অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
“We seem to have reached the age where life stops giving us things and starts taking them away…” (from Indiana Jones and the Kingdom of the Crystal Skull, dir. Steven Spielberg, 2008)
অনুপ ঘোষালের প্রয়াণের পর জনপ্রিয় এই হলিউডি সংলাপকেই বড় বেশি করে মনে পড়ছিল। কোনও এক সময় ‘নব্বই দশক’, বা ‘নাইন্টিজ কিডস’ কথাটার খুব চল উঠেছিল। আমরা যারা নব্বই দশকের গোড়ার দিককার প্রজন্ম, হঠাৎ একসময়ে দাঁড়িয়ে, আমরা ফিরে তাকিয়ে দেখেছি– নব্বই দশক মানে আর দশ-বিশটা বছর নয় কেবল। নয় নয় করে আমরাও যে প্রত্যেকেই, খান তিরিশেক বসন্তের হিসেব পেরিয়ে এসেছি। আমাদের ছোটবেলাও অনেকদিন ফুরিয়েছে। আমরাও তাই এখন একে একে আমাদের ছোটবেলাকার আইকনেদের একেকজনকে হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছি। হারানো বিষয়টা আর আমাদের কাছে নতুন নয় এখন। আমরা এখন প্রাপ্তির পাশাপাশি হারানোতেও অভ্যস্ত বেশ।
কাজের চাপে আমরা সকলে হয়তো জানতামও না বোধহয়, অনুপ ঘোষাল তপন সিংহের ছবিতে গান গেয়েছেন। এমনকি সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতেও তিনি একটি গানে গলা মিলিয়েছেন। নজরুলগীতির নামজাদা শিল্পী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এমন সমস্ত পরিচয়কেই ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর গুপীর কণ্ঠ হয়ে ওঠার ইতিহাস। ভারতীয় তথা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে, কোনও অভিনেতা বা অভিনেত্রী অবধি নয়, স্রেফ একজন চরিত্রের চিরপরিচিত কন্ঠ হয়ে উঠবার মতো স্বীকৃতি–এমনটা বোধহয় আর কারও কপালেই কখনও জোটেনি। তাই আরও শত কৃতিত্ব থাকা সত্ত্বেও–গুপীর কন্ঠ হিসেবেই বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন অনুপ। ৭৮ বছর বয়সে গত ১৫ই ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
হয়তো কেবল প্রতিভা দিয়ে এই সাফল্য আসে না। হয়তো ভবিতব্যেরও অনেকটাই জড়িয়ে থাকে এমন কিংবদন্তী হয়ে ওঠার পিছনে। কিন্তু তারও পরবর্তীতে যে প্রভাব তাঁরা পিছনে রেখে যান, সেই রেশ কাটিয়ে উঠতে আমাদেরও সময় লাগে অনেক। অনুপ ঘোষাল বলতেই আমাদের প্রথম মনে পড়ে গুপীর গান, আর ঠিক তার পরেপরেই ‘আহা কি আনন্দ, আকাশে বাতাসে’র প্রিলিউড। সে এক অদ্ভুত মোহময় মাদকতা। ‘ছোটবেলা’র বোধহয় এর চেয়ে ভালো কোনও সংজ্ঞা হয় না। এই প্রিলিউডের সঙ্গেই আমাদের যেন মনে পড়ে যায় সেই নব্বই দশকের কলকাতা ময়দান, হয়তো বা বইমেলাও। ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য অপেক্ষা, হলুদ-কালো ট্যাক্সি, শীত-সময়ে মায়ের হাত ধরে গুপী গাইন বাঘা বাইনের কোনও স্পেশাল স্ক্রিনিং দেখতে যাওয়া। তখন যে রাস্তা পেরতে ভয় করত না কোথাও। হাত চেপে ধরে থাকতেন অন্য কেউ। আজ সেই তাঁদেরকেই বোধহয় আমাদের তরফে হাত ধরাধরি করে রাস্তা পার করাতে হয়। একে একে যে অনেকগুলো দশক পেরিয়েছে।
অনুপও গেলেন সেই শীতকালেই।
আমরা যেমন ভাবে বড় হয়েছি, মাঝের সময়ে অনুপ ঘোষাল যখন রাজনীতিতে এলেন হইচই তখনও বড় কম হয়নি। কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন শিল্পী অনুপ বোধহয় সেই রাজনীতির কোন্দলের ভিতরে হারিয়ে গিয়েছিলেন। বয়স তখনই পঁয়ষট্টির উপরে তাঁর। সেই সময় উত্তরপাড়ার বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়ে তিনি আরও এক নতুন পরিচিতি পেলেন। তাঁর গানের বিপুল প্রচারকে কাজে লাগিয়েই ভোট-বৈতরণী পার করল কেউ। কিন্তু রাজনীতি বোধহয় তাঁর পরিসর ছিল না। সেই অনুপ আড়ালেই থাকুন আজ।
সচেতন ভাবে অনুপ ঘোষালের জীবন, সত্যজিৎ-সান্নিধ্যে কেমন ভাবে তাঁর গুপী’র কণ্ঠ হয়ে ওঠা, অথবা সমতুল কোনও স্মৃতিধর্মী আলোচনায় এই প্রবন্ধের পরিসর বাড়াতে চাইছি না। কেবল অনুপের চলে যাওয়া কেমন ভাবে সত্যিই এক প্রজন্মকে প্রভাবিত করে, সেই অনুভূতিগুলিকেই এখানে ছোট ছোট করে ভাগ করে নিতে চেষ্টা করছি। কিছুদিন আগেই পার্ক স্ট্রিট গিয়েছিলাম। আগে যেখানে মিউজিক ওয়ার্ল্ডের বড় দোকান ছিল, উঠে গিয়ে এখন সেখানে অন্য দোকান হয়েছে। ক্যাসেট, ডিভিডি, টেপ রেকর্ডার, সিডি ড্রাইভ এমনকি হার্ড ডিস্কের পৃথিবীকেও আমরা ক্রমশই পিছনে ফেলে আসতে শুরু করেছি। এখনকার প্রজন্মের মানুষেরা আর ভিসিআর দেখবে না। আমার খুব মনে পড়ে ছোটবেলায় সেই ম্যাগনেটিক টেপের ক্যাসেটেই আমার প্রথম শোনা গুপী-বাঘার গান। ভিডিও ক্যাসেটের মাধ্যমেই বাড়িতে দেখা গুপী গাইন বাঘা বাইনের সিনেমা। সত্যজিৎ রায়, অনুপ ঘোষাল, রবি ঘোষ, অথবা তপেন চট্টোপাধ্যায়। সোনার কেল্লার মন্দার বোস, কামু মুখোপাধ্যায় বিদায় নিলেন যখন, তখনও বয়স অতটা বাড়েনি। তারপর ২০১০এ গেলেন তপেন চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতের সিনেমার মুখ হয়ে উঠেছিলেন এঁরা একেকজন; আর ’২০র কোভিডের পর থেকেই হঠাৎ যেন এক অনন্ত নীরবতা।
তখনই যেন মৃত্যুকে আরও ভালো করে টের পেতে শিখেছি। একে একে গেলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সস্ত্রীক শঙ্খ ঘোষ। মৃত্যুই যে আদত সত্য, সর্বশক্তিমান– আমরা তা টের পেতে শুরু করলাম। এবারে বিদায় নিলেন অনুপ ঘোষাল। চরণদাসের কণ্ঠ অমর পাল আগেই গিয়েছিলেন। গুপীর কন্ঠেও নীরবতা নামল। অন্ধকার।
মৃত্যুতেই জীবনের শেষ নয়। একথাও সত্যি, একটা সময় পেরিয়ে আমরা অনেকেই যখন ক্রমশ ‘বড়’ হয়ে উঠতে চেষ্টা করি–হয়তো বা কেউ কেউ নিজেদের ভিতরকার শৈশবটাকেও ক্রমশ হারিয়ে ফেলি হঠাৎ। হয়তো বা হারিয়ে ফেলতে চাই। শৈশব হারানোতেই যেন বা আমাদের একেকজনের ‘বড়’ হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা। সেই তাদের চিত্তে অনুপ ঘোষালের মৃত্যু কতখানি দাগ কাটবে জানি না। কিন্তু আবার আমাদেরই মতো অনেকেরই হয়তো আজ, নৈঃশব্দে মনে হচ্ছে কোথাও যেন এক অসীম শূন্যতাবোধ। আমাদের মনে হচ্ছে, এখনও যে যুদ্ধবিধ্বস্ত প্যালেস্তাইন, অথবা ইউক্রেন এখনও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের হানাদারিতে রক্তাক্ত। তবু যতদিন এই পৃথিবীতে যুদ্ধবিরোধী মিছিল থাকবে, যুদ্ধবিরোধী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ থাকবে –ততদিন অবধি সেই মিছিলে অনুপ ঘোষালের কন্ঠ থাকবে-উদাত্ত স্বরে সেই মিছিল-করিয়েরাই সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠবে হাল্লারাজার সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অসারতার গান। এভাবে থেকে যাওয়াটাই তো চিরকালীন!
শিল্পের কোনও জন্ম হয় না– শিল্পেরও কোনও মৃত্যু নেই – অনুপ ঘোষাল তাই গুপী’র গান হয়েই, গুপী’র স্বর হয়েই সেভাবে বেঁচে থাকবেন শিল্পের মজলিশে – অনন্তকাল।
Tags:
বিশেষ রচনা