কৌশিক চক্রবর্ত্তী
মনে আছে সেই দিনটার কথা? একটু ফাঁকা পেয়ে দু পায়ের মাঝখানে জড়িয়ে সাপের মত পেঁচিয়ে সোমার বুকে অজস্র চুমু খেয়েছিল ঋষি। পড়ার ব্যাচে হৈচৈ কাণ্ড। পাস আউটের বারো বছর পর হরিশকে এ'সব কথাই বলছিল তমাল। বি এস সি ফিজিক্স ২০১১ ব্যাচ, প্রেসিডেন্সি৷ যৌনতা নিয়ে কথা বলতে কোনোদিনই কোনো ছুৎমার্গ ছুঁতে পারেনি তাদের। ছেলে মেয়ে ফ্যাক্টর নয়৷ বিষয়টা হল কে কাকে কতবার গাঁজার ঘোরে ঠোঁটে চুমু খেতে পারে তার প্রতিযোগিতাও হয়ে গেছে বার কয়েক।
আরে বাবা যৌনতা অপরাধ নাকি! খিদে পেলে তরতাজা যুবক যুবতীর স্তনমর্দন করবে এতে এতো লুকোচুরি কিসের হে?
শালা সেক্স করবি নাকি থিয়েটার দেখাবি বাল? কুকুর নাকি? ওসব হয় না৷ তুই রেখে দে তোর খিদে৷
এসব তমাল আর হরিশের কথোপকথন। আমি বেমক্কা খিস্তি দিচ্ছি ভেবে পড়াটায় লাগাম লাগিয়ে দিলেন নাকি? যদি থামিয়ে দেন, তবে বুঝবো যৌনতা আর ধর্ষণকে এক পংক্তিতে বসাতে আপনি ইতস্তত করছেন না। শুনুন, ঋষিরা বন্ধ ঘরে সোমাদের পেঁচিয়ে ধরুক আর পড়ার ব্যাচে ধরুক, যৌনতা একটা আপেক্ষিক পর্দা ঠিকই তৈরি করে। আর সেই পর্দার আড়ালে নিশ্ছিদ্র আড়ালের দাবী। আরেবাবা, চোখটা একবার আলোতেই খুলুন না৷ দেখবেন আপনি ধর্ষক নয়।
ভালো খারাপ জানিনা৷ সেইসব আলোচনা করতে যৌনতা নিয়ে কলম ধরিনি৷ কলম ধরেছি গল্প বলতে। হারেমের নাম কে না জানে। ভারতে মুঘল শাসনে হারেম এক অতিচর্চিত অধ্যায়। কিন্তু জানেন কি হারেম অবাধ যৌনতার তপোবন নয়৷ হারেম হল এমন এক অন্দরমহল যেখানে তুমুল নিরাপত্তায় নারীরা নিরাপদে অবস্থান করবেন। এমনকি সেখানে পুরুষ প্রবেশ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। তুরস্কে অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যে হারেম প্রথা ছিল। সে হারেমের নাম ছিল সেরাগ্লিয়ো। আর সে হারেমের দাসীদের ছিল সুলতানের কাছে যাবার প্রতিযোগিতা। অর্থাৎ যৌনতার লড়াই। সেই লড়াইতে সুলতানের থেকেও দাসীদের তাগিদ অনেক বেশি। এভাবে কোনো সুন্দরী যদি সুলতানের কোনো সন্তানের জননী হয়ে যেতো, তবে সে নারী তখন সুলতানের স্ত্রীর মর্যাদা পেতো। দশম অটোমান সুলতান সুলেমানের হারেমের নারী হুররম খাতুন সন্তানের জননী হয়ে স্ত্রী হয়ে যান। এভাবেই উত্থান হয় বীর আলেকজান্ডারের। ভারতীর সংস্কৃতিতে যৌনতার স্থান ঐতিহাসিক। মুঘলদের হারেম তো আজও চর্চার একটি বিষয়। পত্নী, উপপত্নী ছাড়াও বাদশার কন্যা, দাসী থেকে সম্রাজ্ঞী, সবার জন্যই ছিল আলাদা আলাদা কক্ষ। শুধু সম্রাট আকবরের সময়েই মুঘল হারেমে ছিল প্রায় ৫০০০ নারী। সম্রাটও বাঁধভাঙা। এমনকি মুঘলদের দেখাদেখি স্থানীয় নবাব শাসকরাও কম যাননি হারেম প্রস্তুতে৷ বাংলার নবাবদেরও ছিল নিজ নিজ জেনানা, যেখানে বিলাসবহুল জীবনে ভাটা পড়লে তাদের হালে পানি পাওয়া দায় হয়ে যেত।
এবার বেশ মন দিয়েই পড়ছেন তো? জানি পড়বেন। পুরনো কলকাতায় বটতলার গল্প শুনেছেন তো? অভিজাত বই বিক্রেতার তুলনায় বটতলা সাহিত্যের বাজার সে যুগেও ছিল রমরমা৷ আবার মনে মনে কি সব ভাবছেন! বটতলা মানে কামসূত্র? দেখছেন তো কতকিছু ভেবে নেন আগেভাগেই। এই হল যৌনতা নিয়ে বিকৃত সংস্কৃতির আদ্যোপান্ত রূপ৷ বলে বোঝাবার নয়। আরে বাপু, বটতলার সাহিত্য হল উনবিংশ শতাব্দীর ধীরে ধীরে বদলে যাওয়া বাঙালি সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। বটতলার ভৌগোলিক অবস্থান সম্বন্ধে সুকুমার সেন তাঁর ‘বটতলার বই’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন—
“সেকালে অর্থাৎ আজ থেকে দেড়শ বছরেরও বেশি কাল আগে শোভাবাজার কালাখানা অঞ্চলে একটা বড় বনস্পতি ছিল। সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় তখনকার পুরবাসীদের অনেক কাজ চলত। বসে বিশ্রাম নেওয়া হত। আড্ডা দেওয়া হত। গানবাজনা হত। বইয়ের পসরাও বসত। অনুমান হয় এই বই ছিল বিশ্বনাথ দেবের ছাপা, ইনিই বটতলা অঞ্চলে এবং সেকালের উত্তর কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা খুলেছিলেন, বহুকাল পর্যন্ত এই ‘বান্ধা বটতলা’ উত্তর কলকাতায় পুস্তক প্রকাশকদের ঠিকানা চালু ছিল... ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ছোট সস্তার প্রেস গড়ে ওঠে। এগুলির চৌহদ্দি ছিল দক্ষিণে বিডন স্ট্রিট ও নিমতলা ঘাট স্ট্রিট, পশ্চিমে স্ট্র্যান্ড রোড, উত্তরে শ্যামবাজার স্ট্রিট এবং পূর্বে কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট”।
কি বুঝলেন? বটতলা মানে অবাধ যৌনতা? যে যুগে বাঙালির সাহিত্যে কলম ধরেছিলেন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, কালীপ্রসন্ন সিংহরা। তাঁরা সেযুগে সবার জন্য নন। ঠিক তখনই একটা প্যারালাল লিটারেচার কলকাতায় মাতিয়ে রাখছে কম শিক্ষিত এবং আপাদমস্তক ছাপোষা বাঙ্গালীদের। ভাবুন তো! কিন্তু সময়ের গুণে সেই বটতলাই কিরকম ভাবে রূপ বদল করল দেখুন। তাই সংস্কৃতির হাল হকিকত নিয়ে যৌনতার অবস্থান সত্যিই যে কি তার বিচার করতে বসলে বাঙালি হাঁপিয়ে যাবে না তো?
এদিকে আবার আড়াইশো বছর আগে বাংলার সো কল্ড 'শেষ স্বাধীন নবাব' সিরাজউদ্দৌলার হাত থেকে নিজের মেয়ে তারা সুন্দরীকে বাঁচাতে রানী ভবানী নকল চিতা জ্বালালেন মুর্শিদাবাদের বরানগরে। অথচ তারাসুন্দরী চলে গেলেন বারানসী। অর্থাৎ শাসকদের হাত ধরে বদলে যাচ্ছিল হারেমের রূপ ও তাদের লালসাও। যদি ধরে নিই বাংলার সংস্কৃতি রক্ষা করতেই মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মতো মানুষ মিরজাফরকে সমর্থন করে সরাসরি দাঁড়িয়েছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিপরীতে, তাহলে কি খুব ভুল বিচার হবে? নাকি ইতিহাসের করিবর্গা গুলো এখনই চক্রান্ত করে ভেঙে ফেলবেন আমার মাথায়? মুর্শিদাবাদে গেলে মীরজাফরের বাড়ির দিকে তাক করে থুতু দিতে খুব ভালো লাগে, ওই কৃষ্ণনগর গিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে গালি তো কেউ দেন না? অথবা নিদেন পক্ষে মহিমাপুরে জগৎ শেঠের গদি দেখতে গিয়ে গেল গেল রব তুলে বুক তো কেউ চাপড়ান না? এসব ঐতিহাসিক দ্বিচারিতা কি বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে ধরে নেব? অথচ কি অদ্ভুত দেখুন, মুন্নি বেগম বাব্বু বেগমদের নিয়ে সংসার করা এক ধার্মিক পরোপকারী এবং অযথা যৌনতার বারবাড়ন্তে সীলমোহর দিয়ে যেখান সেখান থেকে নারী তুলে আনার বদভ্যাস না থাকা একটা সম্ভ্রান্ত বংশের পুরুষকে বাঙালি সংস্কৃতির অজুহাতে কেমন গালমন্দ খেতে হয় আড়াইশো বছর ধরে। প্রশ্ন ওঠে যৌনতা এবং সংস্কৃতি সমানুপাতিক নাকি ব্যস্তানুপাতিক? সাবালক হও বাঙালি।
বাঙালি অবশ্য সাবালক হয়েছে। সিনেমা ওয়েব সিরিজ গুলোয় বেশ অবাধে খিস্তি খেউরের প্রতিযোগিতা লেগেছে। তা হবে নাই বা কেন। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন "থ্যাটারে লোক শিক্ষে হয়"। তো লোকশিক্ষা হওয়ার এমন অতি আধুনিক উদাহরণ আর কিই বা হতে পারে? আর লোকশিক্ষা তো সংস্কৃতিরই ধারক ও বাহক। তবে এতো গেল গেল রব কেন? মিড জেনারেশন ক্রাইসিসে ভুগছে না তো একটা জাতি? তা বলে মেট্রো রেলে মাস্টারবেট করলে তাকে ক্যালাতে ভুলবেন না মোটেই। ইস্! আরে আমার দেখুন কাণ্ড৷ লিখতে লিখতে কলমটাও কেমন ক্যাওড়া হয়ে গেছে। আপনাদের মত এলিট পাঠকদের সন্তুষ্ট করতে যৌনতাকে যে মোড়কে দেখাতে হবে, তা কি আমি পারছি? কি জানি!
হঠাৎ মনে পড়ল, সোমা আর ঋষি যেন কিভাবে পেঁচিয়েছিল? সাপের মত। আচ্ছা ১২ বছর পরে দেখা হয়ে হরিশ ও তমালের তাদের দুই সহপাঠীর সেই অশ্লীল জড়িয়ে ধরার মুহূর্তটাই প্রথম মনে পড়লো কেন বলতে পারেন? এখন তো তারা দিব্য চায়ের পেয়ালায় চুমুক মারছে। মুঘল সাম্রাজ্য, বটতলা সাহিত্য, সিরাজউদ্দৌলা সব পেরিয়ে এখন তারা ডুব দিয়েছে সংসারের গল্পে। ঠিক তখনি হরিশ তমালকে সব ঘুরে ফিরে প্রশ্ন করে বসলো, "দ্বিতীয় ইস্যু কেন নিচ্ছিস না তমাল?" ধন্য হে যৌনতা! ধন্য হে বাঙালির সংস্কৃতি!
- প্রথম পাতা
- বিষয়
- _গল্প
- _কবিতা
- _প্রবন্ধ
- _ভ্রমণ
- _ফটোফিচার
- _বাংলাদেশের কলম
- _ধারাবাহিক
- _ফিল্ম রিভিউ
- _পাঠ পরিক্রমা
- Editions and Archive
- _২৫শে বৈশাখ
- _বৈশাখী সংখ্যা
- _স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা
- _প্রাক শারদ সংখ্যা
- _ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সংখ্যা
- _শারদ সংখ্যা
- _মাহশা ইরান সংখ্যা
- _দীপাবলি সংখ্যা
- _ঋত্বিক ঘটক সংখ্যা
- _শক্তি চট্টোপাধ্যায় সংখ্যা
- _শীতকালীন সংখ্যা
- _প্রথম বর্ষপূর্তি সংখ্যা
- _বইমেলা সংখ্যা
- _ভাষা দিবস সংখ্যা
- _দোলযাত্রা সংখ্যা
- _পয়লা বৈশাখ সংখ্যা
- _কার্টুন সংখ্যা
- _শারদ সংখ্যা ১৪৩০
- _বিশেষ সংখ্যা
- _রক্ত করবী সংখ্যা
- Contact Us
- Editorial Team
- About Us