মালবিকা মিত্র
গল্প করতে করতে বসার ঘরে, সশব্দে ঢেঁকুর তোলাটা কুরুচিকর, আন কালচারড। আবার তাড়িখানায় সশব্দে পশ্চাদ্দেশের বায়ু নিঃসরণ কারো ব্যাঘাত ঘটায় না। কারো কুরুচিকর মনে হয় না। মানে, আমি বলতে চাইছি, রুচি তরিকা সংস্কৃতি স্থান কাল ও শ্রেণী ভেদে পাল্টায়। ফলতঃ আমার দৃষ্টিতে, সংস্কৃতির কোনো নির্দিষ্ট মাপকাঠি বা মানদণ্ড হয়না।
সংস্কৃতি হলো জীবন যাপন পদ্ধতি। আমার কথা, আমার পোশাক, আমার বাচনভঙ্গি, আমার খাদ্যাভ্যাস, এই সবই, এমনকি আমার ব্যক্তিগত জীবন, যৌন জীবন, যৌনতা সম্পর্কে আমার ধারণা ও বিশ্বাস, সবই সংস্কৃতির অঙ্গ। কোনো যৌন কর্মীর কোঠিতে কেউ যে ভাষায় কথা বলেন, নিশ্চয়ই অফিসে সেই ভাষা বলেন না। কথা হলো, রেল লাইনের ধারে যে ঝুপড়ির সারি, সেখানে একটা মাত্র ঘরে পাঁচ জন -- বউ, ভাই, দুটি সন্তানের বাস। সেখানেই তৃতীয় সন্তান জন্ম নেয়, ভাইয়ের বিয়ে হয়, বউ আসে। যৌন জীবন, মাত্র একটি গামছা চাদর দিয়ে আড়াল করে ব্যক্তিগত পরিসর গড়ে ওঠে। সেখানে শিশু - কিশোর দের যৌন চেতনার মাপকাঠি, আর আমার ১৬০০/২০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে তিন সদস্যের বসবাস, শৈশব থেকেই শিশুর পৃথক ঘর, খেলাধুলা, পঠন, শয়ন; এই শিশুর যৌন চেতনার মানদণ্ড ভিন্নতর। যৌনতা ও সংস্কৃতির কোনো একটা নির্দিষ্ট টাইপ নির্মাণ অসম্ভব।
সংস্কৃতিকে যদি যাপন তরিকা বলে মেনে নিই, তবে যৌন জীবন সেই যাপনেরই অঙ্গ। এ প্রসঙ্গে একটা অভিজ্ঞতা বলি - আমার সহকর্মীর সন্তানের স্কুলে প্যারেন্টস কল হয়েছে। তাই সহকর্মী সেখানে হাজিরা দিয়ে, একটু দেরি করে ব্যস্ত হয়ে কর্মস্থলে ঢুকেছে। শুনলাম বাচ্চার স্কুলের প্রিন্সিপাল নাকি বলেছেন, "আপনাদের প্রাইভেট লাইফ সম্পর্কে একটু সতর্ক থাকা প্রয়োজন।" জানা গেল, বাচ্চা তার বাড়ি থেকে মায়ের স্যানেটরি ন্যাপকিন এনে স্কুলে বন্ধুদের দেখিয়েছে। শুনে তো মা বাবা খুব লজ্জিত। বাইরে এসে বাচ্চাকে প্রশ্ন করেছে, এটা কেন করেছে সে। বাচ্চা বলেছে, "ওগুলো তো কালি শোষা, টিভিতে দেখেছি। মায়ের আলমারিতে কত্তো কালি শোষা। তাই নিয়েছি, আমার ফ্রেন্ড কেও দিয়েছি আমি।" এটা হলো মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা। যাকে দেওয়া হয়েছে, সে উচ্চবিত্ত পরিবারের। সে জানে ওটা কালি শোষা নয়। সে গুগলের সৌজন্যে ও অভিভাবকের সাহচর্যে "পিরিয়ড" বিষয়টা ভাসা ভাসা জানে। আর রেল বস্তির বাচ্চাদের কাছে ওটার গোপনীয়তাই নেই। ন্যাপকিনের ব্যবহার, ব্যবহৃত ন্যাপকিন যত্রতত্র পড়ে থাকা, তার সাথে লেগে থাকা রক্ত সব দিবালোকের মতোই স্পষ্ট।
মধ্যবিত্ত রুচিতে ইনার গার্মেন্টস প্রকাশ্য স্থানে রাখা তো হয়ই না, এমনকি অন্য পোশাকের আড়ালে শুকোতে দেওয়া হয়। বাসে ট্রেনে দেখেছি কোনো ভদ্র মহিলা সহযাত্রী মহিলার ব্লাউজ টেনে ইনারের ফিতে ঢেকে দিচ্ছেন বা সচেতন করে দিচ্ছেন। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর গন্তব্য স্থানে পৌঁছে উঠে দাঁড়াতেই, পেছনের কাপড় টেনে ঠিক করে দিচ্ছেন। এসবই মধ্যবিত্ত যৌন চেতনার সাথে সম্পর্কিত। এখন আধুনিক স্কিন টাইট জিনস, ইনারের ফিতে বাইরে শো করা, মধ্যবিত্ত চিন্তা চেতনার সাথে বেখাপ্পা। কিন্তু বাজার অর্থনীতি সেকথা মানবে কেন। সে চায় স্থান কাল উৎস নির্বিশেষে ভোক্তা। অতএব অসংগতি।
একদিন রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটি ওষুধের দোকানে গিয়েছি। রাত্রি তখন সাড়ে দশটা হবে। দোকানের সামনে হাই ড্রেনের উপর দুটো ঢালাই স্ল্যাবের মাঝে একটু বেশি ফাঁক। কারো পা ঢুকে, বিশেষ ভাবে বাচ্চাদের পা ঢুকে বিপদ ঘটতে পারে। আর ওই রাত্রে দেখলাম দোকানের সামনে একটা ছয়/সাত বছর বয়সী বাচ্চা সম্পূর্ণ একাকী। আমি ফাঁকাটা দেখিয়ে সাবধান করলাম। সে জবাবে আমাকে একটি খিস্তি দিল, না বুঝেই। ফাঁক নিয়ে যা খিস্তি ওর বুদ্ধিতে আসে। দোকানি জানালো, ওর নাম মণি, মনিরুল। মা রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে সবজি বিক্রি করে। মালপত্র গুছিয়ে ফিরতে সাড়ে এগারো/বারোটা বাজবে। ততক্ষণ মণি রাস্তায় ঘুরবে। সবাই ওকে চেনে। কারো অটো মোটরবাইক ধরে দিল্লি রোড চলে যায়।
আমি আঁতকে উঠি, কি সর্বোনাশ! এখান থেকে দিল্লি রোড ২.৭৪ কিলোমিটার! দোকানদার বলল তাতে কি! ওভাবেই আবার কাউকে ধরে ও ফিরে আসবে। ও জানেনা হেন গালাগাল নেই। জীবন রহস্যের সব কথা ওর জানা। ওই বাচ্চা মা বাবার টাইম পাস সূত্র জানে। এইটুকু শিশুর মুখে ওই সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক কথা ও খিস্তি শোনার জন্য লোকে ওকে পয়সা দেয়। ও বড়দের আড্ডায় একটু একটু মদ খেতেও শিখেছে। প্রশ্ন করলাম, ওর বাবা? দোকানি বলল, ওর বাবা কেরালায় রাজমিস্ত্রির কাজ করে। নয় মাসে ছয় মাসে আসে। এবার বলুন এই শিশুর সংস্কৃতি বা যাপন তার সাথে যৌনতা বোধ ও চেতনা যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে । এটাকে আমার মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি ও যৌনতা বোধ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
আমার বাড়ির খুব কাছেই আঠারো আনা গরিব পরিবার ও তাদের বসতি সুবিস্তৃত। ও পাড়া থেকে আমাদের মধ্যবিত্ত পাড়ায় প্রাত্যহিক কাজের মানুষ সরবরাহ হয়। ও পাড়ায় আমার যাওয়া আসা একটু বেশি। কার ছেলে মেয়ে স্কুল যায় না, কেন যায় না, কে হাই প্রেশারের রুগী, ওষুধ ঠিকমতো খায় কিনা, কে টিবি রোগী, কে কুষ্ঠ রোগী, এসব খোঁজখবর আমার জানা ছিল একসময়। ওই পাড়াতেই দেখেছি বিরাট জলাশয় সাহেব পুকুর, তার চারপাশে ঘন গাছে ঘেরা। সেখানেই ওপাড়ার মানুষের প্রধান জলের উৎস। স্নান, ধোয়া, কাচা সব চলে। কম বয়সি মাঝ বয়সি মেয়েরা বুকের ওপর সায়া সেমিজ টা বেঁধে নিয়ে, এসে আগেই কাপড়টা কেচে ফেলে ও শুকাতে দেয়। তারপর একে একে সব ধোয়া কাচা মাজাঘষা সেরে, স্নান করে নেয়। ততক্ষণে কাপড়টা শুকিয়ে যায়। সেই কাপড়টাই পরে ফেরে। এ সময় এই কাঁধ খোলা পোশাকটায় ওরা বেশ সচ্ছন্দ স্বাভাবিক। কোন আড়ষ্টতা দেখিনি। বরং এদের মাঝে আমার উপস্থিতিটা মনে হয়েছে বেমানান, হংস মধ্যে বক যথা। আমি যত দ্রুত সম্ভব প্রস্থান করেছি। কিন্তু ওই পুকুরেই অন্য এক ঘাটে ওপাড়ার পুরুষেরা ছেলেরা স্নান করে। তাদের চোখে তেমন কোন আড়চোখ বা উঁকিঝুঁকি চটুলতা দেখিনি। ওদেরই মা বোন তো। প্রসঙ্গত বলি, ওই সাহেব পুকুরে ও সংলগ্ন বাগানে শীতকালে নানান অফিস থেকে কেরানি কুল সপরিবারে পিকনিক করতে আসে, দলে দলে। তাদের ভেতর বরং অনেক বেশি উশখুশ আড়চোখ এর অভিযোগ শুনেছি ওই এলাকাবাসীর কাছে।
ঘুরেফিরে সেই শ্রেণী বা বর্গের কথাই এসে পড়ে। সমাজের সর্বনিম্ন স্তরে খোলাকাঁধ, খোলাপিঠ বিসদৃশ্ নয়, সমাজ স্বীকৃত। আবার সমাজের উচ্চস্তরে সেখানেও পার্টিতে, কোন অনুষ্ঠানে, মহিলাদের ওপেন শোলডার, ব্যাকলেস একটি স্বীকৃত পোশাক। সমস্যা হয় আমার মত মধ্যবিত্তের পরিবারের সাংস্কৃতিক চেতনায়। সেখানে এগুলি কোনটাই অনুমোদিত নয় সংস্কৃতির সাথে যৌন চেতনা সমাজের উচ্চ স্তরে ও সর্বনিম্ন স্তরে অঙ্গীভূত হয়ে মিশে আছে। তাদের কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্তের সংস্কৃতিতে যৌন চেতনা বিরাজ করে জুতোর উঠে থাকা পেরেকের মত। বহাল থাকে, আবার প্রতিনিয়ত তা খোঁচা দেয়। ফলতঃ সেটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
আমি দেখেছি মধ্যবিত্ত পরিবারেও ইদানিং উচ্চ বর্গের পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, মদ্যপান, ধূমপান, অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু তা করে থাকলেও, খুব স্বাভাবিকভাবে তা বিরাজ করে না, সুসম ভাবে ব্লেন্ডেড হয়নি। বহু কাকা পিসি মামা মামি এগুলো নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা ও তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। অর্থাৎ মধ্যবিত্ত সমাজের উচ্চ বিত্তের অভ্যাসগুলি এখনও স্বাভাবিক ভাবে স্বীকৃতি পায় নি। সংস্কৃতির সাথে খাপ খায় নি, বেখাপ্পা ভাবে লগ্ন হয়ে আছে।
শুধু তো শ্রেণীর প্রশ্ন নয়। আঞ্চলিক সামাজিক প্রভাব এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক। লোক সংস্কৃতিতে খুব সহজ সরল ভাষায় যৌনতার কথা আসে অনাবিলভাবে। সেখানে খুব আড়াল আবডাল থাকে না। থাকা কাম্যও নয়।
"মেনকা মাথায় দিলো ঘোমটা
বেছে বেছে করলি জামাই তোর
ও সে, সারা জীবন ল্যাংটা রে ল্যাংটা!"
ননদ ননদাই নিয়ে কত না রসের কথা ও সুর। মা দুর্গার দুপাশে লক্ষ্মী সরস্বতীর বর্ণনা :
"আছে ডাইনে বাঁয়ে দুইডা ছেমড়ি,
পইরা আছে ঢাহাই শাড়ি,
ঘুরতে দেখছি বাড়ি বাড়ি,
ফশম (ফ্যাশন) দেখায় ভারি!"
অপবর্গের এই সরল সহজ ভাষা আমার মধ্যবিত্ত শ্রবণে সমস্যা করতে পারে, হ্যাঁ করে। মনে আছে সত্তরের দশকে, পড়ার একটি বিচিত্রানুষ্ঠানে নির্মলেন্দু চৌধুরী ধরলেন সেই সময়ের সাড়া জাগানো লোক সঙ্গীত
"আকাশে বিজলী হানা
বুক করে মোর পানাপানা
বুকের কাপড় হাওয়ায় উড়াইয়া নিলো রে।"
পাড়ার দাদারা সে গান গাইতে দেয়নি। যুক্তি, পাড়ার মা বোনের শালীনতার কথা বলা হলো। অথচ ওই জলসায় লোকাল শিল্পী গাইতে পারলো বিনা বাধায় "সামনে যা দেখি জানিনা সেকি আসল কি নকল সোনা"। এখানেই মধ্যবিত্তের সমস্যা। নিম্নবর্গ বা অপবর্গ যে স্পষ্টতা বজায় রাখে, মধ্যবিত্তকে বহু রূপক ও উপমার আশ্রয় নিতে হয়।
উল্লেখ্য, গত তিন দশকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশের আর্থিক সমৃদ্ধি এই শ্রেণীকে অর্থ কৌলীন্য দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সে তার পুরানো সাংস্কৃতিক পরিচয়ে অতৃপ্ত। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সে পরিবর্তন আনতে চাইছে। কৃত্রিম শ্রেণীর সংস্কৃতি অনিবার্য ভাবেই কৃত্রিম। এভাবে সাম্প্রতিক মধ্যবিত্ত সংস্কৃতি সাবালক স্বাভাবিক হতে গিয়ে, অপ্রয়োজনে সিনেমা, টক শোতে যৌন সম্পর্কের দৃশ্য, শরীরের প্রদর্শন, খিস্তি গালাগালি আমদানি করছে। হ্যাঁ, আমদানি। স্পষ্ট বোঝা যায়, নেপথ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনা মূল গল্পে যেটা সাসপেন্স তৈরি করেছে, দৃশ্য মাধ্যমে সেটা নেপথ্যে থাকে নি। কাঁচে ঘেরা বাথরুমে স্নান, কমোডের ব্যবহার খুব বেড়ে গেছে। কুকথা গুলি সিনেমার সাথে সম্পৃক্ত দ্রবণ না হয়ে আস্ত আস্ত ক্রিস্টাল হয়ে রস ভঙ্গ করে। লোক সংস্কৃতির সারল্য হারিয়ে, ছাড়িয়ে, রেভ পার্টি, নাইট ক্লাব, ক্যাবারে তে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। যার ফলে মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির মধ্যে যৌনতার কৃত্রিম মিশ্রণ ঘটেছে।
আমি এক আনকাট বাঙাল বাড়িতে প্রাইভেট টিউশন করতাম। বাড়ির মেয়ে ক্লাশ টু/থ্রি তে পড়তো। তার দাদাকে পড়ানোর সময় সে আমার পাশে এসে বসে খেলা খেলা পড়া করতো। একদিন দেখি সেই ৭/৮ বছর বয়সী শিশু অকথ্য খিস্তি গালাগালি পাতা ভরে লিখে রেখেছে। আর খিস্তি গালাগালি মানেই যৌনাঙ্গ ও যৌনকর্মকেন্দ্রিক। আমার মধ্যবিত্ত শালীনতা বজায় রেখে ওর মাকে বললাম, "বৌদি, বাচ্চা তো না বুঝে লিখেছে। আপনারা ওকে বকবেন না। একটু ওয়াচ করুন কোথায় কি শিখছে। আমি আপনাকে মুখে বলতে পারবো না, আপনি নিজেই দেখে নেবেন।" পরদিন তার পিসি হাসতে হাসতে আমাকে বললো, "আপনে বোঝেন নাই, ওই গুলান তো মজার মস্করা কথা। আমরা বাড়িতে হগলডি কই। বিয়া কইরা বৌদি যহন পেরথম আইছিল আমাগো এই বাড়িতে, বৌদির তো কানে আঙ্গুল, সদাই ভিরমি খাইতো।" শুনে আমার চোখ কপালে। আমরাও ষোলো আনা বাঙাল, কিন্তু এসব ভাষা কখনো শুনিনি। তার পিসির শেষ কথাটি শুনুন -- "যাই কন আপনি, এইডুক মাইয়া, লিখছে ব্যাবাকডি নির্ভুল বানান। ও যে এতো কিছু গাইল জানে, হেইয়ার লইগ্যা সাবাশ।" ভালো মন্দ না বুঝে, না ভেবে, অভ্যাসে ওরা এসব বলে। ওই বাচ্চার বাবা ভালো সরকারি চাকরি করেন, পিসি টেলিফোনে উচ্চ পদস্থ অফিসার। ওদের ভাই বোন আত্মীয় স্বজনদের আড্ডায় অবাধে চলে এসব কথা। আমার শুনলে মনে হতো কানে কেউ অ্যাসিড ঢেলে দিলো।
আমার বাড়ির লাগোয়া অন্তহীন সুবিস্তৃত ধানক্ষেত। জমিতে কাজ করতে আসা মহিলা পুরুষ মজুররা দুপুরে আমার বাড়ির ছায়ায় বসে টিফিন খায়। নানা ঠাট্টা তামাশা, রঙ্গ রসিকতা করে। সেসব শ্রবণ যোগ্য নয়, অশ্রাব্য। কোনো মহিলা আর পুরুষের মধ্যে এই ঠাট্টা অভাবনীয়। কিন্তু ব্যাস, ওইটুকু মাত্র। তাদের মধ্যে ঠাট্টা তামাশার অধিক কোনো আড়চোখ, কু ইঙ্গিত কখনো দেখিনি। অনেক বেশি স্বচ্ছতা, ফেস ভ্যালুতেই শেষ। যৌন চেতনার বিকৃতি ঘটে মধ্যবিত্ত চেতনার মাঝে। নিম্নবর্গ ও উচ্চবর্গের মধ্যবর্তী হবার ফলে তার পক্ষে সাহেব পুকুরে যাওয়া হয় না। আবার বিলাসবহুল বাথটব বা কোভালাম, গোয়ার সী বীচ হয়না, এই দুয়ের মাঝে অবিকশিত বা বিকৃতভাবে বিকশিত।
একটি মাত্র ঘর, ১০/১২ বছর বয়সী শিশু ঘুমের ভান করে চোখ বুজে শুয়ে আছে বাধ্য হয়ে। শুনতে পাচ্ছে মা বাবার শারীরিক মিলনের কথোপকথন। হয়তো বা বাবা নয়, অন্য কোনো আত্মীয় দুপুরে বাবার অনুপস্থিতির সুযোগে। শিশু দমবন্ধ করে সবটা হজম করতে বাধ্য হয়। আসলে হজম হয়না, বদহজম হয়। সুস্থ সম্পর্কের সাথে যৌনতা একাত্ম হয়না। উহ্। কি অসহায় অসহ্য যন্ত্রণা। কারও সাথে সেই অভিজ্ঞতা শেয়ার করাও যায় না। বুড়ো বুড়ি দাদু ঠাকুমার আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে এই দুঃসহ অভিজ্ঞতার সুযোগ ছিল না। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি, চৌখুপী ফ্ল্যাটে সেই আশ্রয় প্রশ্রয় থাকেনা। ফলতঃ গুটি ফেটে সুন্দর প্রজাপতি বাইরে আসেনা, গুটির মধ্যেই মরে যায়। যৌন জীবনের সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। সার্থক সংশ্লেষণ হয়না।
আমার বিশ্বাস সংস্কৃতিকে হতে হবে তার উৎসভূমিতে দৃঢ়মূল। সেই কারণে, অনুকরণ সর্বস্ব সংস্কৃতি, যা বাছ বিচার না করেই গ্রহণ করে, সেটি কৃত্রিম এবং অনিবার্যভাবেই বিসদৃশ। নির্দিষ্ট শ্রেণী, সমাজ, তার উৎসভূমি, এসব নিয়েই একটা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পায় । তাই বলে আমি বলছি না সংস্কৃতিকে সংস্কারের মত আঁকড়ে, কুণ্ডলী পাকিয়ে রাখতে হবে। গ্রহণ বর্জন চলবে, কিন্তু তা নিজের ভিত্তিভূমিকে অবলম্বন করেই। সেই ভিত্তিভূমির সাথে খাপ খাইয়ে। অন্যথায় সংস্কৃতি ও তার চেতনা, বোধ, বেখাপ্পা হতে বাধ্য। ঘর থেকে বেড়িয়ে, নিজের গাড়িতে উঠে, সোজা পার্টি অ্যাটেন্ড করায় সমস্যা নেই। আপনি যা খুশি পোশাক পরিধান করতে পারেন। আবার বস্তিবাসী তার নিজের সমাজে ছোটো বৃত্তে খুশি মতো পোশাক পরিধান করতে পারেন। সাহেব পুকুর আর সী বীচ কে মাথায় রেখে বলছি। কিন্তু ট্রেন বাস ট্যাক্সি টোটো অটো ধরতে গেলেই পটভূমি চ্যুত হতে হয়। হোঁচট খেতেই হয়। কে কোথায় মানানসই মধ্যবিত্তের সেটা অনুধাবন করা জরুরি।
কথাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক, কারণ সদ্য শেষ পুজোর ফ্যাশন প্রসঙ্গে ও সদ্য শুরু শীতের ফ্যাশন প্রসঙ্গে পত্রিকায় পড়লাম, ফিটিংস, লুক, আন কভার, এইসব শব্দের প্রাধান্য। কোথাও কমফোর্ট বা আরাম প্রাধান্য পায় না। অথচ চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয়েছে dress should be comfortable and loosen as possible. কারণ নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে সাথে আমাদের শরীরের প্রসারণ সংকোচন হয়। টাইট ফিটিংস পোশাকে সে কাজ ব্যাহত হয়।
সমস্ত ফ্যাশন ডিজাইনের প্রধান লক্ষ্য, শরীরকে যতটা সম্ভব ফুটিয়ে তোলা, খোলামেলা অথবা ঢাকা চাপা, সে যেমনই হোক। প্রশ্ন হল, সমস্ত সাজার ক্ষেত্রেই তো একজন বিশেষ উদ্দিষ্ট থাকে, কাকে উদ্দেশ্য করে আমি সাজলাম। টু হুম ইট মে কনসার্ন। সমস্যা হল আপনি যখন কোন বিশেষ সজ্জায়, পাবলিক বাসে, ট্যাক্সিতে, অটোতে, টোটোতে বেরোলেন ; তখন উদ্দিষ্ট আর বিশেষ থাকে না, বারোয়ারি হয়ে যায়। বারোয়ারি প্রাঙ্গণে কোথায় যে আপনি হোঁচট খাবেন, সেটাই সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। ভাবুন শীতের ফ্যাশনের পোশাকে বলা হচ্ছে, আপার হবে লঙ কার্ডিগান, ডিজাইন যেমনই হোক। অথচ লোয়ার থাকবে ওপেন। লোয়ার ওপেন থাকলে লুকটা নাকি ভালো হয়। ঠান্ডা আটকানো বড় কথা নয়, আরামটাও এখানে প্রশ্ন নয়। বিবেচ্য হল কেমন দেখাবে। আর ঠিক এখানেই এসে পড়ে, কে দেখবে সেই প্রশ্নটা। কে দেখবে যখনই বারোয়ারি হবে, আপনি পদে পদে হোঁচট খাবেন। কারণ যৌন চেতনা, যৌনতা বোধ, শ্রেণী সমাজ স্থান কাল ভেদে পাল্টে যায়, তা বারোয়ারি ক্ষেত্রে বিকৃত হবেই, অতএব প্রবেশ নিষেধ।
এতক্ষণ বলার পরেও মনে হচ্ছে, ঠিক কথাটা বলা হলো না। এবার মনে পড়ল, শ্রীরামপুর রেল স্টেশনের আপ প্ল্যাটফর্মের একটা মহুয়া গাছের কথা। ওই গাছের নিচে সন্ধ্যা হলেই আড্ডা জমাতেন কবি মৃদুল দাশগুপ্ত, কবি অরুণ চক্রবর্তী প্রমুখ গন। একদিন কবি অরুণ চক্রবর্তী মহুয়া গাছটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
"হেই দ্যাখ, তু হিথাক কেনে!
তু রাঙ্গা পাথরের দ্যাশে যা,
রাঙ্গামাটির দ্যাশে যা,
হিথায় তোরে মানাইছে নাই রে,
ইক্কেবারে মানাইছে নাই রে।"
গানটা আমাদের নাগরিক সমাজে বহু চটুল বিকৃতির মাধ্যমে খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বটে। কিন্তু মোদ্দা কথাটা থেকেই যাচ্ছে --
"হিথায় তোরে মানাইছে নাই রে
ইক্কেবারে মানাইছে নাই রে।"
বোধকরি এটাই এতক্ষণ বলতে চাইছিলাম, কোথায় কোনটা মানানসই।