দোঁহা

নলহাটি ও দেবী নলাটেশ্বরী: লোক-বিশ্বাস ও কিংবদন্তি যেখানে মিশে যায় ইতিহাসে


সুদীঘ্ন দাস

পুরনো সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে অবস্থিত নলহাটি জংশন পূর্ব রেলওয়ের অন্যতম প্রধান ষ্টেশন। এখান থেকে একটি শাখা মুর্শিদাবাদ জেলার আজিমগঞ্জ পর্যন্ত চলে গিয়েছে। বর্তমানে এই স্থানটি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার একটি মুখ্য শহর ও পুরসভা। পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ডের সীমানার কাছাকাছি অবস্থিত শহরটি এককালে খুবই স্বাস্থ্যকর স্থানরূপে পরিচিত ছিল এবং দক্ষিণবঙ্গের মানুষ হাওয়া-বদলের জন্য এখানে এসে সরকারি ডাক-বাংলোয় কয়েকদিন নিশ্চিন্তে কাটিয়ে যেতেন।
 
এখনও অবশ্য এই শহরে বহু মানুষের যাতায়াত। তবে হাওয়া-বদলের টানে যত না তারা আসেন, তার থেকেও বেশি আসেন নলাটেশ্বরী পাহাড়ের অগ্নিকোণে (দক্ষিণ দিকে) অবস্থিত পার্বতী দেবীর বা দেবী নলাটেশ্বরীর মন্দিরে ভক্তি নিবেদনের নিমিত্তে। প্রসঙ্গত, দেবী মন্দিরের অনতিদূরে নলাট পাহাড়ের উপর হজরত আনা শহীদ পীরের সমাধি বা মাজার রয়েছে। সেখানেও বহু ভক্তের সমাগম হয় সারাবছর।

 প্রথমেই আসি স্থানটির পৌরাণিক বিশেষত্বের কথায়। কেননা, সতীপীঠ হিসেবেই নলহাটির জনপ্রিয়তা সমধিক। ‘পীঠনির্ণয়’ (‘মহাপীঠনিরুপণম্’) তন্ত্রে যে ৫১ শক্তিপীঠের উল্লেখ আছে, তার মধ্যে নলহাটির কথা বলা হয়েছে এইভাবে:

 
"নলাহাট্টাং নলাপাতো যোগীশো [পাঠান্তরে যোগেশো] ভৈরবস্তথা।
তত্রসা কালিকা দেবী সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িকা (পাঠান্তরে ‘তন্ত্রসিদ্ধির্নশংসয়ঃ’)।।"
 
ঐতিহ্যশালী তন্ত্রশাস্ত্রে উল্লিখিত এই উক্তি থেকে জানা যায় যে, বিষ্ণুচক্রে কর্তিত শিব-পত্নী সতীর দেহাংশের ‘নলা’ (বা ‘নুলো’; কনুইয়ের নিম্নভাগ, সংস্কৃত ‘নলক’ শব্দ থেকে উদ্ভূত; অর্থাৎ লম্বা অস্থি) পতিত হওয়ায় নলহাটিতে দেবী কালিকা এবং তাঁর ভৈরব যোগীশ (যোগেশ) স্বমহিমায় বিরাজ করছেন। আবার ‘শিবচরিত’ গ্রন্থে ৫১টি শক্তিপীঠের পাশাপাশি যে ২৬টি উপপীঠের কথা বলা হয়েছে, নলহাটি তার অন্যতম। দেবীর কন্ঠনালি পতিত হওয়ার কাহিনী এবং দেবীর ‘শেফালিকা’ ও ভৈরবের ‘যোগীশ’ নামের উল্লেখ এই গ্রন্থমধ্যে আছে। কেউ কেউ দেবীর নাম ললাটেশ্বরীও বলে থাকেন। তাঁদের মতে, এখানে দেবীর ‘ললাট’ (কপালের অংশ) পড়েছিল, তা থেকেই এরকম নাম। সুতরাং, হিন্দুধর্মে সতীপীঠ রূপে নলহাটির গুরুত্ব যে সর্বজনস্বীকৃত, তা বলাই যায়।
 
বীরভূমের রামপুরহাট মহকুমা থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে, ব্রাহ্মণী নদীর তীরে এই মন্দিরের অবস্থান। পাশেই নলাট বা ললাট পাহাড়। মধ্যযুগের চারচালা শৈলির মন্দিরের গর্ভগৃহে পূজিতা প্রায় চার ফুট উচ্চ পাষাণ খণ্ডের মধ্যেই দেবী বিরাজিতা। দেবীর মুখমণ্ডল সিঁদুর দিয়ে রাঙানো। দেবীর মাথার ওপর চাঁদির ছাতা রয়েছে। ত্রিনয়না দেবীর দীর্ঘ ভ্রু। দাঁতের ওপরের আর নীচের পাটির মাঝখান দিয়ে দেবী কালীর চিরাচরিত রূপের মতই বিরাট স্বর্ণনির্মিত জিহ্বা বেরিয়ে আছে। অথচ রুদ্রমূর্তি নন, দেবীর রূপ এখানে যেন বড়ই স্নিগ্ধ ও শান্ত।

 মন্দিরের নিত্য পূজার্চনাদি ভক্তগণের উপস্থিতিতেই ঢোল-বাদ্যি-কাঁসর সহযোগে সুসম্পন্ন হয়। দেবী নলাটেশ্বরী আমিষাশী। তবে দেবীর পুজোর প্রধান উপকরণ খুবই সাধারণ— চাঁছি ও পেঁড়ার সন্দেশ। বছরের ৩৬৫ দিনই এখানে মাকে অন্নভোগ দেওয়া হয়। তবে শুধু মাত্র কালীপুজোর দিনই মায়ের ভোগ হয় রাত্রে। এছাড়া এখানে বলিপ্রথা চালু রয়েছে। প্রথা মেনে দুর্গা নবমী ও দীপান্বিতা কালীপুজোর দিন বলি হয় মন্দিরে।

 
মন্দিরের আদি ইতিহাস স্পষ্ট নয়। একসময় ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল গোটা এলাকা। সাধারণ মানুষের খুব একটা আনাগোনা ছিল না। সেসময় এই স্থানে দাপিয়ে বেড়াতেন তান্ত্রিক সাধকেরা। যদিও পরবর্তী সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতির উন্নতি হয়। স্থানীয় অধিবাসীরা বলেন, দেবীর এখনকার মন্দিরটি তৈরি করিয়েছিলেন নাটোরের (বর্তমান বাংলাদেশে) রাজমাতা রানি ভবানী (১৭১৬ – ১৮০২)। তাঁর এক আত্মীয়া মুর্শিদাবাদের নসিপুরের জমিদার দেবী সিংহের স্ত্রী, রানি সূর্যকুমারীর নামে ছিল মন্দিরের জমি ও সম্পত্তি। পরে রানি রাসমনী মন্দির সংস্কার করান। এখন ‘শ্রীনলাটেশ্বরী মন্দির ট্রাস্ট’ যাবতীয় পুজোর পরিচালনা এবং কাজকর্ম দেখভাল করার দায়িত্বে আছেন। মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্ত-সাধারণের থাকবার জন্য ধর্মশালার সুব্যবস্থা রয়েছে।
 
কিংবদন্তি বলছে, মারাঠা বর্গীদের হাঙ্গামা কালে নলহাটি বর্গীদের অত্যাচারের হাত থেকে অব্যাহতি পায়নি। তখন এখানে বসত বড় ও সমৃদ্ধ বাজার। তাছাড়া, শোনা যায়, মন্দিরের পার্শ্ববর্তী নলাট বা নলাটেশ্বরী টিলার উপর প্রাচীনকালে এক গড় ছিল, বর্গীরা সেইটি দখল করে সেখানে তাদের আস্তানা স্থাপন করে। কিন্তু নবাব-সৈন্যের আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে বর্গীরা শেষপর্যন্ত এই স্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে, পাহাড়ের উপর যে পীরের সমাধি আছে, তিনি বর্গীদের বিপক্ষে যুদ্ধ করে ‘শহীদ’ হয়েছিলেন। সেই থেকে, ওই টিলার উপর তাঁর মাজার প্রতিষ্ঠিত। এই গড়টি সম্ভবত প্রাচীনকালে ‘নলরাজগণের গড়’ রূপে পরিচিত ছিল। ময়ূরেশ্বর থানার অন্তর্গত ‘সন্ধিগড় বাজার’ বা ‘সিন্ধুগড়’ এবং চণ্ডীদাস-নানুর অঞ্চলে ‘নলরাজ’ সম্বন্ধীয় প্রবাদ প্রচলিত আছে। যদিও, এসব লোক-বিশ্বাস ও গল্পগাছা আকর্ষণীয় মনে হলেও, এই নলরাজাদের সম্পর্কে অন্য কোনো ঐতিহাসিক তথ্য সেভাবে পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলে, নলহাটির ইতিহাসের আরেকটি দিক উন্মোচিত হবে।
 
নলহাটির পশ্চিমে অনতিদূরে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড় বীরভূমের সীমান্ত প্রাচীররূপে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নলহাটির প্রায় ১২/১৪ কিমি পশ্চিমে অবস্থিত ‘নাথ পাহাড়ে’ নাথ সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসীরা বসবাস করতেন, তাঁদের নামানুসারেই নাকি এই পাহাড়ের নাম হয় ‘নাথ পাহাড়’। রাজা উদয়নারায়ণ এই পাহাড়ের উপর গিরিগোবর্ধনধারী বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা ও মন্দিরাদি নির্মাণ করে দেন। বর্তমানে সেগুলির কার্যত ভগ্নদশা। নাথ-পাহাড়ের দক্ষিণে চন্দ্রময়ী পাহাড়ে ‘চন্দ্রময়ী’ নামে এক দেবীর মন্দির আছে। দেবী নলাটেশ্বরীর অনুরূপ, অপেক্ষাকৃত বৃহৎ এক প্রস্তরখণ্ড ‘দেবী চন্দ্রময়ী’ রূপে অভিহিত।
 
নলাটেশ্বরী মন্দিরের উত্তর দিকে রয়েছে পঞ্চমুণ্ডির আসন। কথিত আছে, কাশী থেকে কুশলানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক সিদ্ধপুরুষ প্রথমে তারাপীঠে এসেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি নলহাটিতে এসে এই পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসেই সিদ্ধিলাভ করেন।
 
সবশেষে বলি নলাটেশ্বরী টিলার একটি স্বল্পপরিচিত প্রত্নতাত্ত্বিক দিকের কথা। প্রাচীন, মধ্য ও শেষ প্রস্তরযুগে ব্যবহৃত নানা ধরণের প্রস্তরায়ুধ এই টিলার বিশ্লিষ্ট মাকড়া পাথরের মধ্য থেকে উদঘাটিত হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের পশ্চিমবঙ্গ শাখা কর্তৃক উৎখননে সেইসব নিদর্শন আবিস্কৃত হয়। অতএব এটা খুবই স্পষ্ট যে, কেবল তন্ত্রাচার, শক্তিসাধনা কিংবা নিছক ভক্তিভাবনার দিক দিয়ে নয়— বঙ্গদেশীয় সভ্যতার প্রাচীন ইতিহাসের দিক দিয়েও নলহাটির একটা বিশেষ গুরুত্ব আছেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন