সুমি দত্তগুপ্ত
অষ্টাদশ শতকের শিল্প বিপ্লব সারা বিশ্বে 'দাস' শব্দটির মোটামুটি ভাবে অবলুপ্তি ঘটালেও, ভারত তার ব্যতিক্রম ছিল। কারণ ভারত শিল্প বিপ্লবের আঁচ পেয়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে। উদ্ভুত হয়েছিল ইংরেজদের অনুগ্রহ লোভী এক বিশেষ জমিদার ও বাবু সম্প্রদায়। আর গ্রাসাচ্ছেদনের লড়াই এ লিপ্ত এক দাসানুদাস শ্রেণী। তাদের জন্য ছিল চাবুক, নির্যাতন, আর অনুগ্রহ লোভী, স্তাবকবৃন্দের জন্য ছিল বিভিন্ন পারিতোষিক।
স্তাবকতা শব্দটি ব্যাপকার্থে মোসাহেবী, তোষামোদকারি বা গোদা বাংলায় যাকে বলে চামচেগিরি অর্থে ব্যবহৃত হয়।
স্তাবকেরা যুগে যুগেই আছেন। প্রাচীন যুগে রাজার সভাকবি ,অথবা রাজার বিশেষ নজরে আসার জন্য তার প্রশস্তি বর্ণনা, তার জীবনী রচনায় অতিরঞ্জকতার বহির্প্রকাশ ঘটেছে। যার জন্য সেগুলোকে প্রাচীন ইতিহাস রচনার নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসাবে গ্রহণ করা যায়না।
স্তাবকতা কখনও ক্ষমতা ও বিশ্বাসের শিখরে থাকা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির অঙ্গুলি লেহনেও ঘটেছে। মানুষের ভয়, প্রতিবাদের অনীহা, ধর্মযাজকদের কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্যর ফলে ,গ্যালিলিও গ্যালিলির মত জ্যোতির্বিজ্ঞানীকে চিরদিনের জন্য বন্দিজীবন কাটাতে হয়, তার বিজ্ঞান চর্চা, স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, পাছে তিনি আরো কোনও ধ্রুব সত্য জনসমক্ষে নিয়ে আসেন।
রবীন্দ্রনাথের স্তাবকবৃন্দ নেহাত কম ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা তিনি সম্যক বুঝতেন। তাই তাঁর বিভিন্ন লেখায় আমরা তার উদাহরণ পাই। যে ভাবে তিনি 'বিদূষক' রচনায় স্তাবকতার মর্মন্তুদ দৃশ্য চিত্রায়ন করেছেন, তা প্রমাণ করে মোসাহেবী কোন পর্যায়ে যেতে পারে!
রবীন্দ্রনাথের দুই বিঘা জমি কবিতায় জমিদারের অসহায় দুর্বল প্রজার জমি কেড়ে নেওয়ার কাহিনী, তো নয়,এই কাহিনী জমিদারের অনুচরবৃন্দের রাজানুকল্য পাওয়ার আকুতির চরম প্রকাশ ওই লাইন কটির মধ্যে রয়েছে, "বাবু যত বলেন, পারিষদ দলে, বলে তার শত গুণ।"
লেখক, সাহিত্যিক, শিল্পী, খেলোয়াড় যশস্বী লোকেদের চারপাশে মৌমাছির সংখ্যা কম থাকেনা। তারা হল, সুখের পায়রা, মানুষটির কাছ থেকে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করাই এদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু মানুষটির বিপদের সময় এরা অদৃশ্য হয়ে যান। বাংলা সাহিত্যের উত্তম কুমার বলে যিনি পরিচিত, সেই সমরেশ বসু, যখন তিনি অসুস্থ, তখন তিনি প্রায় বন্ধুহীন সেকথা, নবকুমার বসুর 'চিরসখা'য় আমরা জেনেছি। আর ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারও কম স্তাবক পরিবেষ্টিত ছিলেন না। কলকাতা ময়দানের স্তাবক বৃন্দের দ্বারা অন্ধকার জগতে নিমজ্জিত একজন খ্যাতনামা খেলোয়াড়ের করুন পরিণতির জ্বাজ্বল্য নিদর্শন মজিদ বাসকার। অনেক কষ্টে তাকে ওই পঙ্কিল জগৎ থেকে উদ্ধার করে স্বদেশে ফেরানোর বন্দোবস্ত করেন অবশেষে তার প্রকৃত অর্থে দু একজন সুহৃদ।
পেশাগত জীবনে, উচ্চপদ, খেতাব, উপাধি সরকারী সম্মান পাওয়ার জন্য শাসক দলের দলদাস হয়ে থাকা শিল্পী, সাহিত্যিক, অধ্যাপক কম দেখেনি ভারত বর্ষ। দেখেছে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উপাচার্য পদ, কিংবা গবেষণা পরিষদগুলোর উচ্চ পদে আসীন হওয়ার জন্য ক্ষমতার আশে পাশে ঘুরে বেড়ানো আত্মসম্মান বিবর্জিত, আমাদের কাছে একদা সম্মানীয় ব্যক্তিদের যশ লোলুপতা।
জওহরলাল নেহরুর সেক্রেটারি এম. ও. মাথাই এর ‘নেহরুর সঙ্গে' বইতে পড়েছিলাম নেহরুর শয়নকক্ষে পায়ের কাছে পদ্মজা নাইডু তার বিরাট ছবি রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘুম ভেঙেই তার মুখদর্শন করেন। এই স্তাবক তার মানদণ্ড কি হওয়া উচিত আমার জানা নেই। কারণ আমার কাছে তো তিনি সরোজিনী দুহিতা, হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ভাগ্একদা নাকি আসামের কংগ্রস প্রেসিডেন্ট ও মুখ্যমন্ত্রী দেবকান্ত বরুয়া 'ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া' বলে নিজের যে প্রভু ভক্তির পরিচয় রেখেছিলেন, তা সারা ভারতে প্রচণ্ড ভাবে সমালোচিত হলেও আজকের তুলনায় তা কিছুই নয়।
চৌধুরী চরণ সিংহের সর্বক্ষণের পার্শ্ব সহচর রাজনারায়ণ একবার বলেছিলেন, 'আমি চরণ সিংহের হনুমান।' রাম ভক্তির এই নিদর্শন তখনও সেই যুগে শুরু হয় নি। এই মানুষজনেরা আজ অতীত।
এখন প্রভু ভক্তি, স্তাবকতা অন্য ধারায় প্রবাহিত। তখন অর্থ মোহের চেয়েও বেশি কার্যকরী ছিল কাছে থাকার মোহ, পার্শ্ব সহচর হয়ে থাকা কিংবা বড়ো পদ লাভের মোহ। আর এই প্রভুভক্তদের অল্প কয়েকজন যোগ্যতার নিরিখে পিছিয়ে পড়া মানুষ হলেও, বেশির ভাগেরই কিছু ছিল, সে যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন,তারপর তারা কৃপাপার্থী হওয়ার জন্য, ঘুরঘুর করতেন, অর্থের চেয়েও যশ ও পদের মোহ ছিল অনেক মূল্যবান।
কিন্তু জমানা বদল গয়া। শুরু হলো তোষণ, সেই তোষণ চাকরি পদ প্রার্থীরও। যোগ্যতার নিরিখে নয়,অন্যভাবে শুরু হল কলেজ সার্ভিস কমিশনে, স্কুল সার্ভিস কমিশনে, পাবলিক সার্ভিস কমিশন এ নিয়োগ।
তারপরে শুরু হল বিশ্বায়নের যুগ। চারিদিকে অনেক আকর্ষণ, সবাই বড়লোক হতে চায়, টাকা লগ্নি করতে চায়। তাই তখনকার স্লোগান হয়ে উঠলো, 'ফেলো কড়ি, মাখো তেল, তুমি কি আমার পর?’ অর্থাৎ সব সম্পর্কই নির্ধারিত হতে শুরু করলো অর্থকরী আদান প্রদানে। তুমি যতই স্তাবকতা করো; বিধায়ক, সংসদের টিকিট তোমার মিলবে, তুমি কত টাকা পার্টি তহবিলে দিতে পারছ,তার নিরিখে। খুবই practical ব্যাপার স্যাপার।
তাও কাছে আসতে হবে শাসকের,তার জন্য কি প্রাণান্তকর প্রয়াস। বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিদের সাথে শাসক শ্রেণীর তুলনা করে তার মহিমা কীর্তন। যাতে কোনোভাবে কৃপালাভে বঞ্চিত হতে না হয়। এবং সেই সুযোগে নিজের যাবতীয় কুকীর্তি ঢেকে রেখে, বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। চোরের মার বড়ো গলা এই আপ্তবাক্য কে একেবারে সঠিক প্রমাণিত করার জন্য মরিয়া চেষ্টা, লাজ, লজ্জা, আত্মসম্মান বিবর্জিত হয়ে।
এই স্তাবকদের যে বড়ো দরকার ভোটের বৈতরণী পেরোতে ,তারা পার্টিকে টাকা যোগান, জনবল দেন, ছাপ্পা ভোট জোগাড় করে দেন,পরিবর্তে তাদের দিতে হয় নানা বেআইনি নির্মাণকাজ,গরু পাচার, অবৈধ ,অসামাজিক কাজকর্মের লাইসেন্স। আগে গোবিন্দ নিহালনি,শ্যাম বেনেগালের মুভিতে এই অর্ধসত্য সত্য হয়ে দেখা দিত। এখন চোখের সামনে,রোজনামচা এটাই।
সংসদীয় রাজনীতিতে ভোটে জেতাই যেখানে চরম ও পরম লক্ষ্য ও সত্য ,সেখানে এই চামচে রাই সব। তারাই পারবে শাসক কে স্বখাত সলিলে ডোবাতে এবং বাঁচাতে। তাই তাদের অবাধ গতি রুধিবে সেই সাধ্য কার ?
সত্তরের দশকের বাংলা ক্লাব ফুটবলের দলবদল নিয়ে যে নাটকীয় এবং অতি নাটকীয় ঘটনা কলকাতা ময়দানে ঘটত। তার থেকেও বেশি রোমাঞ্চকর দৃশ্যের সাক্ষী হই আমরা যখন এই স্তাবকেরা তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে। শুধু তাই নয় দলত্যাগ বিরোধী আইন কে মাথায় রেখে,কখনও বা কাঁচ কলা দেখিয়ে যেভাবে তারা শিবির ত্যাগ করে অন্য শিবিরে পদার্পণ করেন,কিংবা বিরাট অর্থের বিনিময়ে ।শোনপুরের মেলায় যেখানে কথিত আছে ,চুপিসারে মানুষ বিক্রিও হয় (তথ্য সূত্র: বাণী ধ্বনি বেণু বনে : সমরেশ বসু) সেই চিত্রকে ম্লান করে দিয়ে ভোটের পর সাংসদ কেনা বেচা হয়।। শুধু তাই নয় সেই সাংসদ তার পূর্বতন দল ও দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে যেভাবে বিষোদগার করতে থাকেন, আর দুদিন আগেই যার বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়েছেন,অর্থের বিনিময়ে তাকে বুকে টেনে নিতে কসুর করেন না,তাতে মনে হয়, এই পৃথিবী সত্যিই এক রঙ্গ শালা।
একদা আলোর বৃত্তে থাকা বিশিষ্টজনদের দেখে সবচেয়ে অবাক হই,যখন একটুকরো আলো পাওয়ার জন্য তারা সত্যি কথা বলতে পারেন না,বিভিন্ন ছুঁড়ে দেওয়া দয়ার দান,মাসোহারা ,প্রথম শ্রেণীর অ্যাটেনডেন্ট সহ ট্রেনের টিকিট, শর্ত দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া ফ্ল্যাট যে ফ্ল্যাট তার মৃত্যুর পরে শাসকের হাতে চলে আসবে,এইটুকুর জন্য শাসকের সবরকম অন্যায়,দুর্নীতি,অত্যাচারের প্রতি এক চরম উদাসীনতা, নির্লিপ্ততা দেখিয়ে চলেছেন,তখন অবাক হয়ে ভাবতে হয়,এই দেশে একসময় শাসক দলকে আই পি টি এর গান,নাটক কে সম্ভ্রম করতে হয়েছে,,তারা কমিউনে থেকেছেন। ‘Kaifi and I’ শাবানা আজমীর মার লেখা এই বই সেই ইতিহাসের দলিল ।রুমা গুহ ঠাকুর তা,সলিল চৌধুরী কোনোদিন থেমে থাকেনি নি তাদের সৃষ্টির সততা থেকে। মানুষ সৎ না হলে তার সৃষ্টি কিভাবে সৎ হবে? তাই সেই সৃষ্টি আজ ও আমাদের নাড়া দেয়।
স্তাবকতা ক্ষণিকের, বেঁচে থাকে তাই সত্তা, নিজস্বতা, আত্মসম্মান, সেটাই সত্য, সেটাই ভবিষ্যত। আলবেরুনি বলেছিলেন, ভারতীয়রা ইতিহাস বিমুখ জাতি। কিন্তু আমরা এখনও মনে রেখেছি,সংসদে ইনডিপেনডেন্ট দলের সদস্য হিসেবে,মেঘনাদ সাহার সেই উক্তি - 'মাননীয় মিস্টার নেহরু, নেহরু যাবে,নেহরু আসবে, কিন্তু মেঘনাদ সাহা একজনই হবে।'