ঋষভ চট্টোপাধ্যায়
ক্লাসে আফ্রা বেনের 'রোভার' নাটকটি পড়াচ্ছিলাম। সামনে উনিশ কুড়ির ছেলেমেয়ে। নাটকের নাম ভূমিকায় থাকা উইলমোর নেশার ঘোরে বন্ধুর প্রেমিকাকে চিনতে না পেরে ধর্ষণ করতে যায়। এই জায়গাটা পড়ানোর সময় কয়েকজন ছাত্রছাত্রী বলে, "স্যার, ও তো স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না। তাহলে কী ওকে ঠিক রেপিস্ট বলা যায়?"
বুঝতে পারলেন কী হল ? এই মন্তব্যটার পেছনের গতিপথ যদি একটু ট্রেস করেন কতকগুলি জিনিস ধরা পড়বে। প্রথমত, ওই কয়েকটি ছাত্রছাত্রী এবং তাদের মতো লক্ষ লক্ষ ওই বয়েসের ছেলেমেয়েরা ধর্ষণের আইনসম্মত সংজ্ঞাটাই জানে না। দ্বিতীয়ত, কনসেন্ট বা সম্মতি বলতে কী বোঝায় এবং কী কী রকমভাবে তার লঙ্ঘন হতে পারে, তা নিয়েও তাদের বুনিয়াদি ধারণা কম। সবচেয়ে মারাত্মক যেটা সেটা হল এটা যে, মদ্যপ অবস্থায় নারী নির্যাতন চালানো পুরুষকে যে সমাজ ক্ষমার চোখে দেখে সেই বিষাক্ত ধারণা, সমাজ ইতিমধ্যেই তাদের কুড়ি পেরোনো মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
যে কলেজের ঘটনা বললাম, সেই কলেজে যোগ দেওয়ার আগে ইন্টারভিউতে প্রিন্সিপাল আমাকে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন। সেটা যৌনতা ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গে খুবই জরুরি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে প্রখ্যাত নাট্যকার মহেশ দত্তানীর একটি নাটক অন্তর্গত আছে। সেই নাটকের ভাবনাগত জায়গায় রয়েছে এক সমকামী ভাই। প্রিন্সিপাল আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, "যে ছাত্রছাত্রীরা সমকাম কী তাই জানেনা বা জানলেও যাদের মধ্যে সমকাম নিয়ে সমাজের শেখানো ভ্রান্ত ধারণা গেঁড়ে বসে আছে, তাদেরকে সমকাম নিয়ে সঠিক ধারণা তুমি দেবে কিভাবে?"
এই দুটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে আমি যেটা বোঝাতে চাইলাম, সেটা এটাই যে, স্কুল পর্যায় থেকে যৌনশিক্ষা না থাকলে ভবিষ্যতে কী পরিমান বিপদের সামনে পরতে হতে পারে যে কোনো প্রজন্মকে | সম্প্রতি "OMG ২" ছবিটিতে দেখানো হয়েছে যে কিভাবে হাইস্কুলের একটি কিশোরের মনে তার লিঙ্গ নিয়ে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ধারণা তৈরী হয় এবং তাঁর ফলস্বরূপ পৌরুষের হীনমন্যতায় সে আত্মহত্যা করতে যায়। এরকম ঘটনা ভারতীয় সমাজে নিয়মিতভাবে ঘটে চলেছে, তা খবরের কাগজ খুললেই জানতে পারা যায়।
যৌন শিক্ষা না থাকার সমস্যার তালিকা দীর্ঘ। এই প্রবন্ধে আমি যে বিষয়টার উপরে ফোকাস রাখবো সেটা হল এটা যে, নারীবিদ্বেষ ও লিঙ্গ বিভাজনের সঙ্গে যৌন শিক্ষার সম্পর্ক। আমরা প্রায়শই খেয়াল করতে ভুলে যাই যেটা, সেটা হল আমরা কিশোর কিশোরীদের যে শিক্ষাই দিই বা না দিই কেন, একটা বিশেষ বিদ্যালয় সকলের অলক্ষে, নীরবে তাকে শিক্ষা দিয়ে চলেছে। সেই বিদ্যালয়ের নাম সমাজ। সমাজ একই ক্লাসের সহপাঠীদের মধ্যেই ছেলে আর মেয়েদের ক্লাসে আলাদা জায়গায় বসতে বলে। ব্যাস ! ছাত্র আর ছাত্রী দুজনেই শিখে যায় ছেলে আর মেয়েরা কখনো সমান হতে পারেনা, মিলতে পারেনা। পিতা সন্তানকে বলেন মা'কে সম্মান করতে অথচ নিজেই তিনি স্ত্রীকে অসম্মান করেন। পুত্রসন্তান শিখে যায় প্রেমিকা বা স্ত্রীর সাথে কি রকম ব্যবহার করতে হয়। স্ত্রী সেই অপমান বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক অংশ হিসাবে গ্রহণ করেন, আর কন্যাসন্তান শিখে যায় নিজের প্রেমিক বা স্বামীর থেকে কী ব্যবহার পেলে সে বিনা প্রশ্নে সহ্য করে নেবে। পিতৃতন্ত্র শেখানোর কোনো নির্দিষ্ট বিল্ডিং নেই, কারণ আমাদের আশেপাশের সমাজের পরিকাঠামোর রন্ধ্রে রন্ধ্রেই তা লুকিয়ে আছে। সেই অদৃশ্য ভাইরাস চোখ মুখ নাক দিয়ে অবিরত ঢুকে চলেছে কিশোর কিশোরীদের শরীরে। আমরা তাদের যৌনশিক্ষা দিই বা না দিই, পিতৃতন্ত্র তাদেরকে লিঙ্গ বিভাজনের শিক্ষা, নারীবিদ্বেষের শিক্ষা, সম্মতিকে পায়ে মাড়িয়ে যাওয়ার শিক্ষা একদিনও ছুটি না নিয়ে দিয়ে চলেছে।
এই জায়গায় এসে একটা কথা বলা জরুরি। অনেকেই বলতে পারেন যে, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য, নারীবিদ্বেষের ভাইরাস থেকে বাঁচানোর জন্য যৌনশিক্ষার প্রয়োজন কোথায়? তার জন্য পিতৃতন্ত্রের খতরনাক দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করলেই তো চলে। বাস্তবতা আসলে উল্টো। যৌনশিক্ষা ছাড়া নারীবিদ্বেষ বলুন বা লিঙ্গভেদ কোনোটাকেই দূর করা সম্ভবই না। যৌনশিক্ষা-হীন শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্লাসরুমে ছেলে আর মেয়েদের আলাদা বসানোই একদিন তার মনে এই বীজ গেঁথে দেয় যে যৌনতার প্রসঙ্গে পুরুষটি হচ্ছে সক্রিয় কর্তা আর নারীটি হচ্ছে নিষ্ক্রিয় গ্রহণকারী। সে তখন যৌনতাকে দুটি মানুষের করা কর্ম হিসেবেই ভাবে না; তার কাছে নারীশরীর তখন যৌনকর্ম সম্পাদনের জমি। সমাজে যদি পুরুষ নারী সমান না হয়, বিছানাতেই বা হবে কেন? যৌনশিক্ষার অভাব এভাবেই সামাজিক লিঙ্গ বিভাজনকে যৌনতাগত বিভাজনে পরিণত করে। আর এভাবেই একদিকে সামাজিক আরেকদিকে যৌনতা দুইক্ষেত্রেই লিঙ্গভেদ আর নারীবিদ্বেষ তরতর করে বাড়তে থাকে।
একজন কিশোর উঠতি বয়েস থেকেই নারীকে একটা ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে, তাঁকে শুধুমাত্র যৌনবস্তু হিসেবে দেখছে কারণ সে মনে করে যৌনতা এমন একটা জিনিস যেটা মেয়েটার কাছে আছে, আর সেটা হরণ করে নিলে সে নিজেই চরম সুখ পাবে। সে যদি জানতো যে যৌনতা যে কোনো মানুষের জন্যই অতি স্বাভাবিক একটা প্রবৃত্তি, সে যদি বুঝতো যে সম্মতিক্রমে হওয়া যৌনতার ইচ্ছা ও প্রয়োজন ছেলেদের মতোই মেয়েদেরও সমান প্রমানে আছে, তাহলে সে মেয়েটিকে ' তিজোরি ' আর নিজেকে ডাকাতরাজ ভেবে অশেষ প্রশস্তি পেত না। সে যদি এই শিক্ষা পেত যে সম্মতি বলতে ঠিক কী বোঝায় এবং সম্মতির বিষয়টি দুটি মানুষের মধ্যে কিভাবে কাজ করে, তাহলে সে বুঝতো সুস্থ যৌনতা আর ধর্ষণের মধ্যে ফারাকটা কোথায়।
যে কিশোর বা কিশোরী শ্লীলতাহানি কী এবং তাঁর প্রকারভেদ কী কী রকম হতে পারে, সে নিজের অজান্তে এই কাজে লিপ্ত হতে পারে অথবা নিজে এর শিকার হলেও সে যে আক্রান্ত তা বুঝতে ব্যর্থ হতে পারে। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে বিপদের আশঙ্কা কোথায় সকলেরই জানা। প্রথমটির ক্ষেত্রে যেটা আমরা খেয়াল করিনা সেটাই একটু বলা দরকার। বালক ও কিশোর বয়েসেই অনেকেই অনেক ধরণের কাজে লিপ্ত হয়, যা অনায়াসে যৌন অত্যাচারের পর্যায়ে পড়ে যায়। এদিকে সেই কাজগুলো যে ভুল এবং কেন ভুল সেটা বলে দেওয়ার কেউ নেই। ফলতঃ, মনের মধ্যে এই কাজগুলি একটা ন্যায়সঙ্গত লাইসেন্স পেয়ে যায়। সেই ভাবনার উপর ভিত্তি করে শিশু বা কিশোরটি বড় হয়, আর তার মনের মধ্যে বড়ো হয় একটি ন্যায়সম্মত যৌন অপরাধের ধারণা।
এই রকমভাবে ভাবলে বুঝতে পারা যায় যে কোনো লিঙ্গভিত্তিক অপরাধের সঙ্গে যৌনতার সম্পর্কের থেকে অনেক গভীর সম্পর্ক আসলে ক্ষমতার। ১৯৭০- ৮০'র দশকে উঠে আসা রাডিক্যাল ফেমিনিস্টরা এইজন্যই ধর্ষণকে (এবং অন্যান্য লিঙ্গভিত্তিক অপরাধকে ) যৌন অপরাধের থেকেও বেশি ক্ষমতাকেন্দ্রিক অপরাধ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। একদিকে পিতৃতন্ত্রের ক্রমাগত ট্রেনিং আর অন্যদিকে যৌন শিক্ষার অভাব পুরুষদের কাছে নারীদের দ্বিতীয় স্তরের নাগরিক বলে প্রতিভাত করে তোলে। অর্থাৎ যৌনশিক্ষার অভাব পুরুষকে বোঝায় যে নারীশরীরের উপরের যথেচ্ছ অধিকার তার লিঙ্গপরিচয়গত অধিকার। এটা হবেই কারণ সে কোনোদিন যৌনতাকে স্বাভাবিক জিনিস হিসেবে নেয়ই নি। তার কাছে যৌনতা ক্ষমতা প্রদর্শনের অস্ত্র মাত্র। যৌনশিক্ষা থাকলে তাকে কিশোর বয়েসেই বোঝানো যেত যে নারীবিদ্বেষ আর লিঙ্গ বিভাজনের কতগুলো শিকড় প্রোথিত রয়েছে যৌনতার ভ্রান্ত ধারণায়।
যৌনতাকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করা খুবই জরুরি। ক্ষমতার অনিয়ন্ত্রিত বাজারে অসংজ্ঞায়িত যে কোনো কিছুই ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে। এই ক্ষমতার কীট চিন্তায় মিশে মস্তিষ্কে পৌঁছে যাওয়া আটকাতে হলে যৌনশিক্ষার মতো কীটনাশকের দ্রুত প্রয়োগ প্রয়োজন।
