মালবিকা মিত্র
-সাহেব তো রাগে কাঁপছেন, লাল মুখ আরও লাল হয়ে গেছে। আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেছি।
-তারপর? তারপর?
বুড়ো বুড়ি বাচ্চা জেয়ান সবাই শোনার জন্য উদগ্রীব। কারো তর সয় না। সবাই জানতে চায় তারপর কি হলো। সবার বিস্ফারিত চক্ষু।
-গেট লস্ট, সোয়াইন, রাবিশ, নেটিভ কি সব ইংরেজি গালাগালি দিয়ে "থুঃ" শব্দ করে আমার দিকে থুতু ছূঁড়লেন।
শ্রোতাদের চোখ আরও বড়ো, পলক হীন, "তারপর?"
-তারপর, সাহেবের থুতু তো আমার গায়ে পড়লেন।
এক্ষণে একটু বিরাম নেওয়া যাক। মোসাহেব নিজের বাড়িতে এসেছেন। পরিবার, প্রতিবেশী, শিশু, বৃদ্ধ সকলেই সাহেবের গল্প শুনতে চায়। সেই গল্পই চলছিল। "সাহেবের থুতু তো আমার গায়ে পড়লেন।" সাহেবের থুতু বলে কথা, সম্মান তো জানাতেই হবে। সাহেবের প্রতি এই সম্মান ও সমীহ ভাব থেকেই তো "উলঙ্গ রাজা" কে দেখেও মোসাহেবের দল মানতে চায়না যে রাজা উলঙ্গ :
"রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম, চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।"
কারণ এই মোসাহেব কারা কারা হতে পারে তার একটা আন্দাজ দিয়েছেন কবি। অর্থাৎ মোসাহেবের নানান ক্যাটাগরি তিনি প্রকাশ করেছেন :
"কারও মনে সংস্কার, কারও ভয় ;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি
অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক"
অর্থাৎ কবি নীরেন চক্রবর্তী মোটা দাগে দুটি বিভাজন করেছেন, একটি ভয়, সংস্কার ও অপরের বুদ্ধিতে চলা পক্ষ। মানসিকভাবে মোসাহেব। এবং দ্বিতীয়টি অনুগ্রহভাজন, স্বার্থরক্ষা, কিছু প্রাপ্তির আশা এবং উচ্ছিষ্টভোগী। বৈষয়িক কারণে মোসাহেব। আসলে একটি সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হলো স্তাবকতা বা তোষামোদ। বলা ভালো, ক্ষমতার অনুষঙ্গ হলো স্তাবকতা। বিদ্যালয়, ক্লাব, পল্লী উন্নয়ন, পৌরসভা, সরকার, সর্বস্তরের ক্ষমতার চারপাশে জন্ম নেয় স্তাবকতা। ক্ষমতা যদি প্রতি পদক্ষেপে ভিন্ন মতের সম্মুখীন হয় এবং শেষ অবধি একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহলে সেই ক্ষমতা থেকেও নেই। সেই সঙ্গে ক্ষমতা বিষম বিস্বাদ। ক্ষমতা হবে বাধাহীন, নিয়ন্ত্রণহীন, নিরঙ্কুশ। এরজন্য ক্ষমতা তার চারপাশে হা জী হা জী গোষ্ঠী তৈরি করে। রাজা বলবেন, একটা শুভ লগ্ন দেখো দেখি জ্যোতিষী। আর জ্যোতিষী যদি গণণা করে রাজার সিদ্ধান্তে বাদ সাধেনন, তাহলে অমন জ্যোতিষী রাখা কেন। জ্যোতিষী কে বলতে হবে-
"লগ্ন তো সম্রাটের হাতে,
পঞ্জিকা কি বলে
কি আসে যায় তাতে?
এ কি পঞ্জিকার কাজ-মহারাজ?"
ব্যাস, সিদ্ধান্ত গ্রহণ কতো সহজ হলো। এই জন্যই চাই রাজ-জ্যোতিষী। অন্ধ স্তাবক, সাহেবের চাই মোসাহেব।
তাহলে শুনুন ইতিহাসের গল্প। সুলতান ইলতুৎমিস দিল্লির ক্ষমতায় এলেন। এর আগে তিনি ছিলেন সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের একজন দক্ষ অভিজাত, বদাউনের শাসনকর্তা এবং সুলতানের জামাই। অন্যান্য অভিজাত তাঁকে সুলতান হিসেবে বাড়তি সম্মান দেখাতো না। তাঁদের সমকক্ষ বলে মনে করতো। ফলে দরবার পরিচালনা করা, কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, কার্যত অসম্ভব ছিল। এই অবস্থায় ইলতুৎমিস অন্যদের চেয়ে নিজের আসন মহিমান্বিত করার জন্য বাগদাদ খলিফার কাছে আনুগত্য প্রকাশ করে দূত মারফত পত্র ও উপহার সামগ্রী পাঠালেন। মহামান্য খলিফাও পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা, হিন্দুস্থানের সুলতানের আনুগত্য গ্রহণ করে, একটি লিখিত স্বীকৃতি পত্র ওই দূতের হাতে দিলেন। এবার সুলতান ইলতুৎমিস ওই স্বীকৃতি পত্রের সুবাদে অন্যান্য অভিজাতদের থেকে পৃথক হলেন। কারণ তিনি খলিফার দ্বারা স্বীকৃত অন্য অভিজাতদের এই স্বীকৃতি নেই। এক্ষেত্রে সুলতান বুঝি নিজেই কৌশলে স্তাবকতা করলেন। উদ্দেশ্য আপন কার্য সিদ্ধি।
এরপর ইলতুৎমিস দরবারে একদল ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞ, উলেমা, মৌলভীদের আহ্বান জানালেন ও দরবারে স্থায়ী সম্মানিত পদ অর্পণ করলেন। তারাও সুলতানের এই আনুগত্য গ্রহণ করলেন। উলেমাদের উচ্চমানের থাকা-খাওয়া, জীবনযাপনের ব্যবস্থা হলো। বিনিময়ে এরা দরবারে সুলতানের সকল সিদ্ধান্তের পেছনে শাস্ত্রের অনুমোদন যোগান দিতেন। ফলে সুলতানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনেকটা সহজ হল। কারণ সুলতানের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার অর্থ শরীয়তের বিরোধিতা করা। প্রবল ক্ষমতাবান ইলতুৎমিসের শাসনে এই উলেমা গোষ্ঠী মোসাহেব হিসেবে কাজ করতেন । বিনিময়ে প্রভূত পরিমান বিষয় আশয়, ভূ সম্পত্তি ও ক্ষমতা লাভ করেছিল।
কিন্তু সুলতানি শাসনের দুর্বল পর্যায়ে এই উলেমারা আর মোসাহেব থাকেননি। তারা সুলতানকে নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট ছিল। এমনকি বিভিন্ন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, তারা শরীয়তের প্রশ্ন তুলে সুলতানকে সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখেন। চরম ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন আলাউদ্দিন খলজী। তিনি উলেমাদের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে কাজী মুঘিসউদ্দিন কে স্পষ্ট জানিয়ে দেন-'I do not know whether it is sanctioned by Sariyat or not. I do that which I think best suitable for my state.' আলাউদ্দিন খলজির সময় এই উলেমাদের দরবার থেকে বিদায় দেওয়া হয়। আসলে ক্ষমতার শীর্ষে বসে আলাউদ্দিন উপলব্ধি করেন 'Kingship knows no kinship', তাঁর ক্ষমতা তখন মধ্যগগনে।
সম্রাট অশোক সামরিক বিজয় অপেক্ষা ধর্ম বিজয়ের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে অশোকের পূর্বেই বিন্দুসারের সময়ে, মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি এক সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। অশোক কোন নতুন করে সামরিক বিজয় করেননি, একমাত্র কলিঙ্গের বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। সে যাই হোক অশোক এই সুবিশাল সাম্রাজ্য ও প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সম্পর্ক স্থাপন, নিয়ন্ত্রণ রক্ষা ও সংহতি সাধন, করার ক্ষেত্রে সামরিক বিজয় অপেক্ষা ধর্ম বিজয়ের ওপর গুরুত্ব দেন। তার ধর্ম বিজয়ের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম মহামাত্রগন। অশোকের প্রশ্রয়ে এই ধর্ম মহামাত্ররা অস্বাভাবিক ক্ষমতা অর্জন করে। বলা যায় এরা ছিলেন অশোকের যুগের স্তাবক বা মোসাহেব। কিন্তু কালক্রমে এরা প্রভূত শক্তির অধিকারী হয়ে, মৌর্য সাম্রাজ্যের সংহতির বিপদ ডেকে আনেন।
ক্ষমতাবান শাসক মোসাহেব ছাড়া চলতে পারেনা। কারণ মোসাহেবরা শাসকের কথার অন্যথা করে না, কোন পাল্টা যুক্তি তর্ক করে না। বরং শাসকের চাটুকারিতা করে। সিদ্ধান্তের পেছনে সংখ্যা গরিষ্ঠের সমর্থন যোগায়। ফলে শাসকের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুবই সহজ হয়। শাসক কোন ভিন্ন স্বর, অন্যস্বর শুনতে চায় না। শুনতে পায়ও না। কেবলই সমস্বর জেগে থাকে। কিন্তু এর ফলে ভিন্ন স্বর বা বহুস্বর গুলি তো আর নির্মূল হয় না। চাপা পড়ে থাকে মাত্র। কালক্রমে একদিন সেগুলি মহীরূহ হয়ে শাসকের দূর্গ প্রাকারে ফাটল ধরায়।
মোসাহেবের সাথে শাসকের সম্পর্কটা ভারী অদ্ভুত, বিচিত্র ভারসাম্যে প্রতিষ্ঠিত। এ যেন সাধও আছে, গালও পোড়ে। ঠাকুমা দিদিমারা বলতেন :
"পানে চুন বেশি খাইলে মুখ পুইড়্যা যায়, আবার কম খাইলে বুক জ্বলে…"
ক্ষমতার সাথে মোসাহেবের সম্পর্কটা তেমন, 'আচ্ছা', 'আজ্ঞে', 'ঠিকই তো', 'আপনি যা বলেছেন', 'জো হুজুর', শুনতে ভালো। আবার এরাই সর্বনাশের কারণ হয়। এদের কারণে কখনো ground reality সামনে আসে না।
"নিন্দারে রসনা হতে দিলে নির্বাসন
নিম্নমুখে অন্তরের গূঢ় অন্ধকারে
গভীর জটিল মূল সুদূরে প্রসারে,
নিত্য বিষতিক্ত করি রাখে চিত্ততল।"
শাসকের চোখে ground reality কখনোই সামনে আসে না। একসময় লোহার অস্তিত্ব থাকে না, সবটাই মরচে। আর মরচের আয়তন লোহার চেয়ে বেশি। শাসক নিজের ক্ষমতার আন্দাজ পায়না। একদিন হুড়মুড় করে সব ভেঙে পড়ে। তখন শাসক রক্তকরবীর রাজার মতো বলে ওঠে- "ঠকিয়েছে, আমার নিজের লোকেরা আমাকে ঠকিয়েছে।"
সাম্প্রতিক ইতিহাসেও একই নজির দেখতে পাওয়া যায়। ৭০ দশকে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে "এশিয়ার মুক্তি সূর্য" আখ্যা দেওয়া হয়। "এক দেশ, একদল, এক নেত্রী" শ্লোগান উঠেছিল। এমনকি দেবকান্ত বড়ুয়া মন্তব্য করেন, "ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা, এন্ড ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া"। স্তাবকতা ও মোসাহেবির এক চরম দৃষ্টান্ত। ১৯৭৭ এ শোচনীয় ভাবে এই ক্ষমতা সৌধ ভেঙে পড়ে। ফলে আজ যখন বলা হয় "মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়", তার নামে স্টেডিয়াম, তার নামেই মন্দির, "বিশ্বগুরু" অভিধা, তখন আশ্চর্য হইনা। কারণ এই অভিজ্ঞতা ইতিপূর্বেই হয়েছিল, বড্ড চেনা ছবি। ভাবা যায়? নেপোলিয়ন যখন রুশ রণাঙ্গনে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন, ফ্রান্সের মাটিতে তখন ষড়যন্ত্র চলছে। নেপোলিয়নের বিশ্বস্ত(!) অনুচর(মোসাহেব) ম্যালেট নেপোলিয়নের মৃত্যু সংবাদ রটনা করে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করে। ২০০৬ এর পর ক্ষমতা শীর্ষ থেকে টিম বুদ্ধের পতন একই ইতিহাসের সাক্ষী। হিটলারের ক্ষেত্রেও শোনা যায়, ন্যুরেমবার্গ বিচারে হিটলারের বাঘা বাঘা স্তাবকের দল, তাদের জবানবন্দি তে "আমি কিছু জানি না, ওরা সব জানে" এই গোছের পাশ কাটানো অজুহাত দিয়েছিল।
ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায় প্রাচ্যবাদীরা যখন এদেশের অতীত ঐতিহ্য ও জ্ঞানের সমুদ্রে অবগাহন করতে ব্যস্ত, সেই সময় পাশ্চাত্যবাদীদের যুক্তি ছিল, প্রজার ঐতিহ্য নিয়ে শাসক প্রভুর বেশি আদিখ্যেতা করা উচিত না। এতে প্রজা লাই পেয়ে মাথায় চেপে বসে। পাশ্চাত্যবাদীরা এদেশীয় শিক্ষার পরিবর্তে এমন একটি শিক্ষার সুপারিশ করেছিল, যে শিক্ষা ভারতীয় ঐতিহ্যকে ঘৃণা করতে, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে শেখাবে। ব্রিটিশ প্রভুকে পরিত্রাতা হিসেবে, আলোকবর্তিকা হিসেবে, জ্ঞান করবে। এভাবে একদিকে হীণমন্যতা ও অন্যদিকে প্রভু ভক্তি বৃদ্ধি পাবে। এরাই হবে ভবিষ্যতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের রক্ষাকবচ। এদের জন্যই এদেশে ইংরেজ শাসন এত সুদীর্ঘকাল টিঁকে ছিল। এই মোসাহেবদের একটা উদাহরণ দেওয়াই যথেষ্ট। বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে একটি সুবিশাল সমারোহ পূর্ণ পার্টি দিয়েছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। তিনি নামিদামি ব্রিটিশ প্রভুকে সেখানে সপরিবারে আমন্ত্রণ করেছিলেন। যেখানে আলোকমালায় জ্বলজ্বল করছিল লেখা-"গড সেভ দা কুইন"।
থাক গে এসব কথা। মোসাহেবের উনিশ শতকের এই বাবুদের গল্পে, একবার ঢুকে পড়লে, গল্প আর শেষই হবে না। অতএব উনিশ শতকিয় মোসাহেবের গল্প আপাতত বন্ধ থাক। উপনিবেশের এই মোসাহেবের পোশাকি নাম বাদামী সাহেব, ব্রাউন সাহিব। ভাবতে পারেন উমেশ নামটির বানান কখনো Woomesh হতে পারে! কারণ সাহেবরা উমেশচন্দ্রকে ভুল উচ্চারণে ওমেশ চন্দ্র বলতেন। সেই থেকে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে গেলেন ডব্লিউ সি ব্যানার্জি, কি বিচিত্র! এমনকি প্রথম যুগের এই বাদামী সাহেবরা, ব্রিটিশ প্রভুর শোষণ-পীড়ন-লুণ্ঠন-সম্পদ নিঃসরণ প্রত্যক্ষ করেছেন। সেগুলির বিস্তারিত বিবরণ লিখেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সততার সাথে। কিন্তু শেষে সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, এদেশে যারা শাসক হয়ে আসেন, তারা খারাপ ব্রিটিশ, আন-ব্রিটিশ। ইংল্যান্ডে আছে ভালো ব্রিটিশ। তাই দাদাভাই নওরোজির বইটির নাম ছিল "পভার্টি : অ্যান আন ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া" এটা মোসাহেবি নয়?
সে যাক গে, রাজনীতির কথা এসে পড়বে। বাদ দিন ওসব। এডওয়ার্ড সাঈদ বলেন, এভাবে বাহ্যিক আগ্রাসন নয়, যখন চিন্তা চেতনা মননে আগ্রাসন সম্পন্ন হয়, তখন বাহ্যিক আগ্রাসন প্রয়োজন হয় না। ঘরের চাল ফুটো, টপ্ টপ্ করে জল পড়লেও, মন দুঃখি হয়না, বিদ্রোহী হয় না। বরং চোখে ভাসতে থাকে, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর গাড়ির বনেটে জল উঠেছে। বাধ্য হয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজের গাড়ি ছেড়ে পুলিশের জীপে উঠছেন রাস্তার জলে পা ভিজিয়ে। "সত্যি কলকাতা শহরের মানুষের কত্তো কষ্ট"। ঠাসাঠাসি ভীড়ে বনগাঁ লোকাল, এক যাত্রী উদাসীন ভাবে চিন্তা করছে-কাগজে লিখেছে, "মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের এসি মেশিন খারাপ। তাই তিনি ভূমি সংস্কার মন্ত্রী বিনয় চৌধুরীর ঘরে বসে কাজ করেছেন।" নিজের সব কষ্ট তুচ্ছ মনে হয়। মগজে মোসাহেবি বাসা বেঁধেছে।
শুধু তো ক্ষমতা কেন্দ্রিক স্তাবকতা মোসাহেবি নয়। ক্ষমতার বাইরে প্রতিষ্ঠাকামি শক্তির মধ্যেও চালু থাকে স্তাবকতা। কারণ সেই শক্তি যদি ক্ষমতার বাইরে নিজে একটি বিকল্প প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, ওঠার সম্ভাবনা হয়ে থাকে, সেখানে মোসাহেব জুটবেই, আপনি চান বা না চান। হাওয়ার্ড জিন এর রচনা "মার্কস ইন সোহো” থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক :
পাইপার ছিলেন একজন তোষামুদে মোসাহেব। মার্কসকে খুশি করার জন্য তিনি মার্কসের লেখার উদ্ধৃতি দিতেন। এক সন্ধ্যায় পাইপার মার্কসকে জানালেন যে তারা "মার্ক্সিস্ট সোসাইটি লন্ডন" নামে এক সংস্থা গড়েছেন। মার্কসকে ওই সভায় ভাষণ দিতে আমন্ত্রণ জানালেন। মার্কস জবাব দিলেন "আমি তো মার্ক্সিস্ট নই"। মার্কসের কথাগুলো বিকৃত করে সেগুলোই সমর্থন ও প্রচার করতেন পাইপার। এদের সম্পর্কে মার্কস খুব বিরক্ত ছিলেন। মার্কসের আশঙ্কা ছিল বিপ্লব আসার পর পাইপার এর মত মার্ক্সবাদীরাই ক্ষমতার মাথায় চড়বে। ক্ষমতার বাইরে থাকলে এরা চাটুকার তোষামুদে মোসাহেব। আর ক্ষমতায় থাকলে এরা উৎপীড়ক ও দাম্ভিক। এরা এক নয়া পুরোহিত তন্ত্র জন্ম দেবে। যেখানে চলবে বহিষ্কার, তর্জন গর্জন, অপরাধের তদন্ত, বিচার, ফায়ারিং স্কোয়াড, যত রকম অমানবিক ব্যবস্থা। এসবই চলবে সাম্যবাদের নামে । আমাদের সুন্দর স্বপ্নকে এরা নোংরা বিকৃত করে দেবে। তাকে পরিষ্কার ও শুদ্ধ করতে হয়তো আরো দুটো বা তিনটে বিপ্লব ঘটাতে হবে। মোসাহেবের এমন তাত্ত্বিক উদ্ধৃতির পর আর কোন মন্তব্য চলে না।
তাহলে ব্যাপার দাঁড়ালো-শুধু ধান্দাবাজ, উমেদার, উচ্ছিষ্ট ভোগীর দলই কি স্তাবক? প্রাপ্তি ধান্দার বাইরে কি বিপুল সংখ্যক মানুষ মানসিক ভাবে, চৈতন্যে, মোসাহেব হয়ে আছে? গান্ধিজি এই চৈতন্যের পরাধীনতা থেকে মুক্তিকে প্রকৃত স্বাধীনতা বা স্বরাজ বলতেন। ঔপনিবেশিক মেকলের শিক্ষা প্রস্তাবে কথিত "গাত্রবর্ণে ভারতীয় কিন্তু মননে ইংরেজ" নীতি কে আমরা আজও উত্তরাধিকার সূত্রে বয়ে চলেছি। অতএব স্তাবকতা ও মোসাহেবিই সত্য। কারও ক্ষেত্রে এক আনা সত্য, কারও ক্ষেত্রে আঠারো আনা সত্য।
স্তাবকতা মোসাহেবির গল্প দিয়েই শেষ করা যাক। স্তাবক নিয়োগ হবে। সরাসরি যোগাযোগ করুন। "ওয়াক ইন" ইন্টারভিউ।
(১)
-আপনি জানেন কাজটা ঠিক কি রকম?
-হ্যাঁ, জানি।
-ও জানেন! তাহলে আপনি এখন আসুন। পরে জানাবো।
(২)
- আপনি কি এই কাজ করতে পারবেন?
-একশো বার পারবো। দশ বছরের অভিজ্ঞতা আমার।
-বেশ। তাহলে আপনি এখন আসুন। পরে জানাবো।
(৩)
-আপনি জানেন কাজটা ঠিক কি রকম?
-হয়তো জানি, হুজুরের যদি মনে হয়। স্যার আমি জানি কি?
-কাজটা পারবে তো?
-আজ্ঞে আপনি মনে করলে পারবো। আপনি বললে বাঘেও কাঁঠাল পাতা খায় স্যার।
-আসলে কাজটা খুব কঠিন।
-তা বটে, খুব কঠিন।
-তুমি সেটা জানো?
-আজ্ঞে, আপনিই তো বললেন। তাই জানলাম।
-সন্দেহ হয়, এ কাজ তোমার দ্বারা হবে না।
-হুজুরের যখন মনে হচ্ছে, তাহলে নিশ্চয়ই হবে না। হুজুর জহুরী, চিনতে ভুল করেন না।
-কবে থেকে আসবে?
-হুজুর যখনই ডাকবেন, বান্দা হাজির।
যথার্থ মোসাহেব নিজের মত কখনো প্রকাশ করে না। প্রভুর কথায় তাল ঠুকবে, চিৎ করলেও আছি, উপুড় করলেও।
-আপনি কেন তোষামোদ করেন?
-কেন করবো না। স্যারের এই কোটি কোটি টাকার কারবার, এসব তো আসলে আমার, আমার ছেলের।
-আপনি কেন করেন?
-কি করবো, দু পয়সা কামাতে হবে তো, এটা আমার পেটের ধান্দা।
-আপনি কেন করেন?
-এসব মানুষের পাশে থাকাটা ভাগ্যের ব্যাপার। কতো ছবি, পত্রিকা, টিভি, কতো প্রচার।
-আপনি কেন তোষামোদ করেন?
-বাপ ঠাকুর্দাকে করতে দেখেছি, আমিও করি।
-আপনি কেন করেন?
-আমি তো এমনি এমনি করি,
সব্বাই করে বলে।
সব্বাই করি তাই।