দোঁহা

কালের নৌকায় যৌনতা ও সংস্কৃতি


 নীলম সামন্ত 

পাকস্থলীর চাহিদা মেটানোর পর যদি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কোন চাহিদা প্রাণী সমাজে থেকে থাকে তা হল যৌনতা। পৃথিবীতে প্রাণীজগৎ টিকিয়ে রাখার উপায়, যাকে ঘিরে আমাদের নানান ট্যাবু। অথচ খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার পর অস্তিত্ব টিকিয়ে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ পৃথিবীতে নিজেদের ঝান্ডা ওড়ানোর জন্য যৌনতা ছাড়া বিকল্প কোন পন্থা নেই। তবে আধুনিক সমাজ কিংবা আরো কয়েকশো বছর আগের সমাজ যৌনতাকে ঘিরে নানান অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে বস্তুটিকে 'আই ক্যাচি' করে তুলেছে৷

ইংরেজ সামাজিক নৃবিজ্ঞানী জেডি আনউইন তাঁর 'সেক্স অ্যান্ড কালচার' বইটিতে বলেছেন, যে সমাজের বিকাশের সাথে সাথে তারা আরও যৌনভাবে উদার হয়ে ওঠে, সমাজের সামাজিক এনট্রপিকে ত্বরান্বিত করে, যার ফলে এর "সৃজনশীল" এবং "বিস্তৃত" শক্তি হ্রাস পায়। বলেছেন, একটি যুক্তিবাদী সমাজ বজায় রাখার জন্য, যৌন ড্রাইভকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত এবং আরও উৎপাদনশীল কাজের দিকে নিয়ে যাওয়া উচিত।

ভেবে দেখুন, যখন আমরা আদিম সমাজে তখন যৌনতা নিয়ে এত ধরাকাট ছিল না, বিবাহ প্রথা ছিল না। এমনকি বহুগামীতা নিয়ে বিশেষ কোনো বক্তব্য বা তত্ত্বও ছিল না। বায়োলজিক্যালি মানুষ পশুদের মতোই পলিগ্যামি আমাদের মধ্যে ট্রান্সজেন্ডার বা সমকামিতা জন্ম ইস্তকই খুব সাধারণ বা স্বাভাবিক ঘটনা। বেশ কিছু বছর পিছিয়ে গেলে দেখা যায় আমাদের দেশেই প্রথম যৌনতা নিয়ে গ্রন্থ লেখা হয়। সালটা সম্ভবত ৪০০-২০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ। যা চারপাশে ছড়িয়ে যায়৷ এছাড়াও পরবর্তী ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা একসায় নানান মন্দিরে অবাধ যৌন ভাস্কর্য৷ পুরীর কোনার্ক মন্দির থেকে শুরু করে খাজুরাহো মন্দির কিংবা অজন্তা ইলোরা সবেতেই উন্মুক্ত শরীরের বিভিন্ন যৌন প্রবৃত্তি। মূর্তির মধ্যে দেব-দেবী, যোদ্ধা, গায়ক, প্রাণী, পাখি, ইত্যাদি। কিছু কিছু মূর্তি প্রগাঢ় যৌনতাবিশিষ্ট। পশু কিংবা দুইয়ের অধিক সঙ্গী বিশিষ্ট যৌনতাও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷ সে যুগে যৌনকর্মের এই চিত্রাঙ্কনকে শুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কেননা, এর মাধ্যমে নতুন সূচনা ও নতুন জীবনের আরম্ভকে বোঝানো হতো। অনেকের মতে, এই মন্দিরগুলো ছিল প্রার্থণা ও শিক্ষার স্থল। আর ঐতিহ্যগতভাবেই যৌনতা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই এ মন্দিরগুলোতে যৌনতাকে আড়াল করার কোন চেষ্টা করা হয়নি।

অথচ, বর্তমান সংস্কৃতিতে জনসমক্ষে যৌনতা বিষয়ক আলোচনা তো অনেক দূর, যৌন শব্দটাই উচ্চারণেই মস্ত ট্যাবু। সাহিত্যে কোন যৌনাঙ্গের যেমন স্তন, যোনি শিশ্ন ইত্যাদির উল্লেখ থাকলে তাকে সাহসী সাহিত্য বলে উল্লেখ করা হয়। সমকামীদের বিকৃত ভেবে একঘরে করে দেবার অলিখিত প্রথা তো আছেই। জনসমক্ষে প্রস্রাব করা আর চুমু খাওয়া একই ধরনের অন্যায়। শালীনতা অশালীনতার ডিভাইড অ্যান্ড রুল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন সমাজের উচ্চপদস্থ সাংস্কৃতিক সংগঠন। এতে কি সত্যিই সংস্কৃতি বজায় থাকে? অপসংস্কৃতির সৃষ্টি হয় না? সমাজ মাঝে মধ্যে এটাই ভুলে যায় যৌনতা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যার শিক্ষা ও ধারণা খুব স্পষ্ট ভাবেই বাড়ন্ত শিশুর মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হয়। যেখানে যত গোপনীয়তা সেখানে ততই অপকর্ম৷ আমাদের এই ট্যাবুর কারণে কত অঘটন ঘটে যায় তার দায় সমাজ ও সমাজের উন্নয়নশীল সংস্কৃতি নেয় না৷ কারণ বন্ধ ঘরে তো যা খুশিই হতে পারে, যেখানে যৌনতা শব্দটাই জনসমক্ষে অশ্লীল উচ্চারণ৷

চলুন একবার মহাভারতে দেখে নিই তৎকালীন সংস্কৃতিতে যৌনতা ঠিক কেমন ছিল।

প্রাচীন ভারতের এই সর্ববৃহৎ গ্রন্থে রাজ্যপাঠ, রাজনীতি, অস্ত্রশিক্ষা ইত্যাদির পাশাপাশি যৌনতাকেও অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া হিসেবে দেখিয়েছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। মহাকাব্যের শুরুর দিকে দেখা যায়, একদিন পরাশর মুণী সত্যবতীর নৌকায় উঠে তাঁর অমোঘ সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে মিলন প্রার্থনা করেন। কুমারী এবং লজ্জিত সত্যবতী বলেন তাঁর কৌমার্য নষ্ট হলে সমাজ তাঁকে ত্যাগ করবে। তিনি দিনের আলোয় নদীবক্ষে মিলনেও রাজী নন। উপরন্তু তাঁর দেহে মৎসের দুর্গন্ধ। এখানে দেখা যায় সত্যবতী বুদ্ধিমতী এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। পরাশর তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন তাঁর পুত্র লাভ তাঁকে কুমারিত্ব ফিরিয়ে দেবে। তিনি চারিদিকে কুয়াশার সৃষ্টি করেন, সত্যবতীর শরীরে মৃগনাভির গন্ধ প্রদান করে মিলন অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেন। যে কারণে তিনি গন্ধবতী এবং এক যোজন দূর থেকে তার গন্ধ পাওয়া যেত বলেই যোজনগন্ধা নামে পরিচিত। পরাশর মুণির ঔরসে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান, যার গায়ের রঙ কালো এবং যমুনার দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন বলে এর নাম রাখা হয় কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন। এই পুত্রই পরে ব্যাসদেব নামে খ্যাত হন। উল্লেখ্য, পরাশর মুনির বরে সন্তানপ্রসবের পরেও সত্যবতী পুনরায় কুমারীতে রূপান্তরিত হন।

আমরা প্রত্যেকেই জানি সাহিত্যই সেই উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি যেখানে যুগের সংস্কৃতি, মানবজাতির নানান দিক ও সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। মহাভারতের এই অধ্যায় জানার পর আমার বারবারই মনে হয়েছে কাম কোন লুকনো জিনিস না৷ দুই প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির পূর্ণ ইচ্ছেতে যৌন মিলন সমাজে নিষিদ্ধ ছিল না৷ এখানে যে যার ফায়দা মেটাতে যৌন মিলন কে একটা পন্থা হিসেবে অবলম্বন করেছে৷ যা আজও করা হয় গোপন ভাবে৷ প্রকাশ্যে এলেই চরিত্রে কালো দাগ৷ আসলে মানুষ সৃষ্টির আদি থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বহুগামী, সে নারীই হোক বা পুরুষ৷ কিন্তু পরবর্তী জীবনযাত্রা যখন সমাজবদ্ধ হল, সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নানান নিয়মকানুন তৈরি করে মনোগ্যামি করা হয়েছে৷ কিন্তু তাতে কি তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ধ্বংস হয়ে যায়?

আবার দেখুন মহাভারতেই দেখানো হয়েছে শর্ত মেনে শান্তনু বিয়ে করলেন সত্যবতীকে। জন্ম হল চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য।  শান্তনুর মৃত্যুর পর চিত্রাঙ্গদ সিংহাসনে বসেন, তবে অল্পকালেই গন্ধর্বের সাথে যুদ্ধে মারা যান। এরপর বিচিত্রবীর্যের রাজ্যভিষেক হয় এবং ভীষ্ম কাশীরাজের তিন কন্যাকে স্বয়ম্বর সভা থেকে অপহরণ করেন। দুই কন্যা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে বিচিত্রবীর্যের সাথে বিয়ে দেন। বিচিত্রবীর্য দুই বধূর সঙ্গেই অমিত যৌনাচারের ফলে দুর্বল হওয়ায় যক্ষ্মা রোগে মৃত্যু ঘটে। এবং তিনিও কোন উত্তরাধিকার না রেখেই মারা যান। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সত্যবতী উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। সিংহাসন খালি। তিনি তখন তাঁর কানীন পুত্রের কথা ভীষ্ম কে জানান, ভীষ্ম বলেন ‘যে লোক কাজ করার পূর্বে ধর্ম, অর্থ, কাম এই তিনটির কথা ভাবেন তিনি বুদ্ধিমান। আপনি আপনার পুত্রকে স্মরণ করুন।’ এমতবস্থায় তিনি তাঁর প্রথম পুত্র, ব্যাসদেবকে সকলের সামনে আনেন। সত্যবতীর আদেশে ব্যাস তাঁর ভাত্রীবধূদের গর্ভে ক্ষেত্রজ পুত্র স্থাপন করেন। ব্যাসদেব ছিলেন অত্যন্ত কদাকার, অম্বিকা অম্বলিকা ত্রস্ত হয়ে অত্যন্ত বিতৃষ্ণায় ব্যাসের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। অম্বিকা চোখ বুজে মিলিত হন এবং অম্বালীকা ভয়ে পান্ডু(ফ্যাকাশে) হন। জন্ম হয় জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের(অম্বিকা) ও পান্ডুবর্ণ পুত্র পান্ডুর(অম্বালিকা)।

অতিরিক্ত যৌনাচার যে স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো না সে উল্লেখও স্পষ্ট। এই যথেচ্ছাচারের কারণে নানান যৌন রোগ দেখা যেত। মানুষ রিপুর পেছনে ছুটতে গিয়ে শরীর ভুলে যায়৷ রিপু এমনই ভয়ংকর জিনিস৷ তাই রিপুতে লাগাম টানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হওয়া উচিত৷ আবার উন্মুক্ততার বিচারে দেখুব সে যুগে সন্তান উৎপাদনের তাগিদে মানুষ বহুগামী হয়েছে৷ খুব সাবলীল ভাবেই তা ঘটত৷ যেমন পান্ডবদের জন্ম হল, ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু'র জন্ম হল৷ এই সবই তো সংস্কৃতি৷ আলো অন্ধকার। ভাবলেই পথ নইলে বিপথ।

এখন যুগের পরিবর্তন ঘটেছে৷ সংস্কৃতি ও সমাজের উন্নয়নের জন্য আজ যৌনতা নিয়ে আমাদের দেশে মস্ত ট্যাবু৷ অথচ এই বিষয়েই মানুষ কত বিকৃত৷ ভেবে দেখুন তো এই ট্যাবুটির বদলে যদি স্বাভাবিক পাঁচটা বিষয়ের মতো এই বিষয়েও শিক্ষা প্রদান হত তাতে কি সংস্কৃতি বাধাপ্রাপ্ত হত? না হত না৷ বরং রিপু নিজস্ব অধীনেই থাকত আর বিকৃতি নিয়ে অঘটনগুলো কম ঘটত৷ আজ এত উন্নত হয়েও আমরা সমকামীতাকে মানসিক রোগ ভাবি। এগুলো তো আসলেই শিক্ষার অভাব। তাই আমার বারবারই মনে হয় সংস্কৃতিকে সুস্থ রাখতে গেলে যৌনতা নিয়ে নাক উঁচু ট্যাবু তুলে দেওয়াই সুস্থ পদক্ষেপ৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন