শোভন ভট্টাচার্য
বিংশ শতাব্দীর জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায় এসে এক বাঙালি কবি লিখলেন ‘প্রতিটি লোক যৌনভাবে সৎ’। কিন্তু কোন মানুষটি যৌনভাবে ঠিক কতখানি সৎ, বোঝা যায়, তাঁর যৌনতা বিষয়ক শিক্ষা-রুচি-সংস্কার যখন যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হবার চেয়েও কোনও সংবেদনশীল পরীক্ষার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। আসলে এমন একটা সময়ে আমরা বাস করছি যখন আমাদের সন্তানকে যৌনতার সদর্থক রূপটি বুঝিয়ে দেওয়া একজন দায়িত্বশীল অভিভাবকের পক্ষে একান্তই আবশ্যক। সুতরাং একজন অভিভাবকের সর্বপ্রথম কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যৌনতার স্বরূপ সম্পর্কে নিজে সম্যক অবহিত হওয়া। যারা শুধুই পর্নোগ্রাফিক তথা ‘পণ্যগ্রাফিক’ দৃষ্টিতে যৌনতাকে দ্যাখেন, তাঁদের কাছেও যেমন এ একটা দুঃস্বপ্নসম পরীক্ষা, তেমনই যারা আবার ‘পাপের ঝাঁপি’ হিসেবে যৌনতাকে দ্যাখেন, তাঁদের পক্ষেও এই পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া বেশ কঠিন।
আমরা কি শুনিনি ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে ‘মাল’ বলে সম্বোধন করা হয়ে থাকে কখনও কখনও, কোথাও কোথাও? সেখানে আবার ‘মাল’-এর আগে ‘খাসা’ ‘ডাসা’ ‘চামকি’ ‘ঝিঙ্কু’ ‘ডবকা’ ‘সেক্সি’ জাতীয় বিশেষণের চকিত ব্যবহার সেই ‘মাল’কে যে সাক্ষাৎ সেক্সটয়েরই জান্তব প্রতিমূর্তি রূপে প্রকাশ করতে চায়, তা তো আমাদের কারওরই অজানা নয়। এই যে ভোগ্যপণ্যের চোখে বিপরীত লিঙ্গের মানুষকে দ্যাখার সংস্কৃতি, সেখান থেকেই জন্ম নেয় একেকজন ছদ্মবেশী ধর্ষক, যাদের মধ্যে অনেকেই সাহস এবং সুযোগের অভাবে চরিত্রবান বলে পরিচিত হন সমাজে। কিন্তু যখন তাঁরা অভিভাবক? স্বামী? তখন কি তাঁরা চান নিজের ছেলে তেমনই কোনও ছুপা-ধর্ষক হয়ে উঠুক, মেয়েবউ হোক ধর্ষিতা? না, তিনি অবশ্যই তা চান না, তাই তিনি নিজের ছেলেমেয়েবউকে সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখেন, পারলে তাদের পিছনে গোয়েন্দা লেলিয়ে দেন। মেয়েবউকে বাড়ি থেকে বেরোতেই দিতে চান না কিংবা আপাদমস্তক মুড়িয়ে প্রিয় পোষ্যের মতো সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে বেরোন। এমনটাই দেখে এসেছি আমাদের কমবয়স পর্যন্ত।
এখন আবার সেই ছবিটা ঘুরে গেছে একশোআশি ডিগ্রি। টেলিভিশনের ডান্স-ধামাকায় কিংবা পাড়ার বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’ বা ‘শীলা কি জাওয়ানি’-র সঙ্গে নাচার জন্য নিতান্ত মধ্যবিত্ত বাড়ির বাপ-মা আজকাল গর্বিতচিত্তে ছেলেমেয়েকে মাচায় তুলে দিচ্ছে। মেয়ে সিনেমার নায়িকা হবে বলে মা তাঁর অতিস্বল্পবাস পরিহিতা মেয়েকে প্রোডিউসারের ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসছেন। এই যে সংস্কৃতি, এও একটা নিখুঁত বিবর্তনেরই অব্যর্থ ফলাফল। একদিন যারা কৈশোর-যৌবনে নিজেরাই মেয়েদের ‘মাল’ বলতে শিখেছে, তার সন্ততীই যদি আজ বিনোদন-পেশার আড়ালে যৌনদাসী হতে এগিয়ে যায়, বলার কিছু থাকে কি? একদিন যে মনের অত্যন্ত গোপন কোনও স্নানাগারে নিজেকে যথার্থই ধর্ষকমনস্ক করে তুলেছে, আজ তারই সন্তান যদি ধর্ষক হয়ে ধরা পড়ে ফাঁসি যায়, তাকে দোষারোপ করা কি তার বাপের মুখে মানায়?
অথচ আমরা তো এও জানি যে এই পৃথিবীতে যত ফুল ফোটে, যত পাখি গায়, যত সুরের তরঙ্গ ওঠে আকাশে, যত কাব্য ধ্বনিত হয় বাতাসে, সবেরই পিছনে এক উর্জাবতী শক্তি হিসেবে কাজ করে যৌনতা। তাহলে তা পাপই বা হতে পারে কীভাবে আর পণ্যই বা হতে পারে কীভাবে? যদি আমরা যৌনতার প্রজননের দিকটা ছেড়ে শুধু তার লীলাপ্রসঙ্গেই ভাবি, তাহলেও তা এমন এক উচ্চতায় চলে যেতে পারে যখন যোগিয়া রাগের বুকের ভেতরেও ফুটে উঠতে দেখা যায় হর-পার্বতীর লিঙ্গযোনি। কথাটা হেয়ালি বলে মনে হতে পারে, কিন্তু কেউ যদি গোটা রাত জেগে ভোরের প্রথম প্রহরে রাগ যোগিয়ায় বাঁধা ‘পিয়া মিলন কি আস্’ ঠুমরিটা ভীমসেন যোশীর কন্ঠে শুনে ফেলেন দৈবাৎ, তাহলে তিনি এর প্রাসঙ্গিকতা অবশ্যই অনুভব করতে পারবেন। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার যে আমাদের প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রে, সহজিয়া বৈষ্ণব পরকীয়া সাধনে, আউল-বাউল-ফকিরি দেহতত্ত্বে, যৌনতা একটা মূল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। ‘বৈজ্ঞানিক’ বলছি এই কারণে যে এই পথগুলি প্রবৃত্তিকে এড়িয়ে নিবৃত্তির কথা বলেনি। বরং প্রবৃত্তির ভিতর দিয়ে গিয়ে, তাকে অতিক্রম করেই নিবৃত্তির পথের বিশ্বাসযোগ্য দিশা দেখিয়েছে।
আচ্ছা, আমরা কি ভেবে দেখেছি যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন মন্দিরগাত্রে মিথুনমূর্তির উপস্থিতি ঠিক কোন বার্তা বহন করে? যদিও, অনেক ভেবেও তার কোনও কূলকিনারা পাওয়া মুশকিল, কেননা নানা মুনির নানা মত। কিন্তু একটা ব্যাপারে একমত না হয়ে উপায় নেই যে প্রাচীন ভারতবর্ষ যৌনতাকে এক অতি উচ্চস্তরীয় শিল্প এবং সাধনার অংশ হিসেবে বুঝতে পেরেছিল। তা না হলে মহর্ষি বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’-কে শাস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হল কেন! তার পাতা কিঞ্চিৎ ওল্টালে বোঝা যায় কাম যথার্থই কলাবিশেষ। আমাদের মহাকবি কালিদাস যে শুধু ‘শৃঙ্গারতিলক’, ‘শৃঙ্গাররসাষ্টক’ নামক কাব্য রচনা করেছিলেন তা তো নয়, বরং তাঁর সমগ্র কাব্যেই আদিরস, সৌন্দর্যের প্রধান পরাকাষ্ঠা হয়ে দ্যাখা দিয়েছে। এমনকি কুমারসম্ভব কাব্যের অষ্টম সর্গে হরপার্বতীর সম্ভোগ-শৃঙ্গারের যে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে, প্রাচীনপন্থী গবেষকগণ তার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ পর্যন্ত এনেছিলেন। তা সত্ত্বেও কালিদাসের কাব্যগুণ সমগ্র পৃথিবীর সাহিত্যেই অনন্য। তাঁর সৌন্দর্যচেতনায় দীক্ষিত হতে পারলে আজ হয়তো আমাদের পাশ্চাত্যের আমদানিকৃত জান্তব পর্নোটোপিয়ায় আক্রান্ত হতে হতো না।
আজ মনে হয়— আমরা যদি সুন্দর চোখে সত্যকে দেখতে পারি তাহলে যেমন পাপ-পুণ্যের অবকাশ থাকে না, তেমনই পর্নো তথা পণ্যের কৃত্রিম চাহিদাও স্তিমিত হয়ে আসে। আমরা যদি ধারণা করতে পারি যে এই সমগ্র জগৎ আকাশ-মাটির মিথুন-মূর্তি রূপে প্রকাশিত, যদি ভাবতে পারি শিব আর শক্তি অর্থাৎ সগুণ আর নির্গুণ, মিলিত হয়েই এই ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব সম্ভব করেছে, তাহলে কি আর আমাদের পক্ষে যৌনতাকে বাঁকা-চোখে দ্যাখা সম্ভব?
যৌনতা বিষয়ক সংস্কারসমূহ কোনও জাতির হাজার হাজার বছরের শিকড়ে জড়ানো। আমরা যদি আমাদের শাস্ত্র পুরাণ মহাকাব্যসমূহের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব আমাদের একান্তই ভারতবর্ষীয় কিছু যৌনতা বিষয়ক সংস্কার ও সংস্কৃতি প্রাচীনকাল থেকেই সগৌরবে বিদ্যমান। এমনকি ঋগ্বৈদিক গায়ত্রীমন্ত্রের ‘প্রচোদয়াৎ’ শব্দের মধ্যেও ‘চোদন’ তথা ‘চোদনা’ শব্দের এক অপূর্ব মহাজাগতিক ব্যঞ্জনা প্রকাশ পেয়েছে। এখানে সর্বদেবতার মধ্যে যিনি ‘ধীমহী’ তিনি তাঁর সেই ধী আমাদের মধ্যে প্রবিষ্ঠ করছেন। কেন এর ব্যঞ্জনাকে মহাজাগতিক বলেছি, এবার আর সেটা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। বিশ্বাসযোগ্য গ্রন্থাদিতে পড়েছি যে সার্থক যৌনসঙ্গমের চূড়ান্ত মুহূর্তে না কি ওঁকারধ্বনি পর্যন্ত শুনতে পাওয়া যায়। তার সত্যতা যাচাই করা সম্ভব না হলেও আমাদের বিরাট ‘যুগল’ ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে যদি আমরা যৌনভাবে শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারি, তাহলে আমাদের পোশাক পরিচ্ছদ আমাদের চোখেই আর কখনও উৎকটভাবে উত্তেজক মনে হবে না, কারণ তার মধ্যে ঐতিহ্যগত সংস্কারের স্রোত থাকবে বহমান। মনে রাখতে হবে আমদানিকৃত যা কিছু, তা আমরা অঙ্গে ধারণ করলেও রক্তে তথা চেতনায় তাকে মিশিয়ে নিতে পারি না, তাই তাকে প্রায়শই আলগা লাগে, খেলো লাগে, সস্তা লাগে, উৎকট লাগে। অনেক মান্যগণ্য মানুষকেই দেখেছি পাশ্চাত্য সফরে যাওয়ার সময় তাঁর স্বাভাবিক শ্যামবর্ণ শরীরে অস্বাভাবিক টাইকোটবুটের আবরণ চাপিয়ে পাক্কা নেড়িকুত্তার চেহারা ধারণ করছেন, কেননা তিনি ভাবছেন লন্ডন-প্যারিস-নিউইয়র্কের বিশ্বমঞ্চে এই রাজবেশে গিয়ে দাঁড়ালে তাঁকে নির্ঘাত মনে হবে হাউন্ড, স্প্যানিয়াল কিংবা স্পিচ। নিদেনপক্ষে ‘সন অফ আ বিচ’। এও আমাদের যৌনতা বিষয়ক অপসংস্কৃতিরই একটা অঙ্গ। এইসব মাথায় রেখেই যদি আমরা আমাদের সন্তানকে যৌনতা বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার কাজে ব্রতী হই, তাহলে তা অচিরেই জাতিগঠনের মতো মহৎ একটা কাজ হয়ে উঠতে পারে।
