দোঁহা

ভাষা ও জাতিগত ঐক্যের সন্ধান

 


সুমি দত্তগুপ্ত

শিশু আধো আধো বুলিতে যখন দেয়ালা করে, মা আশায় আশায় থাকেন, কখন তার মুখে ভাষা ফুটবে। জানি, মনের ভাব প্রকাশের অনেক মাধ্যম আছে, তবুও খুব সহজেই মনের ভাব,আনন্দ দুঃখের বহি: প্রকাশ, অন্যের কাছে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার এমন মাধ্যম কই।

গুজরাট, পাকিস্তান সীমান্তে ধোলাভিরার বিশাল প্রত্নতাত্বিক খনন কার্যের সামনে দাঁড়িয়ে  দেওয়ালের গায়ে কতগুলো অবোধ্য, পড়তে না পারা সংকেত চিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে একথাই ভাবছিলাম, শুধু ভাষা না থাকায়, কত হাজার বছরের এক নগর সভ্যতার সম্পর্কে কত প্রশ্ন অনুক্ত, নিরুত্তর রয়ে গেল। মনে হচ্ছিল, 'সুখ নেইকো মনে, নাকছাবি টি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে, বনে।’ 

জেমস প্রিনসেপ সাহেব অশোকের শিলালিপি আবিষ্কার করলেও, ভাষা তার প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াল, পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হল না, প্রথম প্রজাহিতৈষনা, মানবতাবাদের সম্যক উপলদ্ধকারী শাসকের অনেক বলে যাওয়া কথা উদ্ধার হলো না।

১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে পট্টি শ্রীরামালু হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের ডাক দেন, পণ্ডিত নেহরুর যাবতীয় বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে। ৫৮ দিন অনশন করেন। অবশ্য তাঁর মৃত্যুর পরেই প্রধানমন্ত্রী নেহরু, তার ভাষা ভিত্তিক রাজ্য গঠনের প্রস্তাব মেনে নেন। তামিল, তেলেগু ভাষা হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান একটিই কারণে, আর্যাবর্তে হিন্দি মুখ্য ভাষা। কিন্তু সমগ্র দক্ষিণ ভারতে হিন্দির মান্যতা কোথায়। তাদের নিজেদের ভাষা রয়েছে, আর তার মধ্যে তামিল বহু প্রাচীন ভাষা। তামিল, তেলেগু, কন্নড়, মালায়ালম প্রতিটি ভাষা একে অপরের থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। তাই মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে অন্ধ্রের থাকা মানে তাদের ভৌম সার্বভৌমিকতা, স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা সব কিছু বিসর্জন দিয়ে নিজেদের ভাষার অস্তিত্ব পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে তামিল ভাষার অধীনতা, হিন্দির আগ্রাসন মেনে নেওয়া। যার জন্যই প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল দক্ষিণ ভারতের নাগরিক সমাজ। আর প্রধান মন্ত্রী নেহরুর বক্তব্য ছিল, এইভাবে ভাষাগত ভিত্তিতে রাজ্যগঠন হলে বিচ্ছিন্নতাবাদ কে প্রশ্রয় দেওয়া হবে।

‘ভাষা এমন কথা বলে,বোঝে রে সকলে'

 আমরা তখন গোরকি সদনে রুশ ভাষার ছাত্রী। একেবারে সরাসরি পদ্ধতিতে মিসেস মিনায়েভা আমাদের প্রথম ক্লাস নিচ্ছেন। আমাদের লিখতে দিয়েছেন রুশ ভাষায় ময়া ফ্যামিলি। আমাদের সাথে ক্লাসে শিক্ষার্থী ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক চিরঞ্জিবের ভাই চিন্ময় দা, নাকতলা হাই স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক, মিনায়েভা তাকেই প্রথম উঠিয়ে বললেন, বলো, তুমি কি লিখেছ। চিন্ময় দা সবই বলছেন, লিখেছেন আর কি, তাদের বাড়ির সবাই স্পোর্টসম্যান, তিনি নিজে ফুটবল খেলেন, এবার আটকে গেছেন বোনের বেলায়, আমরা কেউ কিংবা চিন্ময় দা নিজেও তখন জানেন না। পর্বতারোহীকে রুশ ভাষায় কি বলে, খুব বুঝিয়ে যাচ্ছেন,আর মিনায়েভা বুঝছেন না, তখন চিন্ময় দা বোর্ডে পর্বতের ছবি এঁকেছেন, মিনায়েভা বলে উঠলেন, ক্তো এতা? পর্বতারোহী? প্রথম বিস্ময়, এতক্ষণ দমবন্ধ করে ওকে বোঝানো, অবশেষে স্বস্তি। আর দ্বিতীয়ত: উনি বাংলা জানেন, ভালো জানেন। কি আনন্দ ওর মুখে নিজের ভাষা শোনার আনন্দ। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলে দিলেন। আর একদিনের জন্য ও উনি বাংলায় আমাদের সাথে বলবেন না। কিন্তু কেন জানি না, ওর ক্লাসে নিজেকে আর বিচ্ছিন্ন ভাবতে পারলাম না। অপেক্ষায় দিন গুণতাম ক্লাসের।

 প্রাক বিবাহ কালে, একদিন আমার হবু আমাকে বললেন, তুমি তো রাশিয়ান জানো, তোমার বাবাও একটা বিদেশী ভাষা জানেন, তাই না? আমি তখন বুঝে গিয়েছি কান্ড টা কি ,আসলে সিলেটি, এবং চট্টগ্রামের লোকেরা একই প্রকৃতির দেশোয়ালি দেখলে আর প্রাণ উথলে ওঠে। এরকমই কোনও মুহূর্তে সে দেখেছে আমার বাবাকে, চট্টগ্রামের ভাষা যে ভাষা পৃথিবীর দুর্বোধ্য ভাষাগুলির অন্যতম। অন্তত: বাংলা বলে তো মনে হবেই না। আরাকান, পর্তুগিজ, মগ সবকিছুর সংমিশ্রণে এক অতীব দুর্বোধ্য ভাষা। তবে চাটগাঁইয়া দের কাছে পরম আদরণীয়। দেশভাগ তাদের সবকিছু নিয়ে নিলেও ভাষা টাকে কুক্ষিগত করেই তো তারা নিজেদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

 ভাষা মানুষের সংস্কৃতি, ব্যবহার, স্বজন, প্রতিবেশীদের সাথে আত্মিক বন্ধনের প্রকাশ। একদিন বাসে যেতে যেতে দুজন মেডিক্যাল  রিপ্রেজেন্টেটিভ এর বক্তব্য শুনছিলাম, একজন শিলচরে থাকেন, আরেকজন বদলি হয়েছেন। যিনি থাকেন তিনি বলছেন, আরে জানিস, ওরা ইংরেজিটাও নিজেদের ভাষায় বলে। ধর তোকে জিজ্ঞাসা করতে চায়, তুই মুভি দেখবি কিনা, তোকে জিজ্ঞাসা করবে’, will you go to cinema নি?’ একজন সুন্দরী মেয়ের মুখে এরকম ইংরেজি শুনলে তোর প্রেম পালাবে কিনা বল? কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, নিজের ভাষার প্রতি কতটা ভালবাসা থাকলে একটা মানুষ ইংরেজি ভাষাটাকে ও নিজের ভাষার সাথে এমনভাবে একাত্ম করে নিতে পারে। সিলেটি বলে ওদের হিদল শুঁটকি খাওয়া, ওরকম বাংলা বলা নিয়ে যতই নাক কুঁচকান, ওদের বয়েই গেল। ওরা কিন্তু গর্বিত এইসব নিয়ে। আর বাংলা ভাষা চর্চা, সংস্কৃতি চর্চায় বোধহয় কয়েক কদম এগিয়ে আছে এখনও এই  দু:সময়েও।

শিলচরের  বরাক ভ্যালি ভাষা আন্দোলন আরেকটু পরে ১৯৬০-৬১ সালে হয়েছিল সেটাও কিন্তু আসামের করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, শিলচর এলাকায় প্রচুর বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বাস। তাদের ওপর অসমীয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে। এই ঘটনার প্রতিবাদে চললো স্কুল, কলেজে প্রতিবাদ, মিছিল, পিকেটিং, ছাত্র সমাজ সর্বতোভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলো। কমলা ভট্টাচার্য এই আন্দোলনে শহীদ হলেও আন্দোলন থেমে থাকেনি। পরের দিন তারাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নয় জন যুবক, আর তারপরে আরও দুজন যুবকের মৃতদেহ পাওয়ার পরে শিলচর উত্তাল হয়ে ওঠে। এবং অবশেষে আসাম সরকারকে পিছু হঠতে হয়, মানুষের দাবীকে প্রাধান্য দিয়ে। তবুও আজও শিলচরে ৯ ই মে প্রতিবছর শহীদদের স্মৃতিতে অনুষ্ঠান হয়। আজ যে ২০০৯ সালে ইউনেস্কো ২১ শে ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিল,সেইজন্য এই আন্দোলন গুলির ভূমিকা কোনও অংশে কম নয়।

মানুষের দাবীর কাছে শাসক মাথা নত করতে বাধ্য হয়। প্রথমত, দেশভাগের ভুল সিদ্ধান্ত, মানুষকে না জানিয়ে, দেশভাগের আগের দিনও  রাজশাহী, পাবনার মানুষ জানত না তারা দিনাজপুর কিংবা উত্তরবঙ্গে চলে যাচ্ছে। তারা স্বাধীনতার আনন্দে মশগুল ছিল। কিন্তু জিন্নাহ নিজে একফোঁটাও উর্দু না জানলেও শুরু করে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সব কাজ উর্দুতে, মুদ্রা চালু, সরকারি দলিল দস্তাবেজ সব কিছু লেখা হতে শুরু হল উর্দুতে। যেখানে সেই সময় বাংলা ভাষী,পাঞ্জাবি, পুশতু ভাষী মানুষের সংখ্যা উর্দু ভাষী দের তুলনায় ছিল অনেক বেশি সেইখানে উর্দু কে তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে চললো মানুষের স্বাধীনতা হরণের প্রথম অধ্যায়। মানুষ তা মেনে তো নেয়ই নি, উপরন্তু এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই প্রথম বাংলা ভাষা মুখ্য ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সৃষ্টির বীজ বপন হয়ে গেল। আবদুল,জব্বার, রফিকের এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহীদ দের স্মৃতি, জাতীয়তাবাদ, জনগণের ভাষা মুক্তি আন্দোলন, নিজবাসে পরভূমে থাকার বিরুদ্ধে জনগণের সোচ্চার প্রতিবাদে, ভীত শাসক মেনে নিল বাংলা ভাষা গরিশ্ঠের দাবি। প্রতিবছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস কে শহীদ দিবস হিসাবে পালন করা, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের  স্মৃতি মানুষের মনে জাগরূক রাখা, বিরাট ভাবে ভাষা দিবস পালন স্বীকৃতি এনে দিয়েছে ইউনেস্কোর কাছ থেকে, ইউনেস্কোর মান্যতা জাতিসংঘের দেশগুলোর অনেকদিনের দাবীকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দাবি হোক কোনও জাতি, বা দেশ যেন তার ভাষা হারিয়ে না ফেলে, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলো স্প্যানিশ উপনিবেশ দীর্ঘকালীন থাকার জন্য তাদের অনেকের ভাষা হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভাষা তো শুধু কথ্য নয়। এর মধ্যেই আছে একটা জাতির সার্বভৌমিকতা, রাজনীতি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, তার স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা সব কিছু। তাই ভাষা হীন জাতি আস্তে আস্তে পৃথিবীর মানচিত্র থেকেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। 

'মোদের গরব,মোদের আশা
আ মরি,বাংলা ভাষা।’

ভাষা বিপন্ন, মানে একটা জাতি বিপন্ন, তার অস্তিত্বের সংকট। তাই, এই আন্দোলন আর তার স্বীকৃতি সব দেশের, সব মানুষের, সব ভাষা সংস্কৃতির না হারিয়ে যাওয়া। ভাষার মান্যতা  সেই স্বীকৃতি যা মানুষকে ভুলতে দেয় না তার ঐতিহ্য,সংস্কৃতি,পরম্পরা। আমরা কেউ তো নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণার তালিকায় আমাদের ভাষা কে দেখতে চাই না।


   

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন