প্রতীক মিত্র
ভাষার সাথে বিপন্নতা কথাটি আগে কিম্বা পড়ে থাকলে বুঝে নিতে হবে সমস্যা বেশ গুরুতর। আমি বাংলা ভাষার কথাই বলছি। জাতীয় পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টা বোঝা কঠিন নয়। একে তো ইংরেজী ভাষার প্রাধান্য তার ওপর হিন্দি ভাষা নিয়ে এক প্রকার চরম বাড়াবাড়ি। ভাষা নদীর মতন। বয়ে চলাই তার কাজ। একে অন্যের মধ্যে বৈরিতা তৈরি করা ভাষার কাজ নয়। এ সবই ভাষা ব্যবহারকারীদের ষড়যন্ত্র। ঘরোয়া স্তরে সার্বিক সাংস্কৃতিক দেউলিয়াপনা একটা বড় কারণ। তার ওপরে আছে যথাযথভাবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। বিষয়গুলো একটা একটা করে আলোচনা করলে বিষগুলোকে চিহ্নিত করতে সুবিধা হবে। বাংলাদেশ আর কিছুতে পেরে না উঠুক বাংলা ভাষা চর্চায় সবসময়ই এ রাজ্যের চেয়ে আমাদের দেশের চেয়ে বেশি নম্বর পাবে। কারণ ওই দেশটার ভিত্তিই বাংলা। আমাদের এখানে ভাষার বেড়ে ওঠা অন্য ভাষার সাথে সহাবস্থানে থেকে। একে তো ইংরেজী ভাষার চটক আর অর্থনৈতিক গুরুত্বের সাথে বাংলার পরাজয় নিশ্চিত অন্যদিকে আজকাল যেভাবে হিন্দীকে সিংহাসনে বসানোর জন্য সিংহের হিংস্রতা নিয়ে প্রচার তাতেও লক্ষ্য যেন বাংলার প্রান্তীকিকরণ। এরপর যদি বিশ্লেষণের পরিধিকে আর একটু ছোটো করি তাহলে দেখবো বাংলা সাহিত্যের মানের সেই যে অভিমান হয়েছে তা আর কমেনি। লেখার পরিমাণ বেড়েছে। অনেক বেড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে এখন সবাই লেখক। প্রকাশকদের হাতেপায়ে পড়া নয়, তাদের দ্বারা বাতিল হওয়ার ভয় নয়, যখন খুশি লিখে দিয়ে দাও ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রামে। লোকে পড়েও ফেলতে পারছে না কিনেই। কিন্তু সম্পাদনার অভাবে সেই লেখা অনেক সময়ই পাতে দেওয়ার যোগ্য হচ্ছে না। তাছাড়া যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারক যারা তারাই যদি যা খুশি হাবিজাবি লিখে পুরস্কার পেয়ে যায় এবং বাকিরা সেটাকে হয় তৈলমর্দন কিম্বা ভয়ের কারণে হজম করে নেয় তাহলে বুঝতে হবে বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে। এক্ষেত্রে জনপ্রিয় মাধ্যম তা সে টিভি কিম্বা চলচ্চিত্র তারা ভাষাকে কিভাবে ব্যবহার করছে তার ওপরে ভাষার উৎকর্ষতা অনেকটা নির্ভর করে। সেখানেও বলাই বাহুল্য এদের ভূমিকা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সংলাপকে আরো বেশি মাটির কাছাকাছি, মানুষের কাছাকাছি সর্বোপরি বাস্তবতা-মুখী করতে গিয়ে গালির যা বাড়বাড়িক্কি তাতে চলচ্চিত্রের যে আসল উদ্দেশ্য মানে স্বাস্থ্যকর উপায়ে মনোরঞ্জন সেটাই বাদ চলে যায়। টিভি-সিরিয়ালে কথা নেই বার্তা নেই হিন্দী গানের অনুপ্রবেশ বড় বেমানান ঠেকে। যতক্ষণে এইসব দেখে মানুষের টনক নড়বে, ততক্ষণে যেন মনে হয় বড্ড দেরি হয়ে গেছে কেননা সাধারণের মধ্যেও সেই রুচিহীন ভাষার প্রয়োগই চলতে থাকে যথেচ্ছভাবে। বাসে ভীড়ে বচসা বাঁধলে একজন অন্যজনকে হুমকি দেয়। ক্রমে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে কিছু মানুষ সেটা নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু করে। বলে, “আজকাল সবাই কথায় কথায় মেরে ফেলবো বলে। ক্যালাবো অবদি বলললেও ঠিক ছিল।" আমি তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করি, ক্যালানোটাকেও জনসমক্ষে এত সাবলীলভাবে বলেনা বাঙালিরা। মারধোর, পেটানো ইত্যাদি বলাটাই বেশি শ্রেয়। না তারা সেইসব আর শোনার জন্য ছিল না। স্টপে নেমে গিয়েছিলো দ্রুত। কলেজে পড়ায়। ক্লাসে ঢুকতে নাকি দেরি হয়ে যাবে। আমি বিস্মিত। অধ্যাপককে বোঝানো না গেলে সাধারণকে কে কি আদৌ বোঝানো সম্ভব? এছাড়াও রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করবার জন্য ভাষার ধর্মীয়করণ আরো একটি কারণ ভাষার বিপন্নতার। কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষের জন্য নির্দিষ্ট রকমের বাংলা শব্দের প্রয়োগ রুচির অভাবকেই তুলে ধরে। তাতে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ যেমন বাড়তে থাকে তেমনই ভাষাও তাতে কলুষিত হয়। এভাবেই রকমারি পথে, উপায়ে, পন্থায় বাংলা ভাষার মান নামতে থাকে। বাড়তে থাকে বিপন্নতা।
Show quoted text