দোঁহা

দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রূপকথা ও বঙ্গোপন্যাসে ব্যঙ্গমা- বেঙ্গমী প্রসঙ্গ

 


সুকন্যা দত্ত

"ঝিলমিল ঝিলমিল ঝর্ণা সেথায়,
কুলকুল কুলকুল রোজ বয়ে যায়।
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী গল্প শোনায়
রাজার কুমার পক্ষীরাজ চড়ে যায়,
ভোরবেলা পাখনা  মেলে দিয়ে তোরা
এলি কি বল না সেই দেশ বেরিয়ে?"


গানটা  যতবার শুনেছি, ততবার বিচিত্র রঙের, নানান ঢং এর পাখিদের নিয়ে কৌতুহল বেড়েছে। সময়ের সাথে বহু পাখির সাথে পরিচয় হয়েছে ঠিকই কিন্তু অনুসন্ধিৎসু চোখ খুঁজছে ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীদের। তাদের ঠিকানা পেতে হলে যেতে হয়  রূপকথার দেশে। রাজপুত্র, কোটাল পুত্র, সুয়োরানী, দুয়োরানী, রূপবতী রাজকন্যায় ভরা সে দেশ। ভালো-মন্দের দ্বন্দ্ব ভুলে শেষ পর্যন্ত শুভর জয় হয় রূপকথার জগতে। এই দেশ ঠাকুরমা, দিদিমার ভালোবাসা ও স্নেহ রসে সিক্ত শৈশবের বিস্ময়, বাল্যকালের কৌতুহল, যৌবনের মুগ্ধতা,  প্রাপ্ত বয়সের আবেগ। রূপকথার জগতের প্রতিটা সুতোয় লেগে আছে অফুরান ভালো লাগা, অপার বিস্ময়। এর বৈভব আমাদের দরিদ্র হতে দেয় না।

রূপকথার গল্পে মানুষ ছাড়াও আছে রাক্ষস-খোক্কস, সোনার পাখি, শুক- সারী, পক্ষীরাজ,  ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর কথা।  লোককথায় রূপক হয়ে আসে  চরিত্ররা। তাদের আচার, আচরণ, কার্যকলাপে প্রকাশ পায় সমগ্র জাতির ঐতিহ্য, ইতিহাস, সামাজিক জীবন। বঙ্গদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার বিশ শতকের গোড়ার দিকে যুবক বয়সে পল্লী গ্রামে ঘুরে অগ্রজদের মুখ নিঃসৃত গল্প শুনে ফোনোগ্রাফের মোম রেকর্ডে তাদের লিপিবদ্ধ করেন। গল্পগুলি ১৯০৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে কলকাতার কিছু পত্রিকায় ছাপা হয়। এরপর দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে যোগাযোগ ঘটায় ওনারই  উদ্যোগে বিখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভট্টাচার্য অ্যান্ড সন্স থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় “ঠাকুরমার ঝুলি"। সন্ধ্যেবেলা স্নেহময়ী ঠাকুরমা মুখ নিঃসৃত গল্প স্থান পেলো এই গ্রন্থে। অপরদিকে ১৯০৯ সালে প্রকাশিত “ঠাকুরদাদার ঝুলি” র ভূমিকায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার লেখেন,

“ঠাকুরমার ঝুলি’র সহিত সঙ্গতি রাখার নিমিত্ত এবং ‘গীতকথা'র সুর অনেকাংশেই পুরুষকন্ঠের বলিয়া,  কথাসাহিত্য বাঙ্গালার উপন্যাসের - ‘বঙ্গোপন্যাস- ঠাকুরদাদার ঝুলি ‘ নামকরণ। "

শ্রদ্ধেয় সংগ্রাহকের  কিছু  লেখা "স্বদেশের দিদিমা কোম্পানী ঠাকুরমার ঝুলি" এবং  বঙ্গোপন্যাস “ঠাকুরদাদার ঝুলি” ভরিয়ে রেখেছে তাদের বৈচিত্র্যে। এসেছে সোনার পাখি, ময়ূর,  মানিক- হংস,বেঙ্গমা বেঙ্গমীর কথা। সংস্কৃত বিহঙ্গম বিহঙ্গমী থেকে ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমী শব্দের উৎপত্তি। গ্রন্থগুলির   সংগৃহীত কাহিনীগুলিতে স্বল্প পরিসরে এদের আর্বিভাব। রাজ্য থেকে রাজপুত্র, কোটাল পুত্র কিংবা সওদাগরেরা দূর দেশে যাত্রাকালে গভীর অরণ্যে ভিতর প্রবেশ করতেই   সাক্ষাৎ হয় এই বিহঙ্গ দ্বয়ের সাথে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের অঙ্কিত  চিত্রানুযায়ী এদের মুখাবয়ব মানুষের মতো, গাল ভর্তি দাড়ি অপরদিকে দৈহিক  গঠনে তারা ডানাযুক্ত সাধারণ পাখীর মতোই। এই বৈপরীত্য পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব প্রকাশিত তাদের আদলে। এমনকি শাবক ব্যঙ্গমার মুখাবয়বও একই রকম। এই চরিত্রগুলির মানসিক পরিণতি, অভিজ্ঞতা,  জ্ঞান বোঝাতেই হয়তো এমনভাবে তাদের প্রকাশ করা হয়েছে। গ্রামীন জীবনে পরিবারের প্রধান, বয়োজ্যেষ্ঠ, অভিভাবক স্হানীয় মানুষ যারা তাদের মূল্যবান উপদেশের মাধ্যমে কনিষ্ঠদের সঠিক পথ দেখায়, গল্পগুলিতে ব্যঙ্গমা বেঙ্গমী খানিকটা তেমনভাবেই এসেছে।

এবার আসি পক্ষী ও মানব চরিত্রের মেলবন্ধন প্রসঙ্গে। মহাকাব্য থেকে পুরাণে বারংবার এসেছে ভিন্ন পাখীর প্রসঙ্গ। জটায়ু, গরুড়, পেঁচা, কাক, পায়রা, সারস নিজ নিজ ভূমিকায় অবতীর্ণ। এদের কারও গড়ন সম্পূর্ণ পাখীর মতো, কেউ বা মানুষ ও পাখীর মিলিত রূপ। যদি শারীরিক গঠনে পক্ষী এবং মানব এই দ্বৈত সত্তার  বিশ্লেষণে যাই, তবে বলা যেতে পারে এরা পাখী হলেও আচরণে উপকারী মানুষের মতো। প্রতিকূলতায় মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, বিপদমুক্ত করেছে মানুষকে।  তবে আচরণগত দিক ছাড়াও রয়েছে অপর একটি ধারণা।  প্রাচীন সময়ে অরণ্য জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষ গাছপালা, নদ- নদী, আকাশ, সমুদ্র, পশু পাখিদের দেব দেবী জ্ঞানে পুজা করতো। টোটেম বিশ্বাসী উপজাতি সম্প্রদায়ের কাছে জাগতিক শক্তি ছিলো পূজনীয়। ভয় থেকে বিশ্বাস এবং বিবর্তনের পথ ধরে বনবাসী মানবজাতি অলৌকিক শক্তি, আত্মা, টোটেম বিশ্বাসী হয়ে পড়ে৷ এখান থেকে জীবকূলের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা তৈরি হয়, দৃঢ় হয় বন্ধন। সাঁওতাল গোষ্ঠীর পুরাণের সৃষ্টিতত্ত্বে “ মারাঙ্গবোংগা” কাকের কথা পাওয়া যায়, যিনি পৃথিবী সৃজনকালে সকল জীব সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেন। রূপকথা বা লোককথায় তাই মানব কুল এবং পক্ষীকূলের সহাবস্থান অস্বীকৃত নয়।

প্রতীকী অর্থে পাখি মুক্তি, শান্তি, উন্নতি, আশা, আনন্দ,  সাহস, নব সূচনার প্রতীক। খোলা আকাশে উড়ন্ত পাখি দেখলে মাটির মানুষও দুটো ডানার প্রত্যাশী হয়। বিহঙ্গ হয়ে মুক্তি চায়, অজানা জগতে নিমেষে পৌঁছানোর জন্য পাখির জীবন কামনা করে মানুষ।

“ঠাকুরমার ঝুলি” গ্রন্থের ভূমিকায় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার লিখছেন,

“স্বদেশের কোম্পানী একেবারে দেউলে। তাঁদের ঝুলি ঝাড়া দিলে কোন কোন স্থলে মার্টিনের এথিক্স এবং বার্কের ফরাসী বিপ্লবের নোটবই বাহির হইয়া পড়িতে পারে, কিন্তু কোথায় গেল- রাজপুত্র পাত্তরের পুত্র, কোথায় বেঙ্গমা-বেঙ্গমী, কোথায় - সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের সাত রাজার ধন মাণিক।”

মিত্র মজুমদার মহাশয় এই দুই পাখিকে স্বদেশের বলে আপন করে নেন। বাংলা লোককথায় তারা মনুষ্যসম মর্যাদা পায়। কাহিনীগুলিতে তারা স্বামী (ব্যঙ্গমা)- স্ত্রী (ব্যঙ্গমী),  সন্তান সহ গাছে বসবাস করে। অরণ্য জীবনে বৃক্ষের ডালে, কোটরে কিংবা পাহাড়ের গুহায় মানুষ, পাখি, পতঙ্গ সপরিবারে বসবাস করতো। একত্রে বসবাসের ধারণা  গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। অরণ্য জীবন হোক কিংবা পরবর্তী সামাজিক জীবন মানুষ বাস করতো একান্নবর্তী পরিবারে।   দলবদ্ধভাবে বসবাস করার প্রথা তখন থেকেই বিদ্যমান ছিল। একদিকে পরিবার প্রথা  অপরদিকে দাম্পত্যজীবন যাপনের প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে বেঙ্গমা বেঙ্গমীর মধ্য দিয়ে।

আসি “ঠাকুরমার ঝুলি”র  ‘রূপ তরাসী’ অংশের “নীল কমল আর লাল কমল “ গল্প প্রসঙ্গে। সংগ্রাহক মহাশয় লিখেছেন,

 “নূতন তরোয়াল ধার দিয়া,  দুই ভাই রাক্ষসের দেশের উদ্দেশে চলিলেন।”

বনের ভিতর পথ চলতে ক্লান্ত  রাজপুত্রদ্বয় নীলকমল-লালকমল খুব বড়ো একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় বসলো। সেই গাছে বেঙ্গমা বেঙ্গমীর বাস। রাজকুমার যুগলের কানে এলো দুই পাখীর কথোকপথন। রূপকথার জগত বিস্ময়ে ভরিয়ে আমাদের জানালো, পাখিরাও  কথা বলে। বেঙ্গমা বেঙ্গমী  হয়ে উঠলো মানুষের মতো। মুছে গেলো দুটি ভিন্ন প্রাণী জগতের সূক্ষ্ম রেখা। অজিত কুসুমের কানে এলো বেঙ্গমীর কাতর আর্তনাদ,

“আহ্, এমন দয়াল কাঁরা, দুই ফোঁটা রক্ত দিয়া আমার বাছাদের চোখ ফুটায়!”

এই কাতরতা তো সন্তানের জন্য এক মমতাময়ী মায়ের হৃদয়ের আর্তি। পাখিদের দৃষ্টি শক্তির জন্য মনুষ্য রক্তের উপর নির্ভর করতে হয়। নীলকমল-লালকমল জানায়,

“রক্ত আমরা দিতে পারি।"

দু ফোঁটা শোনিতের বিনিময়ে দৃষ্টি পেয়ে উভয়ের মধ্যে গড়ে উঠলো রক্তের সম্পর্ক।   চিরঋণী বেঙ্গমা বাচ্চারা কৃতজ্ঞতা জানাতে গাছের উপর থেকে রাজপুত্রদের কাছে উড়ে এসে উপকার করতে চাইলো। এ যেন উপকারীর উপকার শোধ করার বাসনা। রূপকথার বেঙ্গমা বেঙ্গমীরা উপকারী।   নীল কমল, লাল কমল বেঙ্গমা বাচ্চাদের পিঠে চড়ে -

“ডাঙ্গা জঙ্গল, নদ নদী, পাহাড়পর্বত- মেঘ, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য সকল ছাড়াইয়া" হু হু করে শূন্যে উড়ে চললো। মনুষ্য জাতির ভার বহনে তারা যেন প্রস্তুত। সাতদিন সাতরাত পর এক পাহাড়ের উপর  নামিয়ে দিল নীল কমল, লাল কমলকে। গহীন অরণ্য থেকে   ভিন্ন এক রাক্ষস জগতে পৌঁছাতে সাহায্য করলো বেঙ্গম বাচ্চারা। এই পাখিরা দুই জগতের সেতুবন্ধন করতে পারে। মানুষ নিজ ক্ষমতায় পৃথিবীর যে অগম পারে পৌঁছাতে সক্ষম নয়, নীল আকাশ পথে বেঙ্গমরা সেখানে তাদের পৌঁছে দেয়। আবার দেখা যায়, “অছিন অভিন্” রাক্ষসপুরী ধ্বংসের পর মৃত রাক্ষসী আয়ী বুড়ির মাথা কাপড়ে জড়িয়ে বেঙ্গমের পিঠে চড়ে  দেশের মাটিতে পা রাখে রাজপুত্ররা ।  বেঙ্গমের উড়ান যেন মানব সমাজের মঙ্গলের জন্য নির্দিষ্ট।

বঙ্গোপন্যাস “ঠাকুরদাদার ঝুলি” গ্রন্থের “শঙ্খমালা” গল্পে পুনরায় এলো ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর প্রসঙ্গ। সেখানে বেঙ্গমা বলে, “বেঙ্গমী!এই যে শঙ্খসাধু বানিজ্যে যায়, আজ শঙ্খ সাধুর ঘরে নীলমাণিক রাজার জন্ম হইবে।"

অর্থাৎ এই পাখি ভবিষ্যৎ বক্তা, ত্রিকালদর্শী। আসন্ন কালের কথা সে সহজেই বলে দিতে পারে। সান্ধ্যকালীন কথোপকথনে পুরুষ পাখি স্ত্রী পাখির কাছে মনের কথা বললেও বেঙ্গমী প্রথমে তা বিশ্বাস করেনি। এরপর বেঙ্গমা সমস্যার সমাধান বাতলে জানিয়েছে,

“ ঐ নদীর ও-পারে মাণিক হংস বলিয়া ডাক দিলেই,  সেই পাখী আসিয়া সাধুকে পিঠে করিয়া ছয় মাসের পথ প্রহরে নিয়া যাইবে, প্রহরে ফিরাইয়া আনিবে।"

বেঙ্গমার দূরদর্শীতায় মানব সমাজ উপকৃত হয়, পথ খুঁজে পায় সমস্যার। রূপকথার পক্ষী যুগল আঁধার থেকে আলোর দিশারী।

শ্রদ্ধেয় দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার সংগৃহীত “ঠাকুরমার ঝুলি”, “ঠাকুরদাদার ঝুলি” বইয়ে বেঙ্গমা বেঙ্গমীর অবস্থান সামান্য হলেও মানব ও পক্ষী এই উভয় জাতির  নির্ভরশীলতা মানবিকতা,  উপকারীতা, মানসিক বিশুদ্ধতাকে চিহ্নিত করে। এরা যেন একে অপরের পরিপূরক। অরণ্য আমাদের উপকার করেছে আজীবন, আশ্রয় দিয়েছে তার শীতলতায়। বেঙ্গমা পরিবার যেন সেই উপকারের প্রতিভূ। আবার রাজপুত্রদের সাহায্য  প্রতিদানে মানুষের অবদানের বার্তা শোনায়। রূপকথার জগত যেন প্রকৃতই ব্যঙ্গমা বেঙ্গমী ছাড়া অসম্পূর্ণ।


তথ্যসূত্র:

১) ঠাকুরমার ঝুলি - দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

২) ঠাকুরদাদার ঝুলি - দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার

৩)  লোক সংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ - পল্লব সেনগুপ্ত

৪) রূপকথার প্রসঙ্গ- বরুণ কুমার চক্রবর্তী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন