেত্রে ভোগকারীর লক্ষ্য শুধুমাত্র সেটা নয়। তার পাশাপাশি অন্য মানুষের ব্যক্তিপরিসরকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার যে আনন্দ, তার নীরব বিরোধিতাকে পরাস্ত করার যে আনন্দ, অন্যের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাকে নিজের যৌনতৃপ্তির জন্য ব্যবহার করার যে উত্তেজনা, সেটাই এই সব ভিডিওর দর্শকের মূল চাহিদা। বলাই বাহুল্য, এর মধ্যে দিয়ে ভোগকারীর সুপ্ত ধর্ষণকামী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে। যে কাজ সে আইনের ভয়ে করতে পারেনা, তার কাছাকাছিও কিছু একটা করতে পারার তৃপ্তি থেকেই এই বিশেষ প্রকার চাহিদার জন্ম ঘটে। এখন 'ব্যক্তিগত'কে বিক্রির বাজার হিসেবে সমাজমাধ্যমের সৃষ্টি মানুষের মনে এইরূপ ধর্ষনকামী চাহিদা জাগিয়েছে, নাকি মানুষের মনে এই ধর্ষনকামী প্রবৃত্তি বরাবরই ছিল, সমাজমাধ্যমে স্রেফ তাকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য করেছে; এই বিতর্ক মুরগি আগে না ডিম আগের মতোই অনেকটা।
অন্য দুজন মানুষের যৌন-উত্তেজক কথোপকথনের প্রতি একেবারে সর্বজনীন স্তরে মানুষের অত্যুৎসাহিতাও এই সুপ্ত ধর্ষণকামী মানসিকতা থেকে মুক্ত নয়। যার সৃষ্টি বাজারীকরণের জন্য হয়নি, তাকে বাজারীকরন করে, দুজন মানুষের যৌনতাকে নিজের অতৃপ্ত যৌনইচ্ছা তৃপ্ত করার জন্য ব্যবহার করাই আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু এই ধর্ষণকামী মানসিকতার পাশাপাশি একপ্রকার ধর্ষকামী মানসিকতাও রয়ে যায় এখানে। উক্ত যুগল বা এইরূপ যে কাউকে নিয়ে অজস্র হাসিঠাট্টা, মিম, জোকে যে ছেয়ে যায় সমাজমাধ্যম, তাও এই অন্যের বিভীষিকার বিনিময়ে পাওয়া ধর্ষকামী পরিতৃপ্তির উল্লাস। মানুষ এখন শুধু খোরাক খোঁজে। কেন? জীবনের সমস্ত রকম হতাশা আর বিপন্নতার মধ্যে একটা শুকনো সস্তা বিনোদনের জন্য অনেকক্ষেত্রেই সেই খোরাক তৈরী হয় অপর মানুষের সর্বনাশের বিনিময়ে। সে হয় হোক, কিন্তু খোরাকের যোগান থামলে চলবে না। একটা শেষ হলেই আরেকটা চাই। সমাজমাধ্যমে এই অনন্ত খোরাকের নেশার অন্তরালে একটা গভীর, ধর্ষকামী তৃপ্তির উন্মাদ ইচ্ছা কাজ করে। ধীরে ধীরে এই ইচ্ছা একটা সংযমহীন নেশাদ্রব্যে বদলে যায়।
দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ইউরোপে 'বিয়ার -বেইটিং' বলে এক নির্মম খেলা হত যেখানে একটা ভাল্লুককে দড়ি দিয়ে বেঁধে বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হত। একাধিক বল্লমের খোঁচায় একটা প্রাণীর মৃত্যু-এটাই ছিল উত্তেজনার খোরাক। এই গোষ্ঠীর নিষ্ঠুরতায় এককের বা ব্যক্তির তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়া, এই যে বহুর ক্ষমতার সামনে ব্যক্তির অসম অসহায় লড়াই ও পরাজয়-এখান থেকেই জন্ম নেয় এরূপ ধর্ষকামী তৃপ্তি। গণধোলাই বা দাঙ্গার সময় উন্মত্ত সমষ্টির মধ্যে ঠিক এই ধর্ষকামী রিরংসাই তীব্রভাবে কাজ করে। গণধোলাইয়ের সময় যে মানুষকে একজন চেনেনা, কোনোদিন হয়তো দেখেওনি, তার সঙ্গে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই, তবু তাকে নির্মমভাবে খুন করার উৎসাহ কোত্থেকে পায় সে? এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে এই ধর্ষকামী রিরংসায়। দুজন প্রাপ্তবয়স্কের সম্মতি অনুসারে হওয়া যৌনাচার নিয়ে এই সামগ্রিক পাগলামি আপাতভাবে নিরীহ মনে হলেও, তলায় তলায় ভয়ঙ্কর বিষ জমতে থাকে সমাজের মনে। বেকারত্ব, আর্থিক দৈন, পারিবারিক অশান্তি, যৌন অতৃপ্তি, সামাজিক অবক্ষয় সবকিছু মিলিয়ে একটা সমাজের সমষ্টিগত মননে বিপুল হতাশা জমাট বাঁধে। সেই হতাশা উগরে দেওয়ার উপায় সে খুঁজে নেয় সমাজমাধ্যমের এইসব খোরাকে।
একটা সমাজের শরীরে বাসা বাঁধা এই রোগ আসলে নিজেকে খেয়ে ফেলার রোগ। যারা এইসব ধর্ষকামী হাস্যরসে যুক্ত হয়, তাদের নিজেদের ফোন ল্যাপটপেও হয়তো এরকমই অনেক কিছু জমা রয়েছে। ব্যক্তিপরিসরের এই চরম বিপন্নতার দিনে মানুষ বেঁচে থাকে দোকানে দড়িবাঁধা খাসির মতো। কখন কবে কার উপরে খাড়ার ঘা নেমে আসবে, কেও জানেনা।
ধর্ষকামী তৃপ্তির অভ্যাস সামাজিক স্তরে একটি বিপজ্জনক, সংক্রামক ব্যাধি।