দোঁহা

আপনার গল্পটা

 


অরিত্র দ্বিবেদী

নমস্কার। আশাকরি সকলে খুব ভালো আছেন। আমার নাম ইস্রাফিল। না ভুল ভাবছেন, আমার হাতে কোনো শিঙা নেই। আমি তো কেবল গল্পবলিয়ে। একটি সমাপিকা এবং একটি অসমাপিকা ক্রিয়ার মাঝে যা কিছু ঘটে থাকে, সেই সব আপনাদেরকে নিষ্ঠার সঙ্গে এবং মুখোরোচকভাবে পরিবেশন করাই আমার একমাত্র কাজ। এ আমার কাজ, কারণ এটা করতে আমার খুব ভালো লাগে, খুব খুউউববব।
      
অনেক আগের কথা, আমরা একটা পৃথিবী দেখতে পাচ্ছি, একটা পৃথিবী বলছি কারণ, এটা আপনাদের চেনা পৃথিবীটা নয়, এর অস্তিত্ব অন্যত্র। একটি বৃহৎ উপমহাদেশের একটি ছোট্ট অঞ্চলের গল্প আজ শোনাবো। ওই যে যেখানে সঙ্গম দেখা যাচ্ছে, মিউ আর জিক্ নামের দুই নদীর, সেখানেই আমাদের চরিত্ররা আর তাঁদের ঈশ্বর থাকেন, শুরু থেকে ওখানেই থেকে এসেছেন, আনন্দে(হয়ত)। গ্রামখানার নাম অসদ্। খানিক ইহুদী, খানিক মুসলমান আর কিছু হিন্দু, সকলেই প্রায় বর্বর এ গ্রামে থাকেন। অথচ, ধর্ম কিন্তু সব্বার এক, পোয়োতা, আর উপাস্য দেবতা দু’জন, একজন পুরুষ, অপরজন নারী। নারীটি স্থিতি, জীবন ও সংহতির দেবী, নাম ‘আসিয়া’, পুরুষটি বিক্রম, হিংস্রতা, ক্ষমতা এবং উচ্চাশার দেবতা, নাম ‘হাইড’। অসদের সমস্ত পুরুষ পুজো করেন হাইডের আর সমস্ত নারীর উপাস্য আসিয়া। এঁদের কাছে এই দুই দেব দেবীই জীবিত, বর্তমান, তাঁরা মাঝেমধ্যেই সে প্রমাণও দিয়ে থাকেন। গ্রামের কোনো সর্দার বা রাজা নেই, শাসনের সমস্ত ভার অর্পিত হয়েছে হাইডের ওপর আর পালনের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন আসিয়া। আজ, মহোৎসবের দিন, আসিয়া আর হাইড জিক্ নদীতে চান করবেন আজ। এইসময়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয় হাইডকে। এর পিছনে এক পৌরানিক ঘটনা আছে। কথিত যে, কোনো একদিন, আকাশে তখনও পশ্চিমের সবচেয়ে বড়ো তারাটা ফোটেনি, সকাল থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে, কুচকুচে কালো মেঘে ভর্তি গোটা উপমহাদেশ। রাতে বৃষ্টি থামলে পর বাইরে থেকে আগুনের চিৎকার, কান ফাটানো শব্দ, আর অদ্ভুত তীব্র আলোয় ঝলসে যাচ্ছিল কালো অন্ধকার, চোখ সইতে অসদের লোক দেখলো, দুই মানব মূর্তি। একজন নারী, অপরজন পুরুষ! নারীটি হাসছেন আর তীব্রতর পুরুষটি ছুটে যাচ্ছেন নারীটিকে হত্যা করার জন্য, কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছেন বারবার। কারণ পুরুষটি বিরাট শিকলে বাঁধা। অলৌকিক, দিব্য শক্তিতে পুষ্ট হয়ে যাচ্ছে সমস্ত চরাচর। নারীটি সুদর্শনা, পুরুষটি বিভৎস, রক্তাক্ত! পুরুষটি চেঁচিয়ে বলছেন, “কী করেছি আমি! নিজের উন্নতি চাওয়া পাপ! কী ক্ষতি করেছিলাম কার! কেন এত বড় শাস্তি দিলে আমায়! কোথায় সেই ফেরেশতা! তোমাকে আমি শেষ করে দেব!” তাঁর অনর্থক হুঙ্কারে কেঁদে উঠেছিল আকাশে ঘুরে বেড়ানো মহাজাগতিক শিশুদের দল। অসদের মাটি ধুয়ে গেছিল পুণ্যে। আসিয়া হেসেছিলেন সেদিন। এই ছিল ঘটনা। ওরা কারা, কোথা থেকে এসেছিল, কেউ জানেনা। কিন্তু সেই থেকে ওরা রয়ে গেছে। তিরিশ চাঁদ আগে কুচু গাঁওবুড়ো যখন বেঁচেছিল, সে বলত এই ঘটনা। সে তখন খুব ছোট , মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে সে দেখেছিল, সে দেখেছিল সেই ফেরেশতাকেও; উনি এসেছিলেন অসদকে পূজার বিধি বোঝাতে। আকাশে তিনটে চাঁদ উঠেছিল সেদিন।
     
এবার দেখুন, ওই যে জেরার, জেরার হাইডের প্রধান উপাসক। আজ, তার অনেক কাজ। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেছে অনেক কিছু, জেরার লুকিয়ে দু'জন নিখোঁজ মানুষের বলি দিয়েছে, যে প্রেতের উপাসক হাইড স্বয়ং তাঁর কাছে উৎসর্গ করেছে ওদের, প্রেত খুশি হয়েছেন, প্রেত তৃপ্ত হয়েছেন। গোপন কোনো যুক্তি হয়েছে জেরার আর হাইডের মধ্যে। অসদের লোক এসবের কিছু জানে না, তাঁদের কোনও সন্দেহও হয়নি। জেরার মন দিয়ে কমলালেবু আর বেদনার বীচি সাজচ্ছে, তার একটা রাক্ষস আঁকার কথা, সেটায় এমন করে আঘাত করতে হবে, শিঙার মত দেখতে ওই তরবারি দিয়ে যাতে ফিনকি দিয়ে ফলের রস বেরিয়ে আসে দুপাশেই। কিন্তু সকলের অলক্ষ্যে, খুব সন্তর্পণে খুব সাবধানে জেরার সাজিয়ে রাখছে, লুকিয়ে রাখছে এক পবিত্র নিশান। সে প্রেতের নাম জানে না, তার স্তাবকতা হাইড অবধিই আর হাইডের ধ্যানজ্ঞান এক এবং একমাত্র প্রেত। হাইড নিজের মুক্তি চায়, জেরার শুধু এটুকুই জানে, তার আর জানার প্রয়োজনও নেই। সে শুধু আজ্ঞাবহ দাস, তার এ পরিচয়েই সে গর্বিত।
    
আচ্ছা, এবার বলুন দেখি, এ দৃষ্টি কি ঠিক?

কী বললেন, নয়! তাই না!

    
আচ্ছা, যদি বলি, হাইড চিরকাল জেরারকে সাহায্য করে এসেছে, জ্ঞানত কোনো ক্ষতি করেনি, শুধু মাঝে মাঝে জুটেছে স্বল্প দুর্ব্যবহার!

    
তবু শ্রোতা, আপনার মত দৃঢ়তার সাথে বদলাতে পারছি না, হুমমম…আচ্ছা তবে কি হাইডের সামনে মাথা নত না করাই আপনার মতন মানুষদের উচিত?

হাঃ হাঃ হাঃ, আসুন দেখে নেওয়া যাক বাকিটুকু…

নাহ্ কোথাও কোনো ভুল নেই। নিখুঁত কাজ জেরারের। আকাশ ঘন কালো, তীব্র শব্দে মাথা ফেটে পড়ার জোগাড়। আপনার পায়ের পাতা কেঁপে গেল। আপনি সবিস্ময়ে দেখলেন হাইড মুক্ত হয়েছে। বেড়ি আপনার পায়ে বাঁধা, জেরার আজ থেকে আপনার দাস। আজ থেকে অসদের মানুষ মনে রাখল আপনাকে, তাদের কাছে হাইড বলে কেউ কখনও ছিল না। যতদিন আপনি ন্যায়ের স্তাবক, যতদিন আপনি সত্যের উপাসক, অন্ধের মতন সত্যের পিছু পিছু চলেন, ততদিন আপনার মুক্তি নেই! আপনার মুক্তি আমার আরাধনায়, আপনি আমার শ্রোতা! আপনার মোক্ষ আমার স্তাবকতায়!

হাঃ হাঃ হাঃ! আমি কেন করেছি? এমনিই। শিশু যেমন খেলনা ভেঙে আনন্দ পায়, এমনিই, আপনি যেমন দুর্বলকে দলে আনন্দ পান, এমনিই, ঠিক তেমনি, আমিও … হাঃ হাঃ হাঃ

কী আমি কে? হুম কারো কাছে আমি জেহোভা, কোথাও ইস্রাফিল, কোথাও রা, কোথাও পরশুরাম! আপনি শুধু এটুকু জানুন আমিই সমস্ত। এই সৃষ্টির কোনো কারণ নেই, কোনো অর্থ নেই, এর ধ্বংসেরও থাকবে না! এক এবং একমাত্র সত্য আমি, আর আমার উপাসকের আহুতি!

রইল তবে অসদ, রইল জেরার, রইলেন আপনি, রইল আমার গল্প বলা, আপনাদের আন্তরিক স্তাবকতা, আপনাদের অর্থনহীন সার্থকতা; আর রইলাম আমি, আমি, আমি একমাত্র আমি!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন