মিঠুন মুখার্জী
'নারী' শব্দটি শুনতে ছোট হলেও এই শব্দটির মধ্যে রয়েছে অসীম শক্তি। নারী এই পৃথিবীতে প্রানের সৃষ্টিকারী। অর্থাৎ সে স্রষ্টা। নারী-পুরুষ উভয়ের উপর ভড় করে মনুষ্যসমাজ গড়ে উঠলেও নারী ছাড়া এ পৃথিবী অকেজো। অথচ যুগে যুগে কালে কালে সেই নারীই পুরুষের দ্বারা অবহেলিত, নির্যাতিত। নারীর জীবন ও শরীর অতীব জটিল। নারীর শরীরের জটিলতা সম্পর্কে বেশিরভাগ পুরুষ তো অজ্ঞ, এমন কি নারী নিজেও তার শারীরিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে জানে না। আজ আমরা আলোচনা করব নারীর জীবনে 'মেনোপজ'-এর গুরুত্ব, এই বিষয়টি নিয়ে।
'মেনোপজ' শব্দটির সঙ্গে অনেক নারীই অপরিচিত। 'মেনোপজ' শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল 'রজঃনিবৃত্তি'। প্রত্যেক নারীর জীবনে থাকে ঋতুস্রাব বা মাসিক। দশ-এগার বছর বয়স থেকে নারীদেহে এই মাসিক লক্ষ করা যায়। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে প্রত্যেকমাসের নির্দিষ্ট দিনে মেয়েদের মাসিক হয়। কিন্তু কখনো কখনো অনেক নারীর দুই থেকে পাঁচ দিন এগিয়ে ও পিছিয়ে এই ঋতুস্রাব হয়। এটাকে স্বাভাবিক ঋতুস্রাব বলা যায়। তবে অনেকের প্রতিমাসে দেরিতে ঋতুস্রাব বা মাসিক হয়। এটা শরীরের পক্ষে ভালো নয়। তবে এই ঋতুস্রাব বা মাসিক সারাজীবন ধরে চলতে থাকা একটি প্রক্রিয়া নয়। অনেকের মধ্যে একটি ভুল ধারনা আছে যে মাসিক সারা জীবন ধরে চলে। ৪৫ থেকে ৫৫ বছর পর্যন্ত নারীদের মূলত স্থায়ীভাবে ঋতুস্রাব বা মাসিক হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানে 'মেনোপজ' বা 'রজঃনিবৃত্তি' বলা হয়। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়া নির্দিষ্ট বয়সের কিছু আগে ও পরে ঘটে থাকে। তাছাড়া কোনো নারীর যদি বারোমাস বা তার বেশি সময় ধরে ঋতুস্রাব বা মাসিক হওয়া বন্ধ থাকে তবে সেই বিষয়টিকেও মেনোপজ বলা হয়। ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে অনেকসময় থেমে থেমে কয়েকমাস অন্তর মাসিক হতে পারে। এটিও মেনোপজের সমস্যা। আবার সন্তান এলেও নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী মাসিক বন্ধ থাকে, যতদিন না সন্তান প্রসব হচ্ছে। আবার কারো কারো ষাট বছর বয়স পর্যন্ত মাসিক বা ঋতুস্রাব হয়ে থাকে। তবে সেই সংখ্যাটি তুলনামূলক ভাবে কম।
মেনোপজ পরবর্তী সবচেয়ে জটিল সমস্যাগুলোর একটি অস্টিওপোরোসিস। এটি হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ। নারীর শরীরে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম এবং কায়িক পরিশ্রমের অভ্যাস না থাকলে মেনোপজ পরবর্তী সময়ে অস্টিওপোরোসিস জটিল আকার ধারণ করতে পারে। মেনোপজ পরবর্তী সময়ে নারীরা অস্টিওপোরোসিসের বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। এর কারণ পুরুষের চেয়ে নারীর হাড়ের পুরুত্ব কম। ইস্ট্রোজেন তাকে এ থেকে নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু শরীরে মেনোপজের পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের নিরাপত্তা কমে যায়। এর কোন উপসর্গ থাকে না কিন্তু খুব অল্পতেই হাড় ভেঙে যেতে পারে।
আমাদের দেশে ও বিদেশের নারীদের মেনোপজের গড়বয়স আলাদা হয়। আমাদের দেশে নারীদের মেনোপজের গড় বয়স ৪৪-৪৫ বছর কিন্তু বিদেশে সেটি ৫০-৫১ বছর। বিভিন্ন কারণে এই বয়সের আগেও রজঃনিবৃত্তি ঘটে থাকে। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল-কোনো কারনে সার্জারি করে জরায়ু বাদ দেওয়া, নিয়মিত মাসিক না হওয়া, ক্যানসারের কেমোথেরাপি। এই পৃথিবীতে অনেক নারী আছে যাদের কাছে মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়াটা বেশ আনন্দের। প্রতিমাসে নিয়ম করে মাসিক হওয়াটি তাদের কাছে ঝামেলার বিষয়। সন্তান চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে তাই মেনোপজের বিষয়টিকে তারা সেরকম গুরুতর কোনো সমস্যা হিসাবে গ্ৰহন করে না।
প্রতিবছর অক্টোবরের ১৮ তারিখে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় 'ওয়ার্ল্ড মেনোপজ ডে' বা রজঃনিবৃত্তি দিবস। নারীর জীবনের এই এক বিশেষ অধ্যায় নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সচেতনতাই দিবসটি পালনের প্রাথমিক উদেশ্য। নারী দেহের জটিল প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে এটি একটি। এই বিষয় নিয়ে পরিষ্কার ধারনা থাকা প্রয়োজন। তবে অকারণ ভীত হয়ে পড়লে চলবে না। মেনোপজের কারনে নারীদের একটি নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে সন্তান নিয়ে নেওয়া উচিত। নতুবা বয়স বাড়ার সঙ্গে নারীদের শরীরে এইরূপ অনেক সমস্যা আসতে পারে।
রজঃনিবৃত্তির সময় নারীর শরীরে হরমোনের নানা পরিবর্তন আসে। ইস্ট্রোজেনের মাত্রা একেবারে কমে আসে, প্রোজেস্টেরনের মাত্রায়ও অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। এসব কারণে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, যেমন বিপাকক্রিয়ার হার কমে যাওয়া, হজম না হওয়া, অ্যাসিডিটি বেড়ে যাওয়া, দুর্বল লাগা। এ সময় ক্যালসিয়ামের ঘাটতি দেখা দেয়, এতে হাড়ের ঘনত্ব কমে যায়। ওজন বাড়তে থাকে, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাও বেড়ে যায়। অনেকেরই এ সময় হট ফ্ল্যাশ (গরম হল্কা অনুভব) হয়, খুব মুড সুইং (মেজাজের দ্রুত পরিবর্তন) হয়, রাতে ভালো ঘুম হয় না।
মেনোপজের লক্ষণ সকলের ক্ষেত্রে একরকম নয়। কারো কারো ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো মারাত্মক আকার ধারণ করে। আবার কারো ক্ষেত্রে খুব কম বা একেবারেই লক্ষণ দেখা যায় না। যে লক্ষণগুলো এই সময় দেখা যায় সেগুলো হল-
১. যোনিপথে অনিয়মিতভাবে রক্তপাত।
২. মুখ-চোখ লাল হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি লাগা, রাতে ঘামা।
৩. যোনিপথ চুলকানো।
৪. শারীরিক সম্পর্কের সময় ব্যথা পাওয়া।
৫. প্রস্রাবের ইনফেকশন।
-এছাড়া মানসিক কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন: অবসাদ, মনে রাখতে না পারা, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি।
মেনোপজের বয়স সর্বপ্রথম রজঃস্রাব বা সর্বশেষ গর্ভধারণের উপর নির্ভর করেনা। এছাড়া এর সাথে গর্ভধারণ সংখ্যা, সন্তানকে দুগ্ধদান, জন্মবিরতিকরণ বড়ি সেবন, আর্থসামাজিক অবস্থা, জাতিগত পরিচয়, উচ্চতা বা ওজনের কোনো সম্পর্ক নেই।
রজঃনিবৃত্তির সময় সঠিক খাদ্যাভ্যাস এটিকে অনেকটা নিয়ন্ত্রনে রাখে। ক্যালশিয়ামজাত খাবার যেমন: দুধ-দই-পনির খাওয়ার খুবই প্রয়োজন। দুধে কেবলমাত্র ক্যালসিয়াম নয় ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন 'কে' রয়েছে, যা হাড়কে মজবুত রাখতে সাহায্য করে। ক্যালসিয়ামের পাশাপাশি ভিটামিন 'ডি' সংগ্ৰহ করতে হবে। চাইলে সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন 'ডি' সংগ্ৰহ করা যেতে পারে। তবে ভিটামিন ডি বেশি পরিমাণে গ্ৰহন শরীরের পক্ষে ভালো নয়। ক্যালশিয়ামের পাশাপাশি প্রোটিনজাত খাবারও এই সময় গ্ৰহন করা উচিত। মাছ, মাংস, ডিম, ডাল ও বীজ জাতীয় খাবার, বীনস (মটরশুঁটি, ছিম, কলাই জাতীয় শস্য) ইত্যাদির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে। এছাড়া শর্করা হিসেবে লাল আটা, লাল চাল, লাল চিড়া, ওটস, ভুট্টা খাওয়া যায়। এসবে প্রচুর আঁশ রয়েছে যা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এছাড়া সামুদ্রিক মাছ, তৈলাক্ত মাছ, বাদাম জাতীয় খাবারও খাওয়া যাবে। কারণ এর মধ্যে আছে ওমেগা থ্রি। শাকসব্জী ও ফলমূলাদিও এই সময় খাওয়া যাবে। ডাকচকলেটও এই সময় খাওয়া যায়। এটি বিষন্নতা কমাতে খুবই সাহায্য করে।
মেনোপজের বা রজঃনিবৃত্তির সময় যেমন কি কি খেতে হবে বলা হয়েছে, তেমনি না খাওয়ার তালিকাটি সম্পর্কে আলোচনা করা হল। প্রক্রিয়াজাত খাবার খাওয়া যাবে না। বেশি তেল-মশলাযুক্ত খাবার হট ফ্ল্যাশ বাড়ায়। অ্যালকোহল, অতিরিক্ত চা, কফি ও ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। চিনি ও মিষ্টিজাতীয় খাবার কম খেতে হবে। অতিরিক্ত লবণ দেওয়া খাবার খাওয়া যাবে না।
পরিশেষে বলা যায় মেনোপজ বা রজঃনিবৃত্তি নারীদের শরীরের একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। প্রতিটি নারীকে তাদের শরীরের এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আগে থেকে সচেতন হতে হবে এবং এবিষয়ে সময়ের আগে সম্যক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তবে রজঃনিবৃত্তির সময় সমস্ত নিয়ম মেনে চললে (খাওয়া - দাওয়া, জীবনযাপন) কম সমস্যায় পড়তে হবে এবং অকারণ মনে ভীতির সঞ্চার হবে না। নারীর পাশাপাশি পুরুষের মধ্যেও এই বিষয়ে সামগ্ৰিক জ্ঞান থাকার প্রয়োজন, তবেই সাংসারিক কোলাহল থেকে বিরত থাকা সম্ভব।