দোঁহা

বেদের বেটি ৺রী মা

 



 সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

পাঁচপো আতপ-চালের ভাত আর কাঁচা-তেঁতুল বা আমড়া দিয়ে কাঁচা মাছ ও পাঁচ-মিশালী সবজির টক- এই হল ৺রী মায়ের নিত্য-ভোগের অপরিহার্য অঙ্গ।

অবাক লাগছে নিশ্চয়!

বলুন তো কে এই '৺রী মা'? কে এই 'বেদের বেটি'? আর কোথায় বসত্ করেন তিনি?

আসুন জেনে নিই আমরা-

বীরভূম জেলার আকালীপুর গ্রামের দক্ষিণে ব্রাহ্মণী (কথ্যে ব্রহ্মাণী) নদীর তীরে স্থাপিত প্রায় আড়াইশো বছরের সুপ্রাচীন এক মন্দির। এই মন্দির-গর্ভে অধিষ্ঠাত্রী কালো কষ্টি-পাথরের অতীব-সুন্দর বিগ্ৰহ ৺রী মা গুহ্য-কালী।

শতাক্ষীর শরীর হতে উৎপন্না অন্যতম মহাশক্তি। গৃহীর কাছে একদা অপ্রকাশ্য মহাকাল-সংহিতার অনু-স্মৃতি প্রকরণের নব-কালীর এক রূপ। তোড়ল-তন্ত্র অনুসারে
যোগ-সাধনায় অভীষ্ট-দায়িনী আরাধ্যা মা তিনি।

পুরাকালে মগধ-রাজ জরাসন্ধ তন্ত্র-সিদ্ধি হেতু গুপ্ত ভাবে পাতালে ৺রী মায়ের এই বিগ্ৰহটির পূজা করতেন।
তাই তো মা আমার 'গুহ্য-কালী'!

রামপ্রসাদী শ্যামা-সঙ্গীতের একটি চরণ–'কে জানে কালি কেমন/ মূলাধারে সহস্রারে সদা-যোগী করে মনন!'

তন্ত্র-সাধনায় দেহস্থ মূলাধারে কুল-কুন্ডলিনী শক্তি জাগ্ৰত করা হয়। যা ব্রহ্ম-রন্ধ্রে মিলিত হয় অধোমুখী সহস্রারে।
সাধনার গুপ্ত-তত্ত্ব লুক্কায়িত মা গুহ্য-কালীর এই বিগ্ৰহে। তাই  মাতৃ-রূপে খুঁজে পাই অভিনবত্ব।
মা আমার চতুর্ভুজা নন, দ্বিভূজা।
দক্ষিণ-হস্তে বর-মুদ্রা আর বামে বরাভয়। আয়তাকার কালো পাথরের বেদীতে দু'টি কুন্ডলীকৃত সর্পের ওপর অর্ধ-পদ্মাসনে উপবিষ্টা তিনি। ডান-পা সাপের মাথা স্পর্শ করে আছে।

মুকুটে শোভিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সহস্র নাগ-ফণা যা সহস্রারের প্রতীক। পঞ্চাশটি নর-মুন্ড দিয়ে তৈরি কন্ঠহার। কর্ণ-কুহর হতে বক্ষ অবধি নেমে আসে দু'টি শব-দেহ। দ্বিমতে কুন্তীর ন্যায় কর্ণ-প্রসবিণী মায়ের দুই নব-জাতক। সর্প-উপবীত। ফণা-ধারী সর্প কোমর-বন্ধণী।
বাম কঙ্কনে তক্ষক-রাজ ও দক্ষিণ কঙ্কনে অনন্ত নাগ-রাজ। কুল-কুন্ডলিনী শক্তির আধার এই সর্প।
নর-করোটির অংশ (মহা-শঙ্খ) দিয়ে তৈরী চক্ষু এবং দন্ত-রাশি।
লোল-জিহ্বা হতে যেন রাতুল-শ্যোণিত ঝরে অবিরত।
বিকট-দর্শনা হলেও অনুভবে মায়ের ভয়াল রুদ্র-রূপ দেখিনা। প্রলয় শেষে মা বড়োই স্নিগ্ধ, মনোমোহিনী।
ঊর্ধাঙ্গে মা বসন-হীনা। নিম্নাঙ্গে শ্যাম-কৃষ্ণ বর্ণের পট্ট-বস্ত্র পরিহিতা। মূলতঃ মায়ের বস্ত্র কৃষ্ণ-বর্ণ। ত্রিনয়নী ৺রী মায়ের উচ্চতা প্রায় চার ফুট।

আরও এক অভিনবত্ব-
৺রী মায়ের বামে বিরাজিত বৎস-রূপী মহাকাল-ভৈরব, পদতলে নয়।

মায়ের মন্দিরের তিনটি প্রবেশ-দ্বার। মূল দ্বার দক্ষিণে। ৺রী মা দক্ষিণাভিমুখী। মন্দিরের দক্ষিণে একটি পঞ্চ-মুন্ডী সিদ্ধাসন আছে। অষ্ট-কোণ দূর্গের অনুকরণে নির্মিত এই মন্দিরটি।
ছোট বাংলা ইঁটের গাঁথুনি। সিঁড়িতে ব্যাসাল্ট শিলা ব্যবহৃত।
রয়েছে কালের সাক্ষী সুপ্রাচীন বট-বৃক্ষ। শিবের জটার মত ঝুরি নেমেছে।
কথিত আছে ইং ২৫শে জানুয়ারি ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দে (বাংলা ১১ই মাঘ ১১৭৮) তন্ত্র-বিধান অনুসারে নদীতটে এক ত্রিস্তরীয় যন্ত্র-বেদী-মূলে মায়ের প্রাথমিক অধিষ্ঠান হয়। কালের গ্রাসে ক্ষয়-প্রাপ্ত ভগ্ন বেদীটি এখনো বিদ্যমান। 

 'তারাপীঠ-ভৈরব' সাধক বামা-ক্ষ্যাপা বলেছেন – 'এই বেদের বেটির সাধনা বড়ই কঠিন'। তিনি প্রায়ই মায়ের কাছে এসে আপনমনে প্রাণের কথা বলতেন। তারা-মা কে 'বড়-মা' আর আকালীপুরের ৺রী গুহ্য-কালী মা কে 'বেদের বেটি' বলে সম্বোধন করতেন তিনি।


–'वेदोऽहमवेदोऽहम्।' অথর্ব বেদোক্ত দেব্য সূক্তের প্রথম চরণ।
আমিই বেদ আমিই অবেদ। কালী নিজেই বেদ। তাই মা আমার 'বেদের বেটি'।
৺রী মায়ের একাক্ষর বীজ-মন্ত্র হলো 'ক্রীং'।
আর বিশেষ বীজ-মন্ত্র:-
'ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুম হুম হ্রীং হ্রীং গুহ্যে কালিকে ক্রীং ক্রীং ক্রীং হুম হুম হ্রীং হ্রীং স্বাহা।'
৺রী মায়ের পূজাধার কিন্তু ঘট নয়।
চন্দন-লিপ্ত তাম্র-পাত্রে খোদাই করা কালী-যন্ত্রের মধ্য-বিন্দুতে 'ক্রীং' লিখে পূজাধার তৈরী করা হয়।
একটি বিন্দু, পাঁচটি ত্রিভুজ, ও তিনটি বৃত্ত ও বৃত্ত ঘিরে আটটি পদ্ম-দল খোদিত আছে এই কালি-যন্ত্রে।
নিত্য-পূজা ও শনি-মঙ্গলবারের বিশেষ পূজা ছাড়াও প্রতি বছর আশ্বিনের শুক্লা চতুর্দশী আর মাঘের কৃষ্ণা রটন্তী চতুর্দশী তিথিতে ৺রী মায়ের পূজা হয়।
পূর্বে ছাগ-মেষ-মোষ বলির প্রচলন ছিল। কোজাগরী পূর্ণিমার আগের দিন এই বলি হতো। এখন মেষের পরিবর্তে চাল-কুমড়ো আর মোষের পরিবর্তে দুধ-আটা-ক্ষীর দিয়ে মোষের আকার গড়ে নিয়ে প্রান-প্রতিষ্ঠা করে বলি দেওয়া হয়। পুরাকালে নরবলিও হতো। লোকশ্রুতি অভাগী মায়ের আর্তি শুনে ৺রী মা বলি দেওয়া সন্তানকে জীবিত করে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এখনও এখানে ছাগ-বলি হয়।

আরও এক অভিনবত্ব- পূজা সম্পন্ন করা হয় দিবাভাগে, রাত্রে নয়। মায়ের নৈশ-লীলার ব্যাঘাত যাতে না ঘটে। মা যে বড়ই জাগ্ৰত! শ্মশান-বাসী মা রূদ্ধ দেবায়তনে বদ্ধ থাকতে পারেন না। প্রতি রাতে মায়ের নৈশ-লীলার জন্য সন্ধ্যারতির পর শীতল দিয়ে মন্দির-প্রাঙ্গণ ফাঁকা করে দেওয়া হয়।  
মা ঘুরে বেড়ান মহা-শ্মশান প্রান্তরে। তাই তো মায়ের পাটের শাড়ীতে চোর-কাঁটা বিঁধে থাকে! নিশুত-রাতে মায়ের গর্ভ-গৃহের দ্বার খুলে যায়। বিচ্ছুরিত হয় মহাজাগতিক রশ্মি। কেউ-বা শোনে কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজ। মা বিচরণ করেন মন্দির-প্রাঙ্গণে। নদী-তট হতে উঠে আসা শ্যামবর্ণা কন্যাকে অনেকেই দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন। কথায় বলে –'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর!'

আড়াইশো বছরের প্রাচীন মন্দিরের সুপ্রাচীন এই বিগ্ৰহটির সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত অলৌকিক নানা কাহিনী–যা লোকমুখে প্রচারিত।
স্বপ্নাদেশ দেন মা।
যারা জীবনে কোনোদিন মাকে দেখেননি অথচ স্বপ্নাদেশ পেয়ে ছুটে এসেছেন এরকম ভক্তেরও সন্ধান পাওয়া যায়।
এখানে বছরে দু'বার মেলা বসে– পৌষ-সংক্রান্তিতে প্রতি-বছর একদিনের জন্য আর কোজাগরী পূর্ণিমার আগের দিন বিশেষ পূজা উপলক্ষ্যে।
মনস্কামনা পূরণের জন্য অগণিত ভক্ত-সমাগম হয় এই স্থানে।

পুরাকালের ঐ মাতৃ-মূর্তি কিভাবে সুদূর মগধ থেকে বীরভূম জেলার প্রত্যন্ত এই আকালীপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় জেনে নিই আমরা-

কালের প্রবাহে মূর্তিটি ধরণী-গর্ভে চাপা পড়ে যায় হাজার হাজার বছর ধরে।
আনুমানিক সময়কাল -
১৭৭১-১৭৭৫ (ইং)
রাণী অহল্যাবাঈ মহাদেব এর স্বপ্নাদেশ পেয়ে শিব-লিঙ্গের অন্বেষণে খনন-কার্য শুরু করেন। তখন উঠে আসে ৺রী মায়ের এই অপূর্ব মূর্তিটি। রাণী উপহার দেন কাশীরাজ চৈত সিং কে। নয়নাভিরাম এই বিগ্ৰহটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে তৎকালীন ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের। মূর্তিটির অপরিসীম ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক তাৎপর্য বিচারে ইংল্যান্ডের মিউজিয়ামে রাখার অভিসন্ধি করেন তিনি। 

 কাশীরাজ মূর্তিটি কে রক্ষা করতে লুকিয়ে রাখেন গঙ্গাবক্ষের এক নির্দিষ্ট স্থানে।

–'আমি কাশীতে গঙ্গা বক্ষে নিমজ্জিত। তুই আমায় উদ্ধার কর।' এদিকে স্বপ্নাদেশ পান মহারাজ নন্দকুমার। সাধক রামপ্রসাদের সমসাময়িক ছিলেন তিনি। আধ্যাত্বিকতায় পরম আস্থা ছিল তাঁর। তখন তিনি ব্রিটিশ-শাসিত অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের দেওয়ান পদে আসীন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ-আলম ইং ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে নন্দকুমারকে 'মহারাজা' উপাধি প্রদান করেন। কাশীরাজের সহায়তায় তিনি নৌকা-যোগে দীর্ঘ গঙ্গা-নদী অতিক্রম করে প্রথমে দ্বারকেশ্বর নদ (কথ্যে দ্বারকা বা বাবলা), পরে দক্ষিণে ব্রাহ্মণী নদী অতিক্রমে বিগ্ৰহটি নিয়ে আসেন আকালীপুর গ্রামে।
প্রবাদে মহারাজ নন্দকুমারের পৈতৃক ভিটা নিকটবর্তী ভদ্রপুরে হওয়া সত্ত্বেও মাঝি-মাল্লাদের নৌকা আটকে যায় এই ঘাটে। তাই এই স্থানটি মনোনীত হয় মাতৃ-মন্দির স্থাপনার জন্য।
হয়তো বা বিগ্ৰহটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে সুরক্ষিত রাখার কারণেও নির্বাচিত হয় শ্মশান সংলগ্ন এই নির্জন জায়গাটি। মন্দির নির্মাণ কার্য শুরু হয়।

ওয়ারেন হেস্টিংসের চক্রান্তে মিথ্যা মামলায় বিনা-দোষে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির আদেশ হয়। পুত্র
গুরুদাস পিতার নির্দেশ অনুসারে অসম্পূর্ণ মন্দিরেই মায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে দ্বিমত থাকলেও জনশ্রুতি ইং ১৭৭৫ খৃষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই (বাংলা ৩১শে আষাঢ় ১১৮২) অসম্পূর্ণ এই মন্দিরটির দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়। আর ৫ই আগষ্ট (২১ শে শ্রাবণ, ১১৮২) মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি হয়। কথিত ঠিক সেই সময় মন্দিরের বাইরে দেওয়ালের উত্তর-ভাগে বড়ো ফাটল ধরে যায়। বর্তমানে তা সংস্কার করা হয়েছে।
অসম্পূর্ণ মন্দিরটি নিয়েও অনেক জন-শ্রুতি আছে।

কল্লোলিনীর কোলাহল হতে দূরে নদীর তীরে প্রকৃতির নির্জন সৌন্দর্য উপভোগ করার উপযুক্ত স্থান এই আকালীপুর কালিবাড়ি।
যাঁরা এই পূণ্য-তীর্থে ৺রী মায়ের দর্শন করতে চান তাঁদের জ্ঞ্যাতার্থে পথ-নির্দেশিকা নীচে দেওয়া হলো-

হাওড়া থেকে ট্রেনে
নলহাটি জংশন ( ২৩৩ কিমি)। স্টেশন থেকে বাসে
নগড়া'র মোড় (আনুমানিক ১২ কিমি)। মোড় থেকে টোটো করে আকালিপুর কালিবাড়ি (আনুমানিক সাড়ে-তিন কিমি)।

আমি ধণ্য!
আমি কৃতার্থ!!
আমার লেখণী মায়ের মাহাত্ম্য প্রচারে নির্বাচিত!
মায়ের কৃপা ব্যতীত এই লেখাটি সম্পূর্ণ করা সম্ভব ছিল না।

৺রী মা গুহ্যকালী'র কৃপা বর্ষিত হোক সবার 'পরে- এই কামনা করি।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার:

শ্রী দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায়। (প্রধান-পুরোহিত আকালীপুর কালীবাড়ি, মুঠোফোন:-৮৬৭০৩৫৫৪২২)এবং শ্রীমতী শুক্লা চ্যাটার্জী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন