বীরেন ভট্টাচার্য
'করাল বদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাং...'
অর্থাৎ ঘন কালো বর্ণ, এলো চুল এবং চার হাত। দক্ষিণা কালিকার মূর্তি এই রূপ। এই দেবী আপামর বঙ্গবাসীর ঘরে পুজিতা। মা কালীর মূর্তিটি আম বাঙালি রোজ সকালে, রাতে বিপদে, আপদে স্মরণ করে। দেবী কালীকে আমরা সবাই এক ভয়ংকরী রক্তপিপাসু দেবী বলে জানি। তন্ত্রশাস্ত্রের গভীর ব্যাখা অনুযায়ী, মা কালীর সঙ্গে রক্ত, বা ভয়ংকরীর কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি শুদ্ধ জ্ঞানদাময়ী, পূর্ণ ব্রহ্ম চৈতন্য স্বরূপা। তাই গানের ভাষায় বলা হয়, 'চেতনায় আলো দিয়ে আমার চৈতন্যময়ী কালো।' অজ্ঞানতার অন্ধকার হরণ করে তিনি জ্ঞানের আলোয় সাধকের, ভক্তের মন আলোকিত করে তোলেন।
আসলে দেবী কালী আগে পুজিতা হতেন শ্মশানে, গভীর জঙ্গলে। তান্ত্রিক, কাপালিক, অঘোরী সাধকরা মদ, মাংস মুদ্রা, মৎস্য সহযোগে মা কালীর সাধনা করতেন। গৃহী ব্যক্তিদের স্বপ্নাতীত ছিল সেই দেবী কালীর পূজা ও সাধনা। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলেন নবদ্বীপের মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তাঁরা ছিলেন দুই ভাই - কৃষ্ণানন্দ ও মাধবানন্দ। পরম বৈষ্ণব বংশে জন্ম নেওয়া মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দের মধ্যে অল্প বয়স থেকেই মাতৃসাধকের লক্ষণ ফুটে ওঠে। তবে নিজের ইষ্ট দেবীকে মৃন্ময়ী রূপ দিয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু মায়ের রূপ কেমন হবে, তা স্থির করতে পারছিলেন না। সেই সময় গভীর রাতে স্বপ্ন দিয়ে মা কালী তাঁকে জানান, সকালে উঠে প্রথম যে মহিলাকে দেখবেন, সেই মহিলা যে অবস্থায় থাকবেন, সেটিই হবে তাঁর রূপ। চমকে ঘুম ভেঙে গেল কৃষ্ণানন্দের। ভোর হতেই ছুটলেন অভ্যাসমতো গঙ্গাস্নানে। পথে দেখলেন বাগদি বউ সকালে ঘরের দেয়ালে ঘুঁটে দিচ্ছেন। একহাত উঁচু করে ধরা ধরা গোবরের তাল, আরেক হাতে গোবর ছুঁড়ে দিচ্ছেন দেওয়ালে। কপালে সিঁদুর লেপ্টে গিয়েছে, খোলা চুল। কৃষ্ণানন্দকে দেখামাত্রই লজ্জায় জিভ কাটলেন তিনি। ব্যস! সেই মহিলার ওই রূপ দেখতেই কৃষ্ণানন্দের মনে অনুরণিত হল মায়ের ধ্যান...'মেঘাঙ্গীং বিগতাং বরাং শবশিবা রূঢ়াং ত্রিনেত্রাং পরাং।' মহিলার পদতলে হাতজোড় করে বসে পড়লেন তিনি। তৈরি হল এক ইতিহাস। নিজের হাতে মা দক্ষিণাকালীর মূর্তি তৈরি করে তার সহজ সরল পুজা ও আরাধনা পদ্ধতি তৈরি করলেন কৃষ্ণানন্দ। পরে সেই পথ ধরে সাধক রামপ্রসাদ, মেহারের সর্বানন্দ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মতো সাধকদের সাধনাবলে দেবী কালী হয়ে উঠলেন বাংলার ঘরের মা। গানে গানে মা কালী আজ বাংলার জননী, ঘরের মেয়ে শ্যামা। গানে গানে তাই বলি, 'ভুল না দক্ষিণাকালী বদ্ধ হয়ে মায়া জালে।'
মা কালীর মূর্তিটি আসলে রূপক মাত্র। তার গভীর তত্ব অনুসরণ করলেই আসল কালী রহস্য জানা যায়। দশ মহাবিদ্যার প্রথম রূপ মা কালী। দেবী কালীর গায়ের রং ঘোর কালো। এর অর্থ কী? কালো এমন একটি বর্ণ যা সব রংকে শোষণ করে নেয়। এখানে রং শব্দ গুণ অর্থে, সব গুণ ধারণ করে তিনি নিজে ত্রিগুণাত্রিত। তাই তাঁর গায়ের রং কালো। বামদিকে ওপরের আর নীচের হাতে খড়গ আর সদ্য কাটা মুণ্ড। এখানে খড়গ জ্ঞানের প্রতীক, তার মানে কী? খড়গ দ্বারা তিনি অজ্ঞানরূপী অসুরের মুণ্ডচ্ছেদন করে মোক্ষ প্রদান করেন। বাম দিকের নিচের হাতে কাটা মুণ্ড মোক্ষের প্রতীক। ডান দিনের ওপরে অভয় আর নিচে বরমুদ্রা। তিনি ভক্তদের বর আর অভয় প্রদান করেন। গলায় মুণ্ডমালা। এখানে প্রতিটি মুণ্ড এক একটি অক্ষরের প্রতীক। স্বর এবং ব্যাঞ্জন বর্ণ মিলিয়ে ৫০টি অক্ষর। মা কালীর গলায় ৫০টিই মুণ্ডমালা আছে। প্রতিটি মুণ্ড এক একটি অক্ষর, অর্থাৎ তিনি জ্ঞানদাত্রী। এলোকেশী রূপেই মা কালীকে আমরা জানি। কালো খোলা চুল তমোগুণের প্রতীক। মা কালীর লাল জিভ। প্রচলিত কথা অনুসারে তিনি রক্তপান করেছেন তাই জিভ লাল। প্রশ্ন হল রক্তপান করায় জিভ লাল, অথচ দাঁত সাদা কেন? শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা অনুসারে, সাদা দাঁত সত্ত্ব গুণের প্রতীক। সত্ত্ব গুণের প্রভাব বাড়িয়ে রজ:গুণকে দমন করার অর্থ বহন করে লাল জিভকে সাদা দাঁত দিয়ে চেপে রাখা। তিনি উলঙ্গ কেন? বিশ্ব চরাচরের যিনি মহাশক্তি, তাঁকে আচ্ছাদিত করে রাখে কোন বস্ত্র? তাই তিনি দিগম্বরী। দক্ষিণ দিকে মুখ কেন? কারণ কথিত আছে, দক্ষিণে স্বয়ং যম বা ধর্মরাজের অবস্থান। তাঁর দর্শনে যম পালিয়ে যায়। সেই কারণে তিনি দক্ষিণে মুখ করে থাকেন। শ্মশানবাসী কেন মা কালী? কারণ, জীবের অন্তিম পরিণতি, শ্মশান পরম শান্তির জায়গা। সেই কারণে তিনি শ্মশানচারিণী। পদতলে শবশিব (শিবের শবরূপ)। এটি সাধকদের বোধগম্য। শবশিব সময়ের প্রতীক। তিনি সময়কে দমন করে রাখেন। কালকে নিয়ন্ত্রণ করেন, সেইজন্য পদতলে শবশিব। আবার অপর অর্থে, শবশিব নির্লিপ্ত মনের প্রতীক। নির্লিপ্ত মনেই মা কালীর অবস্থান। সেই কারণে এই রূপ। সংক্ষেপে লিখলাম।
আজকাল অনেকেই তন্ত্র চর্চা করেন। তন্ত্রশাস্ত্রকে বিষধর সর্পের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ফলে বিস্তারিত না জেনে চর্চা করা উচিত নয়। কালী বা মহাবিদ্যার অন্যান্য দেবীদের আরাধনা করা গুরু পথ নির্দেশিত এবং শুদ্ধাচারের পথ। শ্মশান বৈরাগ্যের ওপর ভর করে দু চারদিনের ভক্ত বা সাধক, তান্ত্রিক সাজা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। পঞ্চমুণ্ডির আসন হোক বা শব সাধনা, প্রত্যেকটি গুরু নির্দেশিত গুহ্য তত্ত্ব। এসব সাধনা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। ভণ্ডামি করলে মৃত্যু বা সমূহ বিপদ আসন্ন। জিতেন্দ্রীয়, অসম সাহসী, সংযমী, মায়ের চরণে শুদ্ধা ভক্তি ছাড়া এই সাধনা সম্ভব নয়। ফলে সেই স্তরে না পৌঁছে এসব চেষ্টা করা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলতেন, পূর্ব জন্মের সংস্কার ত্যাগ না করলে সিদ্ধিলাভ করা যায় না। ফলে, মায়ের কৃপা পেতে গেলে একমাত্র মাকেই ধরে রাখা দরকার। আর তন্ত্রের গুরু, প্রণেতা সদাশিব। স্বয়ং মহাদেবের সৃষ্টি করা এই শাস্ত্রের গুঢ় অর্থ বোঝা, সদগুরুর সন্ধান পাওয়ার জন্য শিব আর শক্তিকে একসঙ্গে ডাকা উচিত। তাঁদের কৃপা হলেই নিশ্চয় সদগুরুর সন্ধান মিলবে, হবে সিদ্ধিলাভ। কারণ, ওই যে গানে গানে বলা হয়েছে, 'তুই নাকি মা দয়াময়ী শুনেছি ওই লোকের মুখে।' তিনি দয়াময়ী, করুণাময়ী। তাঁর অপার করুণা পেতে তাঁকেই ধরে রাখতে হবে। মন মায়ের শ্রীচরণ ছাড়া হলে চলবে না। তবেই দর্শন হবে তাঁর।