দোঁহা

শ্যামা মা কি আমার কালো

 অভিষেক চট্টোপাধ্যায়

বঙ্গদেশ নিঃসন্দেহে শক্তিধর্মের দেশ। শুধুমাত্র ভারতবর্ষের সর্বত্র এই শক্তি আরাধনা শুরু হয়েছিল কিনা তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত যে ভারতবর্ষের মত পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলিতেও মাতৃপূজার প্রচলন ছিল। ভারতবর্ষের মধ্যে শক্তিপূজা বাংলাদেশেই সবথেকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। মাতৃপূজা এবং সেই সংক্রান্ত শক্তিবাদ বঙ্গদেশে দীর্ঘ সময় ধরে প্রাধান্য লাভ করেছিল। শাক্তধর্ম সংক্রান্ত শিক্ষা, দর্শন দীর্ঘদিন ধরে বাঙালির মনের অবচেতনে যে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল তা বলাই যায়। এই ধারার সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিল দেবী কালিকার আরাধনা।

ব্রহ্মশক্তি কালিকার আরাধনা প্রসঙ্গেই আসে দেবী কালিকার মূর্তি প্রসঙ্গ। সেই প্রসঙ্গে সবথেকে উল্লেখযোগ্য নাম বোধহয় স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দ, যিনি পূর্বজীবনে মূর্তিপূজায় সম্ভবত: বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনিই উল্লেখ করেছিলেন- "কালীমূর্তি ভগবানের perfect manifestation." এই মূর্তি একাধারে সৃষ্টি, স্থিতি এবং বিনাশের দ্যোতক, অসি হস্তে নৃমুন্ডমালিনী দেবী নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ শিবকে আশ্রয় করে বরাভয়প্রদান পূর্বক সমগ্র জীবকূলকে রক্ষার অভয় প্রদানকারীরূপে দণ্ডয়মানা। আবার অপরদিকে দেবী হাতে নৃমুন্ড ধারণ করে শত্রুমনে ভয় উৎপাদনকারিনী এবং উপাসকের কাছে সৎ-চিৎ-আনন্দময়ী মূর্তি।স্বামীজীর কথা প্রসঙ্গেই বলা যায় শ্মশানের ঘনান্ধকারে সংহারমূর্তি রূপে দাঁড়িয়ে থাকা সাক্ষাৎ বিনাশকারী মূর্তি আবার অপরদিকে সকলপ্রকার প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও উদাসীন বরাভয় প্রদানকারী মাতৃমূর্তি, দুই ভূমিকাতেই সাধকের কাছে বিপরীত ভাবের এই সমন্বয় নিঃসন্দেহে চৈতন্যময়ী মাতৃমূর্তির এক বিরলরূপ।


কালী কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। একাধারে ধ্বংস ও সৃষ্টির রূপ ধারণ করে কালী বা কালিকা দণ্ডয়মানা। কাল হরণকারী দেবী কালিকা নিঃসন্দেহে বাঙালির দ্বারা পূজিতা দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম। দেবী দুর্গার পূজার মত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলেও দেবী কালিকা যে বাঙালিদের দ্বারা অন্যতম প্রধান আরাধ্যা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দেবী একাধারে আদ্যাশক্তি অন্যদিকে প্রলয়রূপিণী। শত্রু মনে ভয় উৎপাদনকারিনী দেবী উপাসকের চোখে সৎ-চিৎ- আনন্দময়ী। নৃমুন্ডমালিনী দেবী কালিকা শ্মশানচারিণী। মসী রংয়ের ভয়ঙ্করী কালীমূর্তিই বর্তমানে বাংলার সর্বত্র পূজিতা। কিন্তু এ-কথা বলাই যায় যে এই মূর্তির আবির্ভাব কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের হাত ধরে। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা প্রবন্ধ অনুসারে, চৈতন্যদেবের আগমনের পরবর্তী সময় থেকেই সম্ভবত বাংলাদেশে মূর্তিপূজার প্রচলন ব্যাপকহারে শুরু হয় তার শিষ্যদের হাত ধরে। কিন্তু তার আগে যন্ত্রপূজার প্রচলন ছিল। সমস্ত গৃহস্থের ঠাকুরঘরে বেদীর উপর অঙ্কিত থাকত ইষ্টদেবতার যন্ত্র। এখনও হয়ত বেশ কিছু প্রাচীন মন্দিরের দেব-মূর্তির নীচে সন্ধান করলে মিলে যাবে সেই যন্ত্র-চিহ্ন। ধীরে ধীরে মূর্তিপূজার প্রচলনের সাথেসাথে শুরু হল বিভিন্ন দেবদেবীর রূপ কল্পনা।আগমবাগিশ কালীমূর্তি নির্মাণ করে স্বয়ং পূজা শুরু করলেও দীর্ঘদিন বাঙালি সাধক সমাজে তা উপেক্ষিতই ছিল। বরং তখনও চালু ছিল যন্ত্রপূজা। আগমবাগিশের স্বহস্তে কালীমূর্তি তৈরি করে তা পূজা করার পদ্ধতি ‘আগমবাগীশী' কাণ্ড বলে কিছুটা উপেক্ষার চোখেই দেখা হত। আসলে জগদ্ধাত্রী, কালী প্রভৃতি আদ্যাশক্তির পুজো একমাত্র বীজমন্ত্রের ধারকরাই করতেন অন্যরা নয়। অন্যথায় মন্ত্র দেওয়া গুরুকে প্রতিনিধি করেই পুজো সম্পন্ন করার বিধি প্রচলিত ছিল। কিন্তু ক্রমে মূর্তি এনে সেই মূর্তিপূজার পদ্ধতি প্রচলিত হলে দেবীর রূপ কল্পনায় গিয়েই বাঁধলো গোল। মৃন্ময়ী মূর্তি মানেই সেখানে প্রয়োজন তার রং-রূপ স্থির করা। এর আগে দশমহাবিদ্যার রূপ সম্মুখে এনে পুজো করার রীতি প্রচলিত না থাকায় কখনোই কালীমূর্তির প্রকৃত স্বরূপ কী রকমের হবে তা স্থির করার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু এবার পড়ল। আর তখনই দ্বারস্থ হওয়া গেল তন্ত্রের। তন্ত্রে দেবী কালিকার সম্পর্কে লিখিত -

“কালাগ্র শ্যামালাঙ্গীং বিগলিত চিকুরাম্"-

অর্থাৎ কালরুপী মেঘের মত শ্যামালাঙ্গী দেবী কালী। কিন্তু শ্যামল বলতে ঠিক কেমন রং? শ্যমল রংয়েরও তো কত শ্রেণিবিভাগ আমরা সাহিত্য কবিতার ছত্রে ছত্রে পাই। 'শস্য-শ্যামলা' একই শব্দবন্ধে ব্যবহৃত হয়েছে বহু জায়গাতেই। আবার অন্যদিকে ভক্ত কমলাকান্ত তাঁর গানের ছত্রে উল্লেখ করেছেন -

"নব সজল জলদাকায়
দেখিলে আঁখি জুড়ায়"

এখন প্রশ্ন হল কালের মেঘ বা নব সজল জলদ যাই ধরি না কেন তার প্রকৃত বর্ণ কী? আর ঠিক এই স্থানেই এসে বোধহয় সমস্যার সূত্রপাত। শ্যামল রংয়ের প্রকৃত রূপ খুঁজে পাওয়া যখন পটুয়াদের পক্ষে কঠিন বলে মনে হল তখন জলদ-রং কালো স্থির করে কালীমূর্তিকেও দেওয়া হল সেই মসীবর্ণ অর্থাৎ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। কিন্তু শ্যামল রংয়ের প্রকৃত স্বরূপ রয়েই গেল অন্তরালে। আজও শ্যামবর্ণ বলতে আমরা মসীবর্ণকেই বুঝি অথচ কতই না তার প্রকারভেদ। সজল-জলদ-শ্যাম, নীলোৎপল শ্যাম, তপ্তকাঞ্চন শ্যাম, ঘনশ্যাম, দূর্বাদল শ্যাম কতই না প্রকৃতি অথচ সবকিছুই একত্রিত হয়ে পরিণতি পেল ঘোর কালো রংয়ের আড়ালে! আসলে কি সব রংয়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা সম্ভব? মেঘের রং কী বাস্তবেই সম্পূর্ণ কালো? অন্ধকারের রংও কী ঘোর মসীবর্ণ বলে মেনে নেওয়া সম্ভব? আসলে শ্যাম শব্দের প্রকৃতি ব্যাখ্যার মধ্যেই রয়েছে আমাদের অনেক দেবদেবীর প্রকৃত রূপের ব্যাখ্যা। ঠিক একই কথা বলা চলে কালীমূর্তির রূপ বিষয়েও। কালীমূর্তির বিভিন্ন রূপের কথা তন্ত্রের বিভিন্ন বর্ণনায় থাকলেও কোথাও কালো বর্ণের উল্লেখ পাওয়া যায়না। যদিও নীল রংয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু তা-ও শুধুমাত্র তারা মূর্তির বর্ণনায় কালীমূর্তির নয়। কালীমূর্তির যে দু'টি রূপের কথা উল্লেখিত তার একটি আদ্যাশক্তি রূপ এবং অপরটি রণাঙ্গিনী। বর্তমানে যে রূপটি বহুল পরিচিত সেই শ্মশানকালী রূপটি পূর্বে গৃহী দ্বারা পূজিত রূপ নয়। রামপ্রসাদের বর্ণনাতেও সেই ভয়ঙ্করী রূপের বর্ণনা আমরা পাইনা বরং সেখানে দেবী মনমোহিনী, মোটেও ভয়ঙ্করী রণোদ্যত বিনাশকারিনী নয়। রামপ্রসাদই প্রথম শ্যাম ও শ্যামামূর্তির সম্মিলিত রূপের ঘোষণা করেছেন তার গানের মাধ্যমে -


"তেমনি তেমনি তেমনি ক'রে
নাচ দেখি মা।
ব্রজে যেমন নেচেছিলে
হ'য়ে বনমালী।
অসি ছেড়ে বাঁশি ল'য়ে
মুন্ডমালা ছেড়ে বনমালা ধ'রে
তেমনি ক'রে নাচ দেখি মা।"

এই রূপ বর্ণনাতেও অনুপস্থিত সেই রণ-ভয়ঙ্করী ভাব। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আরাধ্যা কালীমূর্তির মধ্যেও মাতৃভাব প্রকট বিনাশকারী রূপ অপেক্ষা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন