দোঁহা

মধ্যবয়েসের আঁচ রোবট-এ.আই আর সংসার

 


শুভঙ্কর দাশগুপ্ত

ভাবুন এরকম একটা সংসার আপনার, যেখানে সবাই যে যার মতো করে আছে।  মোটামুটি সুখেই আছে। আপনার একটা চাকরি আছে, ছেলেমেয়েদের স্কুল আছে। স্বামী-স্ত্রী ও নিজেস্ব জগতে ব্যস্ত। বয়েসের মধ্যগতিতে আপনার চুলে একটু পাক, মুখে উজ্জ্বল্য, শরীরে একটু ওজন আর বুদ্ধি-আরো একটু পরিণত হয়েছে। হয়তো অনেকদিন পর আপনি একটু একা। বাড়ি থেকে কাজ করছেন বা সংসারের কাজ সেরে একটু মোবাইল হাতে খুঁটিনাটি সার্ফিং। হঠাৎই ইলেট্রনিক্স স্ক্রিনে একে  অন্যকে আদর করছে দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। হয়তো সেটা নিছক এক বিজ্ঞাপন। ওদের আবেগ ঘন মুহূর্ত, শ্বাস-প্রশ্বাসের কাছাকাছি চলে আসা, ঠোঁট থেকে ঠোঁটে শুষে নেওয়া প্রেম, আপনাকে বিব্রত করে। এই অনিচ্ছাকৃত চিত্তবিক্ষেপ, যৌবন বা প্রাকযৌবনের রোমাঞ্চের থেকে আলাদা।  অথবা ব্যস্ত দিনে চান করতে করতে সরে গেছে শাওয়ারের পর্দা, আয়নার উপর গরম জলের বাষ্প মায়াময় আবেশ এনেছে। আয়নাতে নিজের নিরাবরণ শরীর দেখে নিজেই  একটু লজ্জা পেয়েছেন। শরীরে কি মেদের  সাথে সাথে মহুয়াও জমেছে? শাওয়ারের উষ্ণ জল যেন নির্লজ্জের মতো চুমু খেতে খেতে নামছে চোখের পলক থেকে পায়ের পাতায়, সব কিছু ছুঁয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছায়। নাকি একটু দুঃখ পেয়েছেন। একটা অজানা বিষন্নতা গ্রাস করেছে। সব থেকেও কি যেন নেই।

মধ্যবয়সে মানুষ যৌন্য একাকীত্বে ভোগে।  জীবনের মাঝামাঝি এসে যখন যৌবনের সূর্য তার তেজ কমিয়ে এক পরিণত আভা ছড়িয়েছে, তখনি নানা কাজে ভুলে থাকা সেই কাম "আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে" র মতো "পুরাতন হৃদয়" কে জাগিয়ে তুলেছে। কিন্তু সুখের সংসার আর দমিয়ে রাখা কাম, কে বেশি গুরুত্ব পায় তা আমরা জানি। ভাল ছেলে আর ভালো মেয়ে হয়ে থাকার সারা জীবনের তকমা আমরা বয়ে বেড়াই। তবে এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। বিয়ের পরপর বিছানা যেন বাক্স ভর্তি দেশলাই কাঠি। একটু একান্তেই তা দাবানল হয়ে ওঠে। একটা দিনের বাদ পড়া যেন হাজার আরব্য রজনী। কোথায় চলে গেলো সেই তীব্র আবেগ আর আসক্তি? কবেই বা চলে গেলো? কিভাগের যৌবনের সেই অদম্য প্রেমিক-প্রেমিকা থেকে আমরা সংরক্ষণশীল বাবা-মা হয়ে উঠলাম? সময়ের দাবি আর পরিবারের দায়ীত্ব মেনে জীবন থেকে কখন যেন বিদায় নিল "একান্ত মুহূর্তেরা"।  অথবা দিনের পর দিন জমে থাকা দাম্পত্যের অভিমান বিছানায় এসে একটা ঠান্ডা যুদ্ধে পরিণত হল। কিংবা সারাদিনের কাজ আর  কাজের চিন্তা সমস্ত ইচ্ছার উপর ক্লান্তির চাদর টেনে দিল। শরীর দুটিও বড়ো বেশি চেনা আর চেনা ভঙ্গি আর ভঙ্গিমা। এদিকে ভঙ্গি আর ভঙ্গিমা পাল্টাতে বলা শালীনতার বাইরে। সেই ভালো ছেলে আর ভালো মেয়ে সারারাত পাশ ফিরে থাকল। কিন্তু চেষ্টা করে উঠতে পারল না নতুন রং আনার। নতুন শাড়ি এল কিন্তু সৌখিন অন্তর্বাস এল না।  বিদেশী হুইস্কি এলো কিন্তু ডার্ক চকলেট এল না।  

হতাশাবাদীরা বলবে আর বিকল্পই বা কি।হস্তমৈথুন, আর সূরার নামে সোডা খাওয়া প্রায় এক। আসলে যৌনতা একটা উপলব্ধি যা এক দুটি অঙ্গে সীমাবদ্ধ নয় । তাতে কথার পিঠে কথা আছে, ছোঁয়ার আবেশে ছোঁয়া, ব্যাথার পাশে ব্যাথা আছে আর আছে সাড়া দেওয়ার ডাক। হস্তমৈথুনে সে আবেশ কোথায়। তবে অনেক সময় সেই হস্তমৈথুন আমাদের কানা মামা। কল্পনায় সবই সম্ভব, আপনি যদি তা সঠিকভাবে সাজাতে পারেন, ফ্ল্যাট বাড়ির ৪ ফুট বাই ৮ ফুটের স্নানঘরেও স্বর্গ নেমে আসে। নিজেকে ছুঁয়েই অনুভূত হয় কাংক্ষিত সঙ্গীর স্পর্শ। কে দিয়েছে দায় কল্পনাকে সে স্পর্শ আপনার জীবনসঙ্গী বা সঙ্গিনী হওয়ার। কল্পনা আনুগত্যের দায় বহন করে না। এখানে বলতে হয় পরিসংখ্যানগতভাবে কানা মামার প্রচলন আমাদের দেশের মেয়েদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম। আসলে সমাজের যৌন্য দ্বিচারিতা মেয়েদের বহুদিনই অন্য চোখে দেখতে বাধ্য করেছে ছেলেদের তুলনায়। সমাজের আর দশটা অধিকার আর অনধিকারের মতো যৌন্য ইচ্ছাও যেন ছেলেদের বাপের সম্পত্তি। অথচ স্বাস্থ্যবিদ্যা অনুযায়ী হস্তমৈথুন একটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ স্বাভাবিক, সুস্থ ও নিরাপদ যৌনক্রিয়া। সমাজের অহেতুক স্টেরিওটাইপ বহু মেয়েকেই এই যৌনসুখ থেকে বঞ্চিত করেছে। বেশ কিছু গবেষণা আর পরিসংখ্যান বলছে অনেক মেয়েরাই হস্তমৈথুনে অর্গাজম অনুভব করেছে যা তারা সঙ্গীর সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে পায় নি। বিশ্বজুড়ে নারীবাদী আন্দোলন সমাজের এই দ্বিচারিতাকে ছুড়ে ফেলে যৌন স্বাধীনতার দাবি জানায়। দুর্ভাগ্যবশত আমরা আমাদের সঙ্গীর সাথে আজও খোলাখুলিভাবে যৌনইচ্ছা নিয়ে আলোচনা করে উঠতে পারি না।

বিকল্প হিসাবে এর সাথে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠছে যৌন্য খেলনা। "ও স্কুল" নামের একটি অনলাইন যৌন্য স্বাস্থ্য প্লাটফর্ম, তাদের সাম্প্রতিক জরিপে দেখিয়েছে অন্তত ৪৮% শতাংশ আমেরিকান যাদের  বয়েস ৪৫ থেকে ৬৪ এর মধ্যে, তারা যৌন্য খেলনার সক্রিয় ক্রেতা। কামসূত্র-র জন্মদাত্রী এই মাতৃভূমিও যৌন্যখেলনার দৌড়ে পিছিয়ে নেই।  কনডমের বিজ্ঞাপন দেখে লজ্জায় মরে যাওয়া মধ্যবিত্ত এখন নেটফ্লিক্সে কিয়ারা আদবাণীর ভাইব্রেটর দৃশ্যকেও রাতের খাবারের টেবিলে হজম করে নিচ্ছে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ফোরামে বলা হচ্ছে কোভিড-১৯ এর পরবর্তী কালে ভারতে যৌন্য খেলনার বিক্রি উল্লেখজনক ভাবে বেড়েছে। আর এই বিক্রির মধ্যে বহু ক্রেতাই বিবাহিত আর মধ্যবয়স্ক।  অনেকেই এই প্রগতির কৃতিত্ব দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় খোলাখুলি যৌন্যতার আলোচনাকে। লোকে বুঝতে শিখছে, আমরা যখন আমাদের শারীরিক চাহিদাকে সামাজিক ছবি  দিয়ে ঢেকে রাখি, তা কেবলমাত্র নিজের ভিতরে বিষণ্ণতাকেই ডেকে আনে।

                                ছবি:শুভঙ্কর দাশগুপ্ত

প্রযুক্তি যুগ যুগ ধরেই কল্পনাদের উড়বার ডানা দিয়ে এসেছে। এবার যৌন আনন্দ দেওয়ার কাজে মাঠে নেমে পড়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।  সঙ্গে আছে রোবট, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি অরে অগমেন্টেড রিয়ালিটির মতো হাতিয়ার। আপনার কল্পনা শক্তি যদি সত্যি এত জোরালো না হয় ভয় নেই। জেনেরেটিভ এ.আই. আপনার সাথে মেতে উঠতে পারে প্রেমের দুষ্টু গল্পে। অভিজ্ঞ প্রেমিক বা প্রেমিকার মতো কথার মাঝে বলে উঠতে পারে অনুরাগের পংক্তি। সঙ্গীর সারা দেওয়ার যে অমোঘ টান, এত দিন ছিল অধরা, সেই অভাবই পূর্ণ করতে পারে এ.আই.। ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে আপনি তৈরী করে নিতে পারেন নিজের অবতার। তার মেদ কমে যেতে পারে, শরীরে আসতে পারে সিক্স-প্যাক। যে পোশাক পড়ার ইচ্ছা কেবল ইচ্ছা হয়েই রয়ে গেলো, আপনার অবতার সেই লাস্যময়ী পোষাক পরে প্রলুব্ধ করতে পারে না-জানা-না-চেনা কোনো অবতার সঙ্গী কে। যেমন ভিডিও গেম আর সোশ্যাল মিডিয়া একটা বড় সংখ্যক কিশোর কিশোরীদের ক্ষেত্রে ঘরের বাইরের খেলা আর মেলামেশায় বাধার কারণ হয়েছে, তেমনই এই  অতিবাস্তব এ.আই. যৌন রোবট মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক পাল্টে দেবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞরা ভাবছেন।


নিন্দুকে বলতে পারে এসবই নিজের আনন্দ আয়োজন। আত্মসুখকে স্বার্থপরতার তকমা দিতে সময় লাগে না সমাজের। এবারে আসা যাক কিছু বিবাহিত জীবনের বিকল্পের কথায়। বিবাহিত জীবনে যৌন্য একাকীত্ব আর অসন্তোষ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলাটা সবচেয়ে জরুরি স্বামী আর স্ত্রীর। আমরা সামান্য জ্বর হলে তাকে ম্যালেরিয়া ভেবে ডাক্তারের কাছে ছুটে যাই, কিন্তু এই গভীর চেপে রাখা অসুখ নিয়ে থেরাপিস্টের কাছে যেতে পা কাঁপে।  যে সমস্যা নিয়ে কথা বলা যায় না, তার চেয়ে বড় সমস্যা এ পৃথিবীতে নেই। যৌনতা কোনো স্বার্থপরতা নয় বরং এক নিঃস্বার্থ আনন্দের খেলায় মেতে ওঠা। প্রকৃতি আমাদের একের অন্যের যৌন্য পরিপূরক করে তৈরী করেছে।  কিন্তু আমরা কি সেই যোগ্য সঙ্গী হয়ে উঠতে পারছি কি? গোড়ায় গলদ আমাদের যৌন বিষয়ক অজ্ঞানতা। কিছু পর্নোগ্রাফিক সিনেমা আর অতি পাকা বন্ধুদের রসালো আলোচনা ছাড়া আমাদের জ্ঞান অতি মাত্রায় সীমিত। ভাগবত গীতা পড়ার যে প্রচার আমরা করি তার এক শতাংশও যদি আমরা ব্যয় করতাম বাৎস্যায়নের কামসূত্রে। পুরুষ আর নারীর শরীর দুটি আলাদা যন্ত্র।  যদি দুই যন্ত্রী, দুই যন্ত্রকে বোঝে তা হলে তা যুগলবন্দী তৈরী করে। নিজের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব ভুলে মেতে ওঠে সুরের খেলায়। কিন্তু একে অন্যের সঞ্চারকে ধরতে না পারলে শুধুই বিশৃঙ্খলা। তার চেয়ে লোকে বিছানায় নিস্তব্দতা আর নিঃসঙ্গতা ডেকে আনে। এদিকে নিঃস্বার্থ যুগলবন্দী এক সুর থেকে অন্য সুরে অনায়াসে বিচরণ করে। ভয় পায়না বিছানায় নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষার। চেনা মানুষকে আবিষ্কার করে অচেনা ভঙ্গিতে। আজকের যুগে অতি সাহসী দম্পতিরা অবারিত বৈবাহিক সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা মেনে নিয়েছে সৎ বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। আমরা কি আমাদের সঙ্গীর সুখের জন্য সত্যি  এতটা ভাবি? নাকি সেই ভাবনাটাও এক তরফা, সংসারের আরো দশটা ভাবনার মত? মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। তার সাথে সাথে সমাজের রীতিনীতির পরিবর্তন আসতে বাধ্য। আমরা অনায়াসে যুদ্ধে সম্মতি দি, কিন্তু আদরের স্বীকৃতি কোথায়? সময় এসেছে নতুন করে ভাবার, সংসারের জন্য যৌনতার বিসর্জন স্বার্থহীনতা না স্বার্থপরতা, সেটাই বড় প্রশ্ন। কখন আমাদের ছেলে-মেয়ে-সমাজ-সঙ্গী বুঝবে আমাদেরও অধিকার আছে একটি পরিপূর্ন জীবনের।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন