দোঁহা

যৌনতা ও সংস্কৃতি


মিলি ঘোষ  

সাধারণভাবে সংস্কৃতি বলতে বোঝায় মানব বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ এবং তা সামাজিক চর্চার বিষয়। যেহেতু এটি মানুষের ভাবনা ও রুচির ওপর নির্ভরশীল, তাই এটিকে কোনও নির্দিষ্ট সীমায় বেঁধে রাখা যায় না। জীবনে চলার পথে এই বৈশিষ্ট্যগুলির মুখোমুখি হওয়ার প্রয়োজন আছে। এগুলি আমাদের বাঁচতে শেখায়। জীবনকে আনন্দময় করে তোলে। অবিরত সৃষ্টির ধারাকে প্রশ্রয় দেয়। আবার সত্যকে সামনে আনে। কঠিন বাস্তবের সঙ্গে লড়তে বাধ্য করে। প্রতিবাদ করতে শেখায়। তবে সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। তার অন্যতম কারণ, মানুষের জীবন যাপনের পরিবর্তন। সময়ের ব্যবধানে মানব মনের গতি প্রকৃতি ভিন্ন হয়। আজ যা ভালো বলে মনে হয়, কাল তা নাও লাগতে পারে। অপরদিকে একজন পুরুষ ও নারী বা দু'জন পুরুষ অথবা দু'জন নারী একে অপরের সঙ্গে যৌনাঙ্গ দ্বারা যে আচরন করেন, তাই হলো যৌনতা। এই আচরনের মধ্যে প্রত্যক্ষ যৌন চাহিদা যেমন থাকে, তেমন তাদের চিন্তা, কল্পনা, মূল্যবোধ, সংযম ইত্যাদিও থাকে। যৌনতা যখন শুধুমাত্র মন-কেন্দ্রিক, তখন সেটিকে পরোক্ষ যৌন চাহিদা বলা যেতে পারে।

সংস্কৃতির কেন্দ্রে অবশ্যই ব্যক্তিগত গুণাগুণ অবস্থান করছে। কিন্তু সমাজে তার সার্বিক প্রকাশ হলো সংস্কৃতি, যা বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্য দিয়ে চলমান। অর্থাৎ বিভিন্ন রূপে সংস্কৃতি প্রতীয়মান। শিল্প, সাহিত্য, খেলাধুলা, সামাজিক রীতিনীতি এমন কি ধর্মীয় অনুষ্ঠানও সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে। আর এই জায়গাতেই সংস্কৃতির সঙ্গে যৌনতার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সংস্কৃতির রূপ ভিন্ন ভিন্ন হয়। সেগুলি প্রধানত পারিবারিক রীতিনীতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই হয়ে থাকে।

সাহিত্য ও শিল্পে যৌনতা আসে বারেবারে। সব রকম শিল্পে অবশ্যই নয়। সব সাহিত্যেও যৌনতা থাকতে পারে না। যেমন শিশু সাহিত্যে যৌনতার কোনও স্থান নেই। কিন্তু একটা নাটক বা একটা সিনেমার প্রয়োজনে যৌনতা আসতেই পারে। যৌনতা জীবনেরই অঙ্গ এবং তা স্বাভাবিক। স্বাভাবিক বলেই জীব-জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিক বলেই জীবন অগ্রগামী। যেহেতু যৌনতা বাস্তবধর্মী এবং তার মধ্যে অনেক ভালোবাসা, বহু সত্য এবং প্রচুর অপরাধ লুকিয়ে থাকে, তাই গল্প, উপন্যাস, সিনেমা, নাটকে যৌনতা আনার প্রয়োজন আছে। অপরাধের কথা তখনই আসে, যখন যৌনতা কোনও একজনের ইচ্ছা বা চাহিদার ওপর অবস্থান করে। একজন লেখক বা একজন চিত্র-পরিচালক এ ব্যপারে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। সাহিত্য জীবন থেকেই নেওয়া। আমাদের সবার জীবনের সঙ্গে তা মেলে না। কিন্তু মানব কুলের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা কারোর না কারোর সুখ দুঃখ যন্ত্রণার ছবিই সাহিত্যে ফুটে ওঠে। আর সেই জায়গা থেকেই উঠে আসে সিনেমা বা নাটকের বিষয়বস্তু। এ ছাড়া ভাস্কর্যে, অঙ্কন শিল্পে যৌনতার প্রকাশ দেখা যায়। এমন কী সঙ্গীত ও নৃত্যেও যৌনতার আবেদন থাকে। কাজেই যৌনতা ও সংস্কৃতির মধ্যে বিরোধ কিছু নেই। একে সহজ ভাবে নিতে পারলে তা সমাজের পক্ষে মঙ্গল। নচেৎ, ভুল বোঝাবুঝি, ঈর্ষা, মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যা সুস্থ মানব সমাজে একেবারেই কাম্য নয়। পুরোনো ধ্যান ধারণা আঁকড়ে থেকে স্বাভাবিকতাকে মানতে না পারলে মানুষে মানুষে বিরোধিতা অনিবার্য। অথচ জীবনকে তার নিজের গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিরোধিতা নয়, সহযোগিতাই কাম্য। তবে কোনও গল্প বা সিনেমা যদি শুধুই প্রত্যক্ষ যৌনতা নির্ভর হয় এবং তার মধ্যে শিক্ষনীয় বিষয় যদি না থাকে, সে ক্ষেত্রে তা সংস্কৃতির আওতায় পড়ে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। কিন্তু এর থেকে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না। প্রশ্ন এই জন্যই থাকে, দর্শক বা পাঠকের ভাবনা, রুচি সবটাই আপেক্ষিক। তাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দাগিয়ে দেওয়া যায় না, যৌনতার মাত্রা কোন পর্যন্ত হলে তাকে সংস্কৃতি বলা যায়।

তবে যৌনতা যখন মন-কেন্দ্রিক তখন তার গতি প্রকৃতি শারীরবৃত্তীয় যৌনতার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সে ক্ষত্রে ব্যক্তির চাওয়া পাওয়া এতটাই সূক্ষ্ম, যে সমাজের চোখে তা ধরাই পড়ে না। এই ধরনের যৌনতা শিল্প, সাহিত্যে চিরকালই জনপ্রিয়। কিন্তু যে যৌনতার মধ্যে একাধিপত্য বিরাজ করে, শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে সঙ্গীর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না, সে যৌনতা অত্যাচারেই পর্যবসিত হয়। কখনও কখনও তা বিকৃত যৌনতায় পরিণত হয়। শিশুর ওপর তার মামা, কাকা বা প্রতিবেশির যৌন আক্রমণকে বিকৃত যৌনতা অবশ্যই বলা যায়। এই ধরনের ঘটনাও সাহিত্যের অঙ্গ হতে পারে। শিশুটির জীবনের লাঞ্ছনা, বঞ্চনা নিয়ে গড়ে ওঠে গল্প। কখনও তা প্রতিবাদী গল্প, কখনও শুধুই বঞ্চনার উপাখ্যান। তবে সাহিত্যে বিকৃত যৌনতার স্বীকৃতি সমাজ সহজে দেয় না। এই ধরনের সাহিত্য সমাজের মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। এক পক্ষ লেখকে সাধুবাদ জানায়। অন্য পক্ষ এটিকে সমাজের অবক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত করে নিন্দা, সমালোচনায় মুখর হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়, শিল্প সাহিত্যে সম লিঙ্গের যৌনতাকে স্থান দিলে। স্বাভাবিককে অস্বাভাবিক বলাটাই যে অস্বাভাবিক, এটা বুঝতেই এক শ্রেণির মানুষ শতাব্দী পার করে দেয়। তবে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও যা মানুষ মন খুলে বলতে সাহস পায়নি, আজ তা'ই নিয়েই নিজেদের অধিকারের দাবিতে সরব হচ্ছে। একে আধুনিকতার জোয়ার বলা যায় না। এ হলো সত্যের দাবি। সংখ্যায় কম হলেই তাকে অস্বাভাবিক দাগিয়ে দেওয়ার মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। কিন্তু এক শ্রেণির মানুষ এখনও সম-লিঙ্গের বা উভয় লিঙ্গের মানুষের অধিকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এবং তারা দলে যথেষ্ট ভারি। তাহলে সমাজের চোখে হেয়, বিপন্ন, নিরপরাধ মানুষদের পাশে দাঁড়াবে কারা ? সেই সব মানুষেরাই দাঁড়াবেন, যাঁরা সাহসী, যাঁরা প্রতিবাদী, যাঁরা ন্যায়ের পক্ষে তাঁরাই। কখনও তাঁরা রাস্তায় নামবেন, কখনও কলম ধরবেন, কখনও বা অভিনয় করে মঞ্চ কাঁপাবেন। কাজেই যৌনতা ও সংস্কৃতি কেউ কারোর শত্রু নয়। বরং বলা যায় এরা পরস্পরের বন্ধু। একে অপরের পরিপূরক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন