অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
…এক দেশে এক কালে এক রাজার রাজত্ব ছিল। স্বরাষ্ট্রের চেয়ে পররাষ্ট্রের বিষয়েই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। কাজেই অধিকাংশ সময়ে তিনি স্বদেশের পরিবর্তে অন্যান্য নানা দেশে ঘুরে কূটনৈতিক দৌত্যের কাজ করে বেড়াতেন। এই প্রসঙ্গে একদিন সেই স্বদেশেরই জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরূপ সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে, সেই রাজাধিরাজের জনৈক কোতোয়াল সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করে বসেন, “কি সৌভাগ্য আমাদের। আমরা মেগাস্থিনিসের ইতিহাস পড়েছি। তাঁকে চোখে দেখিনি। কিন্তু নবযুগের এই মেগাস্থিনিসকে আমরা রক্ত-মাংসের শরীর দিয়ে অনুভব করতে পারছি!” (অরণ্যের প্রাচীন ‘অণু’গল্প সংকলন)
অণুগল্পের এই বিশেষ সংকলন শুভাশিস মাশ্চরক কখনও চোখে দেখেননি। শুভাশিস মাশ্চরক সাহিত্যিক অথবা লিটল ম্যাগাজিন কর্মী নন। কাজেই স্তাবকতার মতো ভারী শব্দ ব্যবহার তাঁর অভ্যাসে পড়ে না। কেবল পরিচিত সকলেই জানে তেল-দেওয়া বিষয়টি তাঁর একেবারেই না-পসন্দ। সেদিন দুপুরে কি কুক্ষণে জানি ভাতের হোটেলে লাঞ্চ সারতে ঢুকে ড্রাইভার গোলাপচাঁদ (ওরফে গুলাবচাঁদ) এহেন মাশ্চরক মশাইয়েরই সামনে পড়ে গিয়েছিল। তদুপরি তার সঙ্গে ছিল তারই দেশোয়ালি ভাই, ‘আপ্রেনটিস’ দশরথ সরেন।
গত জুলাইতেই গোলাপচাঁদ ওরফে গুলাবচাঁদের চাকরি পাকা হয়েছে। দশরথকে এরপরেই সে দেশ থেকে নিয়ে এসে বাবুদের ধরে-কয়ে চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। স্বভাবতই দশরথ এখনও গুলাবের ভাষায় ‘আপ্রেনটিস’, ‘পার্মিনেন্ট’ হতে এখনও তার ‘ঢের’ দেরি আছে। তবুও মাংসের ঝোল বাটিতে ঢালতে ঢালতে হাত তুলে দশরথকে আশ্বাস দেয় গুলাব। এই মাসেই প্রথম ‘পার্মিনেন্ট’ হওয়ার পর নতুন পে-স্কেলের হিসেবে মাইনে ঢুকেছে তার। গুলাব তাই ঝুরঝুরে ভাত মাখে। পাঁঠার মাংসের বাটিটাকে একটিবারে নাকের কাছে তুলে শ্বাস নেয়। গন্ধ শুঁকতে চেষ্টা করে। প্লাস্টিকের প্লেটের ওধারে অর্ধেক করে কাটা পেঁয়াজ। কাঁচালঙ্কা, নুন। গুলাব ভাত মাখে। দশরথ ভেজ থালির অর্ডার দেয়। আজকের মেনুতে আলু-করলার চচ্চড়ি, ভাতের উপরে ঢ্যাঁড়শ সেদ্ধ। আঙুলে নুন মাখিয়ে ভাত মাখে দশরথ। পাশের টেবলে বসে শুভাশিস মাশ্চরক রুইমাছ-ভাতের অর্ডার দেন।
শুভাশিস লক্ষ্য করেন খেতে খেতেই হাত পা নেড়ে দশরথ কিসব যেন বলে চলেছে। গুলাব মাথা নাড়ে আর খায়। পাঁঠার নলিটাকে চুষে হালকা করে দেয়। জিভ চাটে। দশরথ এক বাটি চাটনি আনতে বলে। শুভাশিস লক্ষ্য করেন, চাটনির দাম হাফ পনেরো, ফুল পঁচিশ। ফুল চাটনিরই অর্ডার দেয় দশরথ। এক চিমটি কোনও মতে নিয়ে বা না নিয়েই সে বাটিটাকে গুলাবের দিকে এগিয়ে দেয়। মুখে উচ্চারণ করে, “গুরু তুমিই তো শিখালে কিভাবে খারাব রাস্তায় গাড়ি বের করতে হয়।” শুভাশিস মাশ্চরক নড়েচড়ে বসেন।
“কি গোলাপ, খাওয়া হচ্ছে তো ভালো?” খাঁটি বাঙালী উচ্চারণে শুভাশিস জিজ্ঞেস করেন, “তোমার পাকাপাকি হওয়ার খবরটা পেলাম। ভালো ভালো,” মাশ্চরক রুই মাছের পেটির কাঁটা বাছেন। বড় একটা খণ্ড মুখে পুরে দেন।
ভুল করে ফেলে দশরথ। যার কল্যাণে তার এই চাকরি, সেই গোলাপ ওরফে গুলাবেরই সম্পর্কে দু’চার কথা না বলে সে থাকতে পারে না। শুভাশিসকে সে একই ‘আপিস’এর বাবু হিসেবে দেখেছে। একগাল হেসে সেই বাবুরই কথার প্রত্যুত্তরে সে দুম করে বলে ফেলে, সাতপাঁচ না ভেবেই, “আরে হাঁ বাবু, গুলাব পার্মিনেন্ট হবে না তো হবে কৌন! হামাদের গেরামে উর চেয়ে ভালো কুনো ডেরাইভার আছে! পানির ভিতর দিয়ে, খাদের ভিতর দিয়ে গাড়ি লিয়ে চলে যাবেক। আপনি ধরতে পারবেক লাই” শুভাশিস মাথা নামিয়ে চশমা আর চোখের ফাঁক দিয়ে হাস্যময় দৃষ্টিতে ‘গোলাপ’এর দিকে তাকান।
“তাই নাকি রে গোলাপ! তা হবে। আসলে কলকাতার রাস্তায় খানাখন্দের চেয়েও পথচলতি মানুষের দিকেই বেশি নজর রাখতে হয়,” শুভাশিস তুমি থেকে তুই’তে নেমে এসেছেন, “পরশু শুনলাম মেজবাবুকে নিয়ে ডালহৌসি যাবার সময় সিগনাল না দেখতে পেয়ে আরেকটু হলেই সামনের গাড়িটাকে নাকি তুই ঠুকে দিচ্ছিলি? মাথায় ঠোক্কর খেয়ে মেজবাবুর তো মাথাটা দেখলাম ফুলে আলু হয়ে আছে একেবারে। তা অবশ্য অমন একটুআধটু হয়,” শুভাশিসের গলা শান্ত। মাছের ছালটাকে তিনি পাতের বাইরে ফেলেন। গুলাব খাওয়া শেষ করে ফেলে। দেঁতো হেসে সে হাত ধুয়ে আসতে যায়। দশরথকে উপদেশ দেন মাশ্চরক সাহেব, “কাউকে তেলিয়ে তোমার চাকরি পাকা হবে, এমনটা কিন্তু মোটেও ভেবো না দশরথ সরেন। ভালো করে গাড়ি চালাও। পরিশ্রম করো। শ্রমের কোনও বিকল্প নেই। বুঝলে কিনা?” সশব্দে পিছনে চেয়ার ঠেলে শুভাশিস উঠে দাঁড়ান।
অফিসের দিকে ফিরতে ফিরতে বেয়ারা বিবেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় শুভাশিসের। বিবেক হাত কচলায়। “আজ্ঞে কাগজটা পেয়েছেন স্যার? আপনার টেবিলেই রেখে এসেছিলাম।” টুথপিকে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে শুভাশিস জবাব দেন, “পেয়েছি। যথাসময়ে তোমার ভাইপোকে আমি ইন্টারভ্যুতে ডেকে নেব। কাগজপত্র যা দেখলাম ডাক পেতে কোনও অসুবিধা হবে না। কেবল ইন্টারভ্যুতে যেন না ধ্যাড়ায়,” শুভাশিস বিবেকের উদ্দেশ্যে কৃপাদৃষ্টিতে তাকান, “মনে রেখ চাকরি কেবল নিজের যোগ্যতাতেই অর্জন করতে হয় সবসময়।” “আজ্ঞে সে তো বটেই স্যার, সে তো বটেই,” বিবেক আবারও হাত কচলায়, “স্যার ফেসবুকে আপনার গানের ভিডিওটা দেখলাম স্যার। অফিস পিকনিকের। এত সুন্দর গলা আপনার, আমরা স্যার জানতামই না কেউ!” শুভাশিস দাঁত খোঁচানো থামান। “তেল দিয়ে কোনও কাজের কাজ হয় না বিবেক। তুমি জানো আমি এসব মোটেই পছন্দ করি না।” টুথপিকটাকে রাস্তার ধারে ছুঁড়ে ফেলেন মাশ্চরক। হনহন করে তিনি অফিসের দিকে এগিয়ে যান।
অফিসে এসেই প্রথম খবরটা কানে আসে শুভাশিসের। অনেক দিন ধরেই অফিসের মার্কেটিং বিভাগে সবচেয়ে উঁচু দুটি চেয়ারে নতুন কারা গিয়ে বসবেন সেই নিয়ে বিস্তর টানাপোড়েন জারি হয়ে রয়েছে। যথাসময়ে পদদুটি খালি হলেও এখনও অধস্তন অফিসারদের প্রমোশনের বিষয়ে কোনও পাকাপাকি খবর আসেনি। শুভাশিস জানতে পারেন এর মধ্যে একটি চেয়ারে নিশ্চিত করেই বসতে চলেছেন তারিণীমোহন স্যান্যাল। নামটা শুনে তিনি এতটুকুও অবাক নন। তারিণী স্যান্যালের সম্বন্ধী সত্যস্বরূপ ঘোষ আমদানি-রফতানি ক্ষেত্রের বিরাট ব্যবসাদার। শুভাশিসদের সংস্থায় টপ-ইনভেস্টর হিসেবে তাঁর ক্ষমতা অনেক। বোর্ড মিটিংয়ে সত্য ঘোষের বক্তব্যের উপর আর কারও কথা চলে না। যদিও তিনি কথা বলেন খুব কম। কেবল হাত তুলে কারোর প্রমোশনের বিষয়ে কয়েকখানি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেই সেই ব্যক্তির প্রমোশন আটকায় এমন সাধ্য কার! কাজেই তারিণীর পদোন্নতি হবে না তো কি ওপাড়ার চন্দন শাসমলের হবে! ফুঃ! মনে মনে হাসেন শুভাশিস মাশ্চরক। কিন্তু খবরের অন্য অংশটাই তাঁকে বিব্রত করে তোলে।
কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছে অন্য চেয়ারের জন্য নাকি ডায়রেক্টর সদাশিব বনার্জি, শুভাশিস মাশ্চরক এবং বীরেন মিত্র, এই দুইজনের ভিতর কাকে শেষ অবধি বাছাই করবেন সেই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছেন না। দুইজনেরই পাল্লা নাকি এখন সমান সমান। শুভাশিস নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করেন। একটু পরেই বনার্জি সাহেবের সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান মিটিং রয়েছে তাঁর।
শুভাশিস নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করেন। এই অফিসে প্রায় ষোলো বছর ফুরিয়ে এল তাঁর। অসততা যে তিনি কখনও করেননি এমনটা নয়। কোম্পানি চালাতে গেলে অমন একটু-আধটু হিসেবের এদিক-ওদিক সবাইকেই করতে হয়। মুনাফার কথা ভাবতে গেলে অত হিসেবী হলে চলে না। ডায়রেক্টর বনার্জির কল্যাণেই এমন সব শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন শুভাশিস মাশ্চরক। তবুও হলফ করে বলতে পারেন, এতদিনের চাকরিতে কোম্পানি ভিন্ন নিজের প্রয়োজনে তাঁর এক পয়সার হিসেবেও গরমিল দেখাতে পারবে না কেউ। তবুও কি লোভ হয় না শুভাশিসের? কেবল টাকার লোভ নয়। ক্ষমতার লোভ? একটুখানি পদস্থতার আগুনে উদ্ভাসিত হয়ে, সামান্য কিছু বাহ্যিক, বাইরেকার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের লোভ? বেয়ারা বিবেকের গদগদ ভাব যদি বা আরও একটুও বৃদ্ধি পায়, দশরথের পিঠে কখনও হাত রাখলে, যদি বা সে আরও সামান্য বেশি করেই গদগদ-বিগলিত হয়ে ওঠে, সে সমস্ত পাওয়ার লোভ? মাইনে বাড়লেও কি নেহাতই দুঃখিত হবেন শুভাশিস মাশ্চরক? কলেজপড়ুয়া ছেলের মোবাইল কিনে দিতে গিয়ে এই তো গত মাসেও স্ত্রীর জমানো টাকায় হাত দিতে হয়েছে। মাইনেটা আরও একটু বাড়লে তাঁর – নেহাতই কি তাতে সুবিধা হবে না, হলফ করে সে কথা তিনি বলতে পারেন? শুভাশিসের মনে কি লোভ?
শুভাশিস মিটিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নেন। সেলস ফাইলের ব্রিফগুলি আরও ভালো করে মনের মধ্যে ঝালিয়ে নিতে থাকেন।
প্রায় আধঘণ্টা ধরে সদাশিবের চেম্বারে লালবাতি জ্বলছে। প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে শেষ অবধি অফিসঘর থেকে বেরিয়ে আসেন শুভাশিস মাশ্চরক। তাঁর মুখে হাসি লেগে রয়েছে। শেষদানেই বোধ করি তিনি ঘুঁটি মাত করে এসেছেন। এরজন্য তাঁর ভিতরে এতটুকুও অনুশোচনা নেই। তাঁর কাজের বয়ানে সাহেব খুশি বলেই না শেষমেশ তিনি ওই চালটুকু … শুভাশিস নিজেকে চুপ করিয়ে দেন। সাহেবের মুখে লেগে থাকা সেই প্রচ্ছন্ন খুশির ভাবটাকেই এখন মনে পড়ছে তাঁর।
[***]
তিন মাস পর। অফিসের নীচে চায়ের দোকানে জোর গজল্লা চলছে। বীরেন-তারিণী, আরও কয়েকজন হাজির। বীরেন হাসতে হাসতে বলে, “নিজের কপালেই শুভাশিসদা এমন প্রমোশনটা খোয়ালো, জানো তারিণীদা! আমি তো ভিতরের খবর জেনে হাসব না কাঁদব তাই বুঝতে পারছিলাম না।” তারিণী মাথা নাড়ে, “তুমিও শুনেছ তাহলে?” “আরে শুনব না মানে, গোটা অফিস জেনে গিয়েছে। দ্য গ্রেট শুভাশিস মাশ্চরক কিনা এই বয়সে এসে তেল দিতে গিয়েছিল, তাও আবার সরাসরি ডায়রেক্টর সদাশিব বনার্জিকে স্বয়ং – আবার ঠিক মতো কোনও প্রিপারেশন ছাড়াই!” বীরেন হাসতে হাসতে সিগ্রেট ধরিয়ে নেয়, “সত্যিই তারিণীদা, তাও যদি ঠিকঠাক খবর নিয়ে কিছু বলত। সেদিনকার মিটিংয়ে ওর প্রেজেন্টেশন দেখে বনার্জি স্যর নাকি যথেষ্টই খুশি হয়েছিলেন। তাও শুভাশিসদা বেরিয়ে আসার সময় হঠাৎ ফস করে নাকি বলে ফেলেছিল, আপনাকে দেখলাম সেদিন কলকাতা ম্যারাথনে দৌড়লেন। সত্যিই এই বয়সে আপনার মতো ফিটনেস ধরে রাখা। বলে কেউ!” তারিণীও হাসে, “আসলে শুভাশিসবাবুরই বা আর দোষ কোথায় বলো। প্রতি বছরে বনার্জি স্যর ওই দৌড়ে পার্টিসিপেট করেন। শুধু তাই নয় রেস কমপ্লিটও করেন প্রতি বছর। এই বছরেই যে উনি পা মচকে দৌড়ে নামতে পারেননি সেটাই বা শুভাশিসবাবু আন্দাজ করবেন কি করে? মিস হিট হয়ে গেছে আর কি!”
পাশে কখন বেয়ারা বিবেক এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি কেউ।
“না না স্যর, আসলে সব্বাই ওই তেল দেবার চক্করেই থাকে, এই আমি বলে দিচ্ছি আপনাদের,” নিজের ঝাল উগরোয় বিবেক, “নিজেরা সব বড় বড় ডায়লগ মেরে বেড়ায়, আর তারপর আসল জায়গাতে গেলেই ঠিক ধরা পড়ে যায় কার মতলব কোথায়,” বিবেক পাশের দোকান থেকে সেজে আনা বেনারসি মিঠা পানের তিনকোণা খিলিটাকে বীরেনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বীরেনের কল্যাণেই বিবেকের ভাইপোর চাকরিটাও এখানে বেশ তাড়াতাড়িই হয়ে যেতে পেরেছে। বীরেন বিবেকের দিকে একটা কুড়ি টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়। বিবেক সেটা নিতে অস্বীকার করে। হাত কচলিয়ে সে অফিসের দিকে ফিরতি পা বাড়ায়।
শুভাশিস মাশ্চরক আজকাল বাড়ি থেকেই তাঁর দুপুরের খাবার নিয়ে আসেন।