দোঁহা

ভালো-ভাষা, ভালোবাসা – টুকিটাকির গদ্য

 



অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

একুশে ফেব্রুয়ারি।

মুক্তগদ্য সেভাবে লিখিনি। লিখলেও সে গদ্য প্রকাশ করতে দিইনি। এক সম্পাদকের সঙ্গে বরং এক অদ্ভুৎ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। লেখার পর নিজের একটি রচনাকে আমার ‘গল্প’ বলে মনে হয়েছিল। আবার সেভাবে নিজের সিদ্ধান্তের উপর ‘লেখক-সুলভ আত্মবিশ্বাস’টুকু, সাহসটুকুও যে জন্মাচ্ছিল তাও নয়। সেই রচনাটিকে ‘গল্প’ বলব কি বলব না, যুগের সঙ্গে তাল মেলেনি বলেই তাকে যুগান্তকারী বলে দাবি করব কিনা, এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ‘গল্প’টা সাহস করেই এক কাগজের সম্পাদককে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। সে কাগজের নামোল্লেখ করছি না। তবে এটুকু বলতে পারি তখনও অবধি সে কাগজে কোনওদিন আমার লেখা fiction ছাপা হবে, সে আমার কল্পনাতীত ছিল। কিছুদিন পরেই দেখলাম নতুন সংখ্যাতে আমার রচনাটি জ্বলজ্বলে অক্ষরে বিরাজমান। এদিকে আমি সাহস করে সম্পাদককে বিবেচনা করার কথাও বলিনি। কেবল চলভাষের বার্তা হিসেবে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যদি কোনও সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়াও আসে, সেই আশায়। রচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল। তবে গল্প-বিভাগে নয়। মুক্তগদ্য sectionএই।

এই রচনায় সচেতন ভাবে যে কয়েকটি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছি, সেগুলি ইংরেজি অক্ষরেই লিখেছি। ছন্দের প্রয়োজনে, বাক্য গঠনের প্রয়োজনে কখনও কখনও ইংরেজি উচ্চারণের ঘাত বাংলার চেয়ে তীব্র হয়ে ওঠে। তবে সেই তীব্রতার যে অনুভূতি অথবা সেই অনুভূতিকেই সত্য বলে দাবি করার এই যে প্রচেষ্টা, তার কারণ বাংলা শব্দভাণ্ডারের দৈন্যতা নয়। সে কেবল রচয়িতারই শব্দভাণ্ডারের অভাব। এবারে মুক্তগদ্য যখন, সেই গদ্যে তখন বিষয়ের বাধ্যবাধকতা থাকে না। অথবা থাকলেও তাতে শিথিলতা থাকাই দস্তুর। কাজেই ভালো-ভাষা মন্দ-ভাষা’র চেনা গণ্ডি পেরিয়ে বরং কলমকেই আজ মুক্ত করে দিই অভিজ্ঞতার মাঠে-প্রান্তরে কোথাও। নিয়ম মেনে তো লিখলাম অনেক। নিয়ম ছাড়িয়ে কেবল উচ্চারণ কুড়িয়ে নিই এখন। একটিবার। কোনও একটিবার।

আমরা যারা কর্পো-বৃত্তের (পড়ুন corporate বৃত্তের) মানুষ, এবং যারা এখনও চেষ্টা করে যাই মনটাকে সজীব রাখার, অথচ নিজস্ব অভিজ্ঞতার দৈন্যের কারণে খুব সহজেই, অত্যল্পতেই বিস্মিত হয়ে পড়ি – সেদিন আপিসের পাশে, অস্থায়ী ফুটপাথের কাঠ-tin-asbestosএর ছাউনি দেওয়া চা-জলখাবারের দোকান, চা বাড়িয়ে দেওয়া সেই বড়দি’র গলায় এমনই এক শব্দ শুনে বড় আশ্চর্য হয়ে গেলাম। দিদি বলছিলেন তাঁদের পাড়ার সরস্বতী পুজোর কথা। সেই পুজোর ঘটা-পটা, আয়োজনের বিষয়। দিদি বলছিলেন সেদিন তাদের নৈশভোজের আয়োজন। “প্রায় বারোশো লোকের আয়োজন হয়েচে গো স্যার!” সম্ভাষণের দিক থেকে ওঁরা এখন Sir-Madam’এতেই অভ্যস্ত বেশ। কিন্তু time, arrangement, feast – এমন সব শব্দেরাও এখন না-হক বাংলাতেই ঢুকে পড়েছে। সেখানে হঠাৎ সেই Sirএর পাশাপাশিই মিষ্টি এক বলার ভঙ্গিতে বাংলা ‘আয়োজন’ শব্দটা শুনে বেশ একটা ভালো লাগার অনুভূতি হল। লোকে বলতেই পারে বাড়াবাড়ি করছি। এসব আদিখ্যেতা বৈ তো নয়! তবু বলব, ভালো লাগল। কলেজ জীবনে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে করতে ‘রসিকতা’ শব্দটা ব্যবহার করায় সেই বন্ধু খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল, “দারুণ বাংলা বলিস তো তুই, এমন সব শব্দ ব্যবহার করিস!” ইংরেজি মাধ্যমে মানুষ সেই বাঙালী বন্ধুর বিচারে ‘রসিকতা’ শব্দটিও ‘দারুণ শব্দ’ হিসেবে যখন মান্যতা পেয়েছিল, আমরা এখন দীর্ঘ সময় যাবৎ meeting, conference, zoom-call, অথবা teams-সম্ভাষণের মতো মহোত্তর প্রযুক্তি-যুগের সদস্য হয়ে ওঠা শ্রমজীবী জনতা, আমাদের মন-কানও বোধহয় এমন ‘আয়োজন’এই এখন সন্তুষ্ট হতে, বিস্মিত হতে পারবে। আমরা যে অত্যল্পেই সন্তুষ্ট থাকতে চাই।

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। ভালোবাসারও মাস। কিন্তু এই ভাষারই জন্য এক ভালোবাসার উপলক্ষে কেমন এক গণ্ডগোল পাকিয়ে বসেছিলাম – সেই তথ্য বরং উপসংহারে থাকুক। তার আগে মনে করিয়ে দিই, এই মাসেই অপারের দুনিয়ায় পাড়ি দিলেন ছড়াকার, কবি, সাহিত্যিক ভবানীপ্রসাদ মজুমদার। ১২৫এ এই মাসেই পা দিলেন বাংলা কবিতাকে নবযুগে পার করে দেওয়া সাহিত্যিক জীবনানন্দ দাশ। গতমাসেই ২০০ পেরলেন মধুসূদন। এ যেন বাংলা সাহিত্যের দিকপালেদের সময়। গতবছরেই copyright-মুক্ত হয়েছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। এখন তাই দুই-বাংলার একাধিক প্রকাশকের হাত ধরে তিনি উপযুক্ত প্রচার ও প্রসার লাভ করছেন। ভালো কি মন্দ বিচার করবে ভবিষ্যৎ।

দুই বাংলা বলতে গিয়েও কোথাও যেন একটু আটকিয়ে যায়। কলম আটকিয়ে আসে হঠাৎ। বর্তমান পরিস্থিতিতে হঠাৎ লাগু হতে চলা নানাবিধ আইন, তারই সঙ্গে পূর্ব-ইতিহাস, ভাষার ব্যবহারই যে কখনও কখনও ভিন্ন-ভাষাভাষী মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে মারমুখী করে তোলে, তার উদাহরণ আমরা অনেকবার দেখেছি। তবু সেই ভাষাকে আঁকড়িয়েই সমাজ ও সভ্যতা। ভাষাতেই বিভাজন। আবার ভাষাতেই ঐক্য সঠিক। বিভাজন নাকি ঐক্য, কোন পথে আমরা ভাষাকে প্রবাহিত হতে দেব, সেই বিবেচনাতেই আমাদের পরিচয়, আমাদের মনুষ্যত্বের পরিচয়। আমাদের বোধের পরিচয়। সেই পরিচয় প্রকাশের অধিকার, পালনের অধিকার কোনও সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। রাজনৈতিক কাঁটাতারে আমরা দুই-বাংলার এপার-ওপার হলেও, ভাষাগত দিক থেকে আমাদের যে ঐক্য, তার প্রতি কোনও বিরূপ মন্তব্য যেন আমরা সহ্য না করি। ভাষা ঐক্যের সমতুল। সে অনৈক্যের পূজারী নয়।
 

।।সরবে বলতে চাই, মুখের ‘ভাষা’ মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার ।।

 তবে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কারই কোনও এক বরষার দিন, ভালোবাসা খুঁজতে যাওয়া বর্তমান ‘লেখক’এর এক অতিশয় বিড়ম্বনার অযাচিত কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেই তার প্রথম ও শেষ সরকারি প্রেমপত্র লেখার প্রচেষ্টা। পাছে ভালোবাসার তরুণীটি, পড়া যাক পাত্রীটি, একই সঙ্গে বাংলা আবৃত্তিতে চৌখস ও অন্যদিকে ইংরেজি যুক্তিতর্কের আসরেও বাক-সিদ্ধ, অনেক ভাবনা-চিন্তার বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে ‘লেখক’ তাকে চিঠি দিলেন। চলভাষ ততদিনে উপলব্ধ, কিন্তু লেখক সেই চিঠি পাঠালেন বৈদ্যূতিন যোগাযোগ-ব্যবস্থায় (emailএর মাধ্যমে)। কোনও এক বরষার রাত। সেই চিঠি প্রথমে গেল বাংলা অক্ষরে। পরবর্তী বার্তায় গেল সেই চিঠির ইংরেজি অনুবাদ। এই দ্বৈত-আক্রমণের মুখে পড়ে সেই তরুণী ফিরতি জবাবের পথেও আর হাঁটলেন না একেবারেই। সামাজিক মাধ্যমের ভাষায় সেই পত্রাঘাতের জবাব দিলেন পালটা পাটকেলেই। বন্ধুবৃত্ত থেকে একেবারেই কক্ষচ্যুত হয়ে লেখক স্তম্ভিত চিত্তে দেখলেন, তিনি ‘দোরবন্ধ’ – অর্থাৎ কিনা ‘blocked’ হয়েছেন। দ্বিভাষিক আক্রমণের প্রতিফল হিসেবে দুয়ার থেকেই সরকারকে, (পড়ুন ব্যর্থ ‘পৃথ্বীরাজ’কে) সেদিন ফিরে আসতে হয়েছিল। হেঁটমুণ্ড, বিরহীপ্রাণ – এমতাবস্থাতেই। কাজেই ভালোবাসা’র ক্ষেত্রেও সেজন্য ভালো-ভাবেই, বিচক্ষণতার সঙ্গে যোগাযোগের ভাষা নির্ণয় করা উচিত। নচেৎ কপালে জুটবে এমনই দুঃখভোগ।

শেষাংশে লেখক কিন্তু একথাও স্পষ্ট করতে চান, বর্ষকালের বেশি অবিশ্যি সেই বরষার শাস্তি বলবৎ থাকেনি। দুয়ার খুলেছিল। লেখকও দুয়ারে যাবার অনুমতি পেয়েছিলেন। দুইয়ের মধ্যে এখনও বন্ধুত্বটি অটুট। মাঝের সেই পত্রবোমার ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদটুকুই বরং এতদিন যাবৎ সযত্নে লোকানো ছিল হৃদয়পুরের চিলেকোঠায়। আজ তার প্রাণের সম্পাদককে ফেরাবে না বলেই, লেখক সেই চিলেকোঠার গোপন দস্তাবেজ ভালো-ভাষাতে সাজিয়ে বিলিয়ে দিল ভালোবাসায়। কারণ সে জানে, তার পৃথিবীতে অন্তত মন্দ-ভাষা, মন্দ-বাসার অস্তিত্ব থাকতে নেই।

 …আর তারই সঙ্গে – যে কোনও বন্ধুত্বও যে তার কাছে ভাষারই মতো সুন্দর, ভাষারই মতো নির্মল, সতেজ - লেখক কেবল তার বন্ধুদের এতটুকুই মনে করাতে চায়। প্রতিক্ষণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন