দোঁহা

রজঃনিবৃত্তি: ঋতুস্রাবের ইতি এবং বাহ্যিক ও মনোগত শরীর পুনর্গঠনের ইতিবৃত্ত

 

অত্রি মল্লিক

কালক্রমে সমাজ কাঠামো আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে উপনীত যে গুটিকয়েক গূঢ় বিষয়ের মুক্ত চর্চা আশু প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে প্রায়শই। এহেন মুহূর্তে মেনোপজ অথবা রজঃনিবৃত্তি কি ও সেই জৈবিক প্রক্রিয়ায় শরীর ও মনের পরিবর্তনের সাথে সাথেই তাল মিলিয়ে একটা অদৃশ্য তথা অচর্চিত সামাজিক উচাটন পরিলক্ষিত হতে থাকে। মনে করা হয় এই ঋতুচক্র স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া অর্থাৎ মেনোপজ একটি নারীর জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।  মূলত এটি শরীরের ওপর এবং মনের ওপর বিচিত্র প্রভাব বিস্তার করে। এই বিষয়ে সচেতনতা জরুরি ও খোলামেলা আলোচনা একান্তই দরকার, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মধ্যাংশে এসে। যদিও নারী দেহের ক্ষেত্রেই নয়, পুরুষের প্রতি বছর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই শরীরে টেস্টোস্টেরন ক্ষরণ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং একটা সময় পুরুষদেরও জীবনে এসে উপস্থিত হয় মেনোপজ যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় আখ্যা দেওয়া হয় অ্যান্ড্রোপজ নামে।

অতি সরল অর্থে গড়পড়তা যখন ৪৫-৫৫ বছর বয়সী নারীদের ঋতুচক্র বন্ধ হয়ে যায় এবং যখন একজন নারীর প্রজনন জীবনের সমাপ্তি হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণই হলো মেনোপজ। তত্ত্বকথার নিরীখে নারীদেহে যখন প্রথম মাসিক শুরু হয় তখন তাকে বলে মেনার্কি আর যখন শেষ হয়ে যায় তখন সেটাকে বলা হয় মেনোপজ।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা সদ্য প্রকাশিত একটি ব্রিটিশ মেডিকেল বুলেটিন এমন দিক নির্দেশ করেছে যে, বয়সের অনুপাতে গড়ে একজন নারীর জীবনের আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ সময় মেনোপজের মধ্য দিয়ে কাটে।
ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত হরমোন ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টেরোন শরীরকে নিরাপত্তা দেয়। সেটি মেনোপজের কারণে বন্ধও হয়ে যায়। ফলত এই হরমোনের অভাবে হাড়ের ক্ষয়জনিত রোগ অস্টিওপোরোসিসের উদ্রেক ঘটে যার লক্ষণ স্পষ্টতই অস্থিসন্ধিতে ব্যথাসহ নানা স্থানে হাড়ের ব্যথা। অতিরিক্ত ভঙ্গুর হাড় ও মেরুদন্ড বেঁকে যাওয়ায় হৃদপিণ্ডের উপরেও প্রভাব পড়ে এই সময়ে।

ভারতীয় সমাজের অনেকাংশেই এখনও যৌনতায় নারীর আগ্রহের প্রকাশ পরিস্ফুট হতে থাকলে সেটি সমাজের ঘোষিত রক্ষকদের পছন্দ নয়। তাই যৌনতা তথা যৌন ক্ষমতার হ্রাস ও সম্পূর্ণ নিবৃত্তি নিয়ে এ ভূখন্ডে কথা বলা হয় খুব কম, চর্চা তো বহুদূর।

অনেকেই এই মেনোপজ মেনে নিতে পারেন না বিশেষত যদি অপেক্ষাকৃত কারোর জীবনে এই লক্ষণ কম বয়সেই দেখা যায়। আর ঠিক সেই কারণেই মানসিক সমস্যায় ভোগান্তি হয় অনেকেরই। যাঁদের সন্তান-সন্ততি নেই, মূলত সেই সকল নারীদের ওপর মারাত্মক মানসিক প্রভাব বিদ্যমান হয় এবং শুষ্ক যোনিনালি বা ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেসের কারণে যৌনজীবনে অপরিসীম প্রভাব পড়ে।

মেনোপজ কোনো অলৌকিক ক্রিয়া নয়। বরং মানবজীবনের গতিপথের অংশবিশেষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যমে সূচি ভিত্তিক উদ্যোগ নিয়েছে এর সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য। পাঠ্যক্রমে এই বিষয়ের অন্তর্ভুক্তিকরণ ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের উর্দ্ধে উঠে কর্মশালা আয়োজিত হচ্ছে-যা নির্দ্বিধায় অতিমাত্রায় কাম্য।

'হু'-এর তথ্যানুসারে নারীদের গড় আয়ু বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত ১০ বছরে এই বৃদ্ধির হার ২২‌‌ শতাংশ। ২০১৯ সালের তথ্যের ভিত্তিতে একজন ৬০ বছর বয়সী নারী গড়ে তৎপরবর্তীতে ২১ বছর আরও বাঁচতে পারে।

মেনোপজ যেন এক সেই সুযোগ যা জীবনের উদ্দেশ্য, স্বাস্থ্য ও জীবনচর্যাকে পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ করে দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন

মোট পৃষ্ঠাদর্শন