দোঁহা

ধর্মঘট

 


সুমন সেন

“বালিজোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়। চেনো?”- চায়ের দ্বিতীয় ভাঁড়টায় শেষ চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বটুকবাবু।
“চিনি।” -আমরা সবাই প্রায় একসাথেই বললাম।
“হ্যাঁ, তো...সে’বার আমার ডিউটি পড়ল সেই স্কুলে একটা পরীক্ষার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে থাকার। ওই তোমাদের যেমন বোর্ডের পরীক্ষায় বাইরে থেকে টীচার আসে গার্ড দিতে, সেরকমই আর কি...”
বটুকবাবু কথা শেষ করার আগেই জগন্নাথ প্রশ্ন করে বসল, “আচ্ছা, আপনি কাউকে টুকলি করতে ধরেছেন কখনও?”
সহদেব মৃদু চাঁটি দিল জগন্নাথের মাথার পিছনের দিকে। ছদ্মরাগ দেখিয়ে বলল, “চুপ কর। কথা শুনতে দে।”
বটুকবাবু খানিকক্ষণ ওদের দিকে রুষ্ট হয়ে তাকিয়ে থেকে, নিজের কথা চালিয়ে গেলেন এবং জগন্নাথের প্রশ্ন সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলেন।
“তা...একদিন পরীক্ষা শেষে, স্কুলের সমস্ত কাজকর্ম সেরে বাড়ির পথে ফিরছি। স্কুল থেকে হেঁটে এলাম বালি ষ্টেশনে। এসেই শুনি এক মহা-সমস্যার কথা! কোথায় ট্রেন-লাইনে কী সমস্যা হয়েছে, যার জন্য ট্রেন বন্ধ। আশেপাশে খোঁজ নিয়ে জানলাম – প্রায় তিনঘন্টা ধরে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢোকেনি, এবং শোনা যাচ্ছে আরও কিছুক্ষণ সময় লাগবে ট্রেন চালু হতে।
এইবার একটা অ্যাডভেঞ্চারের ইচ্ছে জাগল মনে। ইচ্ছেটা যদিও অনেক আগে থেকেই মনে জমে ছিল... সুযোগটা হল তখন।
বালি ষ্টেশন থেকে উত্তরপাড়া ষ্টেশনের দূরত্ব খুবই কম। বালি ষ্টেশনের একেবারে উত্তর প্রান্তে দাঁড়ালে উত্তরপাড়া ষ্টেশন দেখতে পাওয়া যায়। এবং দুটো ষ্টেশনের মাঝে পড়ছে ‘বালি খাল’। অর্থাৎ আমি যদি রেল-লাইনের উপর দিয়ে হাঁটা শুরু করি, তাহলে উত্তরপাড়ায় পৌঁছোতে বেশি সময়ও লাগবে না, আর বালি খালের উপর দিয়ে রেলপথ ধরে হাঁটাও হয়ে যাবে – যা আমার বহুদিনের ইচ্ছে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। চলতে শুরু করলাম রেল লাইন ধরে।
বালি খালের উপর দিয়ে যখন হাঁটছি, তখন হৃদপিন্ডটা যেন বুকের বাঁদিক থেকে গলার কাছে এসে লং-জাম্প দিচ্ছে! পায়ের নিচে কাঠের স্লিপারগুলোর ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে গভীর খাল। এমন সময় হঠাৎ যদি কোনো ট্রেন চলে আসে, তাহলেই আমি শেষ। না তো সেই ব্রিজের উপর দিয়ে দৌড়ে পালাতে পারব, না তো ডানে-বাঁয়ে সরে যেতে পারব। ভয়ে বারবার পিছনে ঘুরে দেখছিলাম ট্রেন আসে নাকি।
যাইহোক, সে’যাত্রা আর তেমন কোনো বিপদে পড়লাম না। উত্তরপাড়া ষ্টেশনে এসে একটা সিমেন্টের চেয়ারে বসলাম কিছুক্ষণ। মনটা আনন্দে ভরে উঠল। বহুদিনের একটা ইচ্ছেপূরণ হল বলে কথা!
একসময় মনে হল ট্রেন কখন আসবে তা জানা দরকার। সেই উদ্দেশ্যেই কাছের টিকিট কাউন্টারে গেলাম। গিয়ে জানতে পারলাম লিলুয়াতে লাইনের কিছু সমস্যা হয়েছে, এবং ট্রেন সেখানেই আটকে আছে। আরও তিন-চার ঘন্টা পর ট্রেন চালু হবে।
সর্বনাশ! এত অপেক্ষা করতে গেলে বাড়ি পৌঁছোতে আমার রাত হয়ে যাবে! ভাবলাম-ট্রেনের জন্য আর অপেক্ষা না করে বাসে যাওয়াই ভালো হবে, ট্রেনের থেকে তাড়াতাড়িই চুঁচুড়ায় পৌঁছে যাব।
আর সাত-পাঁচ বেশী না ভেবে, স্টেশন থেকে নেমে জি.টি. রোডের উদ্দেশ্যে হাঁটা লাগালাম।
হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম – দক্ষিণের আকাশে মেঘ ঘণীভূত হচ্ছে।

যখন জি.টি. রোডে উঠলাম, তখন শুনি আরেক বিপদ! আজ বাস ধর্মঘট চলছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে জীবনে কখনও পড়িনি। ওদিকে ট্রেন চলছে না, আবার এদিকে বাসও চলছে না। এবার যাত্রীরা কীভাবে যাতায়াত করবে! মাথায় হাত দিয়ে প্রায় বসেই পড়লাম রাস্তায়। অটো-রিক্সা বা ট্যাক্সি করে যেতে যা খরচ হবে, তা আমার একমাসের হাত-খরচকেও ছাপিয়ে যায়। এ’জাতীয় অপচয়ের ঘোর বিরোধী আমি।
অতএব, নাক বরাবর হাঁটা লাগালাম উত্তর দিকে। এভাবে যতদূর যাওয়া যায় আর কি...পরে নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে!
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম – মেঘটা যেন আমার পিছু পিছুই আসছে। দূরে আবার বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে মাঝে মাঝেই।
একটা সময় বৃষ্টি নামল যতারীতি। ইতিমধ্যে রাস্তাও ফাঁকা হয়ে গেছে প্রায়। শুধু ডানদিক থেকে কয়েকটা গাড়ী হুস্‌-হাস করে বেরিয়ে যাচ্ছে তীব্র গতিতে।
ছাতা খুলে কোনোরকমে মাথাটা বাঁচানোর চেষ্টা করলাম। বৃষ্টির ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সারা শরীর। মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। আজ যেন আমার দিনটাই খারাপ!
ফাঁকা রাস্তায় একা একা পাগলের মত হেঁটেই চলেছি। গন্তব্য অনেক দূর। একবার মনে হল – ফিরে যাই ষ্টেশনে। এই দুর্যোগের হাত থেকে খানিক বাঁচাও যাবে, আর ট্রেন চালু হলে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরাও যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই আমার অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মন জেগে উঠল। সিদ্ধান্ত নিলাম – যেই পথে নেমেছি, সেখান থেকে আর ফেরা নয়। লড়াইয়ে নেমে পিছু হটা মানে কাপুরুষতা। দৃঢ় পদক্ষেপে আবার চলতে শুরু করলাম সামনের দিকে।
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। একবার মনে হল, পথে যদি একটা গল্প করার সঙ্গী পেতাম তাহলে অন্তত একঘেয়ে বিরক্তিকর ভাবটা কিছুটা হলেও কাটত।
চলতে চলতে রাস্তার পাশে হঠাৎ একটা গুমটি চায়ের দোকান দেখতে পেলাম। এই প্রবল বৃষ্টি-বাদলার দিনেও যে এরকম একটা দোকান খোলা পাব, তা একেবারেই আশা করিনি। মনটা আনন্দে ভরে উঠল। দোকানের সামনে এগিয়ে গিয়ে দুটো চায়ের অর্ডার দিলাম।
তাড়াহুড়োতে বলতে ভুলে গেছিলাম যে একটা চা শেষ হলে আরেকটা যেন দেয়। দোকানীও কোন খেয়ালে ছিল কে জানে! দুটো মাটির ভাঁড়ে চা আমার সামনে সাজিয়ে দিল। নিজের বোকামির জন্য মনে মনে নিজের উপরেই অসন্তুষ্ট হলাম। একটা ভাঁড় শেষ করতে করতে তো আরেকটা ভাঁড়ের চা জল হয়ে যাবে!
যাক! আর কী করা যাবে! একটা ভাঁড় তুলে নিয়ে সবেমাত্র চুমুক দিয়েছি, ওমনি কোত্থেকে একটা বেঁটেমত লোক এসে আমার আরেকটা চায়ের ভাঁড় তুলে নিয়ে সোঁ সোঁ আওয়াজ করে চুমুক দিতে শুরু করল। আবারও বিরক্ত হলাম। এ কী অসভত্যা! বলা নেই কওয়া নেই, কোত্থেকে উদয় হয়ে আমার জিনিসকে নিজের জিনিস মনে করে আত্মসাৎ করা – কোন ভদ্রলোকে করে এমনটা!
কট্‌মট্‌ করে ভষ্ম করা দৃষ্টিতে তাকালাম লোকটার দিকে। তবে, লোকটা আমার রাগকে আমল দিল বলে মনে হল না। নিজের মত আয়েশ করে আওয়াজ তুলতে তুলতে, যাকে বলে স্লার্প করা, ঠিক তেমনভাবে চায়ের ভাঁড় বেমালুম শেষ করে দিল।
আমি ভাবলাম, একদিকে ভালোই হয়েছে। প্রথম ভাঁড় শেষ করতে করতে দ্বিতীয় ভাঁড়ের চা ঠান্ডাই হয়ে যেত। আমি আরেকটা চায়ের অর্ডার দিলাম। এইবার দোকানী আমার মুখের দিকে এমনভাবে তাকাল, যেন সে আকাশ থেকে পড়েছে এইমাত্র!
আমি খানিক ধমক দিয়েই তাকে বললাম, ‘কী হল? দাও...’
সে থতমত খেয়ে আরেক ভাঁড় চা দিয়ে দিল। অদ্ভুত লোকজন সব!

আমি সেই ভাঁড়ে চুমুক দিতে দিতে, হঠাৎ আগমন হওয়া সেই লোকটার দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিলাম। আমার চা-টা দিব্যি আত্মসাৎ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। অনুশোচনার তো ছিঁটেফোঁটা নেই! এমন ভাব-যেন কিছুই হয়নি! চায়ের টাকা মিটিয়ে দেবারও কোনো ইচ্ছে দেখতে পেলাম না। বুঝলাম, আমাকেই টাকা মেটাতে হবে। লোকটার মাথায় বোধহয় সামান্য ছিট্‌ আছে!
দোকানীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার বলুন তো...আজ বাস ধর্মঘটের কারণ কিছু জানেন?’
‘এক বাবু গাড়ি নিয়া আইসা চা খাইয়া গেলেন, তার থেইক্যাই শুনলাম কোনো নেতা বাসের তলায় চাপা পইড়া মরসে। তার অনুগামীরাই আবার প্রতিবাদ করতে বন্ধ ডাকসে।’ -দোকানী কাজ করতে করতেই বলল।
আমি চা শেষ করে, তিন কাপের চায়ের মূল্য মিটিয়ে দিয়ে, আবার হাঁটা লাগালাম রাস্তা ধরে। বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে এসেছে তখন।

খানিক এগোতেই দেখি, চায়ের দোকানের সেই ছিটগ্রস্ত খরিদ্দাররটি আমার পিছু নিয়েছে। এবার মনে খানিক ভয়ের উদয় হল। চোর-ডাকাত নয় তো! এই বৃষ্টি-বাদলার দিনে রাস্তায় অসহায় পথিক পেয়ে সর্বস্ব হরণ করার ধান্দায় আসেনি তো এই লোক! সঙ্গে টাকা-কড়ি যদিওবা বিশেষ কিছু নেই। তবে, পিতৃপ্রদত্ত প্রাণটা তো আছে!
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দেখি, লোকটা একেবারে আমার পাশে চলে এসেছে। আমার গায়ের সাথে গা ঠেকিয়ে, আমার ছাতার তলায় নিজের মাথা গোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছে!
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল এবারে। বিরক্তিসহকারে চীৎকার করের উঠলাম, ‘কী হল বলুন তো? আপনি কে মশাই?’
লোকটা কিন্তু বত্রিশটা দাঁত বের করেই বলল, ‘আরে আরে...চটেন কেন?’
‘চটব না? তখন থেকে দেখছি পেছনে লেগেছেন! কে বলুন তো আপনি? কী চাই?’ -আমি ক্রুদ্ধস্বরেই বললাম।
‘আহা...আপনি দেখছি চট্‌ করেই রেগে যান! আমার নাম বিমল মান্না। আমি একজন সমাজসেবী।’
‘ও-ও-ও...সমাজসেবী বুঝি? তা...কীরকম সমাজসেবা করেন আপনি?’
‘খুব বড় কিছু না। ওই পথশিশুদের জন্য একটা অবৈতনিক স্কুল আছে আমাদের। সেখানে কার মধ্যে কোন প্রতিভা লুকিয়ে আছে সেটার অনুসন্ধান করে, সেটা নিয়েই জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করি আমরা। এমনকি তাদের দুবেলা খাবারেরও ব্যবস্থা করে থাকি আমরা।’
‘তা কী নাম আপনার স্কুলের?’
‘বিদ্যাপথ’

লোকটাকে প্রাথমিকভাবে দেখলে যতই ছিটগ্রস্ত মনে হোক না কেন, লোকটা একবার কথা বলা শুরু করলে কিন্তু তার কঠোর ব্যক্তিত্বই প্রকাশ পায়। যেভাবে গাম্ভীর্য নিয়ে লোকটা কথাগুলো বলল, তাতে আমার অন্তত তাই মনে হল। মনে মনে ভাবলাম- ‘বিদ্যাপথ’! সেই বিখ্যাত বিদ্যাপথ! যাকে নিয়ে একবার খবরের কাগজে বিস্তর লেখালিখি পড়েছিলাম! কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘আপনি সেই বিখ্যাত বিদ্যাপথ-এর কথা বলছেন?’
লোকটা আমার ছাতাটা আরও বেশী করে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘বিখ্যাত কিনা জানি না। তবে ওই আর কি...কিছু লোক আমাদের কাজের খুব প্রশংসা করেন। আপাতত বেলঘরিয়াতে আমাদের একটাই স্কুল আছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় আরও পাঁচটি স্কুল খোলার ব্যবস্থা চলছে। তা...মশাইয়ের নাম কী? কী করা হয়?’
খানিক চুপ থেকে বললাম, ‘আমার নাম বটকৃষ্ণ পাল। পেশায় আমি একজন স্কুলমাস্টার। চুঁচুড়ায় একটা স্কুলে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়াই। থাকিও ওখানে। বালিতে একটা স্কুলে আজ আমার ডিউটি ছিল।’
‘বাহ্‌ বাহ্‌...খুব ভালো। আচ্ছা শুনুন, আপনাকে ধন্যবাদটা জানানো হয়নি।’
‘কী ব্যাপারে বলুনতো?’
‘ওই যে চা খাওয়ালেন নিজের পয়সা খরচ করে।’
‘অ’ -বলেই হাসি পেয়ে গেল আমার। ভদ্রলোক বটে! ‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’ -বললাম।

লোকটার সাথে আমার আলাপ ভালোই জমে উঠল। একসাথে গল্প করতে করতে এগোতে থাকলাম দুজন। দুর্যোগের দিনে আমি তো এরকম একটা গল্প করার সাথীই খুঁজছিলাম। নিজের ছাতা শেয়ার করতেও আমার আর সমস্যা হচ্ছিল না তখন। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল লোকটা মহা-ফাজিল আর বাচাল। আবার মাঝে মাঝে তার কথার গভীরতা আমাকে অবাক করে দিচ্ছিল। যদি লোকটা সত্যি বলে থাকে এবং সে বিদ্যাপথ-এর কর্ণধার হয়ে থাকে, তাহলে এই গাম্ভীর্যই তার চরিত্রের সাথে শোভা পায়।
লোকটা বোধহয় আমার মনের ভাব খানিক বুঝতে পারল। হঠাৎ বলে উঠল, ‘আসলে আমি কথা কম বলতেই ভালোবাসি। তবে আপনাকে দেখে মনে হল আপনি গল্প করতে খুব ভালোবাসেন। তাই গায়ে পড়েই আপনার সাথে আলাপ জমাতে এলাম।’
লোকটা অনেক্ষণ ধরে আমার সাথে গল্প করতে করতে হেঁটেই চলেছে। কিন্তু সে কোথায় যাবে এখনও জানতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘তা ভালোই হয়েছে। কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন বললেন নাতো?’
‘এই তো সামনেই যাব।’ -বলল লোকটা।
‘তখন থেকে তো বলছেন সামনেই যাব। কিন্তু আপনার গন্তব্যটা কোথায় – সেটা জানতে পারি?’
‘চলুন না। আমার গন্তব্য এলে, আমি ঠিক চলে যাব।’
লোকটার সাথে এমনিতে খোলামেলা কথা বললেও, এই রহস্যময় ভাবটা আমায় কেমন যেন অস্বস্তিতে ফেলছিল মাঝে মাঝে। প্রসঙ্গ পাল্টে চলতে থাকলাম।

একসময় আমি লোকটাকে জানালাম – আমি তাদের প্রতিষ্ঠানে অবৈতনিক ভাবেই পড়াতে চাই, সুযোগ পেলে।
লোকটা বলল, ‘আপনি আমাদের বেলঘরিয়ার স্কুলে এসে বলবেন – আপনি আমার বন্ধু। তাহলেই আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবে ওরা।’
আমি খানিক অবাক হলাম, ‘ওরা মানে? আপনি থাকবেন না সেখানে?’
‘আমি তো সবসময় আছি। সবসময় থাকব।’ -বলল লোকটা।
আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, এই পরীক্ষাটা শেষ হলেই আমি আপনার স্কুলে যাব।’
গল্প করতে করতে কখন যে বালি থেকে রিষড়া চলে এসেছি বুঝতেও পারলাম না। এবার লোকটা আবার একটা অবাক করা কথা বলল আমায়। বলল, ‘আচ্ছা শুনুন। আপনার ট্রেন চালু হয়ে গেছে। আপনি বাঁ-দিকের রাস্তা ধরে রিষড়া ষ্টেশনে চলে যান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন চলে আসবে।’
আমি অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। লোকটা অন্তর্যামী নাকি? হাঁটছি জি.টি. রোড দিয়ে, কত দূরে ট্রেন লাইনে কোথায় ট্রেন আসছে নাকি – লোকটা বুঝল কীভাবে? ভালো করে শোনার চেষ্টা করলাম ট্রেনের হর্ণ শোনা যায় কিনা! নাহ্‌...এমনিতেও বৃষ্টি পড়ছে, তার একটা আওয়াজ তো আছেই।
ভাবনাচিন্তা করছি দেখে, লোকটা তাড়া দিল। ‘কী হল...যান। এখনই না গেলে দেরী হয়ে যাবে কিন্তু। বাঁদিকের এই রাস্তাটা ধরে নিয়ে সোজা চলে যান।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও লোকটার বলে দেওয়া রাস্তাতে পা বাড়ালাম। একমাত্র মুখের খাতিরে লোকটার অবাধ্য হতে পারলাম না।
যাবার আগে আমার ছাতাটা লোকটাকে দেবার চেষ্টা করলাম। অনেক জোড় করাতেও ছাতাটা নিল না সে। বলল তার অভ্যেস আছে। কী আর করা...গুটিগুটি পায়ে বাঁদিকের রাস্তা ধরে রিষড়া ষ্টেশনের দিকে হাঁটা লাগালাম।
ষ্টেশনের কাছাকাছি আসতেই যান্ত্রিক ঘোষনা শুনতে পেলাম, ‘ব্যান্ডেল যাবার গাড়ি তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে আসছে।’
অর্থাৎ আমি যেই ট্রেনে উঠব সেটাই! লোকটার চিন্তা কিন্তু এতক্ষণে একবারের জন্যেও মাথা থেকে হারিয়ে যায়নি। বড়ই অদ্ভুত সেই লোকটা! কীভাবে সে বলে দিতে পারল এই সময়ে ট্রেন ঢুকছে! ভাবলাম লোকটা গোটা রাস্তায় যা যা বলল, তার সত্যি-মিথ্যার কৌতুহল নিরসন তখনই হবে যখন আমি বেলঘরিয়ার বিদ্যাপথ নামক প্রতিষ্ঠানে যাব!

প্ল্যাটফর্মে উঠতে, যথা সময়ে ট্রেন এল। ট্রেনে চেপে চুঁচুড়া নেমে, বাড়ি পৌঁছোলাম।
খিদে পেয়ে গিয়েছিল খুব। ভিজে জামা-কাপড় ছেড়ে, পরিষ্কার হয়ে নিলাম। তারপর টিভি চালিয়ে খাবার বাড়তে শুরু করলাম। যা ধকল গেল আজ! খেয়ে-দেয়ে কোনোরকমে বিছানা নিতে পারলেই বাঁচি।
হঠাৎ টিভিতে একটা খবর বলতে শুরু করল। আমি আগ্রহী হয়ে টিভির সামনে এগিয়ে গেলাম। যা শুনলাম আর দেখলাম, তাতে আমার মাথাটা পুরো ঘুরে গেল।
সংবাদ পাঠিকা বলছেন, ‘আজ বিদ্যাপথ নামক অলাভজনক সংস্থার কর্ণধার শ্রী বিমল মান্নার নিধন হয়ে গিয়েছে একটা দুর্ঘটনার ফলে। আজ সকাল দশটা নাগাদ হাওড়া ময়দানের কাছে একটা বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পাশে চলতে থাকা যাত্রীদের উপর উঠে যায়। ঘটনাচক্রে বিমলবাবু সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। অন্য যাত্রীদের বাঁচাতে তিনি দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাসের চাকার তলায় চলে আসেন।’
আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, টিভিতে বিমল মান্নার একটা ছবিও দেখাচ্ছে। আর এই মুখ আমার অতি পরিচিত মুখ! ঘন্টা দেড়েক আগেও এর সাথে দেখা হয়েছে আমার! এই লোকটাই জি.টি. রোডে আমার সহযাত্রী হয়ে সাথে সাথে আসছিল!
আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। সংবাদ পাঠিকা বলে চললেন, ‘বিদ্যাপথ – পথশিশুদের জন্য একটা দৈব আস্তানা। এমন একজন সমাজসেবকের মৃত্যু সমাজের জন্য অনেক বড় একটা ক্ষতি। তাঁর অনুগামীরা আজ দুপুর থেকেই বাস চলাচলে বন্‌ধ ডেকেছে। চলে যাচ্ছি অন্য খবরে...লিলুয়াতে লাইনের গন্ডগোলে ট্রেন চলাচল সাময়িক ক্ষণের জন্য বন্ধ...’

তারমানে... সারা রাস্তা আমি যার সাথে গল্প করতে করতে এলাম সে...!
খাওয়া আমার মাথায় উঠল। কাঁপতে কাঁপতে কোনোরকমে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন