দোঁহা

চিতে ডাকাতের কালীবাড়ি


পায়েল চট্টোপাধ্যায়

সময় কাল মোটামুটি ১৬০০ সন। বর্তমান কলকাতার সুতানুটির উত্তর সীমান্তে গভীর জঙ্গল ঘেরা একটা গ্রাম ছিল। চিৎপুর। ডাকাত সর্দার চিত্রেশ্বর রায়ের প্রভাবে চিৎপুর তখন কুখ্যাত। চিতে ডাকাতের ভয়ে বিব্রত ওই অঞ্চলের মানুষ। সাধারণ গরীব-দুঃখী মানুষরা এই প্রভাবশালী, সাহসী ডাকাত সর্দারকে রীতিমতো পুজো করত, আর বিত্তবান মানুষরা ভয় পেত চিতে ডাকাতের হিংস্রতা এবং নৃশংস অত্যাচারকে। ৫০০ সদস্য সহযোগে ডাকাতি করতে বেরোতেন চিতে ডাকাত। ঠ্যাঙাড়ে, লেঠেল, তলোয়ারধারী এই ডাকাতরা একদিকে ছিলেন নিষ্ঠুর, অন্যদিকে লুঠপাট করায়ও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন তাঁরা। বাংলা, বিহার উড়িষ্যা থেকে দুঃসাহসী, দক্ষ, বেপরোয়া লোকজনদের নিয়ে চিতে ডাকাত গড়ে তুলেছিলেন তাঁর ডাকাত-দল। জলদস্যুরাও ছিল তাঁর দলে। এই চিতে ডাকাত অর্থাৎ চিত্রেশ্বর রায়ের নামেই আজকের কলকাতার চিৎপুর।

প্রতিদিন ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে দেবী দশভুজার পুজো করতেন চিতে ডাকাত। তাঁর আরাধ্যা দেবী ছিলেন চিত্রেশ্বরী। এই দেবীর রূপ ও অবস্থান নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। কেউ বলেন মন্দিরটি আগে গঙ্গার ধারে জঙ্গল ঘেরা একটি অঞ্চলে অবস্থিত ছিল, পরবর্তীকালে নদীতে পলি পড়ায় গঙ্গার জল পিছিয়ে যায়, ফলে মন্দিরটি গঙ্গা থেকে দূরে সরে যায়। তান্ত্রিক মতে চিত্রেশ্বর ডাকাত তাঁর আরাধ্যা দেবী চিত্রেশ্বরী পুজো করতেন। নরবলি দেওয়া হতো নিয়মিত। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে "একোর্ডিং টু পপুলার এন্ড আনকন্ট্রাডিক্টেড ট্র্যাডিশন দিজ ওয়াজ দ্য স্পট হোয়ার লার্জেস্ট নাম্বার অফ হিউম্যান স্যাক্রিফাইসেস ওয়াস অফারড টু গড ইন বেঙ্গলি এস্টাবলিশমেন্ট অফ দ্য ব্রিটিশ গভমেন্ট।" কথিত আছে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এই মন্দিরটিতেই সবচেয়ে বেশি নরবলি দেওয়া হয়েছিল।

দেবী চিত্রেশ্বরী এই মন্দিরে দারুমূর্তি। শাড়ি পরিহিতা, মুকুট ও নথ শোভিতা। কানপাশা জ্বলজ্বল করছে। দেবীর সঙ্গে অবস্থান করেন অসুর। এখানে অসুরের গায়ের রং সবুজ। দেবীর সঙ্গে রয়েছে বাঘের মূর্তি। এই বাঘ সুন্দরবনের দক্ষিণরায়। কথিত আছে, বর্তমানে এই চিৎপুর এলাকা একসময় সুন্দরবনের মতই জলে-জঙ্গলে পূর্ণ ছিল। চিতে ডাকাত চিত্রেশ্বরী দেবীকে পুজো দেওয়ার আগে বাঘের পুজো করতেন। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পেছনদিকে বাগানের মধ্যে রয়েছে পঞ্চমুন্ডির আসন। চিত্রেশ্বরী দেবীর মূর্তি দুর্গার প্রতিরূপ হলেও কালীপুজোর নিয়ম মেনেই চিতে ডাকাত দেবীমায়ের পূজো করতেন। বিশেষ করে নরবলির যে সমস্ত তথ্য ও প্রমাণ চিত্রেশ্বরী দেবীর মন্দির সম্বন্ধে পাওয়া গেছে তা থেকে নিশ্চিতভাবে এই মন্দিরটিকে দেবী কালীর মন্দির হিসেবেই বলা হয়। 'ক্যালকাটা ওল্ড এন্ড নিউ' বইতেও তেমনি উল্লেখ রয়েছে। "ওয়াস নোটেড ফর দ্য টেম্পল অফ চিৎপুর অফ কালিজ রিনাউনড ফর দ্য নাম্বার অফ হিউম্যান স্যাক্রিফাইসেস ফরমালি অফারড আফটার স্রাইন।"

বাঘের পুজো করে দেবীর চরণে মন্ত্রপুত জবা ফুল দিয়ে অপেক্ষা করতেন চিতে ডাকাত ও তাঁর দল। ফুল যদি মায়ের পায়ে স্থির থাকতো তাহলে এই বিষয়টাকে মায়ের সম্মতি হিসেবেই ধরে নিতেন ডাকাতের দল। বেরিয়ে পড়তেন ডাকাতি অভিযানে। যদি কোনো কারণে মায়ের পা থেকে ফুল পড়ে যেত বা স্থিরভাবে ফুল অবস্থান করত না, তখনই বাতিল হত যাত্রা।

চিত্রেশ্বরী মন্দির নিয়ে আরেকটি বিষয় কথিত আছে। দেবী চিত্রেশ্বরীর মন্দিরটি আসলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মনোহর ঘোষ ওরফে মহাদেব ঘোষ। মন্দিরের গায়ের প্রতিষ্ঠা পত্রে উল্লেখিত রয়েছে, 'আদি চিত্রেশ্বরের মন্দির চিত্রপুর-স্থাপিত ইংরাজি-১৬১০ সন।'

মহাদেব ঘোষ সম্রাট আকবরের পারিষদ রাজা টোডরমলের গোমস্তা ছিলেন। ধনী, উচ্চবিত্ত এবং অজস্র সম্পত্তির মালিক মহাদেব ঘোষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল চিতে ডাকাতের। চিতে ডাকাতের কথামতই মহাদেব ঘোষ চিত্রেশ্বরী দেবীর মন্দিরটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। তবে এই বন্ধুত্বের আয়ু খুব বেশিদিন ছিল না। কিন্তু দেবী চিত্রেশ্বরীর প্রতি অগাধ ভক্তি ছিল এই মহাদেব ঘোষের। পরবর্তীকালে চিতে ডাকাতের নৃশংসতার কারণে যিনি চিৎপুর ছেড়ে চলে যান, দেবী চিত্রেশ্বরীর টানে আবার ফিরে এসেছিলেন চিৎপুরে। তবে সে ফেরাও স্থায়ী হয়নি। যদিও চিতে ডাকাতের নরবলি ও অত্যাচারে তিনি আবার ফিরে যান। দেবী চিত্রেশ্বরীর মন্দিরের দখল পুরোপুরি চলে যায় ডাকাত সরদার চিতের হাতে। দেবী চিত্রেশ্বরী দুর্গা না কালী এই নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। দুর্গার প্রতিরূপ হলেও লক্ষ্মী, সরস্বতী কার্তিক উপস্থিত নেই দেবীর সঙ্গে, দেবী পাষাণ মূর্তি ধারণ করেন এখানে। দেবীকে জবা ফুল দিয়ে পূজা করা হতো এবং তান্ত্রিক নিয়ম মেনে দেবীর আরাধনা করা হতো বলে পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা চিত্রেশ্বরী দেবীর মন্দিরকে দেবী কালীর মন্দির হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন।

দ্বিতীয়বার মন্দিরের দখল পাওয়ার পর চিতে ডাকাতের রাজত্ব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। চক্রপানি নামের এক ব্যক্তি প্রথমবার চিতে ডাকাতের নরবলির বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি নিজেও চিত্রেশ্বরী দেবীর পূজা দিতেন, তবে চিতে ডাকাতের নৃশংসতাকে সমর্থন করতেন না। ‌এই চক্রপানি একবার কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পৌঁছে যান গৌড়ে। গৌড়ের সুলতানের দরবারে তিনি কাজ পেলেও সুলতান চক্রপানির মেয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে বেগম হিসেবে পেতে চেয়েছিলেন সুলতান। মেয়েকে রক্ষা করতে তিনি আবার চিৎপুরে ফিরে আসেন। ফিরে এসেই চিত্রেশ্বরী দেবীর মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছিলেন চক্রপানি। অমাবস্যার এক রাতে একটি বাচ্চাকে বলি দেওয়ার চেষ্টা করার সময় চক্রপানি অর্তকিতে আক্রমণ করে চিতে ডাকাতকে। তারপর চক্রপানির সৈন্যদের হাতে প্রাণ দেন চিতে ডাকাত।

তবে চিতে ডাকাতের মৃত্যুর পর দেবী চিত্রেশ্বরী বহুদিন অযত্নে, অবহেলায় পড়েছিলেন। অবশেষে সাধক নৃসিংহ ব্রহ্মচারী স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে দেবী চিত্রেশ্বরীর পুজো শুরুও করেছিলেন দ্বিতীয়বার। তিনি দেবীকে চিত্রেশ্বরী মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শোনা যায় মায়ের মূর্তি উদ্ধারের পর নৃসিংহ ব্রহ্মচারী দেবীর বক্ষস্থলে আট চরণে লেখা দুটি শ্লোক দেখতে পেয়েছিলেন, এই মন্ত্রেই আবার দেবীর পূজা শুরু করেছিলেন।

দেবী চিত্রেশ্বরী প্রথমে দক্ষিণমুখী ছিলেন বলেই প্রচলিত। কিন্তু শোনা যায়, সাধক রামপ্রসাদ ভাগীরথী নদীতে নৌকায় চেপে যাওয়ার সময় একবার গান ধরেছিলেন দেবী কালীর উদ্দেশে। সেই গান শুনেই দেবী নাকি নিজের অভিমুখ পরিবর্তন করে পশ্চিমমুখী হয়ে গিয়েছিলেন। বর্তমানে দেবী চিত্রেশ্বরী মন্দিরের সেবায়তরা পশ্চিমমুখী হয়েই পুজো-আচ্চা করেন। দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোর সময় বিশেষ উৎসব পালন করা হয় এখানে। দেবী চিত্রেশ্বরীর মন্দির এখনো চিতে ডাকাতের কালিবাড়ি নামেই পরিচিত। নৃশংস চিতে ডাকাতের এই কালীবাড়িতে বলি দেওয়ার প্রথা আজও প্রচলিত। তবে মায়ের সামনে ফল বাদ দিয়ে কোন কিছুই আর নিবেদন করা হয় না।

তথ্যসূত্র:

১. কলকাতার কালীবাড়ি - অনীশ ঘোষ
২. 'বঙ্গদর্শন' ও 'এই সময়' পত্রিকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন