দোঁহা

যে আলোয় তাঁকে দেখেছি.....

 



অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়


 
[১]

 
তিতাস রোজই তাঁকে দেখতে পায়। অফিস থেকে সে ফেরে যখন, প্রায় দিনই সে মুখ তুলে তাকায়। হ্যালোজেন বাতির আড়ালে সে দেখতে পায় তিনি বারান্দায় এসে বসেছেন। সরুপাড় সাদা শাড়ি পরনে। ঠিক যেন বা ‘সাঁঝবাতি’র লিলি চক্রবর্তী বলে মনে হয়। তাঁর বয়স হয়েছে। কিন্তু এখনও চোখে যথেষ্ট ভালো দেখেন। আলো জ্বালিয়ে তিনি বই পড়েন। কখনও বা রেলিং ধরে উঠে দাঁড়ান। নীচের গলিটাকে দেখেন। তিতাসকে দেখে হাসেন একেকদিন। তিতাস সে হাসি ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তাঁর বাড়িতে সে আজ অবধি কখনও গিয়ে উঠতে পারেনি। তিনি হাত নেড়ে ডাকেনওনি কোনও দিন। কিন্তু তিতাস এও বেশ বুঝতে পারে, তিনি তার সঙ্গে কথা বলতে চান। তিতাস জানে বিষয়টা। তবুও সে গিয়ে উঠতে পারে না। হয়তো বা একটা অস্বস্তি থেকেই যায়। হয়তো বা, তিতাস ভাবতে চায় না সেসব। ভদ্রমহিলার নাম গোধূলি। গোধূলি চক্রবর্তী। তিতাস জানে তাঁর নাম। তার বাড়িতেও সকলে চেনে গোধূলি চক্রবর্তীকে। খুব ভালো করেই।

আজ তেড়ে বৃষ্টি হয়েছে। ফিরতে ফিরতে তিতাস দেখল রাস্তা জুড়ে রাধাচূড়ার হলুদ চেপটে যাওয়া ফুলগুলো ভিজে, থেঁতলে, একশা হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ভেজা এ্যাসফল্টের উপর। মাটি থেকে জলের ভাপ উঠছিল। তখনও টিপটিপ করে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। তিতাস মুখ তুলে দেখল তিনি আজও বারান্দায় এসে বসেছেন। হাতের লাঠিটা পাশটাতে সোজা করে রাখা। আজও তিনি তিতাসকে দেখে হাসলেন। তিতাসও পালটা হাসল। আজ তাঁর হাসিটাকে একটু যেন ক্লান্ত মনে হল। বোধহয় বেরিয়েছিলেন কোথাও। এই বৃষ্টিতে তিনি যে কোথাও বেরুতে পারেন এটা ভাবতেই আশ্চর্য বোধ হয়। তবুও তিতাস লক্ষ্য করল তাঁর শাড়ির নীচটায় অল্প কাদার ছোপ। তাহলে নিশ্চয়ই বেরিয়েছিলেন। তিতাস ওসব নিয়ে বেশী ভাবল না। যে বাচ্চাদুটোকে সে পড়ায় তাদেরও আসার সময় হয়ে গিয়েছে।

তখন রাত অনেক। প্রায় একটা বাজতে যায়। মোবাইল খুলে ফেসবুকে অনলাইন হতে না হতেই তিতাস তার বন্ধু শ্রেয়সীর একটা ছবির পোস্ট দেখে, স্ক্রল করে এগিয়ে যেতে যেতেও অবাক হয়ে থমকিয়ে যায় হঠাৎ। এ তো তারই পাড়ার ছবি। পাশেই পুরসভার পার্কে রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে যে বইমেলা বসেছে, তারই কোথাও তোলা। রেলিংয়ের গায়ে বাঁধানো ধাপির উপরে বসে সরুপাড় সাদা শাড়ি পরা একজন হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁর হাতে ধরা কয়েকখানি কাগজের মতো কিছু। শ্রেয়সী তলায় লিখেছেঃ

ইনিও একজন কবি। বাস উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর থানা অঞ্চলে। অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও পাড়ায় পাড়ায় বর্তমানে পুর-উদ্যোগে যে পক্ষকাল-ব্যাপী রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন চলছে, সেখানেই রোজ দুপুর থেকে বিকেল তিনি এসে বসেন। হাতে থাকে নিজেরই ব্যবস্থায় ছাপা কিছু স্বরচিত কবিতার বই। হাত বাড়িয়ে মেলা ঘুরতে আসা মানুষজনকে তাঁর অনুরোধ, “আমি রবিঠাকুরের মতো লিখিনা। কিন্তু শেষ বয়সে এসে নিজের মনের কথা, নিজের কলমে লিখতে চেষ্টা করেছি। যদি তোমরা নাও ...”

শ্রেয়সী আরও লিখেছেঃ

"অনেকেই হাত বাড়িয়ে সেগুলি নিয়ে উলটে-পালটে দেখেন। কেউ কেউ বা ফিরিয়ে দেন। কেউ বা সংগ্রহও করেন। একেকজনের তরফে জোটে দুর্ব্যবহার। তবুও কবি গোধূলি চক্রবর্তী, তাঁরও জীবনের গোধূলিবেলায় দাঁড়িয়ে সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে অনুরাগ, তাকে বাঁচিয়ে রেখে চলেছেন। আমাদেরও কি দায়িত্ব নয় তাঁকে ভাইরাল করার?" ইত্যাদি ইত্যাদি ...

তিতাস তাকিয়ে দেখল, ১৭টা মতো লাইক পড়েছে।

সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। বাইরে অন্ধকার। এই পৃথিবীতে সবকিছুই ভাইরাল হয়না বোধহয়। সবকিছুকেই সামাজিক মাধ্যমে বিক্রি করা যায় না। সে আলতো করে টুকুসের গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। টুকুস ল্যাজ নেড়ে বলে, মিঁয়াও। তার বয়স আজ তিন মাস পেরুল। তিতাস ঠিক করে ফেলে কাল সে অফিস ফেরত গোধূলি চক্রবর্তীর বাড়িতে যাবে। এবারে বোধহয় সত্যিই দেখা হওয়া দরকার তাদের। সে টুকুসের গায়ে আপন খেয়ালে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

 
[২]


মুখোমুখি দুজনে বসেছিলেন। পুরনো কলকাতার ঘর, পুরনো কলকাতার মেজাজ। পুরনো সংসারের গন্ধ। চারপাশে সবকিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুরনো কাঠের কালো হয়ে আসা আসবাব, দেরাজে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ সাজানো। গোধূলি দেবী এ বাড়িতে একাই থাকেন। তিতাস সে কথা জানত। কেবল দিনে-রাতের আয়ামাসি হিসেবে দুজন আসেন, আর আসে ঠিকে কাজের লোক। রান্নার কাজ সেই করে দিয়ে যায়। আমাদের শহর আজ বৃদ্ধাশ্রম হয়ে উঠতে চলেছে। তিতাস গোধূলির দিকে চেয়ে থাকে। গোধূলিও তিতাসের দিকে তাকান।

-“রেবা কেমন আছে?” গোধূলি জিজ্ঞেস করেন।

তিতাসের ভিতরটা নিস্তব্ধ হয়ে আসে হঠাৎ। এই প্রশ্নেরই যে মুখোমুখি হতে হবে, তা সে জানত খুব ভালো করেই। তবুও ঢোক গিলতে হয়। তিতাস, নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।
 
কেবল বছর পনেরো সময় পিছিয়ে যায়

[…]


খাবার টেবিলে খুবই বিরক্ত মুখ করে বসেছিলেন সবাই। সবাই বলতে বাড়ির বড়দেরই কথা বলা হচ্ছে। তিতাসের বাবার মুখটা রাগে থমথম করছিল। ছোটকাকা সমীরেশ একপাশে দাঁড়িয়ে। রেবতী ওরফে রেবা, তিতাসের পিসি, জেঠু, আর বাবার পর, সমীরেশকাকার উপরে, তিতাসের একমাত্র আদরের পিসুম, মাথা নীচু করে এপারে - টেবিলের এপাশটায় একটা চেয়ারে ঘাড় শক্ত করে বসেছিল। কাঁদছিল বোধহয়। সমীরেশই প্রথম কথা বলে ওঠে।

-“না না বড়দা! এ হতে দেওয়া যায় না,” স্পষ্ট তিক্ততার ছাপ তার গলায়, “এভাবে এতদূর কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে, এভাবে হঠাৎ করে বিয়ে দেব না বললেই হলো? তাছাড়া রেবা আর অধীরের ব্যাপারটা তো পাড়ার সকলেই জানে। অনেক দিন ধরে ওরা...” সমীরেশ চুপ করে যায়। রেবার দিক থেকে একটা চাপা ফোঁপানির শব্দ ভেসে এসেছে। তিতাস ঘরের বাইরে পর্দার কোণটুকুকে আঁকড়ে ধরে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। ঘরের কেউ তার উপস্থিতিকে এতটুকুও আমল দেয় না। তিতাসের বাবা কথা বলেন।

-“দেখ সমী, আমরা সবটাই বুঝতে পারছি। কিন্তু ভদ্রপাড়ায় বাস করে আমরা তো আর গোলমাল বাঁধাতে পারি না। কি করব আমরা, তুইই বল?” তিনি টেবিলের উপর হাতদুটোকে অসহায় ভাবে ছড়িয়ে দেন। জেঠু এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। ভারী গলায় তিনিও মুখ খোলেন এবার।

-“আমি আগেই বলেছিলাম, যুগ যতই পালটাক – এভাবে মেয়েদের লাই দেওয়াটা মোটে ঠিক হচ্ছে না। বলেছিলাম কিনা? রেবারও তর সইল না। কলেজে উঠেছে কি ওঠেনি, পড়াশোনা তো গোল্লায় গেল, তিনি শিখলেন কি করে প্রেম করতে হয়!”
 
-“আঃ দাদা,” তিতাসের বাবা, দাদার কথার মাঝখানেই কথা বলে ওঠেন, “রেবাকে কেন দোষ দিচ্ছ তুমি? রেবার তো একজন কাউকে ভালো লাগতেই পারে। অধীরও তো কতবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। ওদের সম্পর্কটা তো আর আজকের নয়!”

-“আমি সেকথা খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু শুরু থেকেই তো আমি এতে আপত্তি করেছিলাম। আমাদের বাড়ির মেয়েরা এভাবে রাস্তায়-ঘাটে হ্যা হ্যা করে প্রেম করে বেড়াবে এ আমি ভাবতেই পারি না। আমার, আমার বিরক্ত লাগছে,” জেঠু বিরক্তির সঙ্গে হাত নাড়েন, “আজ গুরুজনেরা বেঁচে থাকলে আমরা কোন মুখে তাঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম তোমরা ভেবে দেখেছ?”

পিসুম কাঁদছে। কেঁদেই চলেছে। তিতাস পিছন থেকে দেখলেও সেটা বুঝতে পারছে। তিতাসের কান্না পাচ্ছে খুব। সবাই রেগেমেগে গজগজ করতে করতে একে একে উঠে চলে গেল। পিসুমের বিয়ে ভেঙে গেছে। অধীরদা আর কখনও এবাড়িতে আসবে না। পিসুম বলেছিল খুব শিগগিরই নাকি অধীরদাকে পিসেমশাই বলে ডাকতে হবে। এখন আর সেই নামে ডাকা যাবে না। তিতাস পর্দা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের ভিতরে কেবল ছোটকাকা আর পিসুম।

-“তুই একবার শুধু মুখ ফুটে বল রেবি, ক্লাবের ছেলেরা আছে, আমি আছি। ওই অধীরের বাচ্চাটাকে কি করে একটু পালিশ দিতে হয় আমাদের খুব ভালো করেই জানা আছে। তারপর দেখব ওই গোধূলি চক্রবর্তী কি করতে পারে। স্বামী মারা যেতে পুরো ব্যবসাটা একা হাতে লুটেছে। তাই এত দেমাক! বামুন হয়ে বেনেবাড়ির জাত পেয়েছে শালা -” পিসুম ছোটকাকার মুখ চেপে ধরেছে।

-“না! না ভাই না। এরকম একদম ভাববিও না তুই। উনি, উনি আমার মায়ের মতো। ওনাকে নিয়ে এভাবে কথা বলতে তোর মুখে বাধছে না একটুও?” রেবতীর গোটা মুখ জলে-ঘামে ভিজে একাকার হয়ে রয়েছে।

-“না বাধছে না,” সমীরেশ প্রায় চিৎকার করে ওঠে, “বাধছে না, কারণ সে আমার বোনকে অপমান করেছে। আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করে দিতে বসেছে। বলেছে, বলেছে –“ উত্তেজনায় সমীরেশ আর বলতে পারে না। বলে ওঠে রেবা,

-“কি বলেছে?”

-“বলেছে আমার বোন নাকি তাঁর ছেলের নখের যুগ্যি নয়। তাঁর ছেলে এখন বিদেশে পড়াশোনা করতে যাবে। এসব বিয়ের কথাবার্তা এখন ভুলে যাওয়াই ভালো,” সমীরেশ রাগে কাঁপছে। রেবা তাকে জড়িয়ে ধরে। বুকে মাথা রাখে।

-“এসব তিনি বলেছেন যখন, নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে তার। তোর পায়ে পড়ছি ভাই। আমাকে জোর করিস না। আমাকে, আমার মতো করে এই সবকিছুকে মেনে নিতে দে এবার। তোরাও তোদের মতো করে মেনে নিতে চেষ্টা কর। অনেক, অনেক ছোট করেছি তোদের,” রেবা ফুঁপিয়ে ওঠে আবার, “এবারের মতো শেষ হোক এসব!”

[…]

সময় আবারও আজকের দিনে এগিয়ে এসেছে।

-“পিসুম ভালো আছে। এখন পুরুলিয়ায় আছে। পিসেমশাইয়েরও ওখানেই পোস্টিং এখন,” তিতাস নীচু গলায় জবাব দেয়। গোধূলি দেবী মাথা নাড়েন।

-“আমি তো জানি কি কষ্ট ভুগতে হয়েছে ওকে,” তাঁর গলার স্বরও খাদে নেমে এসেছে, “তুমি কিছু খাবে? এভাবে তুমি সত্যিই আসবে একদিন, আমি ভাবিনি।” গোধূলি চক্রবর্তী তিতাসের দিকে তাকান। তাঁর বলিরেখাক্লিষ্ট মুখটি তিতাসের মনে গেঁথে বসে যেতে থাকে। পনেরো বছর আগেকার যে মুখ, তার থেকে যে বড় একটা পালটিয়েছে তা নয়। কেবল বয়সের ভার আরও দীর্ঘ হয়ে ছায়ার মতো মুখ জুড়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। তিতাস অপলকে সেই গোধূলির দিকে তাকিয়ে থাকে। সময়ের হিসেব থাকে না।

-“মিষ্টিগুলো খেয়ে নাও। তুমি আসবে জানলে আরও মিষ্টি আনিয়ে রাখতাম,” গোধূলি দেবী বলেন। তিতাস অবাক চোখে প্লেটের দিকে তাকায়। রূপোর রেকাবিতে পরপর সাজিয়ে দেওয়া সন্দেশ, চমচম, তক্তি। ফুলকাটা কাচের গেলাসে জল। “চা করতে বলেছি,” ওপাশের মানুষটি বলেন। তিতাস জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে।

-“কেন যে এভাবে হঠাৎ আমার কাছে এলে, সে কথা বলবে না আমায়?” কবির মতোই কথা বলেন তিনি। তিতাস কেমন যেন মুগ্ধ হয়ে যায়। অবশ্য অনেক বছর আগে এই মানুষটারই, এমনই আরেক রূপ সে দেখেছিল। আজও তার কাছে গল্পের মতোই মনে হয় সেসব।

-“আপনি কবিতা লেখেন, আমি জানতুম না।“ অস্ফূটে সে বলে ওঠে, “আমার এক বন্ধুর ফেসবুক থেকে জেনেছি।” গোধূলি দেবী হেসে ওঠেন।

-“ওই আর কি, লিখতে চেষ্টা করি কেবল। কখনও কবিতা। কখনও বা স্মৃতিকথা। লিখতে ভালো লাগে আমার। যদিও ছাপে না কেউ,” তিনি হেসে যোগ করেন, “আমার লেখা পড়তে চাও তুমি?”

-“প্রকাশ করতে চাই,” বলে ওঠে তিতাস।

[৩]


তিতাসের বন্ধু রজত। ওদের একটা লিটল ম্যাগাজিন আছে। নাম ‘মৌরিফুল’। বছরখানেক হলো নিয়মিত বেরুচ্ছে। সেই পত্রিকারই জন্য গোধূলি দেবীর লেখা নিয়েছিল তিতাস। কবিতা নয়। গোটা একটা নিবন্ধ। প্রায় চার হাজার শব্দের স্মৃতিচারণ। তাঁর সময়ের পুরনো কলকাতার কথা। অথচ সেই লেখারও নতুনত্ব ছিল অনেক। গোধূলি দেবী মন উজাড় করে সেখানে লিখেছিলেন স্বামী গত হওয়ার পর কিভাবে নিজের দক্ষতায় তাঁর ব্যবসাটাকে আবারও তিনি দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। লেখার মধ্যে ব্যবসায়িক কথাবার্তা ছিল না। ছিল কেবল মনের জোর, আর একেকটা করে ধাপ পেরুনোর গল্প। কেমন ভাবে তাঁর বাজারে যেতে শেখা, জিনিস চিনতে শেখা, হিসেব রাখতে শেখা। চিনতে শেখা মানুষজন। হোসিয়ারির ব্যবসা ছিল ওঁর স্বামীর। তিতাস জানে বেশ কয়েক বছর হলো সেই সবকিছুই বেচে দেওয়া হয়েছে। মাসখানেক পর সেদিন অফিস থেকে প্রায় লাফাতে লাফাতেই বাড়ি ফিরছিল তিতাস। হাতের মুঠোয় সে শক্ত করে ধরে রেখেছিল ‘মৌরিফুল’, দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যার উদযাপন। চকচকে মোটা কাগজের মলাট-পৃষ্ঠাটুকু তার হাতের ঘামে, আর্দ্রতায়, অল্প অল্প করে ভিজে যাচ্ছিল। তিতাস গন্ধ পাচ্ছিল নতুন কাগজের, যেন বা নতুন এক বিকেল নেমে এসেছে। কিন্তু গোধূলি দেবীর বাড়ির সামনে আসতেই কেমন যেন একটা অন্যরকম গন্ধ পেল তিতাস।

হাসপাতালের গন্ধ, ডাক্তারের গন্ধ, ইথাইল এ্যালকোহল...

বাড়ির সামনে জটলা নেই। কোনও ভিড় নেই। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কেবল একটা নতুন গাড়িকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। বারান্দায় খাঁ খাঁ শূন্যতা। তিতাসের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল হঠাৎ। দরজার সামনেটায় তখনই সে দেখল কাজলমাসি দাঁড়িয়ে রয়েছে। মোড়ের মাথায় যে ওষুধের দোকান, তারই যে ওষুধ দেয়, সেই লোকটার কাছ থেকেই কিছু বা যেন সে বুঝে নিতে চেষ্টা করছে। কাজলমাসি রাতের এ্যাটেনডেন্ট, তিতাস তাকে চেনে খুব ভালো করেই। তিতাস এগিয়ে যায়। প্রশ্ন ফেনিয়ে উঠেছে তার। অদ্ভুৎ এক সন্ধ্যে-অন্ধকার এই পাড়ার পরিসরটুকুতে যেন বা ঝুপসি হয়ে নেমে আসতে চেষ্টা করছে।

-“কি হয়েছে গো দিদার?”

-“সেরিব্রাল গো দিদিভাই! কাল রাতে বাথরুম যেতে গিয়েই পড়ে গিয়েছিল দুম করে মেঝের উপর। ভাগ্যিস আমি পিছনেই ছিলাম। ধরে ফেলতে ফেলতে চোট বেশি লাগেনি। কিন্তু জ্ঞান ছিল না একেবারেই। সকাল হতেই আমি ডাক্তারবাবুরে ফোন করলাম। দাদাবাবুকেও জানালাম, তিনিও চলে এসেছেন গো দিদিভাই, আজ বিকেলেই। এই একটু আগে এলেন। ততক্ষণে অবশ্য ডাক্তারবাবুও এসে দেখে গেছেন। বললেন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও লাভ হবে নাকো বিশেষ। বাড়িতেই থাকুক। জ্ঞান ফিরলে পরে ...” কাজলমাসি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘাম মুছতে চেষ্টা করে, “আজ সারাদিন আর বাড়ি যাওয়া হলো নাকো আমার!”

তিতাস ততক্ষণে বারান্দার দিকে তাকায়। খুব চেনা একটা অবয়ব সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। খুবই অস্বস্তিকর। তিতাসের শরীরটুকু শিউরে ওঠে কেমন। অধীরদা সেই একইরকম দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বয়স বাড়লেও চেহারায় খুব একটা বদল আসেনি তার।

-“অধীরদা, কোথা থেকে এলেন এবার?” তিতাস অস্ফূটে জিজ্ঞেস করে ফেলে।

-“ওই তো, নয়ডা না গুরগাঁও কোথায় যেন আপিস, সেখানেই তো গত দশ বছর ধরে রয়েছে গো। সেখান থেকেই এসেছে আজ,” কাজলমাসি জবাব দেয়। অধীরদা আবারও ভিতরে চলে গিয়েছে।

উপায়ন্তর না দেখে তিতাস হাতের পত্রিকাটাকে কাজলমাসিরই জিম্মা করে দেয়। “দিদাকে, দেখিও। জ্ঞান ফিরবে ঠিক,” ওর গলা জড়িয়ে যায়, “দিদার লেখা বেরিয়েছে,” গলা বুজে আসে, আর কিছু সে বলতে পারে না। কাজলমাসি মাথা নাড়ে। “দেখাব, ঠিক দেখাব। এই দেখেই তোমার দিদার জ্ঞান ফিরে আসবে গো দিদিভাই, এই আমি বলে দিলুম। তুমি ভিতরে আসবে না?” মাথা নাড়তে নাড়তে কাজলমাসিও জিজ্ঞেস করে। তারও গলা হঠাৎ ভার হয়ে এসেছে, টের পায় তিতাস। “এখন থাক, পরে আসবখন,” সে কাজলমাসির প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তারও যে বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে।


।। সূর্যাস্ত ।।

 

সেই রাতে আবারও বৃষ্টি হয়। আবারও ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে এ্যাসফল্ট-শহর। কি কারণে যেন পরদিন তিতাসকে অনেক সকালে বেরুতে হয়। সে পথে হাঁটতে গিয়ে লক্ষ্য করে আবারও ভেজা রাস্তার উপর রাধাচূড়ার হলুদ চেপটে যাওয়া ফুলগুলো ভিজে, থেঁতলে, একশা হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। সে আরও দেখতে পায়, গোধূলি দেবীর বাড়ির সামনে, সেই রাস্তারই উপর দুমড়ে-মুচড়ে স্যাঁতসেঁতে হয়ে ভেজা অবস্থায় পড়ে রয়েছে ‘মৌরিফুল’। মলাটের উপরকার ছাপা অক্ষরগুলো জলে ভিজে ক্রমশ কালচিটে হয়ে উঠে যেতে শুরু করেছে।

তিতাস, নীচু হয়ে বসে পড়ে হঠাৎ

দিন পনেরো কেটে যায় নিস্তব্ধতায়। এরই মধ্যে কাজলমাসির সঙ্গে দেখা হয় তিতাসের। কাজলমাসি জানায়,

“আমি দেখিয়েছিলাম গো লেখাটা তোমার। অনেক রাত্তিরে সেদিন দিদা উঁ-আঁ করছিল। আমি কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে কাগজের লেখাটার কথা বলেছিলাম। দিদা, চোখ মেলে চেয়েছিল গো হঠাৎ। চব্বিশ ঘণ্টার ভিতরে সেই প্রথমবার।“

“সকালে দিদার খাটের পাশে ওই কাগজটাকে দেখতে পেয়ে কেন জানি না দাদাবাবু খুব চটে গিয়েছিলেন। উলটে পালটে দেখেওছিলেন বোধহয়। তারপর, কাগজটা – আমি জানি তুমি কুড়িয়ে পেয়েছিলে সেদিন। কিন্তু দাদাবাবু জানতেন না, আমি সেদিন ভোররাত্তিরেই বেহুঁশ দিদাকে কানে ফিসফিস করে লেখাটা পড়ে শুনিয়েছিলাম। দিদা আঙুল নাড়াতে পারছিল তখন।”

ডাক্তার ঘোষ এটাকে মিরাকল বলেছিলেন। দিন তিনেকের মধ্যেই সম্পূর্ণ জ্ঞান ফিরে এসেছিল গোধূলি চক্রবর্তীর। অধীরদাকে ফিরে যেতে হয়েছিল।

কাজলমাসির মুখ থেকেই তিতাস শুনেছিল, ওরই মধ্যে বাড়ি আর সম্পত্তি নিজের নামে লিখে দিতে জোর করেছিল অধীর। গোধূলি দেবী রাজি হননি। “অসুস্থ হলেও এখনও আমি অজ্ঞান নই, সজ্ঞানে আমি তোমাকে সম্পত্তি লিখে দেব না কোনওভাবেই,” ফাউলার্স বেডে শুয়ে অধীরের মুখের উপরেই বলেছিলেন তিনি। অধীর পড়ে দেখেছিল, গোটা স্মৃতিচারণের লেখাটিতে একটিবারের জন্যও ছেলের নাম মুখে আনেননি গোধূলি চক্রবর্তী। তিতাসও জানে তার কারণ।

... অনেক বছর আগে বাগবাজার ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে দেখেছিল, তার প্রেমিক সেদিন সম্পূর্ণ অচেনা এক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অবস্থায়। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসেছিল। এই ঘটনার হয়তো বা মিটমাট হয়ে যেতেও পারত, যদি না গোপন সূত্রে গোধূলি চক্রবর্তীর কাছেও তাঁর গুণধর ছেলের একাধিক কীর্তিকলাপ ফাঁস না হয়ে যেত। লাম্পট্য ও নেশাখোরের চূড়ান্ত হয়ে উঠেছিল অধীর। রেবা সেসব জানতেও পারেনি। কেবল একজনের সঙ্গেই অধীরকে সেদিন সে দেখে ফেলেছিল। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যেই গোধূলি দেবী তাকে ডেকে পাঠান। চারপাশের পৃথিবীটাকে ঝনঝনিয়ে কাচের মতোই রেবা সেদিন ভাঙতে দেখেছিল। গোধূলি দেবী কেবল নিজের সম্মানটুকুকে ভিক্ষে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ছেলেকে কলকাতা থেকে অনেক অনেক দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিতে তিনি প্রস্তুত। কেবল পাড়ার মধ্যে;

রেবা জানত না কেবল, তিতাস নামের মেয়েটিও সেদিন, বাগবাজার ঘাটের উপর, আরও অনেক, অনেকটা দূর থেকেই তার আদরের, ভালোবাসার পিসুমকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখেছিল।

এই ঘটনারও আরও বেশ কিছুদিন পর তিতাস পিসুমকে গোধূলি চক্রবর্তীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুনে ফেলেছিল। মাসিমণি বলে পিসুম গোধূলি দেবীকে ডাকত তখন। কাজেই দরজার আড়াল থেকে পিসুমের কথা শুনেই তিতাস বুঝতে পেরেছিল পিসুম কার সঙ্গে কথা বলছে। ছোটরা যে এভাবেই অনেক কিছুকে দেখে ফেলে হঠাৎ। শুনে ফেলে, জেনে ফেলে, বুকের ভিতরটুকুতে তারা সেই কালো ইতিহাসগুলোকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। পিসুমকে তিতাস একবার বলেছিল, তার জেনে ফেলার কথা। পিসুম তিতাসকে দিব্যি করে বলিয়ে নিয়েছিল বাড়িতে কেউ যেন কিছু জানতে না পারে, কোনওভাবেই

[...] গোধূলি দেবী আবারও লেখা শুরু করেছেন। ‘মৌরিফুল’এ যে ধারাবাহিক লিখতে হবে তাঁকে। মধ্যে মধ্যে একেকটা সন্ধ্যেরাত, একেকটা বিকেলে হঠাৎ তিতাস আলতো পায়ে গোধূলি দেবীর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কেউ জানতে পারে না। গোধূলি দেবী চেয়ারে হেলান দিয়ে তাঁর নতুন লেখাগুলোকে পড়ে শোনান। আর মাসখানেকেরই যে অপেক্ষা কেবল। তারপরেই তিনি আবারও পার্কে গিয়ে হেঁটে আসতে পারবেন। হ্যালোজেন আলোর ঝাঁঝ,

হলুদরঙ কলকে ফুলেরা তখন টুপটুপিয়ে ঝরে পড়তে চায়...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন